বড় চুল, দুহাতে ডজনখানেক রিস্টব্যান্ড, পড়নে ঢোলা জামা, মুখে এলোমেলো দাঁড়ি, রাতদিন বইয়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মুখ—এমন মানুষদের দেখে যতটা আত্মভোলা মনে হয়; যেমন মনে হয় — তারা মনে হয় সুখেই আছে, নিজেতে নিজেকে সুখী; আসলে অতটা সুখি তারা না। একজন লেখক হিশেবে তারা কতটুকু সফল সেটা বিবেচনায় না নিলে তাদের অধিকাংশকেই দেখা যায় একইরকম একটা খুব বেশি আত্মকেন্দ্রিক জীবনযাপন করতে। সত্য কথা বলতে কি, কবিরা কবিতা দিয়ে আমাদের যত মুগ্ধ করেন, একজন কবি ব্যক্তিমানুষ ততটা মনোমুগ্ধকর নাও হতে পারেন, এবং সাধারণত হন না। মানুষ তাদের এড়িয়ে চলে না, কিন্তু কোন এক অজানা ভয়ে তাদের কাছেও ঘেঁষতে দেন না। আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে এমন মানুষদের এড়িয়েই চলি।
ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে আমি যেসব কবিদেরই কাছে এসেছি অধিকাংশই দেখেছি কোন না কোন কারণে সবসময় হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকতে, বিষণ্ণতায় নীল হয়ে থাকতে। কবিদের ক্ষেত্রে না শুধু, একটু বেশি কল্পনাপ্রিয় কিছু মানুষের বিষয়েও কথাগুলো সত্য। কখনও হয়তো এক লাইনও লেখেননি, কিন্তু স্বভাবে কবি এসব মানুষগুলোকে কখনও চায়লেও আর সবার মত হেসে খেলে বাঁচতে পারে না।
যেকোন কারণেই হোক, স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যেভাবেই হোক কবিদের মন-মানসিকতা অন্যদের থেকে কিছুটা ভিন্ন থাকে। এবং দেখা যায়, কবি হিশেবে তাদের গ্রহণযোগ্যতা যেমন রয়েছে ব্যক্তিমানুষ হিশেবে তাদের গ্রহণযোগ্যতা খুব বেশি কম, সম্ভবত এমন মানসিকতার কারণে। একবার শুনেছি, এক কবি দুঃখ করে বলছেন, ‘আপনি ভাল লেখেন, আপনার আমি খুব বড় ফ্যান—এসব কথা আমাকে ভাত দেয় না।’ ভাতের অভাবে মানুষ মরে যায় না, কিন্তু সত্য বলতে খ্যাতি কখনও একজন মানুষকে সুখি করতে পারে না। অনেক বিখ্যাত শিল্পীদেরকেই শেষজীবনে গিয়ে আত্মহত্যা করতে দেখা যায়, যে খ্যাতি খ্যাতি করে আমরা সব দিতে প্রস্তুত, তাদের সবকিছুর পেছনের কারণ খ্যাতি হিশেবে ধরলে, তারা সবটুকু উপভোগ করেও তারা কেন জীবন দিয়ে দিচ্ছেন!
আমি জানি না, এ মানুষগুলোর কিসের এত দুঃখ। কবিতায় এমন কি আছে, দুঃখ, একাকীত্ব ছাড়া, যার জন্যে বাকী সব অবহেলা করে যাওয়া যায়? খ্যাতি কোনমতেই কবিতা লেখার কারণ হতে পারে না। মাঝেমধ্যে মনে হয়, হয়তো কবিতা কবির রক্তে মিশে থাকা কোন ভাইরাস, যে ভাইরাসের নিরাময় নেই।
মার্চ ৩১ ২০১৮