একজন পুরুষের ব্যক্তিত্বের অনেকগুলো আকর্ষণীয় গুণের মধ্যে একটি হলো তার কিলার ইন্সটিঙ্কট। এই বিষয়টি খুব বিতর্কিতও বটে, বিশেষ করে নারীর বিরুদ্ধে অত্যাচার আর নির্যাতন যখন সব পাশবিকতা ছাড়িয়ে যাচ্ছে সেই সময়ে। মূলত এখানেই আসে এই বিশেষ গুণটির বিশেষত্ব। বিশেষ করে নারীকে অন্যায়-অত্যাচার আর নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই পুরুষের মাঝের এই বিশেষ গুনটি নারীর কাছে এত আকর্ষণীয়। আর সেটাই আমার আজকের লেখার অনুসন্ধানের বিষয়।
পটভূমিঃ
মানুষ সেই শিকারী-সংগ্রাহক সভ্যতা থেকে উন্নত হতে হতেই আজকের এই আধুনিক সমাজ তৈরি করেছে। প্রাচীন সেই সমাজে বেঁচে থাকার জন্য ও পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষা করবার জন্যই মানুষের অনেক বৈশিষ্ট্যের একটি ছিল তার শিকার বা খুন করবার সামর্থ্য। আর প্রায় প্রতিটি গোত্রের সবথেকে ভাল শিকারীর এই একটি বৈশিষ্ট্যের কারণেই যে সে তার গোত্রের নারীর কাছে আলাদাভাবে আকর্ষণীয় ছিল সে কথা না বললেই নয়। তবে সভ্যতার অগ্রগতির সাথে পুরুষের শিকার বা খুন করবার সামর্থ্যের থেকেও বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে তার বুদ্ধি ও মেধাশক্তি। আর সেইসাথে লোপ পেতে থাকে তার চরিত্রের এই বিশেষ গুণটি। আসলে লোপ পেতে থাকে না বলে বরং সমাজ হতেই এই বিশেষ গুণটি দমিয়ে রাখতে শেখানো হয় বলাটা আরো যথাযথ হবে। তবে সেটাকে ঠিক খারাপ বলা যায় না। মনে রাখতে হবে যে সভ্যতা সবসময় মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করেই এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে হয়েছে, তবে মানুষ হিসাবে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার জন্যই তা সবসময় সঠিক বা যথাযথ হয়নি। যাই হোক, এই মানুষের আরেকটি সীমাবদ্ধতা হলো তার সমাজের ব্যপারে ইন্টেলেকচুয়াল কন্সট্রাক্ট বা আধ্যাতিক সমাজব্যবস্থা অথবা ইউটোপিয়ার চাহিদা। এতে সমাজের বাস্তবতা উপেক্ষা করে বরং সমাজ ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিৎ সে দিকে ফোকাস করা হয় বেশি যার ফলে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ধীরে ধীরে মানুষ হিসাবে টিকে থাকার কিছু বিশেষ গুণ হারিয়ে যেতে পারে অত্যন্ত ধীরে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে ভায়োলেন্সকে মোকাবেলা করবার সামর্থ্য তার মাঝে অন্যতম। তবে যুদ্ধ এবং অন্যান্য পারিপার্শ্বিকতার ফলে এ গুণটি মানুষ মাঝে মাঝে চর্চা করেনি বললে ভুল বলা হবে। বিশেষ করে আমাদের ঠিক আগের জেনারেশন যুদ্ধ সামনাসামনি প্রত্যক্ষ করেছে।
