প্রসংগটি খুব অস্বস্তিকর। কিছুদিন আগে একটি পোস্ট পড়লাম। "গেলমান কনফার্মড" Click This Link । লেখক এখানে তার জ্ঞান এবং হাতে থাকা তথ্য দ্বারা প্রমান করতে চেয়েছেন যে, বেহেস্তে সমকামিতা জায়েজ। তার প্রমান হিসেবে তিনি পবিত্র কোরআন শরীফের ৩টি সূরার নামোল্লেখ সহ কয়েকটি আয়াত এর কথা বলেছেন, যার বাংলা অর্থ ব্যবহার করে তিনি প্রমান করতে চেয়েছেন যে, তথাকথিত গেলমান এবং তদ্বারা সমকামিতা ব্যাপারটি বেহেস্ত এ জায়েজ।
যা হোক, লেখাটি প্রায় ৭দিন আগের। এর মধ্যে নিজেই সংবিধান নিয়ে একটা লেখা কমপ্লিট করছিলাম। কিন্তু এ লেখাটির কোন কাউন্টার পোস্ট না আসায়, সংবিধান সম্পর্কিত লেখাটি বন্ধ করে, এ প্রসংগটি নিয়ে লেখা দিচ্ছি। কারন আমি মনে করি, যারা বুঝে-শুনে ইসলামকে হেয় করতে চান তাদের হাজারো বুঝিয়ে লাভ নেই। কিন্তু যারা তুলনামূলক কম জানেন (কিছু ব্যাপার নিয়ে) তারা কনফিউজড হয়ে যেতে পারেন প্রকৃত সত্যতা না বুঝতে পেরে। তাই আমি উক্ত লেখক এর লেখাটির ভুল দিকগুলো তুলে ধরছি। এই ক্ষেত্রে আমি লেখক এর লেখার চৌম্বক অংশ আর একই সাথে আমার বিশ্লেষনটি দেয়ার চেষ্টা করছি।
লেখক তার প্রথম রেফারেন্সটি টেনেছেন, সূরা আত-তুর হতে।
লেখক এর ভাষায়,
সুরা নং ৫২ | আত-তুর, ১ (পাহাড়)
২২| আর আমরা তাদের প্রচুর পরিমানে প্রদান করব ফলফসল ও মাছমাংশ – যা তারা পছন্দ করে তা থেকে।
২৩| তারা সেখানে একটি পানপাত্র পরস্পরের মধ্যে আদান-প্রদান করবে, তাতে থাকবে না কোনো খেলো আচরণ। না কোন পাপ।
২৪| আর তাদের চারিদিকে ঘুরবে তাদের কিশোররা, -- তারা যেন সুরক্ষিত মুক্তো।২৫| আর কেউ-কেউ অপরের দিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এগিয়ে যাবে –
২৬| তারা বলবে - -“নিঃসন্দেহ আমরা ইতিপূর্বে আমাদের পরিজনদের সম্পরকে ভীত ছিলাম।
লেখক এই অনুবাদটির রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন এই লিংক http://www.qurantoday.com/52Tur_Bangla.pdf
এরপর লেখক উল্লেখ করেন সূরা আদ দহরকে। তিনি এই সূরা প্রসংগে যা উল্লেখ করেন তা হলো,
সুরা নং ৭৬ | আল্-ইনসানঃ ১; আদ্-দাহ্রঃ১; (মানুষ অথবা দীর্ঘ সময়)
১৭| আর তাদের তাতে পান করানো হবে এমন একটি পাত্র যার মেজাজ হবে আদ্রকের, --
১৮| তার মধ্যের একটি ফোয়ারাতে যার নাম দেয়া হয়েছে সাল্সাবীল।
১৯| আর তাদের প্রদক্ষিন করবে চিরস্ফুটিত কিশোরগণ, -- তোমরা যখন তাদের দেখবে তাদের তোমরা ভাববে ছড়ানো মুক্তো ।
২০| আর যখন তুমি সেখানে চেয়ে দেখবে, তুমি দেখতে পাবে অনুগ্রহ-সামগ্রি ও এক বিশাল রাজ্য।
২১| তাদের পরিধেয় হবে মিহি সবুজ রেশমের ও পুরু জরির পোশাক, আর তাদের অলংকৃত করানো হবে রূপোর কাঁকন দিয়ে, আর তাদের পরু তাদের পান করাবেন এক পবিত্র পানীয় ।
