অ
আম্মুর বকুনি খেতে খেতে প্রতিদিন পড়তে বসে বর্ণ আর অক্ষর। আম্মুকে দু'জন ভীষন ভয় পায়। চুপিচুপি তারা আম্মুকে 'দারোগাম্মু' বলে ডাকে। ডেকে আবার নিজেরাই হি হি করে হেসে নেয়। অবশ্য আম্মু সেটা কখনোই শুনতে পান না। তারা চুপে চুপে বলেতো।
বর্ণ আর অক্ষর একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র। আব্বুকে অনেক ভালবাসে দুই ভাই। তারা তাদের আব্বুকে বাবাট' বলে ডাকে। বাবাটও তাদের মত বান্দর। আম্মুর পিছনে দুই ভাইয়ের কাছে আম্মুর বিরুদ্ধে একগাদা নালিশ করেন বাবাট! তখন দুইভাই চুপ করে শুনে থাকে। কূটনীতির আশ্রয় নেয়। তারা জানে আম্মু অনেক রাগী হলেও ভীষন ভালো। তাদেরকে খুবই ভালোবাসেন। আর বাবাটও তাদের কাছে আম্মুকে নিয়ে মিছিমিছি নালিশ করেন।
বাবাট দুই ভাইকে একত্রে ডাকেন বর্ণাক্ষর' বলে। এতে নাকি সময় বাঁচে। বাবাট যা মজার মজার গল্প বলেন! কত জ্ঞানীদের গল্প,মুক্তিযুদ্ধের গল্প,রূপকথা আরো কতশত! তাই ছোট ছোট দুই বান্দর বড় বান্দর বাবাটকে বেশি পছন্দ করে।
আ
আজকেও বকুনি খেতে খেতে বর্ণাক্ষর পড়ার টেবিলে বসলো। বর্ণ ছোট আর অক্ষর বড়। বর্ণ মিটমিটে হেসে চুপিচুপি বললো, ভাইয়া, আজকে সন্ধ্যায় আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। আম্মুর বকুনিটা আজকে বেশি হয়েছে। পেট ভরে গেছে- বলেই দুই ভাই হেসে কুটিকুটি।
আম্মু এসে আরেকদফা বকুনি শুরু করলেন। আম্মুর হাতে বিস্কুট আর বড় দুই গ্লাসভর্তি দুধ। দুই ভাই শান্ত ছেলের মত নাস্তাটা করে নিলো। আম্মু তখনো অনবরত বকেই যাচ্ছেন,বলেই যাচ্ছেন। আর বর্ণাক্ষর তখন টেবিলের নীচে দিয়ে কলমবাজি করে চলেছে।
ই
বাবাট বাসায় আসলেই দু'ভাইয়ের আনন্দের সীমা থাকে না। তারা খুশিতে লাফাতে থাকে । এই খাটের উপরেতো এক লাফে সোফায়, আবার স্পাইডারম্যান সেজে ওয়্যারড্রবের উপরে। তাদের আদিখ্যেতা দেখে আম্মু হিংসায় মরে যান। বাবাটকেও আম্মু তখন বকুনি দেন। বলেন, ছেলে দু'টো তোমার মতই বান্দর হয়েছে। বাবাট তখন বর্ণাক্ষরকে বুকে টেনে আম্মুকে রাগাতে বলেন হুম, তোমার মতন ঝগড়াটে হয়নি তাই কম কিসে? আম্মু তখন বাবাটের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টিতে আগুন ছড়াতে থাকেন। আর পিতা-পুত্রদ্বয় মিলে সে কি হাসি হাসতে থাকে।
ঈ
আগামী কাল প্রভাত ফেরি। দুই ভাইয়ের এই নিয়ে চিন্তার অন্ত নেই। ভীষন চিন্তায় পড়েছে তারা। পড়ার ফাঁকে একজন মুখে কলম কামড়িয়ে আরেকজন মাথায় স্কেল ঠেকিয়ে চিন্তায় মগ্ন। আম্মুর কাছে বিকেলে প্রস্তাব করেছিলো আগামীকাল ভোরে প্রভাত ফেরিতে যাবে। তাদের স্কুল থেকে কত ছেলে-মেয়ে যাবে! কিন্তু আম্মু এক ধমকে তাদেরকে থামিয়ে দিলেন। এত ভোরে কোথায় হারিয়ে যাবে আবার! শহীদ মিনার এখান থেকে অনেক দুরে।
যদিও বর্ণাক্ষরদের স্কুলে ছোট্ট করে একটা শহীদ মিনার আছে। কিন্তু এবার দুই ভাই গোপন সিদ্ধান্ত নিয়েছে শহরের সবচে' বড় যে শহীদ মিনারটা,সেখানে তারা ফুল দিতে যাবে। প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারীতে কত মানুষ খালি পায়ে সেখানে প্রভাত ফেরিতে যায় ! এবার তারাও যাবে । কিন্তু আম্মুর ধমক খেয়ে ফুটো বেলুনের মতই চুপসে গেল দামাল দু'ভাই। দু'জন দু'জনের দিকে তাকিয়ে ভেংচি দিলো। এই ভেংচিটা তারা নিজেদেরকে দেয়নি। দিয়েছে আম্মুকে। এভাবেই তারা আম্মুকে ভিংচি দেয়। আম্মুর উপর ভীষন রাগ হলো।
অক্ষর তখন সাহস করে বলেই বসলো 'আম্মু, নানুভাই পুলিশ ছিলেন। তাই কি তুমি এমন!
