শৈশবের কথা বললেই যে ছবিটা সবার আগে আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা হচ্ছে এক শান্ত-নিরিবিলি , নির্জন মফস্বলের এক রাস্তার কথা। যেখানে বাধাহীন স্বাধীনতায় ইচ্ছে মত দৌঁড়ে যাচ্ছে একটা বাচ্চা ছেলে। কে এই বাচ্চা ছেলেটা?? কে আবার! আমি! কেন জানি আজ হঠাৎ ইচ্ছে হলো নিজের শৈশব নিয়ে কিছু লিখি। এই প্রচন্ড যান্ত্রিক জীবনেও মাঝে মধ্যেই এসে উঁকি মারে শৈশবের কিছু চেনা মুখ, কিছু রঙ্গিন স্মৃতি । আজ ইচ্ছে হলো সেই মুখ গুলোর কিছু কথা, কিছু গল্প বলি!
একদম যখন বাচ্চা আমি অর্থাৎ যখন ও স্কুলে ভর্তি হয়নি তখন আমার সময় কেটেছে এক কলোনিতে। কলোনি লাইফের কি মজা তা অন্যরা কেউ বুঝবে না, যারা কখনো কলোনিতে থাকেন নি! তার উপর আমাদের কলোনিটা ছিল কিছুটা ক্যান্টনমেন্টের মত! অর্থাৎ বাইরের মানুষের প্রবেশ প্রায় নিষিদ্ধ! এর ভেতর আমাদের অবারিত জীবন। বিশাল উন্মুক্ত মাঠ, বাসার সামনে খোলা জায়গা, বিশাল বিশাল রাস্তা, কলোনির এক পাশে নদী। নদীর পাশে বাচ্চাদের জন্য খেলার জায়গা , বসার জন্য বেঞ্চ। বলা যায় রাজকীয় হাল! আমার শৈশবের মনে পড়া দিনগুলোর শুরু এখানেই...
একজন আইস্ক্রীম ওয়ালাঃ ছোটবেলা থেকেই প্রচন্ড দুষ্টু ছিলাম! দুষ্টুমির জন্য রীতিমত বিখ্যাত(!) ছিলাম! তখন ও স্কুলে ভর্তি হয়নি। সারাদিন ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ানো আর যাবতীয় অকর্ম সাধন করাই আমার একমাত্র কাজ তখন! আইস্ক্রীমের প্রতি প্রচন্ড টান আমার। কিন্তু ঠান্ডার সমস্যা থাকার কারনে বাসা থেকে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা আইস্ক্রীমের উপর! বড়জোর সপ্তাহে একদিন আম্মু কিনে দিত। রোজ দুপুরবেলা , বিকেল বেলা আইস্ক্রীম ওয়ালা জাবেদ "আইস্ক্রীম --নিবে আইস্ক্রীম" বলতে বলতে হেঁটে যায়! আমি বাসার সামনের রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকি! দুনিয়ার সমস্ত মজা লুকিয়ে আছে আইস্ক্রীমওয়ালার হাতে ধরা ওই বাক্সটার ভেতর! একদিন দুপুরবেলা দেখলাম মেজো মামা হাতে এক বান্ডিল টাকা নিয়ে এসে ভেতরের রুমের কাবার্ডটার নিচের ড্র্য়ারে রেখে দিলেন। মামা ওখান থেকে সরতেই আমি গিয়ে হাজির! অনেক কষ্টে ড্রয়ার খুলে বান্ডিলটা থেকে একটা নোট খুললাম! সংখ্যা চেনার সুবাদে বুঝলাম এটা এশো টাকা! কি মজা! আজ আমি সব আইস্ক্রীম কিনে ফেলবো! আমার আনন্দ তখন দেখে কে! বিকেলে হতেই এক ছুট লাগালাম মাঠের দিকে ,কারন জাবেদ আইস্ক্রীমওয়ালা ওখানেই বসে থাকে। হাঁপাতে হাঁপাতে জাবেদের সামনে এসে পকেট থেকে নোটটা বের করেই গম্ভীর ভাবে বললাম, "এই জাবেদ আমাকে সব গুলো আইস্ক্রীম দে!" জাবেদ কিছুক্ষন আমার হাতের নোটটার দিকে তাকিয়ে থাকল! এরপর আমার হাতে একটা কুলফি মালাই ধরিয়ে দিয়ে নিজে হাতে ধরে আমাকে বাসায় নিয়ে এলো ( আমাদের বাসা ওর চেনাই ছিলো ) !! এরপরে আমার কি হলো তা নাইবা বললাম! কিন্তু আজ ও ভাবলে অবাক লাগে এক সামান্য আইস্ক্রীম ওয়ালা একশোটাকার নোটের লোভ এভাবে সামলালো! না, সে আসলে সামান্য না। আমার শৈশবের এক উজ্জ্বল রঙ্গিন মুখ এই আইস্ক্রীম ওয়ালা জাবেদ। এই ঘটনার কিছুদিন পর জাবেদকে আর দেখিনি ।
