১.
এসবের বাইরেও মানুষের কিছু দুঃখ থাকে। এসব ভালবাসার বাইরেও কিছু ভালবাসা। ভালবাসার বাইরের ভালবাসা, দুঃখের বাইরের দুঃখ, বিষণ্ণতা, ক্লান্তি, নাগরিক যন্ত্রণার সে কথা গত দুদশক ধরে শিরোনামহীন যেভাবে তুলে ধরেছে, ওভাবে পারেনি আর কেউই। "পাখি", "হাসিমুখ", "আবার হাসিমুখ"-এর মত জনপ্রিয় গান, "পরি", "পরিচয়", "ক্যাফেটেরিয়া", "জাহাজী"-র মত ভিন্নধর্মী সুরের গানের সম্মিলনে শিরোনামহীনের সৃষ্টিগাথা।
নগরকে, নাগরিক যন্ত্রণাকে বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্ন ভাবে তাদের কথায়, সুরে এনেছে শিরোনামহীন। "অন্ধ শহর" "আকাশ অল্প" "হাউজিং জ্যাম" "রিকশায় আঁকা পেইন্টিং" "ব্যস্ত জনমথা" "নিয়ন আলোর রাজপথে" শব্দগুচ্ছগুলো ভিন্নরকম স্বাদ দেয় শ্রোতাদের। নগর ভালবেসেও নাগরিক কোলহলকে দূর করে একা পাখিকে আমন্ত্রণ, "শহর মানে গ্রামের গল্প"-জাতীয় বোধ তাদের সৃষ্টির মূলমন্ত্র।
২.
১৯৯৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হাকিম চত্বর, ডাকসু ক্যান্টিন, আর্টস ফ্যাকাল্টি, টিএসসি করিডরে তিনবন্ধু এক গিটার সঙ্গী করে শুরু করে তাদের যাত্রা। ২০০২ সালে ব্যান্ডের অন্য প্রধান দুই সদস্য সরে যায় ও ব্যান্ডের গঠনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। যোগ দেয় শাস্ত্রীয় সংগীতের ছাত্র, জিয়ার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী তানযীর তুহীন। তানযির তুহিনের হাত ধরেই শিরোনামহীনের শিরোনামহীন হওয়ার গল্পের শুরু হয়।
এ পর্যন্ত পাঁচটি এলবাম বেরিয়েছে শিরোনামহীনের। এলবাম ছাড়াও কিছু গান রয়েছে তাদের। সাইকেডেলিক রক, প্রোগ্রেসিভ রক ও ফোক ধাঁচের গান বেশি গায় শিরোনামহীন। তবে শিরোনামহীন রবীন্দ্রনাথ অ্যালবামে রবীন্দ্রসংগীতগুলোকে নিজস্বভাবে গেয়েছে শিরোনামহীন, যা বেশ প্রশংসা কুড়োই। তাদের প্রায় সবগুলো গানই নিজেদের লেখা। ব্যান্ডের প্রথম দিককার সদস্য জিয়াই বেশিরভাগ গানের গীতিকার। তানযির তুহিন, দিয়াতও বেশ কিছু গান লিখেছে। অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন চিত্রকল্পের সমন্বয় দেখা যায় জিয়ার গানগুলোতে।
“কোথায় যেনো বৃষ্টির রিমঝিম শোনা যায়
বইছে বাতাস, কাশফুল ছুঁয়ে শন-শন
বৃষ্টির উচ্ছ্বাস ছুঁয়ে যায় নাগরিক উপকূল।
রিমঝিম রিমঝিম নাচলো আমার মন
অনেকদিন, অপেক্ষায়, সমান্তরাল থেকেই গেলো জেব্রা ক্রসিং…
বৃষ্টির প্রার্থনায় কাশফুল নতজানু,
উড়ে চলে তৃষ্ণার্ত রঙহীন ফড়িং।”
কাশফুল বাতাস ছুঁয়েছে আবার সে উচ্ছাস নাগরিক উপকুল ছিয়ে গেছে। এ দৃশ্যপট হঠাৎ পালটে অন্ধকারাচ্ছন্ন মেঘলা দিনে নিয়মবাধা শহরের রাস্তায় ফড়িঙের উড়াউড়ির কথা চলার কথা এসেছে।
“সেই কবে ছিল উচ্ছাস,
কিছু শঙ্কায় ভরা চুম্বন
ছিল প্রেমিকার ঘন নিশ্বাস,
হাসিমুখে ফোয়ারা।
এই অবেলায় ফোঁটা কাশফুল,
নিয়তির মত নির্ভুল-
যেন আহত কোন যোদ্ধার বুকে
বেঁচে থাকা এক মেঘফুল।”
আবার হাসিমুখের এ প্রতিকি পঙক্তিগুলো একটি নির্দিষ্ট ঘটনাকে ঘিরে আবর্তন করেও বহুমুখী ও বহুভাষী।
অন্যদিকে তানযির তুহিনের গানের কথায় গ্রামের কথা এসেছে, পাখি, বনের কথা এসেছে। তার অধিকাংশ গানই কিছুটা ধীর লয়ের ও আধ্যাত্মিক ঘরানার।
“কথায় কথায় মনের ছায়া, মিথ্যে আশায় দিচ্ছে মায়া
অবাক আলোয় বনের পাখি, মনের কথা কয়
বনের পাখি খাঁচায় থাকে, এমন কি আর হয়
তোমার আমার এই পরিচয়
সত্যি কি আর হয়।”
আত্মার সাথে ব্যক্তিমানুষের সম্পর্কে টানাপোড়নের এমন কথা তুহিনের গলার সুরে মন কেড়ে নেয়, কেমন একটা মন খারাপি এনে দেয়।
“চাইনা আমি বিত্ত সমাজ অর্থ অহংকার
জীবন মাঝে চাইনি বলে নিত্য হাহাকার
তুমি আমার পথেরও শেষ
আকাশ নীলের হাসি
আমি তোমার স্বপনে ভাসি।”
“মনরে বাঁধি কি দিয়ে ছাই, মনটা যে ক্লান্ত নাটাই
তোর আকাশে ঘুড্ডি কাটে, আপন মানুষ অন্য হাতে
তুমি আমার জলের আগুন, তুমি বিনে অনল ফাগুন
ভাসি আমি বনের জলে,অপার জীবন দহন কলে
সময় সিদ্ধ, সময় সত্য, সময় পারাপার উন্মত্ত
সময় বাঁধি কি দিয়ে আর একলা আকাশ এখন আমার।”
যান্ত্রিক বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি দেশীয় বাদ্যযন্ত্র যেমন—দোতারা, মন্দিরা, এস্রাজ, বাঁশির ব্যবহার তাদের গানগুলোকে আরও স্বকীয় করে তোলে। শিরোনামহীন রবীন্দ্রনাথ এলবামের গানগুলোতে বিশেষত বাঁশির ব্যবহার মনে রাখার মত ছিলো।
৩.
জনপ্রিয় এ ব্যান্ড সবসময় শ্রোতাদের কাছে ভিন্নস্বাদের কিছু হিসেবে গ্রহণীয় হয়ে এসেছে। শিরোনামহীন মানে "যাদুকর", "আবার হাসিমুখ" আর এ নাগরিক কোলাহলের শহরে শহরের গান গাওয়া এক "একা পাখি"।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:১১