somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এপিটাফের পরে

০২ রা নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভদ্রলোক পাকিস্তান আমলে কাজ করতেন পাকিস্তান ডিফেন্সের সিভিলিয়ান কর্মচারী হিসেবে । কাঁচা গৌর বর্ণ , টিকালো নাক, লম্বায়
ছ'ফুটের কাছাকাছি ছিলেন।নিম্নপদে কাজ করবেন না বলে , কাজের ফাঁকেফাঁকে পড়া শুনা করছিলেন। বিয়ের ব্যাপারে ও উনার চিন্তা ভাবনা ছিলোনা-বাচক । অন্তত ভালো চাকুরির আগে বিয়ে না । পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি এক শরতের ,শুভ্র সকালে টেলিগ্রাম এলো , Mother Serious , Come Sharp ' উনি মাকে খুব ভালো বাসতেন ।সে দিন ই রওনা দিলেন। বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে অবাক হয়ে গেলেন ।বিয়ে বাড়ীর সজ্জিত গেট ।
তার বিয়ে আজকে । মায়ের দূর সম্পর্কের আত্মীয়া হচ্ছেন বিয়ের পাত্রী । মা বললেন কোনো কথা শুনতে চাইনা ,
এ বিয়ে না হলে উনি আত্মঘাতী হবেন । কি আর করা ! পাঁচ ভাইয়ের দ্বিতীয় এই ভাই বাসর রাতেই প্রথম স্ত্রীকে এক ঝলক দেখলেন । দেখেই বের হয়ে চন্দ্রালোকিত সেই বাসর রাতের বাকী অংশ উনি পুকুর ঘাটে কাটালেন । এটা হয়তো এমন এক চাঁদের আলোয় আলোকিত রাত ছিলো , যে রাতে জীবনানন্দ দাশও আত্মঘাতী হতে চেয়েছিলেন ।
স্ত্রীকে উনার পছন্দ হয়নি । এখন শিক্ষিত সমাজে হয়তোবা কালো ধলোর খুব একটা পার্থক্য করা হয় না, তবে সেকালে এটা খুব হতো ।
ভদ্রলোকের মা সকালে মেয়ে দেখে নিজে ও খুব অবাক হয়ে গেলেন, কারণ তাকে যে মেয়ে দেখানো হয়েছিলো , সে মেয়ে তার ছ ফুট লম্বা , ফর্সা ছেলের সাথে
খুব মানিয়ে যেতো ,যাকে দেখানো হয়েছিলো , তাকে দেয়া হয়নি ।
কিন্ত যে এসেছেন তাকে তো মেনে নিতেই হবে , বিশেষত এ কালো মেয়ের বাবা খুব প্রভাবশালী ছিলেন।
ভদ্রলোকের জীবনের গতিপথ হয়তো সেখান থেকে পরিবর্তন হয়ে গেলো । ভদ্রলোক উনার এই কালো বর্ণের , লম্বায় বেশ খাটো ভদ্রমহিলার সাথে বছর চল্লিশেক
সংসারও করলেন , কিন্ত তাকে মেনে নিতে পারেন নি । ভদ্রলোকের ইন্সপারেশন , জীবনের লক্ষ্য সব হয়তো এই না মেনে নেওয়ার মাঝে বিলীন হয়ে গেলো।
ভদ্রমহিলা ৪০ বছরের সংসার জীবনের শেষের কুড়ি বছর খুব অসুস্থ অবস্থায় কাটিয়ে দিয়েছিলেন।ভদ্রলোকের জমানো টাকা পয়সা এ সময়ে ফুরিয়ে যায় ।
এ সময় বছরে দু -এক বার ভদ্রলোকের সাথে আমার দেখা হতো , আমি তখন কৈশোর পাড়ি দিচ্ছি ।
যে পুকুর পাড়ে উনি বাসর রাতে বসে ছিলেন , সে পুকুর পাড়ে উনি চোখের মোটা চশমার ফ্রেম খুলে মুছতে মুছতে আমাকে বলতেন ,লক্ষিন্দরের লোহার ঘরে
সাপ ঢুকে গেছে , তাকে কে বাঁচাবে ?
উনার স্ত্রী ও বাচেননি , উনি এক সময় মারা গেলেন । দাফনের সময় আমি ছিলাম, ভদ্রলোককে খুব কাঁদতে দেখেছিলাম।
ভালো হতো বাসতে পারেন নি , কিন্ত এতোদিনের অভ্যাসের জন্য ও তো মায়া পড়ে যায় ।
পরের দু বছর উনাকে খুব সুখী দেখেছিলাম, ছেলেদের বিয়ে হয়ে গেছে , ঢাকায় ঘন ঘন আসতেন , আম্মার সাথে খুব গল্প করতেন , উনি আম্মার খুব আপন মুরুব্বী ছিলেন ।
এ সুখ উনার ভাগ্যে সইলো না , উনার বড় ছেলে বলে দিলেন, সংসারে সমস্যা হচ্ছে , ছোট ভাইকে মানুষ করতে হবে , সেটার জন্য বাবাকে আবার বিয়ের পিড়িতে বসতে হবে। উনি রাজী ছিলেন না । এটা নিয়ে বিস্তর দৌড় ঝাপ হলো ঢাকা আর গ্রামে - আমার মা তার কুড়ি পচিশ জন কাজিন মিলে সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলেন ভদ্রলোককে আবার বিয়ে করতে হবে ।