সমস্যাটা আসলে বাধে সমাজের চিরাচরিত শিক্ষাব্যবস্থার বাইরেও যে আরো কিছু শিখবার আছে তা যখন আমরা ভুলে যাই তখন। মানুষ যতই ভায়োলেন্সকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করুক না কেন তা এখন পর্যন্ত একটি সত্য। একে অস্বীকার করবার কোন উপায় নেই, তবুও আমাদের ছোটবেলা থেকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে কোন বিপদ থেকে দূরে থাকবার। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে বলা যায় যে, বিপদে মানুষ দুই ধরনের প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রোগ্রামড- “Fight or Flight” । দুঃখজনক ব্যপার হলো ছোটবেলা থেকে আমাদের শুধু “Flight” প্রতিক্রিয়াটির অনুশীলন করানো হয়েছে সচেতন এবং অবচেতন ভাবে। আর এর সাইড এফেক্ট হিসাবেই আজকের দিনের বেশিরভাগ পুরুষ মানুষ তার শারীরিক সক্রিয়তা এবং বিপদকে সামনাসামনি মোকাবেলা করবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে বললে ভুল বলা হবে না। তবে, এ ব্যপারে আমার পড়াশোনা শুরু হয় মূলত ব্যাড বয়দের সাথে ভালো ছেলেদের পার্থক্যগুলো জানতে গিয়ে, ব্যাড বয়দের অনেকগুলো আকর্ষণীয় গুণের একটি হলো তার কিলার ইন্সটিংক্ট, যা ভালো ছেলেদের মাঝে পুরোপুরিই অনুপস্থিত। Click This Link
ব্যাখ্যাঃ
তবে কি নারী চায় যে পুরুষ মানুষ তাকে অত্যাচার করুক। না, বরং সভ্যতার শুরু থেকেই নারীকে রক্ষা করার জন্য একজন পুরুষ মানুষের যেই সামর্থ্য বা দক্ষতা সেটা পুরুষমানুষের অন্যতম আকর্ষনীয় গুন হিসাবে নারীর মনের অবচেতনের গভীরে রয়ে গেছে। আর এটা ভালো ছেলেদের মাঝে অনুপস্থিত বিধায় অনেক সময়ই নারী ব্যাড বয়দের দিকে আকর্ষণ অনুভব করে একপ্রকার বাধ্য হয়েই।
একজন খুনী কোনভাবেই নারীর কাছে আকর্ষনীয় নয়, তবে আপনার ব্যক্তিত্বে যে প্রয়োজনে বিপদকে চূড়ান্তভাবে ফেস করবার সামর্থ্য আছে সেটা মেয়েদের কাছে মারাত্মক আকর্ষনীয় একটা গুণ। উদাহরণ হিসাবে মনে করুন, স্বামী-স্ত্রীর বেডরুমে কোনভাবে একটা বড় ইঁদুর দেখা গেলো। লোকটি লাফ দিয়ে বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে গিয়ে তার স্ত্রীকে যদি বলে, “মারো, ওটাকে মারো।” আর যাই হোক, ঐ বিশেষ মুহূর্তে যে মেয়েটি তার প্রেমিকের ব্যপারে কোন আকর্ষণ অনুভব করবে না সেটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।
অথবা ধরুন, রাতে ঘুমানোর সময় বাসার রান্নাঘরে অদ্ভুত শব্দ শোনা গেলো। আপনি আপনার স্ত্রীকে বললেন গিয়ে সেটা চেক করতে। উপরোক্ত দু-ক্ষেত্রেই মেয়েটি আপনার ভয় তার মেয়েলি ইন্টুইশন দিয়ে বুঝে ফেলবে। আপনার নির্ভীকতা বোঝাতে আপনার খুনী হবার দরকার নেই, তবে সে জানতে চায় যে আপনি মৃত্যুর মুখে দাঁড়ানোর সাহস রাখেন, একান্ত প্রয়োজনের মুহূর্তে। কার্যত সে জানতে চায় যে, আপনার ভেতর প্রয়োজনে খুন করবার সেই সামর্থ্যটি আছে। সে জানতে চায় যে, আপনার সন্তান এবং পরিবারকে রক্ষায় আপনি যে কোন সীমা অতিক্রম করতে প্রস্তুত। আর এটা মেয়েদের একদম অবচেতনের একটি চাওয়া। শিক্ষাব্যবস্থা যেমন আপনাকে আমাকে শিখিয়েছে, ভায়োলেন্স খারাপ ব্যপার ঠিক একটি মেয়েও সচেতনভাবে তাই জানে। অথচ অবচেতনে পুরুষেরা সবাই জানি, বিপদকে সামনাসামনি ফেস না করতে পারা মানে আত্মসম্মান কমে যাওয়া।