আর এই সূরার রেফারেন্স হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছেন এই লিংকটি http://www.qurantoday.com/76Insan_Bangla.pdf
এরপর তিনি উল্লেখ করেন সূরা নাবা'র কথা। এখানে লেখক যা উল্লেখ করেন তা হলো,
সুরা নং ৭৮ | আন্-নাবাঃ২, (মহাসংবাদ)
পরিচ্ছেদ – ২
৩১| ধর্মভীরুদের জন্য নিশ্চয়ই রয়েছে মহাসাফল্য - -
৩২| ফলের বাগান ও আঙুর,
৩৩| আর সমবয়স্ক ফুটফুটে কিশোর,
৩৪| আর পরিপূর্ণ পানপাত্র।
৩৫| তারা সেখানে খেলো কথা শুনবে না, আর মিথ্যা কথাও নয়।
আর এই সূরার রেফারেন্স হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছেন এই লিংকটি http://www.qurantoday.com/78Naba_Bangla.pdf
তার লেখা পড়ে নিশ্চিতভাবেই ৩টি সূরার ৩টি আয়াতকে চিহ্নিত করা যায়, যার দ্বারা লেখক তার "গেলমান" এবং "সমকামিতা জায়েজ" টাইপ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন।
খুব স্পেসিফিকভাবে বললে আয়াতগুলো হলো,
আত-তুর এর ২৪ নং আয়াতঃ
"আর তাদের চারিদিকে ঘুরবে তাদের কিশোররা, -- তারা যেন সুরক্ষিত মুক্তো।"
সূরা আদ্-দাহ্র, এর ১৯ নং আয়াতঃ
"আর তাদের প্রদক্ষিন করবে চিরস্ফুটিত কিশোরগণ, -- তোমরা যখন তাদের দেখবে তাদের তোমরা ভাববে ছড়ানো মুক্তো।"
সূরা আন্-নাবা'র ৩৩নং আয়াতঃ
"আর সমবয়স্ক ফুটফুটে কিশোর।"
এবার আসুন আয়াতগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা বা লেখক এর মিথ্যাচারিতা(যদি থেকে থাকে), বা তার রেফারেন্স এর ভুল তথ্য তথা তার দাবীর সত্যতা আলোচনা করা যাক।
আলোচনার সুবিধার্থে আমি তার রেফারেন্সকে ২ভাগে ভাগ করছি। প্রথমে আলোচনা করছি সূরা আত-তূর আর সূরা দাহর'কে নিয়ে। যেহেতু দুটি আয়াত এরই বিষয়বস্তু একই। সুতরাং আলোচনা একসাথে করলে কোন সমস্যা হবেনা। খেয়াল করুন সবাই।
আলোচনার প্রথম আয়াত হলো সূরা আত তুর এর ২৪ নং আয়াত। আয়াতটি সবাই খেয়াল করুন।
وَيَطُوفُ عَلَيْهِمْ غِلْمَانٌ لَّهُمْ كَأَنَّهُمْ لُؤْلُؤٌ مَّكْنُونٌ
সুদৃশ্য মোতিসদৃশ কিশোররা তাদের সেবায় ঘোরাফেরা করবে।
And there will go round boy-servants of theirs, to serve them as if they were preserved pearls.
আর আলোচনার দ্বিতীয় আয়াতটি হলো সূরা দাহর এর ১৯নং আয়াতঃ
وَيَطُوفُعَلَيْهِمْوِلْدَانٌمُّخَلَّدُونَإِذَارَأَيْتَهُمْحَسِبْتَهُمْلُؤْلُؤًامَّنثُورًا
তাদের কাছে ঘোরাফেরা করবে চির কিশোরগন। আপনি তাদেরকে দেখে মনে করবেন যেন বিক্ষিপ্ত মনি-মুক্তা।
And round about them will (serve) boys of everlasting youth. If you see them, you would think them scattered pearls.