বলতেই আম্মু এমন এক রাম ধমক দিলেন, দুই ভাই এক দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে পালালো। বাথরুম হলো তাদের গোপন আস্তানা। চকচকে বাথরুমে তারা নাক চেপে ধরে গোপন সভা করে। কেউ সেটা জানে না। নাক চেপে ধরে রাখার কারণে তাদের কথাগুলো সব চন্দ্রবিন্দু দিয়ে হয়। 'আঁজঁকেঁর বৈঁঠঁকেঁ উঁপঁস্থিঁত প্রিঁয়ঁ সুঁধীঁ.....'
উ
সন্ধ্যায় বাবাট বাসায় আসতেই দু'ভাই ঝপাত করে কাঁধে চেপে বসলো। বাবাট তাদের জন্য চকলেট এনেছেন। কিন্তু বর্ণাক্ষর চকলেট ছুঁয়েও দেখলো না। কাঁধ থেকে নেমে বড় মানুষদের মত মুখ ব্যাজার করে নিজেদের অভিব্যক্তিতে অভিমান বুঝিয়ে দিলো। বাবাট তখন বললেন,হেই বর্ণাক্ষর, কী হয়েছে বাবাট! আম্মু বকেছে?
আম্মু তখন কাপড় চোপড় ভাঁজ করছিলেন। দু'ভাইয়ের দিকে শীতল চোখে তাকাতেই তারা চুপসে গেল। বর্ণ সাহস করে তবু বাবাটের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,'পরে বলবো, আম্মু চলে গেলে বলবো'!
আম্মু চলে যেতেই দুই ভাই কান্না শুরু করলো। বাবাট তাদের মাথা ছুঁয়ে দিয়ে বললেন
'বলো বলো রাজার ছেলে
কেন তোমরা কাঁদতে গেলে'!
কোন কারণে বর্ণাক্ষর কাঁদলে বাবাট এই ছড়া কেটে তাদের কাছে জানতে চান। অক্ষর বললো, 'বাবাট, জানোতো আগামীকাল কয় তারিখ? আগামীকাল প্রভাত ফেরি। আমরা প্রভাত ফেরিতে যাবো। কিন্তু আম্মু কিছুতেই যেতে দিবে না'। বলেই আবার কাঁদতে লাগলো । সাথে তাল মিলিয়ে বর্ণও কাঁদতে লাগলো। বাবাট তাদের চোখ মুছে দিয়ে বললেন,'আরে ব্যাটা এটা কোন বিষয় হলো! জানিস, আমি কতবার চুরি করে তোদের দাদুজী'র বকুনি খেয়েও প্রভাত ফেরিতে গেছি। এটা কোন সমস্যাই না। দেশে এরচে' আরো বড় বড় সমস্যা আছে। সেগুলো নিয়ে ভাবো। আগেতো সকাল হোক'!
বর্ণাক্ষর হাত তালি দিয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করলো। হিপহিপ হুররে বললো দু'বার করে চারবার! আম্মু দৌড়ে এলেন। বললেন, কী হয়েছে? বাবাট চেপে গেলেন। বললেন...হে হে এমনিই আমরা চিৎকার করেছি তাই না বাবুরা?
