তিতিরের মাথায় সকাল থেকে যে দুটা জিনিষ ঘুরছে তা হচ্ছে সেমাই আর চিনি। কাল ঈদ, তাই এ দুটা জিনিষ ভাবা অনর্থক নয়।তবে তিতিরের জন্য ব্যাপার টা একটু অন্যরকমই।
তিতির থাকে মেসে,মেসে রান্না করার মত কেউ নেই। বুয়া ছিল,ঈদের ছুটিতে সেও এখন গ্রামের বাড়িতে। মেসে এখন মাত্র দুজন লোক, এক তিতির দুই মেসের ম্যানেজার। এদের দুজনের কেউই সেমাই রান্না করতে পারেনা।
অবশ্য সেমাই আর চিনি ভাবার কারণ অন্য, তিতিরের সকাল থেকে বাসায় যাওয়ার ইচ্ছা করছে। বাসায় গেলে সে সেমাই আর চিনি নিয়ে যাবে এজন্য এ দুটা জিনিষ নিয়ে ভাবনা।
তিতির ওর বাসা যায়না প্রায় এক বছর। গত বছরের কোরবানী ঈদে গিয়েছিল। আর এবার রোজার ঈদ, প্রায় এক বছর।
বাসায় না যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা যায় তিতিরের বাবার প্রতি অভিমান। গতবার তিতর বাসায় গিয়ে টাকা চেয়ে পায়নি। তার উপর ওর বাবাও অনেক কথা শুনিয়েছে। বলেছে এত বড় ছেলে, টিউশনি করলেও তো হয়। বাসা থেকে টাকা নেয়। তিতিরের বাবা আফজাল মিয়ার করার ও কিছু ছিল না,রিটায়ার্ড স্কুল মাষ্টারের সামান্য পেনশন দিয়ে বাসার খরচ চালাবেন নাকি তিতির কে দিবেন?
তিতির সেদিন বাসা থেকে বের হয়ে এসেছিল, বাবাকে বোঝাতে পারেনি যে ঢাকা শহরে টিউশনি পাওয়া এত সোজা না, পরিচিত কেউ না থাকলে কোন ভাবেই সম্ভব নয়।
তবে তিতির এখন টিউশনি করায়,মোট তিনটা। তিনটায় যা ইনকাম হয় তাতে বেশ ভালো চলে ওর। সেবার বাসা থেকে বেরিয়ে আসার পর তিতির আর ফেরেনি বাসায়,ওর মা মাঝে মাঝে ফোন করে এই যা। ওর বাবার সাথেও আর কথা হয়নি।তিতির এক রকম প্রতিজ্ঞা করেছিল, আর ফিরবেনা কখনো বাসায়।
কিন্তু আজ সকাল থেকেই তিতিরের খুব ইচ্ছা হচ্ছে ওর মাকে দেখতে। ওর মাও ফোন করেছিল সকালে। আসতে বলেছে তিতির কে।
ও তখনো বলেনি যাবে কি যাবে না।
তিতির বুঝতে পারছেনা কি করবে?
কাল ঘোরাঘুরির কথা আছে নবনিতার সাথে। আর তাছাড়া বাসায় গেলেও খরচ আছে,এত দিন পর গেলে বাবা মায়ের জন্য কিছু নিতে হবে, এত টাকাও নেই তিতিরের কাছে।
ঈদ হচ্ছে এবার মাসের মাঝামাঝি,বেতন ও নিতে পারেনি। শুধু বলে কয়ে একটা টিউশনির বেতন পেয়েছে।আর দুটা পাবে মাসের শেষে। এ অবস্থায় বাসায় যাওয়া বোকামী।
তবে নবনিতাকে ফোন করে সাজেশন পাওয়া যেতে পারে। যাওয়ার ব্যাবস্থা যেহেতু হয়েছে সেহেতু গেলেই হয়।তিতিরের যাওয়ার ব্যাবস্থা করেছে ওর স্টুডেন্টের বাবা,ওনার নাকি ভাল একটা ফ্রেন্ড আছে কল্যান পুর বাস ষ্টেশন এ। ওই লোকের সাথে তিতিরের কথা হয়েছে,উনি বলেছে তিতির যেন একটু জলদি আসে। যাওয়ার কোন ভাড়া লাগবেনা।এতে একটু সুবিধাই হয়েছে তিতিরের।কিছু টাকা বেঁচে যাবে।
তিতির নবনিতাকে ফোন দেয়। নবনিতাকে সর্যিও বলতে হবে,যদি ও বাড়ি যায়।মেয়েটা অনেক প্লান করে রেখেছিল কালকের জন্য।
-হ্যালো,
-নবনিতা তুমি কোথায়?
-নিউমার্কেট এর দিকে,
-শপিং করছ?
-হ্যাঁ,কিছু টুক টাক। কেন বলো তো?
-তুমি কি জানো সেমাই আর চিনির কেজি কত করে?
