বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বলা হয় বাঙালী জাতির পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জন। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের মানুষকে যে চরম মূল্য দিতে হয়েছে বিশ্বের অন্য কোন দেশের স্বাধীনতার জন্য তা হয়নি। নয় মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় সহযোগী জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দল ৩০ লাখ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেছে। সরকারী হিসেবে ২ লাখ, বেসরকারী হিসেবে সোয়া ৪ লাখ নারী তাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ১ কোটি মানুষকে তারা দেশত্যাগ করে প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে।
১৯৭১-এর ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে স্বাধীন বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণার মাধ্যমে। কোন প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন তার বর্ণনা রয়েছে এর ১৫ দিন পর ১০ এপ্রিল মুজিবনগর থেকে প্রচারিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে। *পরিশিষ্ট-১ দ্রষ্টব্য
বাংলাদেশের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিগণ কর্তৃক জারিকৃত স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রের বয়ান আরম্ভ হয়েছে এইভাবে
'যেহেতু একটি সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ১৯৭০ সনের ৭ই ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সনের ১৭ই জানুয়ারী পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, এবং
যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯ জনপ্রতিনিধির মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জনকে নির্বাচিত করেন, এবং
যেহেতু সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে জেনারেল ইয়াহিয়া খান জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণকে ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ তারিখে মিলিত হইবার জন্য আহ্বান করেন, এবং
যেহেতু এই আহূত পরিষদ-সভা স্বেচ্ছাচারী ও বেআইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়, এবং
যেহেতু পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ তাহাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার পরিবর্তে এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণের সহিত আলোচনা অব্যাহত থাকা অবস্থায় একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করে, এবং
যেহেতু এইরূপ বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ তারিখে ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন এবং বাংলাদেশের মর্যাদা ও অখ-তা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান,...।'
'১০ই এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে ইংরেজীতে প্রণীত 'চৎড়পষধসধঃরড়হ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব্থ মুজিবনগরে ঘোষিত ও জারিকৃত এবং ২৩ মে ১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশের গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
'স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র' হচ্ছে স্বাধীনতাকামী কোন দেশের স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ়োক্তি বা দাবি। এই ঘোষণাপত্র আনত্মর্জাতিক আইন দ্বারা তখনই বৈধতা লাভ করে যখন তা প্রদান করেন দেশের বা জাতির নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বা স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদী নেতৃত্ব। ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রম্নয়ারি জারিকৃত কসোভোর একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা সার্বিয়া যখন আনত্মর্জাতিক আদালতে চ্যালেঞ্জ করে তখন (জুলাই ২০১০) আদালতের রায়ে এই নিরিখে বলা হয়'কসোভোর স্বাধীনতার ঘোষণা আনত্মর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেনি।' ২০১১-এর ১৭ ফেব্রম্নয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কসোভোর স্বাধীনতার ৩য় বার্ষিকীতে প্রদত্ত এক বাণীতে দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়ন সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করে কসোভোর আর্থসামাজিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি কামনা করেছেন।
সোয়া দু'শ' বছর আগে আমেরিকার স্বাধীনতাও ঘোষণা করেছিলেন সে দেশের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা, যে ঘোষণাপত্র পরবর্তীকালে বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া প্রণয়ন করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া থেকে নির্বাচিত টমাস জেফারসন, যিনি স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া রচনা করেছিলেন ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী গণপ্রতিনিধি ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, যিনি বলেছেন ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই জারিকৃত যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তাঁকে কিভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।