সবাইকে একটু সূরা দুটির প্রেক্ষাপট বলবো। খুবই সংক্ষেপে। তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে সবারই। সূরা তুর এর তুর শব্দটি হিব্রু ভাষা থেকে এসেছে। যার অর্থ পাহাড় যাতে লতাপাতা ও বৃক্ষ উদগত হয়। এই পাহাড়ের উপর হযরত মুসা (আঃ) আল্লাহতাআলার সাথে বাক্যালাপ করেছিলেন। এক হাদিসে আছে, দুনিয়াতে জান্নাতের চারটি পাহাড় রয়েছে, তার মধ্যে তূর একটি (কুরতুবী)। তূরের কসম খাওয়ার মধ্যে উপরোক্ত বিশেষ সম্মান ও সম্ভ্রমের ইঙ্গিত রয়েছে। এই সূরাটির মূল উদ্দেশ্য ছিল "একটি উদ্দেশ্যকে" মানুষের চিন্তাধারার নিকটবর্তী করা। উদ্দেশ্যটি হলোঃ "কিয়ামত সংঘটনের আসল কারন, প্রতিদান ও শাস্তি"।
আর সূরা দাহর এর অপর নাম সূরা ইনসান ও সূরা আবরার (রুহুল মা'আনী)। এতে মানবসৃষ্টির আদি-অন্ত, কর্মের প্রতিদান ও শাস্তি, কেয়ামত, জান্নাত-জাহান্নামের বিশেষ বিশেষ অবস্থার উপর আলোকপাত করা হয়েছে।
মূল আলোচনায় আসি,
কেয়ামতের পর মানুষ তারই প্রতিফল পাবে যা সে পৃথিবীতে করেছে। যারা আল্লাহভীরু, তারা জান্নাতের উদ্যানসমূহে ও ভোগবিলাসের মধ্যে থাকবে। সূরাটির ২০নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, "আমি তাদের আয়তলোচনা হুরদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে দেব। যারা ঈমানদার তারা এবং তাদের সন্তানরাও ঈমানে তাদের অনুগামী(অর্থাৎ তারা ঈমানদার তবে পিতা-মাতার সীমা পর্যন্ত পৌছাননি) তারাও তাদের পিতা-মাতার বদৌলতে বেহেস্তে যাবেন। আর এ কারনে পিতা-মাতার আমলও বিন্দুমাত্র হ্রাস পাবেনা। এমন যদি হয় যে, কোন পিতার আমল হয়তো কোন কারনে সন্তানের চাইতে কম, তবে সে কারনে পিতাকে বেহেস্তে নিচের স্তরে দেয়া হবেনা বা সন্তানকে উপরের স্তরে দেয়া হবেনা। বরং পিতাগণ উচ্চস্তরেই থেকে যাবেন এবং সন্তানদের তাদের কাছে পৌছে দেয়া হবে। অবশ্য সন্তানদের মধ্যে ঈমানের শর্ত পূরন না থাকলে তারা মুমিন পিতাদের সাথে মিলিত হতে পারবেনা। এই সূরাতে আরো বলা হয়েছে, বেহেস্তবাসীদের ফলমূল পৌছে দেয়ার জন্য তাদের সেবায় কিছু কিশোর নিয়োজিত থাকবেন। যারা সুরক্ষিত মোতির ন্যায়। এখন ব্যাপারটি খেয়াল করুন। আল্লাহ তাআলা এই সূরাতেই কিন্তু বেহেস্তবাসীদের এই সুখবর দিয়েছেন যে, তারা হুরদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবেন। আবার যারা বেহেস্ত পাবেন তারা তো সকল ভালো কাজ করেছেন বলেই বেহেস্ত পাচ্ছেন। তাহলে এটা কিভাবে সম্ভব যে, তারা বেহেস্তে এসে সমকামিতা করবেন। বরং এখানে আল্লাহ এই কিশোর দ্বারা বেহেস্তবাসীদের সন্তানদেরকে বুঝিয়েছেন, এটা ভাবা তো মোটেও অত্যুক্তি না। আবার, যদি এমনিতেও বেহেস্তবাসীদের ফরমাস খাটার জন্য কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়, তাহলে তারা কিশোর নাকি কিশোরী কোনটি হওয়াটা যুক্তিসংগত? সুতরাং এটা খুব স্বাভাবিক এবং সূস্থ্য মানসিকতার হবে এটাই ভাবা যে, বেহেস্তবাসীদের সাথে তাদের নিজ নিজ সন্তানদের পাশাপাশি মোতির ন্যায় উজ্জ্বল কিশোর থাকাটাই বেশী যুক্তিসংগত। আর সূরা দাহর এ অতিরিক্ত আরো যা বরা হয়েছে তা হলো, "তাদেরকে দেখে মনে করবেন যেন বিক্ষিপ্ত মনি-মুক্তা।" এই বাক্যটি দেখে অনেকেই ভুল বুঝেছেন। এখানে মুক্তো বলতে মূলত পরিচ্ছন্নতা ও চাকচিক্যকে বোঝানো হয়েছে। আর চলাফেরার দিক দিয়ে বিক্ষিপ্ত বলা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা উচ্চস্তরের তুলনা মাত্র। অর্থাৎ মহান রাব্বুলআলামীন এটাই বুঝাতে চেয়েছেন যে, শুধুমাত্র ব্যবহার্য জিনিসপত্র নয় বরং বেহেস্তের সব উপাদানই হবে অতি উচ্চমানের। আর তার ই কন্টিনিউশনে বলা হয়েছে, এই কিশোরদের পরিধেয় পোশাকও হবে অত্যন্ত দামী। আশা করি যারা এই আয়াতদুটিকে ভুল বুঝছিলেন তারা এখন কিছুটা হলেও বুঝতে পারছেন।
এবার তৃতীয় আয়াতটি নিয়ে কথা বলা যাক। এই আয়াতটি নিয়ে কাজ করার সময় বেশ সমস্যায় পড়ে যাই। কারন লেখক তার যে রেফারেন্স দিয়েছেন তাতে আয়াতটির অনুবাদ আছে এভাবে,
সূরা আন্-নাবা'র ৩৩নং আয়াতঃ
"আর সমবয়স্ক ফুটফুটে কিশোর।"
কিন্তু লেখকের এই রেফারেন্সটি ছাড়া অন্যান্য যেকোন অনুবাদে আয়াতটির অর্থ দেখা যায় নিম্নরূপঃ
وَكَوَاعِبَأَتْرَابًا
সমবয়স্ক, পূর্ণযৌবনা তরুনী
And young (mature) maidens of equal age.