বাবুরা মাথা নেড়ে সায় দিলো।
আম্মু আবার কাজে চলে গেলেন। এবার বর্ণ বললো, কিন্তু বাবাট, একটা বিরাট সমস্যাতো থেকেই যায়। আমরা এত সকালে ফুল পাবো কোথায়? ফুলতো কেনা হয়নি। শহীদ মিনারে ফুল দিতে না পারলেতো প্রভাত ফেরিই মাটি হবে।
বাবাট বললেন, হুম চিন্তার বিষয় বটে।
অক্ষর বললো, বাবাট আমার আবার কান্না পাচ্ছে। ফুল ছাড়া প্রভাত ফেরি কেমন হবে বলো!
বাবাট আস্তে করে চিৎকার দিয়ে 'হুররে' বলে উঠলেন। পেয়েছি ফুল পেয়েছি।
বর্ণাক্ষর কৌতুহলী চোখে বাবাটের দিকে তাকিয়ে রইলো। বাবাট দুষ্টু হেসে বললেন, চলো খেতে বসি। তোমাদের ফুলের জন্য চিন্তার দরকার নেই। আগে সকাল হোক।
বাবাটের উপর বর্ণাক্ষরের অনেক আস্থা আছে। তাই তারা আর কথা বাড়ালো না। গোপনে আম্মুকে না জানিয়ে প্রভাত ফেরির জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলো।
ঊ
খুব ভোরবেলা কে যেন বর্ণাক্ষরের কানের কাছে ফিসফিস করতে লাগলো। বর্ণ ধ্যাত' বলে কার বড় একটা হাত মাথার উপর থেকে সরিয়ে দিলো। তারপর সে জেগে গেল। তার মনে হয়ে গেল বাবাট তাদেরকে প্রভাত ফেরিতে যাবার জন্য ডাকছেন। তাড়াতাড়ি বর্ণাক্ষর জেগে উঠলো। ঘুমচোখে চুপিচুপি বিড়ালের মত নিঃশব্দে তারা ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আম্মু টেরও পেলেন না। বাসা থেকে বের হয়ে বাবাট তাদেরকে নিয়ে চললেন পাশের একটা সরকারী স্টাফ কোয়ার্টারের দিকে। তখনো আঁধার কেটে যায়নি। সব নীরব। রাস্তায় তেমন লোকজনের চলাচল নেই। চুপি চুপি তিন চোর গেল হাড় কিপটে আর বদরাগী দারোয়ান হরিপদের বাগানের ফুল চুরি করতে। অক্ষরের আনন্দ আর ধরে না। সাথে বর্ণটা আগে আগে ফড়িংয়ের মত লাফিয়ে চলছে। বাবাট কী বান্দর- মনে মনে দু'ভাই ভাবে। চুপচাপ তারা অনেকগুলো ফুল নিয়ে নিরাপদে বের হয়ে এলো। সকালের তাজা ফুলগুলো দেখে বর্ণাক্ষরের এত ভালো লাগলো যে আনন্দে তাদের চোখে পানি চলে এলো। তাদের বাবাটটা এত ভালো!
কিন্তু ফুল চুরি করেছে বলে তাদের একটু খারাপ লাগলো। তখন বাবাট বললেন, আরে প্রভাত ফেরির জন্য আমরা ছোটকালে কত্ত ফুল চুরি করেছি! তাছাড়া হাড় কিপটের বাগান থেকে ফুল চুরি করলে কিচ্ছু হবেনা-বলে বাবাট হাসতে লাগলেন। বর্ণাক্ষর আবার খুশিতে ঝলমল হয়ে উঠলো। তারাতো আর জানেনা যে বাবাট রাতেই ফোন করে ফুল চুরির অনুমতি নিয়ে রেখেছেন!
ঋ
...........
...........
তারপর কুয়াশায় ঢাকা পিচঢালা পথে হাতে তাজা ফুল নিয়ে খালি পায়ে তিনজন মানুষ প্রভাত ফেরির দলে ভিড়ে গেল। দুরে অনেক দুরে তাদের ছায়া দেখা গেল।
উৎসর্গঃ ঘাসফুল জুনিয়র হাসান এবং হোসাইনকে ।
(অনেক দুঃখ নিয়ে ছোটদের এই গল্পটা পোস্ট করলাম। অনেকদিন আগে 'ছোটদের সামহোয়্যারইন.এ সদস্যপদের আবেদন করেছিলাম। আজ পর্যন্ত সদস্যপদ প্রক্রিয়াধীনই রয়ে গেল। আপসুস, কবে যে সদস্য হতে পারবো আর পিচ্চিদের জন্য লিখতে পারবো!)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১০ সকাল ১১:৪৯