-মেসে রান্না করবা? তোমাকে তো বলছি আমাদের বাসায় আসবা। বাবাকে বলছি তোমার কথা,
-না আসলে
-আসলে কি?
তিতির একটু চুপ করে থেকে বলে,
-বাসা যাবো,
-কালকে ইদ,আজ কিভাবে যাবে?
হঠাৎ কি এমন হল?
-বাসার কথা মনে পড়তেছে,
-আচ্ছা, টিকেট কাঁটছ?
-না,
-তাহলে , মানুষ দুই সপ্তাহ আগে থেকে চেষ্টা করে টিকেট পায়না। আর তুমি?
-আমার এক স্টুডেন্টের বাবার পরিচিত আছে উনি জোগাড় করে দিচ্ছে,
-আচ্ছা,ঠিকাছে তাহলে।
-হ্যাঁ,,
-তো কি কি কিনে নিয়ে যাবা?
তিতির একটু ভেবে নিয়ে উত্তর দিলো,
-যা যা লাগে আর কি?
-আচ্ছা,, তো আমি সব কিনে দিচ্ছি। তুমি আমার সাথে ঘন্টা খানেক পরে দেখা করো,
-আচ্ছা,
তিতির যেন একটু হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ও ঈদের জন্য কখনো কেনাকাটা করেনি। কি কি নিতে হয় তাও জানেনা?
তবে ও জানে ঈদের জন্য সব চাইতে গুরুত্ত্বপূর্ণ জিনিষ দুটা হচ্ছে সেমাই আর চিনি।
এ দুটা থাকতেই হয়।
তবে তিতিরের একটু চিন্তাও হচ্ছে, নববিতার খরচের হাত ভাল। ও কত কি খরচ করে নিয়ে আসবে কে জানে?
অবশ্য এই খরচ গুলো বাসা গিয়েও করা যেতে পারত। তবে বাস কখন নিয়ে যাবে কে জানে?
নবনিতা কে ভালভাবে বলে দিলেই হত যে তিতিরের কাছে খুব বেশি টাকা নেই।তার উপর নবনিতা যদি বাবা মায়ের জন্য কাপড় চোপড় কিনে ফেলে তাহলে তিতির কে বেশ বিপদেই পড়তে হবে।
তিতির যে ভয় করছিল সেটাই হলো। নবনিতা সোজা এসে তিতিরের হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-তোমার বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবী আছে আর তোমার মায়ের জন্য একটা শাড়ি। শাড়ির রঙ টা একটু ডিপ। কেমন লাগবে আন্টির কাছে জানিনা?
-তোমাকে এসব আনতে বলেছিলাম?
নবনিতা একটু হেসে জবাব দেয়,
-রাগ করোনা,এগুলা তোমার তরফ থেকে নয়। আমার তরফ থেকে।হবু শশুর শাশুরীকে তো দেয়া যায়,নাকি যায়না?
আর শোন,সেমাই চিনি বাসায় গিয়েই কিনবা। ঠিকাছে?
নবনিতার কথা শুনে তিতিরের চোখে পানি এসে গিয়েছিল। ও অন্য দিকে তাকিয়ে সে পানি লুকালো।
নবনিতা আবার বলল,
-তোমার টিকেটের ব্যাবস্থা হয়েছে?
-হ্যাঁ,
-তোমাকে নিয়ে আমার এ ঈদে প্লান ছিল অনেক,
-সর্যি,,
-সর্যির কিছু নেই। আমি খুশি হয়েছি তুমি যাচ্ছ। অনেক দিন যাওনা।
-তুমিও চলো,
-না এবার নয়, পরের বার। এবার গিয়ে আমার কথা বলো। হুট করে গেলে কি না কি ভাববে।
তিতির মেয়েটার কথা শুনে হেসে উঠলো। নবনিতাকে দেখে ও মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায়। এরকম মেয়ে পৃথিবীতে আছে।
নবনিতাকে বিদায় দিয়ে একটু জলদিই বাস স্টানে চলে আসে তিতির। ওর টিকেট করা সম্ভব হয়নি। সব বাস লোড, তবে ওর যাওয়ার ব্যাবস্থা করা হয়েছে একটা আলাদা মাইক্রোবাসে। মাইক্রোবাসে কিছু দরকারী জিনিষ পত্র নিয়ে যাওয়া হবে রংপুর।সেখানে খুব আরামেই তিতির যেতে পারবে।
তিতরের মাইক্রোবাস ছাড়ল প্রায় রাত একটার দিক। ও ভেবেছিল ওর রংপুর পৌছাতে পৌছাতে হয়ত সকাল আটটা নটা বেজে যাবে কিন্তু রাস্তা ফাঁকা থাকায় সে মাইক্রোবাস পৌছালো ছয়টায়। তিতির গাড়ি থেকে নেমে নবনিতাকে ফোন করে জানিয়ে দিল সে পৌছে গেছে। তারপর বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল।
তিতির বাসায় পৌছে কোন ডাকাডাকি করল না,শুধু গেটে দুটা টোকা দিল। ওর বাবা আফজাল মিয়া বেড়িয়ে এসে বলল,
-কে?