বহু দেশ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদান ছাড়াই ঔপনিবেশিক প্রভুদের সঙ্গে দেনদরবার ও সমঝোতা করে স্বাধীন হয়েছে। পাকিসত্মানের জাতির জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যেমন বলেছেন তিনি একটি টাইপ রাইটারের সাহায্যে পাকিসত্মান স্বাধীন করেছেন। স্বাধীনতার জন্য ভারতবাসীকে লড়াই করতে হয়েছে প্রায় ১০০ বছর। তারপরও ভারত স্বাধীন হয়েছে সমঝোতার মাধ্যমে। সমঝোতার স্মারক হিসেবে শেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন কিছুকাল স্বাধীন ভারতের গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং স্বাধীনতা লাভের ঘটনার সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে। তবে একটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অন্য যে কোন দেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের তুলনায় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও গুরম্নত্বপূর্ণ দাবি করা যায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ সরকার কিভাবে পরিচালিত হবে, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কী হবে তা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যেভাবে বলা হয়েছে বিশ্বের অন্য কোন দেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সেভাবে বলা হয়নি। যে কারণে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন পর্যনত্ম বাংলাদেশ শাসিত হয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের দ্বারা। এই ঘোষণাপত্র অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২-এর ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন। এই ঘোষণাপত্র একাধারে ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন সংবিধান এবং বাংলাদেশের মূল সংবিধানের 'জেনোসিস' বা 'সৃষ্টিতত্ত্ব'। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর চতুর্থ তফসিলের ১৫০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বঙ্গবন্ধু কোন পরিস্থিতিতে ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন সে বিষয়টি যেমন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে নির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে এর সঙ্গে আরও বলা হয়েছে
'আমরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণ কতর্ৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কতর্ৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে, নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণপরিষদরূপে গঠন করিলাম, এবং পারস্পরিক আলোচনা করিয়া, এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থ, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম এবং তদ্দ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কতর্ৃক ইতিপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করিলাম।'
যেহেতু বঙ্গবন্ধু ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং যেহেতু এই ঘোষণা নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে অনুমোদন করেছেন সেহেতু ঘোষণাপত্রের শেষে বলা হয়েছে'আমরা আরও সিদ্ধানত্ম গ্রহণ করিতেছি যে, স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ তারিখে কার্যকর হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে।' স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ১০ এপ্রিল জারি করা হলেও এই ঘোষণাপত্র এবং বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এই দিন থেকে বাংলাদেশে অবস্থানকারী পাকিসত্মানী সামরিক জানত্মা দখলদার বাহিনীতে পরিণত হয়েছে, যাদের দখলদারিত্ব রক্ষার জন্য হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগি্নসংযোগ করেছে জামায়াত এবং তাদের সহযোগীরা।
বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম বাক্যটি হচ্ছে, 'আমরা বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রীস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া...স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করিয়াছি।'
বাংলাদেশের মূল সংবিধান প্রণীত হয়েছে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা, যা ১৯৭২-এর ৪ নবেম্বর গণপরিষদে গৃহীত হয়েছে এবং কার্যকর হয়ছে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ থেকে। যে কোন দেশের সংবিধান প্রণীত হয় গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম তিনটি শব্দ 'আমরা বাংলাদেশের জনগণ' যার ইংরেজী ভাষ্য হচ্ছে ্তুডব, ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ইধহমষধফবংয্থনেয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের আগে পৃথিবীর কোন দেশের সংবিধান জনপ্রতিনিধিরা প্রণয়ন করেননি। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে আরম্ভ হয়েছে এইভাবে ্তুডব ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ঃযব টহরঃবফ ঝঃধঃবং...্থ 'আমরা...জনগণ'-এর অর্থ হচ্ছে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ। যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধানের মতো বাংলাদেশের সংবিধানেও বলা হয়েছে জনগণই হচ্ছে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান কিংবা সংবিধান প্রণয়নের আইনসম্মত অধিকার রয়েছে শুধুমাত্র জনগণের দ্বারা নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের, অন্য কারও নয়।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন স্বাধীনতাকামী জাতির অবিসংবাদী নেতা হিসেবে, নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি হিসেবে। আনত্মর্জাতিক আইন অন্য কাউকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের অনুমোদন করে না। কোন দেশে কেউ যদি তা করে থাকেনও তার কোন আনত্মর্জাতিক বৈধতা নেই। দালাইলামা তিব্বতের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন ১৯৫৯ সালে। যেহেতু তিনি নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি ছিলেন না সেহেতু তাকে এবং স্বাধীনতাকামী তিব্বতীদের আশ্রয়দানকারী ভারতও দালাইলামার স্বাধীনতার ঘোষণাকে স্বীকৃতি দিতে পারেনি।
