অথচ তার জীবনটা এমন হবার কথা ছিলো না। কত বিন্দু বিন্দু ভালবাসা দিয়ে সে সাজিয়েছিল তার স্বপ্ন গুলো। কত দীর্ঘ অপেক্ষার রাত কাটিয়েছে সে এই স্বপ্ন গুলো বুকে নিয়ে। একজন মানুষ কেমন করে পারে তার ক্রদ্ধ হাত দিয়ে কারো হৃদপিন্ডটিকে ছিন্নভিন্ন করে তার স্বপ্ন গুলোকে কেড়ে নিয়ে যেতে!
মৃদুল তার জীবনে যখন এসেছিল হৃদিতা তখন বেণী দোলানো এক উচ্ছল কিশোরী। সারাদিন প্রজাপতি হয়ে প্রজাপতির পিছনে ছুটতো। সেই সময় মৃদুল তার জীবনে এসে হাত ধরে এক স্বপ্নের দেশে নিয়ে যায়। বর্ষার বাঁধ ভাঙ্গা নদীর মত হৃদিতার পৃথিবীটা ভাসিয়ে নিয়ে যায় এক অবাক করা সুখে। মনে হয় এই সম্পূর্ণ পৃথিবীকে তার ছোট্ট বুকে ধারন করতে পারবে সে। কিন্তু সেদিন সে, বোঝেনি, ভালবাসা যা দিয়ে যায়, নিয়ে যায় তার থেকে নিয়ে যায় অনেক বেশী। মৃদুল একদিন তার জীবনের স্বপ্নের কথাগুলো হৃদিতাকে খুলে বলে, সে জীবনে অনেক দূর যেতে চায়। জীবনে কিছু একটা হতে চায় সে। তাই উচ্চ শিক্ষার জন্য সে বিদেশে পড়ালেখা করতে যাবে। সেদিন হৃদিতা মৃদুলের হাত ধরে বলেছিল তোমার স্বপ্ন আজ আমারো স্বপ্ন। আমি বলেতো এখন কিছু নেই আমার। আমার সব কিছুই তুমি। যেখানেই যাও আমি সব সময় তোমার পাশেই থাকবো। কিন্তু যখন সত্যি সত্যি যাবার সময় আসলো আসলো নিজের মনকে কিছুতেই মানাইতে পারেনা হৃদিতা। মনে হয় তার হৃদপিন্ডটা কে যেন ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে। তবুও হৃদয়ে পাথড় চাপা দিয়ে তাকে বিদায় জানিয়ে আসার পড় মাসের পর মাস লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছে পাগলি মেয়েটি।
কথা ছিল প্রতি দুই সপ্তাহে একটা করে চিঠি লিখে জানাবে। তখনতো এখনকারমত ই মেইল ছিল না। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে এত ফোন করারো সামর্থ ছিল না। তবুও তার জন্মদিনে মায়ের দেয়া নিজের কানের দুলটুকু বিক্রি করে তার জন্য উপহার পাঠিয়েছিল সে। তার মনে হত আমার অলংকার দিয়ে কি হবে, সেইতো আমার অলংকার। তারপর আস্তে আস্তে তার চিঠির সংখ্যা কমতে থাকে। ফোন করলে বিরক্ত হয়। একদিন কেঁদেকেটে বললাম প্লিজ কি হয়েছে আমাকে বলো। আমাকে কিচ্ছু বললো না। আমি উপায় না দেখে তার বন্ধুর কাছে ফোন করে জানলাম সে টাকার জন্য ইউনিভর্সিটি ছেড়ে দিয়েছে এবং রেফিউজি হিসেবে থাকার জন্য আবেদন করেছে। এটা শুনে কত যে কেঁদেছি আমি সে শুধু আমার সৃষ্টিকর্তা জানেন। দিন যায় তার রেফিউজি মামলা চলতে থাকে। কবে ফিরতে পারবে সেটাও অনিশ্চিৎত। মনে মনে বলি আমি কিচ্ছু চাইনা শুধু তুমি ফিরে আসো তবুও তাকে বললাম আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবো সারা জীবন। এমন করে কেটে যায় দশটি বছর। বাসা থেকে চাপদেয় বিয়ে দেবার জন্য। শেষে কথা বলা বন্ধ করে দেয় বাবা আমার সাথে। আমি বসে থাকি আমার মৃদুলের জন্য। একা একা তাকিয়ে থাকি চাদের দিকে।
একদিন আমাকে ডেকে ছিল চাঁদ
বলেছিল কি চাও আমার কাছে?
বলেছিলাম তাকে, যদি দেখা হয় তার সাথে
তোমার একটু আলো দিয়ে পথ দেখিও তাকে।
বলে ছিলো সে মৃদু হেসে,
সূর্যের মত ভালবাসা ঘিরে রেখেছে যারে,
আমার আলোর কি সাধ্য আছে
তার কাছে পৌছুতে পারে।
অবশেষে সে একদিন জানালো সে ফিরে আসছে। আমার অন্ধকার আকাশ ভরে উঠলো রুপালী আলোয়। আমার জান, আমার মৃদুল আমার কাছে ফিরে আসছে। আমি কি করবো ভেবে পাইনা। মনে হ্য় এক স্বপ্নের মধ্য আছি আমি। এতদিন পর নিজের দিকে নজর দিলাম একটু। কেমন যেন বুড়িয়ে গেছি আমি। চোখের নিচে কালি জমেছে তার জন্য রাত জেগে জেগে। সারাদিল কেটে যায় সে আসলে কি করবো না করবো এইসব ভেবে। তার আসার দিন যত কাছে আসতে থাকলো প্রতিটি মিনিট কে মনে হ্য় এক একটি বছর। আবশেষে যেদিন তার সাথে দেখা হলো তাকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রেখে অনেক ক্ষন কাঁদলাম আমি। মনে হলো আমার পৃথিবীকে আমার বুকের মধ্যে পেয়েছি আমি। তারপরেও মনে হলো আমার আগের মৃদুলকে কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছি আমি। সে শুধু বললো "এমন বুড়িয়ে গেছো কেন? নিজের দিকে খেয়াল রাখোনা?" তারপর কাজ আছে বলে তারাহুরো করে চলে গেলো। এর পর প্রয় পনেরো দিন তার কোন খোজ পাইনি। ফোন করলেও ধরে না। একদিন তার বন্ধুকে ফোন করে বললাম তুমি আমার ভাইয়ের মত, তুমি সত্যি করে বলো সে এখন কোথায়। সে বলে মৃদুল কম বয়সি এক সুন্দরি মেয়ে কে বিয়ে করে গতকাল বিদেশ চলে গেছে। আমি নাকি বুড়িয়ে গেছি। তার সোসাইটিতে আমাকে মানাবে না।
আজ তবুও দোয়া করি অনেক সুখি হোক সে। আমরা একি আকাশের নিচে আছি। একই চাঁদ আমাদের আলো দেয়। এই সান্তনা টুকু নিয়ে আমি আমার বাকি জীবনটা পার করে দিতে পারবো।
"আমরা তো জানি কত সুন্দর জিনিস আছে,
সুমেরু শিখর আছে , তুষার মৌলি হিমালয় আছে,
আমরা কি যেতে পারি?
জানি তারা আমারই আছে, তবু কি পেতে পারি?
তাই বলে সেটা ভোলা নয়,
সে আমার গোপনতম সত্তায় লগ্ন সুন্দরতম স্বপ্ন। " ---মহামতি জেবীন
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:১৯