বিষয়টা ধাঁধার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঈদের আনন্দ আসলে কীসের জন্য? ধাঁধা কেন হলো তা আগে বলি। এরপর ধাঁধার উত্তর হবে নে।
আজ সকালে পত্রিকা পড়ছিলাম। নজরে পড়ল বিপণী বিতানগুলোর এবার ঈদের প্রস্তুতির নিউজটি। বাজারে এবার হরেক রকম ড্রেস এসেছে। সেগুলোর আবার নানা রকম নাম আছে। সাব্রিয়া, নাব্বেয়া, ডিনকাচিকা, মাসাক্কালি, মোঘলে আজম ইত্যাদি। এ সবই নাকি হিন্দি সিরিয়াল আর মুভির চরিত্র বিশেষ। এবার আরো যোগ হয়েছে ব্রিটিশ রাজ পরিবারের নববধূর পরিহিত ড্রেসটি। নিউজে এক দোকান মালিকের উদ্ধৃতি এভাবে তুলে ধরা হয়েছে, "হিন্দি সিরিয়ালের কাপড় বেশ চলছে। মোঘলে আজমের চাহিদা অনেক। ব্রিটিশ রাজ পরিবারের নববধূর ড্রেসের চাহিদাও বেশ।"
প্রতিটি ড্রেসের দাম গড়ে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা। কিনছেন মধ্য মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ উচ্চবিত্তের মেয়েরা। এ নিউজটি আসলে ঈদকে ঘিরে আমাদের বিপণী বিতানগুলোর, বিশেষ করে ফ্যাশন হাউজগুলোর আলাদা উৎসাহ প্রকাশ করছে।
ঈদকে ঘিরে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। দিনরাত রেকর্ডিং চলছে। স্টুডিওগুলো খুব ব্যস্ত। আর্টিস্টদের দম ফেলবার সময় নেই। কলাকুশলীগণ ওভারটাইমের পর ওভারটাইম করছেন। ঈদে মিনিমাম এক সপ্তাহ স্পেশাল অনুষ্ঠান প্রচার করতেই হবে। নাটক, সিনেমা, টক-ঝাল-মিষ্টি শো, আরো কত কী..
এ ছাড়া ফার্নিচার কোম্পানীর বিশেষ ছাড়, মোবাইল কোম্পানীর সুলভ মূল্যে কথা বলার প্যাকেজ, ইন্টারনেট প্রোভাইডারের রমজান প্যাকেজ, জুতার শোরুমে বিশেষ Sale ইত্যাদি ইত্যাদি..
এসব দেখে প্রশ্ন হয়, ঈদের আনন্দ আসলে কীসের আনন্দ? সে আনন্দ প্রকাশের ধরণটাই বা কী হবে? কাদের জন্য এই ঈদ?
রাসূল স. এর হাদীসের দিকে তাকালে সহীহ বুখারী ও মুসলিমে একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, রোজাদারের জন্য দুটো আনন্দ। ১. যখন সে রোজা ভাঙে (বা রোজার দিন শেষে ঈদ আসে) তখন একটি আনন্দ। ২. যখন সে ক্বিয়ামতের দিন তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন আরেক আনন্দ।
এই হাদীস স্পষ্টতই বলছে, ঈদের আনন্দ রোজাদারের। দীর্ঘ সময়, দীর্ঘ দিন রোজা রাখার পর যখন সে রোজা ভাঙার অনুমতি পায়, তখন পানাহারের নিয়ামত লাভ করে সে ভেতরে অফুরণ আনন্দ অনুভব করে। একে তো পানাহারের অনুমতি, তার ওপর আল্লাহর নিজের পক্ষ থেকে দেয়া সওয়াবের প্রতিশ্রুতি তার এ আনন্দ বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়। দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সরাসরি কোনো উপহার পাওয়ার আনন্দ যতটুকু, তার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি এই আনন্দ।
এ জন্য একটি দিন আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা ও পরস্পরে এ আনন্দ বেটে নেয়ার জন্য আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যাকে আমরা ঈদুল ফিতর বা রোজা ভাঙার আনন্দ বলে জানি।
সাহাবীদের অনেকের জীবনী খুঁজলে দেখা যায়, এই ঈদের দিনেও তারা কাঁদতেন। এই ভয়ে যে, আনন্দ তো তারই মানায় যার গোনাহ ক্ষমা করা হয়েছে। আর আমার গোনাহ ক্ষমা করা হয়েছে কিনা তা তো জানা যায় নি।
অনেকে ঈদের আগের রাতে (চাঁদ রাতে) সারা রাত এবাদতে কাটাতেন। কারণ এই রাতটি আল্লাহর বিশেষ নিয়ামতের রাত।
এবার আমাদের দিকে একটু তাকাই। আমরা যে আনন্দ করি, তা কীসের আনন্দ? যদি রোজাদারের সেই আনন্দ হত, তাহলে রোজা তো আল্লাহর জন্য করা হয়। রোজার পরিপ্রেক্ষিতে যে আনন্দ হবে, তা প্রকাশের ধরণও নিশ্চয় আল্লাহর পছন্দনীয় হবে। কিন্তু আমরা কী তা করছি? এসব মোঘলে আযম আর মাসাককালি ড্রেস কি সেদিকেই ইঙ্গিত করছে? রোজা না রেখে বিপণী বিতানে ঘুরে বেড়ানো কী সেই আনন্দের প্রস্তুতি?
আচ্ছা, তাহলে এটা রোজাদারের আনন্দ নয়, নিশ্চিত হলাম। তবে আর কীসের আনন্দ? ঈদ নামক এক দিবসের? ঈদ কি কোনো ঐতিহাসিক আনন্দ-দিবস? যার পেছনে একটি আনন্দঘন স্মৃতি রয়েছে, যাকে মনে করে সবাই আনন্দ করে? নাকি ঈদের আনন্দের কারণ প্রতি বছর নতুন করে আসে? যদি প্রতিবছর এ আনন্দের কারণ নতুন করেই আসে, তাহলে আনন্দের কারণ অর্জন না করে শুধু আনন্দ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? আমাদের মাঝে আর সেই শিকল বাধা পাগলের মাঝে কি কোনো পার্থক্য আছে, যে বুঝেও হাসে, না বুঝেও হাসে
=====
ব্যক্তিগত ব্লগে প্রথম প্রকাশিত