অংক ম্যাডামঃ ছোটবেলা স্কুলে যেতে কি ভয়াবহ রকম অনীহা আমার ছিলো তা আগে একটা লেখায় বলেছিলাম! সেটা ছিলো ক্লাশ ওয়ানের ঘটনা। এর কিছুদিন পরে নতুন স্কুলে চলে এলাম অর্থাৎ আমাদের কলোনির স্কুলে। খুবই কঠোর নিয়ম কানুন, প্রচন্ড রকম মেজাজি সব স্যার-ম্যাডাম! কিন্তু আমার সেই রোগ যে তখন ও সারেনি! রোজ সকালে আম্মু আমাকে ধরে বেঁধে স্কুলে দিয়ে আসে। প্রথম পিরিয়ডটা কোনমতে কাটে। কিন্তু পিরিয়ড শেষের ঘন্টা বাজতেই আমার মন ছুটে চলে যায় জানালা দিয়ে বাইরের মাঠটায় । মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল শিরিষ গাছটার আড়ালে! দ্বিতীয় পিরিয়ড হচ্ছে অংক্ ম্যাডামের। ম্যাডাম দেখতে রীতিমত পরীর মত! মিষ্টি করে হাসেন, কেউ অংক না পারলে একটু ও বকা দেন না! সপ্তাহখানেক বহু কষ্টে ক্লাশ করলাম আমি! এরপর একদিন কাঁচুমাচু মুখে ম্যাডামের সামনে গিয়ে হাজির! "ম্যাডাম আমার না খুব পেট ব্যাথা করছে। ক্লাশ করব না। আমাকে ছুটি দিন"। ম্যাডাম আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসেন, "ক্লাশ করতে ভালো লাগে না?", ফিসফিস করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমাকে! যেন ষড়যন্ত্র করছেন আমার সাথে! আমি ও সাথে সাথে জানিয় দেই উত্তর। ম্যাডাম তখনই আমাকে ছুটি দিয়ে দিলেন! আহ, কি আনন্দ! স্কুল থেকে এক ছুটে বের হয়ে এসে দাঁড়ালাম বড় মাঠে ( আমাদের স্কুলের তিনটা মাঠ ছিল! ছেলেদের বিল্ডীং এর সাথে একটা, মেয়েদের সাথে একটা আর বিশাল বড় কেন্দ্রীয় মাঠ। যেখানে একটা স্টেডিয়াম চাইলে বানানো যাবে!) । কিন্তু এবার তো পড়লাম বিপদে! এখন যদি বাসায় ফিরে যাই, তবে আম্মু বুঝে যাবে আমি স্কুল ফাঁকি দিয়ে এসেছি! নির্ঘাৎ আমাকে আবার ধরে স্কুলে দিয়ে যাবে! সুতরাং কিছুক্ষন ইচ্ছেমত মাঠের এদিক ওদিক হাঁটলাম, দোঁড়াদৌড়ি করলাম! কিন্তু এতটুকু একটা বাচ্চার পক্ষে এতখানি সময় এভাবে কাটানো খুবই কষ্টকর! সুতরাং সেদিনের মত বসায় ফিরে গেলাম! অবিশ্বাস্য হলেও সত্য পরদিন থেকে এটাই হল আমার রুটিন! প্রতিদিন অংক ম্যাডামের সামনে গিয়ে দাঁড়াই আর ছুটি নিয়ে চলে আসি! ততদিনে আমার দু' জন বিশ্বস্ত সঙ্গী জুটে গেছে! এরা আবার ম্যাডামকে বলার ধার ধারে না! প্রথম পিরিয়ড শেষ হলেই বের হয়ে আসে! স্কুলের দারোয়ান প্রথম প্রথম আটকাতো! কিন্তু প্রতিদিন ম্যাডামের কহা বলায় সেই বেচারাও ক্লান্ত হয়ে আর আমাদের আটকায় না! আমরা তিনজন মাঠের কোনায় কোনায় বিভিন্ন গাছের গোঁড়া খুজে দেখি, গর্ত আছে কিনা! থাকলে ওখানে নির্ঘাৎ সাপ আছে! সাপ যদি থাকেও তাতে আমাদের কি লাভ তা এতদিনে মনে পড়ছে না আর! কোনদিন ছুটে চলে যেতাম নদীর পাড়ে! নদীর পাড়ে গেট লাগানো