'৭১-এর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এটি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উলেস্নখ করার ১৩ দিন আগেই বিশ্বের সকল গণমাধ্যমে গুরম্নত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। এই সংবাদের উৎস ছিল ভারতের আগরতলা থেকে শ্রম্নত বেতারবার্তা যা পাঁচটি আনত্মর্জাতিক বার্তা সংস্থা প্রচার করেছে। এই বার্তা সংস্থাগুলো হচ্ছে পিটিআই, এনডিপি, টিএসএ, বিবিসি ও ইউএনআই। পাকিসত্মান, আমেরিকা ও অন্যান্য দেশের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা বলা হয়েছে। এই স্বাধীনতা ঘোষণার জন্যই পাকিসত্মানী সামরিক জানত্মা সামরিক আদালতে তাঁর বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর বিরম্নদ্ধে প্রণীত শ্বেতপত্রে পাকিসত্মানী সামরিক জানত্মা পাকিসত্মানের অখ-তার বিরম্নদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর প্রধান রাজনৈতিক সহযোগীদের দায়ী করেছিল, যারা ছিলেন নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি। ২৭ ও ২৮ মার্চের কোন সংবাদপত্রে, পাকিসত্মানী বা অন্য কোন দেশের সরকারী নথিপত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা জিয়াউর রহমান প্রদান করেছেন এমন তথ্য পাওয়া যাবে না। জিয়া নিজের জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধুকেই স্বাধীনতার ঘোষক বলেছেন, নিজেকে কখনও ঘোষক দাবি করেননি। তবে '৭১-এর ২৭ মার্চ স্বাধীন বাংলা বিপস্নবী বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জিয়া যে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেছেন তা ছিল নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণাদায়ক। তার এই সংক্ষিপ্ত ভাষণ থেকে আমরা জেনেছি পাকিসত্মানী সেনাবাহিনীর বাঙালী সদস্যরাও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।
স্বাধীনতার ৪০তম বার্ষিকীতে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অসৎ বিতর্ক আবারও সামনে আনা হয়েছে। বিএনপির অন্যতম শীর্ষনেতা মওদুদ আহমদ বলেছেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষক এটি যদি সংবিধানে ঢোকানো হয় তাহলে ক্ষমতায় গিয়ে তারা তা বাতিল করে দেবেন। তাদের সঙ্গে সমঝোতা না করে নাকি সংবিধানে এ রকম কিছু ঢোকানো যাবে না।
২০১০ সালে সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বাতিল করে উচ্চতর আদালত যে যুগানত্মকারী রায় দিয়েছে তারপর শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার সংবিধান সংশোধনের জন্য ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটির সদস্য হচ্ছে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী (চেয়ারপার্সন), সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (কো চেয়ারপার্সন), আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, আমীর হোসেন আমু, শেখ সেলিম, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ফজলে রাব্বী, রহমত আলী, শিরীন শারিমন চৌধুরী, হাছান মাহমুদ ও বিএনপির একজন।
'সংবিধান সংশোধন সংক্রানত্ম বিশেষ কমিটি' গঠিত হয়েছে নবম জাতীয় সংসদে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা যার ভেতর বিএনপির একজন সদস্যের স্থানও রয়েছে। বিএনপি এখন পর্যনত্ম এই কমিটিতে তাদের সদস্য কে হবেন তার নাম পাঠায়নি। সংবিধান সংশোধনের জন্য এই কমিটি যা প্রসত্মাব করবে তা জাতীয় সংসদে বিসত্মারিত আলোচনার পরই গৃহীত হবে। কমিটিতে বা সংসদে আলোচনা না করে মওদুদ আহমদ মাঠে ময়দানে বা টেলিভিশনে যেভাবে সংবিধান সংশোধনের কথা বলেন সেটা উপযুক্ত ক্ষেত্র নয়। মাঠে ময়দানে এ বিষয়ে কথা বলব আমরা যারা আমজনতা। আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কথা বলবেন জাতীয় সংসদে।
বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ একজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ। তিনি খুব ভাল করেই জানেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং '৭২-এর সংবিধানের গুরম্নত্ব। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেননিএ কথা নিছক সত্যের অপলাপ বা রাজনৈতিক মতলববাজি নয়। এ কথা বলার অর্থ হচ্ছে'বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র' অস্বীকার করা। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বৈধতা, মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ সরকারের যাবতীয় কার্যক্রমের বৈধতা অস্বীকার করা, বাংলাদেশের সংবিধান অস্বীকার করা। যার সরল অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বৈধতা অস্বীকার করা। যারা বাংলাদেশকে অস্বীকার করে তারা বাংলাদেশের নাগরিক থাকতে পারে কি না এর আইনী ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আমরা মওদুদ আহমদের মতো বিজ্ঞ আইনজীবীর কাছে চাইতে পারি।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে মওদুদ আহমদের সামপ্রতিক দুরভিসন্ধিমূলক বক্তব্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন 'সংবিধান সংশোধন সংক্রানত্ম বিশেষ কমিটি'র কো-চেয়ারপার্সন এ্যাডভোকেট সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি যখনই বললেন প্রসত্মাবিত সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘোষক এটি তারা সংবিধানে ঢোকাবেন, তারপর থেকেই আমরা মওদুদদের এতদসংক্রানত্ম আস্ফালন লক্ষ্য করছি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র যেহেতু সংবিধানের অংশ'বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষক' এটি নতুন করে সংবিধানে ঢোকানোর প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন রয়েছে ইউরোপের মতো আইন প্রণয়নের কেউ যদি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে তা হবে শাসত্মিযোগ্য অপরাধ।
দুই.
বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের স্বগোত্রীয় মৌলবাদী দলগুলো দাবি করে কোরান নাকি তাদের সংবিধান। তারা মানবরচিত সংবিধান, আইন-আদালত মানে না। তাদের এই বক্তব্য থেকেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় ইসলামের তকমাধারী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ধর্ম নিয়ে বৈশ্যবৃত্তির স্বরূপ। যে কোন ধার্মিক মুসলমান বিশ্বাস করেন কোরান আলস্নাহর কালাম, কোরানের একটি হরফও বদলানো যায় না। সংবিধান হচ্ছে মানুষের শাসিত রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শন ও নিয়মকানুন। সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্রের কা-ারিদের সঙ্গে জনগণের চুক্তিবিশেষ যা প্রয়োজন ও নিয়ম অনুযায়ী সংশোধন ও পরিবর্তন করা যায়।
বিশ্বের প্রথম মুসলিম রাষ্ট্র মদিনার সংবিধান রচনা করেছিলেন স্বয়ং মহানবী (সঃ)। তিনি চাইলে কোরানকে মদিনার সংবিধান হিসেবে চালু করতে পারতেন, ইসলামকে মদিনার রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা দিতে পারতেন। মহানবী তেমন কিছু করেননি বরং তাঁর সংবিধানে মদিনার মুসলিম ও অমুসলিম নাগরিকদের সমান অধিকার দেয়া হয়েছে, রাষ্ট্রকে কারও ধর্মের বিষয়ে হসত্মক্ষেপের সুযোগ দেয়া হয়নি এবং অমুসলিমদের নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। যে কারণে ৬২২ সালে মহানবী (সঃ) কতর্ৃক প্রণীত মদিনার সংবিধানকে গণ্য করা হয় বিশ্বের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান।
ধার্মিক মুসলমানরা বিভিন্ন ইমামের বিধান মেনে চলেন। সুনি্ন মুসলমানরা যে চার ইমামকে অনুসরণ করেন তাঁরা হচ্ছেন ১) ইমাম মালিক, ২) ইমাম আল শাফি, ৩) ইমাম আবু হানিফা ও ৪) ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল। অধিকাংশ সুনি্ন মুসলমান ইমাম আবু হানিফার অনুসারী, যাদের বলা হয় হানাফি। মওদুদীবাদী জামায়াতীরা তথা ওহাবীরা নিজেদের হানাফি বলে দাবি করলেও অনুসরণ করে ইমাম হাম্বলের বিধান। চার ইমামের ভেতর সবচেয়ে রক্ষণশীল হচ্ছেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, যিনি জেহাদকে প্রত্যেক মুসলমানদের জন্য ফরজ করেছেন। কোরানের উৎসের ব্যাখ্যা নিয়ে বাগদাদের খলিফা মামুনের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য চরম আকার ধারণ করলে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বলেছিলেন, খলিফা যেন রাজ্য শাসন ও রাজনীতির মধ্যে নিজের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখেন, ধর্মের বিষয়ে যেন নাক না গলান; কারণ ধর্মের ব্যাখ্যা দেয়ার এখতিয়ার ইমামের, খলিফার নয়। ইমাম ইবনে হাম্বলের এই বক্তব্যের সারকথা হচ্ছে রাজনীতি থাকবে রাজনীতির জায়গায়, ধর্ম থাকবে ধর্মের জায়গায়। জামায়াতী ও ওহাবীদের মোনাফেকি হচ্ছে দরকারমতো তারা হানাফি হবে, আবার তাদের দরকার হলে হাম্বলি হবে, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির খিচুড়ি পাকাবে এবং ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ ধর্মভীরম্ন মানুষদের তা গেলাবে।