খেয়াল করুন, সূরা নাবার এই আয়াতটির সংলগ্ন আয়াতসহ যদি উক্ত লেখক এর মত করে আপনি অনুবাদ পড়েন, তখন সূরাটির কি রূপ দাড়ায় খেয়াল করুনঃ
৩১| ধর্মভীরুদের জন্য নিশ্চয়ই রয়েছে মহাসাফল্য - -
৩২| ফলের বাগান ও আঙুর,
৩৩| আর সমবয়স্ক ফুটফুটে কিশোর,
৩৪| আর পরিপূর্ণ পানপাত্র।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, ধর্মভীরুরা ফল, পানপাত্র এর সাথে পাবেন সমবয়স্ক ফুটফুটে কিশোর? এটা তো যে কারো মনে সন্দেহ তৈরী করতেই পারে।
সূরা তূর সহ পূর্ববর্তী সূরাগুলোর ক্ষেত্রে আয়াতগুলোতে উল্লেখ ছিলো, বেহেস্তবাসীরা হুরদের বিয়ে করবেন। তাদের নানাকাজে সেবা করার জন্য তাদের সন্তানরা সহ থাকবেন কিশোররা। কিন্তু এখানে এই কথাগুলো তো উল্লেখ নাই। স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ বাসা বাধতে পারে মনে। আসলে আয়াতটির ভুল অর্থ দেয়া আছে, এই আয়াতগুলো হবে এমন,
৩১| ধর্মভীরুদের জন্য নিশ্চয়ই রয়েছে মহাসাফল্য - -
৩২| ফলের বাগান ও আঙুর,
৩৩| আর সমবয়স্ক, পূর্ণযৌবনা তরুনী,
৩৪| আর পরিপূর্ণ পানপাত্র।
এখনকি আর অসামন্জস্য মনে হচ্ছে আয়াতগুলোকে?
সবাইকে অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য। আসলে কেউ যদি জোরপূর্বক কোন ধর্মকে(ইসলাম বা যে কোন তধর্মকে) ছোট করতে চান তো, একটা তথ্যকে বিকৃত করে নানাভাবেই তা করা সম্ভব। আমি মনে করি যারা পবিত্র কোরআন শরীফকে নিয়ে নানা বিভ্রান্ত তৈরী করে তাদের কথাতে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। নিজেরাই তর্জমা-তাফসীরসহ কোরাআন শরীফ পড়লে এই ধরনের যে কোন বিভ্রান্তি হতে দূরে থাকা সম্ভব। ধন্যবাদ সবাইকে।
তথ্যসূত্রঃ
বাংলা কিতাব.কম http://www.banglakitab.com/index.htm
কোরআন শরীফ অনলাইন http://www.quraanshareef.org/
ইসলামপিডিয়া http://www.islampedia.info/index.php
কোরআন টুডে.কম http://www.qurantoday.com/76Insan_Bangla.pdf
ইসলাম.নেট.বিডি http://www.islam.net.bd/
বিডি ইসলাম.কম http://www.bdislam.com/
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিঃ
ব্লগার কঠিন চিজ http://www.somewhereinblog.net/blog/Bappy_edu ও ব্লগার তাহসিন আলম http://www.somewhereinblog.net/blog/tahsinalom এর প্রতি।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ৮:২০