ঈশ্বর কটমটাইয়া তাকাইলেন আদমের পানে। আদম দিনকে দিন বেয়াদব হইয়া উঠিতেছে, শুরুর দিকে মিনমিন করিতো, ইদানীং ঘাড় বাঁকাইয়া রগ ফুলাইয়া কথা বলে। লক্ষণ ভালো নয়।
তিনি গম্ভীর গলায় বলিলেন, "দলিল? কীসের দলিল?"
আদম গোঁ গোঁ করিয়া বলিলো, "সম্পর্কের দলিল।"
ঈশ্বর বলিলেন, "কীসের সম্পর্ক? সম্পর্কের আবার দলিল কী? এসি ল্যান্ড এর মতো কী বকিতেছো আবোলতাবোল? সম্পর্ক কি জলমহাল না দখলকৃত অর্পিত সম্পত্তি যে দলিল থাকিবে?"
আদম পায়ের নখ দিয়া দরবারের মাটি খুঁড়িতে লাগিলো। ঈশ্বর ধমকাইয়া বলিলেন, "পরিষ্কার করিয়া বল।"
আদম ফুঁসিয়া উঠিয়া বলিলো, "ঈভ আমাকে ভালোবাসা করিতে দেয় না। তাহার গায়ে হাত দিলে সে আমাকে মারিতে উদ্যত হয়। ঐদিন রাত্রি দ্্বিপ্রহরে আমি একটু উত্তেজিত হইয়া তাহার উপরে আরোহণ করিতে গিয়াছিলাম, সে আমাকে জুডো মারিয়া ছুঁড়িয়া ফেলিয়াছে। ইহার কারণ জিজ্ঞাসিয়াছিলাম, সে আমাকে গালি দিয়া বলিয়াছে, তাহার সাথে তো আমার কোন সম্পর্কের দলিলই নাই, আমি কোন সাহসে তাহাতে উপগত হইতে যাই! আপনি বউ দিয়াছেন, কিন্তু দলিল দান করেন নাই। গাছে তুলিয়া মই কাড়িয়া লহিয়াছেন। এখন আমাকে আমার বামহস্তের উপর ভরসা করিয়া দিন গুজরান করিতে হয়। এই কি ইনসাফ?"
ঈশ্বর চিন্তিত হইয়া পড়িলেন। ঈভ এমন রমণবিমুখ কেন?
আদম থামিলো না, বকিতে লাগিলো, "পঞ্জরের হাড্ডি হইতে উহাকে সৃষ্টি করিয়া আপনি আমাকে লসে ফেলিয়াছেন। এখন আমার একটি অস্থি কম, ঘটনা হইলো এ-ই। লোকে নাকের বদলে নরুণ লাভ করে, আমি তো পুরাই ক্ষতিগ্রস্থ হইলাম। বেয়াড়া একটি রমণী, বলিলাম ঠিক আছে উপগত হইব না, চলো ঊনসত্তর ধারায় প্রেম করি ... সে তাহাতেও রাজি নহে।"
ঈশ্বর থতমত খাইয়া বলিলেন, "ঊনসত্তর ধারা আবার কী?"
আদম সরোষে কহিলো, "সে আপনি বুঝিবেন না, উহা আমাদের এজেন্ডা, আপনার সিলেবাসে নাই। কিন্তু ঈভ কহিয়াছে, নির্দলিল ভালোবাসায় সে বিশ্বাসিনী নহে, টাইপরাইটার সে আমাকে ব্যবহার করিতে দিবে না, সে আমাকে ঘরের বাহিরে গিয়া যা কিছু লেখার হাতে লিখিতে বলিয়াছে ...।"
ঈশ্বর বলিলেন, "টাইপরাইটার, সে আবার কেন?"