পুরুষের শিকারী/যোদ্ধা ব্যক্তিত্বের যেই ডার্ক এনার্জি, যে প্রয়োজনে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে দ্বিধাবোধ করেনা, এটা আপনার আমার চরিত্রের একটি অপরিহার্য অংশ। তবে বর্তমান সমাজের শৌখিনতা আমাদের শিখিয়েছে এই এনার্জিটাকে অবচেতনেই দমিয়ে রাখতে। আর ফলাফল হিসাবে সমাজে শিষ্ঠাচারযুক্ত ভালো ছেলে আর শ্বাশত চরিত্রের বিনীত নারীর কোন অভাব নেই। অথচ এই দুইয়ের ব্যক্তিত্বের ডার্ক এনার্জি ঠিকই সময়ে সময়ে বের হয়ে আসে, যা সচেতনভাবে তার নিজের শাসনের বাইরে। [উল্লেখ্য যে, সাইকোলজির একটা বিশেষ তত্ত্ব হলো গিয়ে আমাদের চরিত্রের কোন অংশ/আবেগ যদি অবচেতনে গভীরভাবে দমিয়ে রাখা হয় তবে তা বিকৃতভাবে বের হয়ে আসার সম্ভাবনা থেকে যায়। ব্যক্তিত্বের যে কোন মন্দ দিক তাই উপস্থিত জেনে তবেই তাকে শাসন করতে হবে।]
প্রতিটি নারীর সুন্দরী হাসির পিছেই আছে তার ডার্ক এবং শক্তিশালী আরেকটি এনার্জি [ হিন্দু মীথলজির কালী দিয়ে যাকে বোঝানো হয়েছে] যা আজকালকার বেশিরভাগ ছেলেই সামলাতে পারেনা। বরং মেয়েদের বিভিন্নভাবে দোষ দিয়ে নিজের দুর্বলতাকে লুকানোর জন্য ছুতা বের করে। আমার মনে হয় যে, নারী-নির্যাতন এবং ধর্ষণের মতো ব্যপারগুলোয় নারীকে দোষারোপ মানে হলো যে কোন পুরুষের দুর্বলতার সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ। তার শক্তিমত্তার প্রদর্শন হিটলারের মতো- নিজের কাপুরুষতা/ ইনসিকিউরিটি ঢাকতে যে লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষকে অমানবিকভাবে শেষ করে গেছে। অদ্ভূত।
যাই হোক, আজকের সমাজে পুরুষকে এই বিশেষ গুণটি এমনভাবে দমিয়ে রাখতে শেখানো হয়েছে যে, বেশিরভাগ পুরুষ তার মুখে একটি মেকী হাসি ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, তার কমফোর্ট জোনের বাইরে পা রাখতে সে একদমই রাজী নয়, তার ব্যক্তিত্বের অদম্য সেই এনার্জিটি একদমই অনুপস্থিত, যে কোন বিপদকে সামনে থেকে মোকাবেলা না করে বরং পালিয়ে পালিয়ে হলেও টিকে থাকাটাই তার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। আর মেয়েদের কাছে কমে যাচ্ছে সার্বিকভাবে পুরুষের গ্রহণযোগ্যতা। ব্যাড বয়দের মাঝে কিলার ইন্সটিংক্ট আকর্ষনীয় হলেও সেটা তারা শাসনে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে, আর মেয়েরা দোষারোপ করছে সকল পুরুষকে। ধরুন, রিকশা করে প্রেমিক-প্রেমিকা সন্ধ্যার সময় হাইজেকারের হাতে পড়লো। এমন অবস্থায় কার ওপর মেয়েটির আস্থা বেশি থাকবে- একটা ভালো ছেলে যে কিনা বাচার জন্য সবকিছু দিয়ে দেওয়াকেই একমাত্র উপায় বলে ধরে নিয়েছে নাকি একজন ব্যাড বয় টাইপ ছেলে যে কিনা প্রয়োজনে হাইজ্যাকারের সাথে লড়তেও ভয় পাবেনা। কে বেশি আকর্ষনীয়?