-বাবা আমি,
-তিতির?
-হুম,
আফজাল মিয়া তিতির কে জড়িয়ে ধরেন। ওনার বিশ্বাস হচ্ছেনা তিতির এসেছে। ওনার চোখে পানি এসে গেছে খুশিতে। উনি তিতির কে জড়িয়ে ধরেই বললেন,
-কেমন আছিস?
-ভাল,তুমি কেমন আছ বাবা?
-ভাল,আয় ভেতরে আয়।কতদিন পরে তোকে দেখছি তোকে,,
তিতির ওর বাবার আচরণে একটু অবাক হলো।ওর বাবার প্রতি ওর যে রাগ ছিল সেটা নিমিষেই উড়ে গেল।
তিতির ঘরের ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করে,
-মা কোথায়?
-তোর মা নারিকেল আনতে গেছে। তুই আসবি আজ এটা তোর মা স্বপ্নে দেখেছে। আমি কত করে মানা করলাম। শোনেনি।
তিতির একটু হাসলো। ওর মা মাঝে মাঝেই ওকে অবাক করে। কিছুক্ষন বাদেই ওর মা ঘরে ফিরল। হাতে দুধের বোতল আর নারিকেল। ওনার ধারণা এগুলা ছাড়া ভাল সেমাই রান্না করা সম্ভব নয়। এতদিন পর তিতির আসবে,ওর ভাল মন্দ কিছু খাওয়া উচিত।
তিতির ব্যাগ থেকে শাড়ি আর পাঞ্জাবী টা বের করে ওর বাবা মায়ের হাতে দিল। তার সাথে নবনিতার কথাও বলল। যে এগুলো ওর কেনা নয়,নবনিতার কেনা।
শাড়ি নিয়ে যে ভয় নবনিতা করছিল তেমন টা হলোনা, শাড়ি বেশ পছন্দ হলো তিতিরের মায়ের।
তিতিরের সেমাই চিনি কিছুই কিনতে হল না, সব আগে থেকেই কেনা।তবে ও গিয়ে মাংশ কিনে আনলো দুপুরে খাওয়ার জন্য।
নামাজ পড়ে এসে তিতির আর ওর বাবা এক সাথে খেতে বসলো।তিতিরের মনে বেশ আনন্দ হলো।কতদিন পর সবাই এক সাথে খাচ্ছে ওরা। তিতিরের নবনিতার কথা বেশ মনে পড়ছে। মেয়েটা ওর সাথে আসলেই পারতো।
তিতির খাওয়া শেষে ফোন দিল নবনিতাকে,
-হ্যালো,
-হুম,বলো,
-কি করছ?
-রান্না শেষ করলাম,তোমার বাসায় সব ঠিক ঠাক।
-হ্যাঁ,
-তোমার মা শাড়ি পছন্দ করেছে?
-হ্যাঁ, আর তোমাকেও,
একটু অবাক হয়ে নবনিতা জিজ্ঞেস করে,
-আমাকেও মানে?
-মানে,তোমার কথা বললাম
-কি বলছ?
-যা হয়েছে সব, মাকে তোমার পিক দেখিয়েছি। মা বেশ পছন্দ করেছে ।
-তুমি একটা বেশি,
-আম্মু তোমার সাথে কথা বলবে,
-কি বলবো আমি, আরে,
তিতির আর কিছু না বলে ওর মাকে ফোন টা দিয়ে উঠে ওর নিজের ঘরে আসে। অনেক দিন এ ঘরে শোয়া হয়না,বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই তিতিরের চোখ বব্ধ হয়ে আসে। এক সময় ওর মনে হয় পৃথিবীর সব চাইতে সুখী মানুষ টা সে।কারণ ওর কাছে বাবা মেয়ের ভালবাসা আছে, আর পৃথিবীতে বাবা মায়ের চাইতে দামী বা কি?
তিতির আজ ওর বাবার চোখের পানি দেখেছে, ওর বাবা ওকে কতটা ভালবাসে, তা আজ ও জানতে পেরেছে। আর এ ভালবাসা গুলো কোন ভাবেই কেনা যাবেনা, না টাকা দিয়ে না অন্য কিছু দিয়ে। তিতির প্রতিজ্ঞা করেছে আর কখনো বাবার মনে সে কষ্ট দিবেনা,কোন ভাবেই না।
তবে তিতিরের সব চাইতে আনন্দ হয়েছে যখন ওর মা নবনিতার দেয়া শাড়িটা পড়েছে। মাকে শাড়িটাতে বেশ মানিয়েছিল।
মায়ের মুখে হাসি ছিল,এমন হাসি খুশি মাকে শেষ কবে দেখেছিল তিতির,ওর মনে নেই।
তবে এসবের জন্য নবনিতার একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য। ধন্যবাদ নবনিতা।
-নাহিদ পারভেজ নয়ন