আদম মাটিতে পা ঠুকিয়া বলিলো, "আপনি দেখি ভালো ভালো কোন চুটকিই শ্রবণ করেন নাই, দুরো, আপনার সহিত বাক্যালাপ করাই একটা ঝামেলা ... যাহাই হউক, আপনি আমাকে একখানা দলিল দিন। কোন স্বর্গদূতকে কাজী বানাইয়া কবুল পড়াইয়া দিন। নিজের ঘরে গরমাগরম বউ রাখিয়া যদি হাতে কাজ নিতে হয়, এ জীবন আর রাখিয়া লাভ কী? খুদখুশি করিবো।"
ঈশ্বর ভুরু কুঁচকাইয়া বলিলেন, "তুমি নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ না করিয়াই যেইরূপ বখিয়াছো, ঐ ফল ভক্ষণ করিলে তো তুমি স্বর্গ অস্থির করিয়া ফেলিবে। পশুপক্ষী কিছুই নিরাপদে থাকিবে না।"
আদম বলিলো, "হাঁ। কী করিবো, কান্ট্রোল নেহি হোতা।"
ঈশ্বর বলিলেন, "ঐসব দলিল টলিলের ঝামেলা পোহাইতে পারিবো না বাপু। এমনিতেই স্বর্গে কাগজ নাই, ভূর্জপত্রের উপর আমার আস্থা নাই, দ্যাখো না আমার যাবতীয় বাণী এখানে প্রস্তরখন্ডের উপর লিখিত ও রক্ষিত? কাগজ নাই। আর তুমি দিবারাত্রি আড্ডা না মারিয়া যদি বইপুস্তক কিছু পড়িতে, কিভাবে অবাধ্য রমণীকে বশ করিতে হয়, তাহলে তো এই দলিলের তর্কে ফাঁসিতে হইতো না। যাও, লাইব্রেরিতে গিয়া বাৎস্যায়নের কামসূত্রখানি ইসু্য করিয়া লইয়া অধ্যয়ন করো, লেখাপড়া করে যেই বউয়ের ওপর চড়ে সেই, যাও যাও, বিলম্ব করিও না ... শুভস্য শীঘ্রম।"
আদম চটিয়া উঠিয়া কহিলো, "লেখাপড়া করিয়া এখন ঈভকে সামলাইতে হবে? তাহলে আপনি আমাকে একটা দলিল লেখাপড়া করিয়া দিন না কেন? ভারি ভারি পুস্তক রেফারেন্স না দিয়া এক পাতায় একটা দলিল লিখিয়া দিতে সমস্যা কোথায়?"
ঈশ্বর হাসিয়া বলিলেন, "ওহে আদম, আমার গৌরব তাতে সামান্যই বাড়ে, তোমার গৌরব তায় একেবারে ছাড়ে! তুমি সামান্য পঞ্জরসম্ভূতা ঈভকে পটাইতে পারো না, সে দলিল দাবি করিতেই তুমি লৌড়াইয়া চলিয়া আসিয়াছো খোদ ঈশ্বরের কাছে ধর্ণা দিতে, এই নারী তো তোমাকে সাত ঘাটের জল খাওয়াই চৌদ্দ হাটে নিয়া বেচিবে দেখিতেছি। বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা হইলেও একটা কথা থাকিতো, ঈভের বয়স তো তোমার কাছাকাছি।"
আদম এইবার কাঁদিয়া ফেলিলো, "অ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা ... দলিল ... আমার দলিল ... অ্যাঅ্যাঅ্যা ...।"
ঈশ্বর বলিলেন, "আচ্ছা আচ্ছা, চিন্তা করিয়া দেখি ... ক্রন্দন করে না ... দেখিতেছি দলিল নিয়া কী করা যায়, এইবার তুমি আসিতে পারো।"
আদম চোখ মুছিতে মুছিতে চলিয়া যায়। ঈশ্বর চিন্তিত মুখে ভাবিতে বসেন। আদম বেয়াকুবটার জন্য সঙ্গিনী নির্মাণ করিয়া এক গেরোই বাঁধিয়া গিয়াছে। সে-ই এখন আদমকে নাচাইয়া বেড়াইতেছে। দলিলদস্তাবেজ দাবি করিয়া বসিয়াছে। দুইদিন পর দেখা যাইবে ঈশ্বরের কাছে আসিয়া লাইসেন্স দেখিতে চাহিবে।
ঈশ্বর দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া ভাবিলেন, আদমটাও আপাদমস্তক ছাগু, জামাল ভাস্করের মতো সিস্টেম করিয়া লইবার বুদ্ধিটাও নাই।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০