অবচেতনে নারী আমাদের এই সামর্থ্য বুঝতে পারে তার নিজস্ব রাগ, ক্রোধ অথবা মেয়েলি ব্যক্তিত্বের অস্থিতিশীলতাকে একজন পুরুষ কিভাবে সামাল দিচ্ছে তা থেকে। তার প্রেমিক কতটা সফলভাবে একটা মেয়ের মেয়েলিপনাকে হ্রাস না করে তার আবেগকে সামাল দিতে সক্ষম সেটা থেকেও তার ভেতরের এই ব্যক্তিত্বটি সম্বন্ধে বুঝতে পারে মেয়েরা। নারীর ডার্ক এনার্জিকে ভয় না পেয়ে বরং কতটা সফলভাবে পুরুষ তার অদম্য ভালোবাসা দিয়ে একটি মেয়ের আবেগের জটিলতাকে ভেদ করতে পারে সেটাই প্রমাণ করে পুরুষ মানুষ হিসাবে সে কতটা শক্ত এবং দুঃসাহসী। এজন্য প্রতিটা শক্ত মেয়েরও মাঝে লুকোনো ছোট্ট মেয়েটিকে অথবা ছোট্ট মেয়েটির মাঝে লুকোনো শক্ত চরিত্রের নারীটির হৃদয়েও আবেদন রাখতে সক্ষম লোকটিকেই শক্ত চরিত্রের পুরুষ বলে ধরে নেয় মেয়েরা।
পুরুষের ব্যক্তিত্বের এই অদম্য কিলার ইন্সটিংক্টের প্রতি নারীর আকর্ষণ মূলত প্রতিটি পুরুষের জন্য নারীর দেয়া একটি উপহার, আর এই উপহারের প্রতি পুরুষ সম্মান জানাতে পারে নিজের ব্যক্তিত্বের ডার্ক এনার্জিগুলোকে শাসন এবং উন্নতির মাধ্যমে। এতে পুরুষের নিজেকে বিপদ বা সমালোচনা থেকে রক্ষা করে চলবার চাহিদা হ্রাস হবে, প্রতিটি মূহূর্ত হবে আরো নগ্ন, অনাবৃত এবং সমালোচনাযোগ্য, অথচ সত্য এবং চরম বিশ্বাসযোগ্য। নিজের দুর্বলতাকে গ্রহণ করে নিজস্ব ভুলের দায়িত্ব নেয়ার পথ এতে খুলে যাবে। কৃত্রিম নিরাপত্তার দেয়ালের পিছে অবস্থান না করে বরং প্রতিটি মুহুর্তকে অনুভব করে বেঁচে থাকতে শিখবে সাহসী পুরুষ।
করণীয়ঃ
একটা সময় ছিল যখন গোত্রের ছেলেদের বিভিন্ন পরীক্ষা এবং রিচুয়ালের মাধ্যমে তার পুরুষত্ব প্রমাণ করতে হতো। এক একটি গোত্র বা সমাজে প্রাচীনকালে ছিল এক এক রকমের রিচুয়াল। কোথাও হয়ত বিষাক্ত পিঁপড়ার গর্তে হাত দিয়ে, কোথাও হয়তবা ভয়ানক কোন শিকারের মধ্য দিয়ে, আর কোন কোন ক্ষেত্রে প্রকৃতির খারাপ রূপের সাথে যুদ্ধ করে একটি ছেলে পুরুষত্বের অধ্যায়ে প্রবেশ করতো। বর্তমানে সেভাবে না হলেও খুব সচেতনভাবে নিজের ব্যক্তিত্বের অবচেতনে দমিয়ে রাখা লড়াই করবার ক্ষমতাকে চর্চা করবার উপায় বের করে নিতে হবে। মার্শাল আর্ট, খেলাধুলা, শরীরচর্চা এমনকি অ্যাডভেঞ্চার হতে পারে এই বিশেষ গুণটি চর্চার উপযুক্ত ক্ষেত্র। ব্রুস লি এর বলা আমার একটা প্রিয় উক্তি না দিয়ে পাড়লাম না-
“Approach martial art with the idea of mastering the will. Forget about winning and losing; forget about pride and pain. Let your opponent graze your skin and you smash into his flesh; let him smash into your flesh and you fracture his bones; let him fracture your bones and you take his life! Do not be concerned with your escaping safely – lay your life before him.”
খেলাধুলা বা মার্শাল আর্টস অথবা যাই বলি না কেন, কিলার ইন্সটিংক্ট হলো সেই বিশেষ মুহুর্তটি যা সক্রিয় করা মাত্র আমরা যে কোন পরিণতির কথা পুরোপুরি ভুলে যেতে সক্ষম, যখন জয়-পরাজয় এর থেকেও বড় হয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তিত্বের সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ ঝেড়ে ফেলে ঐ মুহূর্তে নিজের ভেতরকার সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করা। আর যুগে যুগে নারীকে রক্ষা করবার দ্বায়িত্ব যেহেতু পুরুষ সেচ্ছায় গ্রহণ করেছে, নিজেকে শক্ত করে তোলা হোক নারীর প্রতি আজকের দিনের পুরুষের উপহার।
https://www.facebook.com/DoctorXBD
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০১৪ দুপুর ১২:৪৮