থাকত, আমরা হেঁটে বেড়াতাম। কখনো ছোট ছোট জাহজ বা লঞ্চ গেলে চিৎকার করে ডাকতাম ওদের! ওখান থেকে কেউ কেউ আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ত, হাসত! প্রচন্ড বিস্মিত হয়ে তিন বন্ধু তাকিয়ে থাকতাম নদীর ও পাড়ের দিকে! কি রহস্যই না আছে ওখানে! ছুটে যাওয়া ছোট জাহাজগুলো না জানি কোন সুদূরে যায়! পুরো ক্লাশ টুতে এই ছিল আমার রুটিন। আজ যখন নিজের ছোট্ট ছোট্ট কাজিনদের দেখি পড়াশোনার চাপে আর ব্যাগের ভারে দিশেহারা তখন নিজেকেই প্রশ্ন করি , সেই অংক ম্যাডাম কি সত্যি ছিলেন? যদি থাকেন , তবে কোথায় এখন এরকম শিক্ষকেরা?? ম্যাডাম আপনাকে কোনদিন বলা হয়নি আমার শৈশবের এক বিরাট অংশকে অসম্ভব রকম রঙ্গীন করতে কি অনবদ্য ভূমিকা আপনার আছে, আপনার কারনেই স্কুল ভিতি দূর হয়েছিল আমার। ম্যাডাম আপনি যেখানেই থাকুন অনেক ভাল থাকুন!
বালিকারাঃ ছোট বেলার বালিকা পর্ব এর আগে আমার এক লেখায় বলেছিলাম! আজ সেই বালিকার কথা আর বলব না। আজ বলব অন্যদের কথা! আসলে ছোটবেলায় বালিকাদের প্রতি আমার কোনরকম বিদ্বেষই ছিলো না, বরং তাদের প্রতি ছিলো আমার কোমল অনুভুতি!
আমাদের বাসার কিছু দূরেই থাকত এক বালিকা। পারিবারিক সম্পর্ক থাকার সুবাদেই কলোনি লাইফের একদম শুরতেই আমার প্রধানতম খেলার সঙ্গী ছিলো এই বালিকা! বালিকা যেমন আমাদের বাসায় আসত , ঠিক তেমনি আমিও যেতাম বালিকাদের বাসায়। কিন্তু খেলার চেয়ে খেলা ধ্বংস প্রবৃত্তি ই ছিলো আমার ভেতর বেশি! উদাহরন দিই, বালিকা হয়ত সামান্য তেঁতুল এনে রান্না-বাটি খেলার হাঁড়ির ভেতর তা রান্না করার ভান করছে, এমন সময় তার বাসায় হাজির আমি! কোন কথা না বলেই নির্দ্বিধায় তেঁতুলটা নিয়ে মুখে পুরে দিতাম আমি! বালিকা কখনো কাঁদতো না! তার মায়ের কাছে নালিশতো দূরের কথা! যদি কখনো বা একটু চিৎকার করত , তবে সাথে সাথে আম্র উত্তম মধ্যম! একদিন বিকেলের ঘটনা ....বালিকা আমাদের বাসায় ছুটতে ছুটতে এসেছে! হাতে কটা বই! এসেই সোজা আমার আম্মুর কাছে! "আন্টি , আব্বু আমার জন্য এই সুন্দর বইটা এ্নেছে!" আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম অ, আ , ১,২ এসবের বই! আম্মু দেখে খুব সুন্দর বলে বালিকাড় গাল টিপে দিলো। আমি এবার গম্ভীরভাবে বললাম , 'দেখি আমাকে দাও তো! " হাসি খুশি বালিকা সরল মনেই আমার হাতে দিলো বইটা! এরপর.... আমি বইটা নিয়ে দলামোচা করে ছুঁড়ে দিলাম দরজার বাইরে! কেন যে এই কাজ করলাম, কে জানে! কিন্তু বালিকা ততক্ষনে কাঁদতে কাঁদতে তার বসার পথে! এরপর ও বালিকা আমার সাথে খেলতে আসত ,সন্ধ্যার পর আমার বরফ-পানি খেলতো! তার জন্মদিনে গেলে নিজ হাতে আমাকে কেক খাইয়ে দিলো আর বিনিময়ে আমি তার সুন্দর চুলে সুন্দর করে কেক মাখিয়ে দিলাম! এই ছিলো বালিকার সাথে আমার সম্পর্ক! বছরখানেক পরেই কলোনি থেকে চলে আসায় বালিকার সাথে আর যোগাযোগ রইল না। তবে এর বহুদিন পর আবার তার সাথে দেখা হয় আমার! সে কাহিনী অন্য একদিন!