মওদুদীবাদী, ওহাবীবাদীরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, নিজস্ব রাজনৈতিক মতবাদ প্রচারের জন্য দেশে দেশে ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করেছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছেতাদের কৌশল যখন ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল অনুসরণ করে। ইসলামের ব্যাখ্যা নিয়ে আমিনীদের সঙ্গে নিজামীদের গুরম্নতর মতপার্থক্য রয়েছে। কিন্তু যখনই ক্ষমতার মুলা নাকের ডগায় ঝোলে তখনই তারা আদর্শগত যাবতীয় বিরোধ ভুলে গিয়ে মুলায় দাঁত বসাবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অবিস্মরণীয় বিজয়কে অনেকে বলেছেন 'ভোট বিপস্নব'। এই বিপস্নবের লক্ষ্য বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রকে পাকিসত্মানীকরণ ও ওহাবীকরণ থেকে মুক্ত করে মুক্তিযুদ্ধের মূলধারায় প্রত্যাবর্তন। মহাজোট সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্রম্নতি পূরণের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি '৭২-এর আদি সংবিধানে বর্ণিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাসত্মবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকা-ের পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর বাংলাদেশের সংবিধানকে পাকিসত্মানীকরণ ও ওহাবীকরণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন পাকিসত্মানপ্রেমী মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল জিয়াউর রহমান। সামরিক ফরমান জারি করে তিনি যেভাবে '৭২-এর মূল সংবিধানের বিকৃত করেছিলেন ৩০ বছর পর উচ্চতর আদালতের রায়ে তার এই কাজকে বেআইনি ও শাসত্মিযোগ্য অপরাধ বলা হয়েছে, বাতিল করা হয়েছে জেনারেল জিয়ার কুখ্যাত ৫ম সংশোধনী। হাইকোর্টের এই রায়ের বিরম্নদ্ধে জিয়া-মওদুদীবাদীরা সুপ্রীমকোর্টে আপিল করেছিল, কিন্তু সুপ্রীমকোর্ট সব কিছু বিবেচনা করে হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেছেন।
নির্বাচনী অঙ্গীকারের পাশাপাশি উচ্চতর আদালতের রায় মহাজোট সরকারকে দায়িত্ব দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আদি সংবিধান পুনর্প্রবর্তনের। পাশাপাশি আদি সংবিধানের কিছু ত্রম্নটি সংশোধনের উদ্দেশ্যে সরকার ১৫ জন আইন প্রণেতার সমন্বয়ে 'সংবিধান সংশোধন সংক্রানত্ম বিশেষ কমিটি' গঠন করেছে।
আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি সরকারের নীতিনির্ধারকরা জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ কর্তৃক জারিকৃত ৫ম ও ৮ম সংশোধনীর অনেক ধারা বহাল রেখে মূল সংবিধানে প্রত্যাবর্তনের কথা বলছেন যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং উচ্চতর আদালতের রায়ের পরিপন্থী। (চলবে) ১১/৪/২০১১
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(গতকালের পর)
যদিও আইনমন্ত্রীসহ বিশেষ কমিটির কয়েক সদস্য বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর সরকার কর্তৃক প্রণীত সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রের ৪ মূলনীতি বহাল থাকবে, কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে তারা ইসলাম ধর্মকে এই সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিতে চান।