নতুন বাসায় এসে উঠলাম। পাশের ফ্ল্যাটে আমার সমবয়সী এক বালিকা এবার! আমার স্কুলেই পড়ে! কিছুদিনের মধ্যেই তার সাথে সখ্যতা জমে উঠল দারুন! তবে এই বালিকা মোটেই আগের জনের মত শান্ত শিষ্ট নয়! স্কুলে টিফিন নিয়ে যেতে দারুন অনীহা ছিলো আমার! দেখা যেত আমার টিফিন পিরিয়ডে বালিকা এসে হাজির আমার টিফিন বক্স হাতে! আম্মু ওর কাছে দিয়ে দিয়েছে! স্কুল ছুটি হওয়ার পর ও বন্ধুদের সাথে খেলার মজাই আলাদা! কিন্তু ততক্ষনে বালিকা গিয়ে বাসায় বলে দিয়েছে, স্কুলের পাশে কোথায় কোন বন্ধুর সাথে আমি খেলছি! ফলাফল , আব্বু চলে এসেছে আমাকে ধরে নিয়ে যেতে! বৃষ্টির দিন যেখানে আমি নিজের ইচ্ছেমত ছাতা নিয়ে লাফাতে লাফাতে স্কুলে যাবো, সেখানে জোর করে আমাকে বালিকার সাথে এক রিকশায় তুলে স্কুলে পাঠিয়ে দেয়া হতো! এরকম অত্যাচারের পর যখন ভাবি, ক্যারাম খেলায় ওকে নিলে হারিয়ে প্রতিশোধ নিবো , সেখানেও আমি ধরাশায়ী! আমার গুটি যেন পকেটই খুঁজে পায় না আর ততক্ষনে বালিকার সব গুটি খাওয়া শেষ! হায়, বালিকার উপর প্রতিশোধ আর যেন নেয়া হলো হলো না আমার! না, প্রতিশোধ একবার নিয়েছিলাম তবে সেটা শৈশবের মধ্যে পড়ে না, সেটা কৈশোর কালে! তাই সেই গল্প আজ না!
এরকম আরো অসংখ্য রঙ্গিন মুখ নিয়েই , কিছু অসাধারন স্মৃতি নিয়েই কেটেছে আমার মফস্বল তথা শান্ত এক শহরতলীর শৈশব। যা এক লেখায় পুরোপুরি বলা হলো না। অনেক মুখ, অনেক গল্প বাদ রয়ে গেলো। নিজেকে প্রচন্ড রকম ভাগ্যবান মনে হয় এরকম একটা শৈশবের জন্য। আর এই বর্নিল শৈশবের পেছনে বিরাট অবদান এই রঙ্গিন মুখগুলোর! যেখানেই থাকুক এই প্রিয়, চেনা মুখগুলো যেন প্রচন্ড রকম ভালো থাকে। এই কামনা সব সময়।
আগের বালিকা পর্বঃ
একটি বাল্যকালীন রোমিও কাহিনী
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১২ ভোর ৬:৫৩