প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, 'আমরা ধর্মকে কারও হাতিয়ার হতে দিতে চাই না। 'বিসমিলস্নাহ' ও 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' বহাল রেখেই সংবিধানে সব ধর্মের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হবে। একইভাবে বাহাত্তরের সংবিধানে যে চার মূলনীতি ছিল তা বহাল নিশ্চিত করা হবে। একইভাবে বাহাত্তরের সংবিধানে যে চার মূলনীতি ছিল তা বহাল থাকবে। নির্বাচনের মাধ্যমে অর্জিত জনগণের ম্যান্ডেট এবং পঞ্চম সংশোধনী সংক্রান্ত সুপ্রীমকোর্টের রায়এ দুটো মিলেই সংবিধান সংশোধনের প্রসত্মাব আনা হবে। আমরা আর একটা 'মিড নাইট ল' করতে চাই না। সংবিধান সংশোধনের আগে আমরা বিএনপিসহ সবার কথা শুনতে চাই। তাদের জন্য আমাদের দরজা সবসময় খোলা।' (যুগান্তর, ৫ এপ্রিল ২০১১)
'৭২-এর আদি সংবিধান যে গণপরিষদ পাস করেছে এ্যাডভোকেট সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তার সদস্য ছিলেন এবং আমরা তাকে একজন ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী হিসেবে জানি। কিন্তু যুগান্তরে প্রকাশিত তাঁর মনত্মব্য আমাদের সুকুমার রায়ের ছড়ার চরিত্র 'হাসজারম্ন', 'হাতিমি' আর 'বকচ্ছপে'র কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। তাঁর আগে প্রধানমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন সংশোধিত সংবিধানে 'বিসমিলস্নাহ...' থাকবে, ধর্মের নামে রাজনীতি থাকবে এবং 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম'ও থাকবে। এর জবাবে আমরা বহুবার বলেছি সংবিধানের মাধ্যমে একটি বিশেষ ধর্মের বিশ্বাস, রীতি ও বিধান ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া শুধু গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বঙ্গবন্ধুর দর্শনের পরিপন্থী নয়, এটি ইসলাম ধর্মের আদর্শেরও পরিপন্থী। কোন রাষ্ট্রীয় দলিলে 'বিসমিলস্নাহ...' রাখার যে প্রয়োজন নেই এটি ইসলামের ইতিহাস যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই জানেন। এ বিষয়ে আমি বহু জায়গায় লিখেছি_'রাষ্ট্রীয় দলিল বা চুক্তিতে 'বিসমিলস্নাহ...' বা ইসলামের প্রতি পক্ষপাতমূলক কোন বাক্য সংযোজনের যে কোন প্রয়োজন নেই এটা ইসলামের মহানবীর শিক্ষা, এ বিষয়ে মওদুদী-বান্না-বিন ওয়াহাবের নির্দেশ মানার কোন প্রয়োজন নেই। ৬২৮ খ্রীস্টাব্দে মহানবী কতর্ৃক স্বাক্ষরিত হুদাইবিয়ার সন্ধিচুক্তিতে হযরত আলী প্রথমে 'বিসমিলস্নাহির রাহমানুর রাহিম' লিখেছিলেন। কোরেইশদের দলনেতা চুক্তির অপর স্বাক্ষরকারী সোহেল এতে আপত্তি করেছিলেন। তার আপত্তির কারণে মহানবীর নির্দেশে হযরত আলী 'বিসমিলস্নাহ...' কেটে দিয়েছিলেন। এরপর চুক্তিকারী প্রথম পক্ষ হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর নামের সঙ্গে যখন 'আলস্নাহর রাসুল' লেখা হলো তখনও সোহেল আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন মহানবীকে তারা আলস্নাহর রাসুল হিসেবে মানেন না। প্রতিপক্ষের আপত্তির কারণে তাও বাদ দিতে হয়। চুক্তির শুরম্নতে লেখা হয়_আব্দুলস্নাহর পুত্র মোহাম্মদের সঙ্গে আমরম্নর পুত্র সোহেলের এই মর্মে শানত্মিচুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে...।'
বঙ্গবন্ধু এবং তার সহযোগীরা কোন পটভূমিতে কী কারণে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের নীতি হিসেবে গ্রহণ করে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন সে বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকলে এমন কথা তাঁর আদর্শের অনুসারী কেউ বলতে পারেন না_ সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্ম দুই-ই থাকবে।
তিন.
১৯৭২ সালের ৪ নবেম্বর সদ্যস্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ যে সংবিধান প্রণয়ন করেছিল তার ভিত্তি হচ্ছে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। '৭১-এ পাকিসত্মানী দখলদার বাহিনীর বিরম্নদ্ধে বাংলাদেশের সর্বসত্মরের মানুষের যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয় তার প্রধান লক্ষ্য স্বাধীনতা হলেও এই স্বাধীনতার যুদ্ধ নিছক একটি ভূখ- লাভ, জাতীয় সঙ্গীত বা পতাকা বদলের জন্য ছিল না। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পরিচয়, বৈশিষ্ট্য ও লক্ষ্য এই যুদ্ধের মাধ্যমেই স্থির হয়েছিল। যে কারণে '৭১-এর এই যুদ্ধকে নিছক স্বাধীনতার যুদ্ধ না বলে মুক্তিযুদ্ধ বলা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মূর্ত হয়েছে '৭২-এর সংবিধানে। এই সংবিধান গণপরিষদে উত্থাপনের সময় স্বাধীন বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন_'আমরা শাসনতন্ত্র প্রদান করেছি, এর ওপর আইন পাস হবে, যার দ্বারা দেশ পরিচালিত হবে। শাসনতন্ত্রের অর্থ আইন নয়। শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে আইন হয়। আইন যে কোন সময় পরিবর্তন করা যায়। শাসনতন্ত্র একটা জিনিস যার একটা আদর্শ, নীতি থাকে। সেই শাসনতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে আইন পাস করতে হয়। অনেকে ভুল করেছেন, ভুল করে যাচ্ছেন। বলছেন, শাসনতন্ত্র বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। কেউ বুঝবার চেষ্টা করেন নাই বা বুঝবার মত আক্কেল নাই, তাই বুঝতে পারেন না কিংবা বুঝতে চান না। শাসনতন্ত্রের মৌলিক নীতির উপর ভিত্তি করে আইন হয়। সেই মৌলিক নীতির উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ এ্যাসেম্বলিতে আইন পাস হবে। এই মৌলিক নীতির বিরোধী কোন আইন হতে পারবে না। শাসনতন্ত্রে মানুষের মৌলিক অধিকার দেয়া হয়েছে। সমাজতন্ত্রের গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদের গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে কৃষক, শ্রমিক, দুঃখী, মেহনতী মানুষকে যেন কেউ এঙ্পস্নয়েট করতে না পারে। তাদের শোষণ করার জন্য যারা দায়ী সেইসব শোষকদের অধিকার খর্ব করা হবে। শোষকদের ভোটের অধিকার দেয়া হয় নাই বলে সমালোচনা করা হয়েছে। যারা দোষী সাব্যসত্ম হবে তাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবার দাবিও আছে। আমার দেশে ফিরে আসার আগে দেশের লোক তাদের যে মেরে ফেলে নাই সেজন্য তাদের শোকর করা উচিত। আমরা এমন শাসন ব্যবস্থা কায়েম করবো যেখানে প্রকাশ্য আদালতে বিচারের ব্যবস্থা থাকবে। সাধারণভাবে যারা দোষী, যারা দালালি করেছে, যারা আমাদের হাজার হাজার ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়ে মিলিটারির কাছে দিয়ে গুলি করে হত্যা করিয়েছে তাদের আমরা ভাত খাওয়াচ্ছি, অনেককে জেলে ডিভিশন পর্যনত্ম দিয়েছি। আইনের শাসন আমরা মানি। যারা নিরপরাধ তারা নিশ্চয়ই মুক্তি পাবে। যারা দোষী, যারা জনসাধারণের সঙ্গে শত্রম্নতা করেছে তাদের তারা নাগরিক অধিকার দিতে চায় না। তাদের নাগরিক অধিকার পাওয়া উচিতও নয়, কারণ প্রকাশ্যে গাড়ি দিয়ে, ঘোড়া দিয়ে তারা পাক-মিলিটারিকে সাহায্য করেছে। মানুষকে ধরে, আমাদের ছেলেদের ধরে মিলিটারির কাছে দিয়েছে। নানাভাবে তারা দালালি করেছে। স্পীকার সাহেব, এই এ্যাসেম্বলিতে যে চেয়ারে আপনি বসে আছেন তার আশপাশে এবং এই এ্যাসেম্বলির এমন কোন দেওয়াল নাই যেখানে আমাদের ছেলেদের রক্তের দাগ ছিল না। এই আইন সভায় সেসব দাগ আমাদের পরিষ্কার করতে হয়েছে। আইন পরিষদ দেশের শ্রেষ্ঠ স্থান, সেখানে তারা ঘরের মধ্যে নিয়ে এসে কত লোককে ধরে ধরে হত্যা করেছে। আপনি দেওয়ালের সেইসব দাগ দেখেছেন কিনা জানি না। এই পরিষদের যাঁরা কর্মচারী আছেন তাঁরা নিশ্চয়ই দেখেছেন এখানকার ঘরে ঘরে, কামরায় কামরায় দেওয়ালে রক্তের দাগ। অনেকে নিজের রক্ত দিয়ে দেওয়ালের গায়ে 'জয় বাংলা' লিখে গিয়েছে। এই এ্যাসেম্বলির হলের মধ্যে তারা দালালদের সাহায্যে বহু মানুষকে ধরে এনে জুলুম করেছে। নিরপরাধ যারা আছে তাদের খালাস দেয়া হবে। কিন্তু যারা তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করে গণপরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের_ যাঁরা দেশের জন্য যুদ্ধ করছিলেন, তাঁদের আসন খালি করিয়ে আচকান গায়ে দিয়ে উপনির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এহিয়া খানকে সাহায্য করেছেন। তাদেরকে বাংলাদেশের নাগরিক অধিকার দেয়ারও জনগণ আপত্তি করেছে। জনগণ তাদের বাইরে পেলে কেটে ফেলতো, তাদের আমরা জেলের মধ্যে রেখে ভাত খাইয়ে রক্ষা করেছি ...।'** গণপরিষদের ধারা বিবরণী, ৪ নবেম্বর ১৯৭২
বঙ্গবন্ধুর এই সহজ সরল বক্তব্যের রূঢ় বাস্তবতা ও পটভূমি অনুধাবন করলে বাংলাদেশে কেউ যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতির সঙ্গে আপোস কিংবা ধর্মের নামে রাজনীতি বৈধ করার কথা বলবেন না।
চার.
বিশ্বের ইতিহাসে এ পর্যন্ত যত রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণীত হয়েছে তার ভেতর বিভিন্ন কারণে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে তিন মহাদেশের চারটি সংবিধান। এই দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, তুরস্ক ও ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান হচ্ছে প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান, যেখানে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক রাখার কথা বলা হয়েছে। ফ্রান্সের সংবিধানও ধর্মনিরপেক্ষ, তবে এই সংবিধানে ফরাসী বিপস্নবের চেতনায় সকল মানুষের সমান অধিকারের কথা প্রথমবারের মতো বলা হয়েছে। তুরস্ক হচ্ছে প্রথম মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্র, যে দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়েছে। প্রায় ছয়শ' বছর ইসলামের নামে খলিফাদের দ্বারা শাসিত একটি রাষ্ট্রের জন্য এটি ছিল এক যুগানত্মকারী পদক্ষেপ। ১৯২৮ সালের ৯ এপ্রিল কামাল আতাতুর্ক 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' বাতিল করে ধর্মনিরপেক্ষতাকে তুরস্কের অন্যতম নীতি হিসেবে সংবিধানে যুক্ত করেছিলেন। এরপর উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত, যে দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণের পাশাপাশি পশ্চাৎপদ নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের পক্ষে বিশেষ আইন প্রণয়নের অধিকার রাষ্ট্রকে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানপ্রণেতাগণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবিধান পর্যালোচনা করেছেন এবং মডেল হিসেবে বিবেচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, তুরস্ক ও ভারতের সংবিধানকে। সংবিধান হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের দর্পণ, যেখানে প্রতিফলিত হয় রাষ্ট্রপরিচালনার দর্শন। একটি রাষ্ট্র কতটুকু সভ্য ও আধুনিক, মানুষের অধিকার ও মর্যাদার প্রতি কতটুকু দায়বদ্ধ তার পরিচয় পাওয়া যায় সে দেশের সংবিধানে। নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের দায় এবং রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের দায় নিশ্চিত করে সংবিধান। '৭২-এর সংবিধানে বাঙালী ছাড়া অন্যান্য জাতিসত্তাসমূহের অসত্মিত্বের স্বীকৃতি, তাদের অধিকার ও মর্যাদার কথা বলা হয়নি, যা এর প্রধান ত্রম্নটি। এটি ছাড়াও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আরও কিছু ত্রম্নটির কথা বলা যায়, যা সংশোধন প্রয়োজন। তবে রাষ্ট্রের দর্শন সম্পর্কে প্রসত্মাবনায় যা বলা হয়েছে তা নিঃসন্দেহ বাংলাদেশের আদি সংবিধানকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধানের মর্যাদা প্রদান করেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা যদি বঙ্গবন্ধুর প্রধান অবদান হয় তাঁর দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। বঙ্গবন্ধুর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের দিন নয়। (চলবে) ১২/৪/২০১১