বিষয় টা এমন পর্যায়ে গড়িয়ে গেলো উনি রাজী হতে বাধ্য হলেন, পাত্রী উনার বড় ছেলে পছন্দ করলেন , আর কেউ সেই পাত্রী দেখলো না ।
এই পাত্রীও উনি বাসর রাত্রে প্রথম দেখলেন , তবে পুকুর পাড়ে আর রাত কাটাতে পারলেন না , বাড়ী ভর্তি লোকজন ছিলো , বাসর রাতে সেই পুকুর পাড়ে
আমার মা খালাদের খুব আনন্দ ফূর্তি হচ্ছিলো ।
ভদ্রলোকের দ্বিতীয় স্ত্রী প্রথম স্ত্রী হতে আরো কৃষ্ণবর্ণ এবং এক চোখে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছিলেন । পরে শুনা গেছে উনার বড় ছেলে এই বিয়ের বাবত, পাত্রী পক্ষ হতে ছ গন্ডা জমি বুঝে পেয়ে ছিলেন।
বন্ধ্যা এই মহিলা অনেক ভালো ছিলেন, আমি বাড়ীতে গেলে আমাদের খুব যত্ম আত্তী করতেন , ভদ্রলোককে কিন্ত ঘরে পেতাম না , উনি হয় পুকুরের পাড়ে
কিংবা উনার বাবার কবর স্থানের পাশে পাটি বিছিয়ে তাল পাতার বাতাস খেতেন ।
উনার এই দ্বিতীয় স্ত্রীও খুব বেশী দিন বাচেননি , বিয়ের ১২/১৩ বছরের মধ্যেই মারা যান ।
ভদ্রলোক মারা যান তার ও ৬ বছর পর ।
তবে এই ছয় বছর উনি দৃষ্টি হীনতা আর বার্ধক্যজনিত সমস্যার জন্য খুব কষ্ট পেয়েছিলেন । দু বছর আগে আমি , নানা বাড়ীতে যাই , আমার ছেলের সাথে উনার অনেক ছবি তুলি । সে ছবি প্রিন্ট করে উনাকে পাঠাইনি , কারণ উনি শেষের দিকে দেখতে পেতেন না ।
বাড়ী থেকে চলে আসার রাত টি ছিলো মন পোড়া জোছনার রাত । সে রাতে আমার আর আমার ছেলের মুখে হাত দিয়ে কি জানি বুঝার চেষ্টা করেছিলেন,
এশার নামাজ শেষে পুকুরের পাড়ে উনি বসে ছিলেন।আমি কাছে গিয়ে বসতেই , বিড়বিড় করে আপন মনে বলছিলেন
'I dreamt my lady came and found me dead '
এ বছর উনি মারা যাবার পর , আমি আর নানা বাড়ী যাইনি , ইন ফাক্ট খবর ও পেয়েছিলাম কদিন পরে , গ্রামের কবরে এপিটাফ দেওয়া যায় না ,দেয়া গেলে আমি হয়তো জুলিয়েটের প্রতি রোমিও র এই অমর বাণী খোদাই করে, একটি মার্বেল পাথর তার অন্তিম শিয়রে রেখে দিতাম ।
পছন্দের মানুষগুলো কোথায় যে হুট করে চলে যায় , চাইলেও একটু দুটি ছোট পার্শেল তাদের পাঠানো যায় না , পাঠানো গেলে আমি ভদ্রলোককে আমার জীবনের অল্প প্রাপ্ত সুখগুলো থেকে , অল্প কিছু সুখ পাঠিয়ে দিতে চাইতাম।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:৪৪
১০টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এই শহর আমার নয়

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৬ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৫:০২




এই শহর আমার নয়
ধুলিমলিন, পোড়া ধোঁয়ায় ঘেরা
ধূসর এক স্বপ্নহীন চেহারা।
এই শহর, আমার নয়।

ঘোলাটে চোখে জমে হাহাকার,
চেনা মুখেও অচেনার ছাপ।
পথে পথে স্বপ্নরা পোড়ে,
আলোর ছায়ায় খেলে আঁধার।

এই শহর... ...বাকিটুকু পড়ুন

টিউবওয়েলটির গল্প

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৬ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:০৪



এটা একটি টিউবওয়েল।

২০০৯ সালে, যখন আমি নানী বাড়ি থেকে লেখাপড়া করতাম, তখন প্রতিদিন এই টিউবওয়েল দিয়েই গোসল করতাম। স্কুল শেষে ক্লান্ত, ঘামাক্ত শরীর নিয়ে যখন ঠান্ডা পানির ঝাপটায় নিজেকে স্নান... ...বাকিটুকু পড়ুন

গাজায় গণহত্যা : মুসলিম বিশ্বের নীরব থাকার নেপথ্যে !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৬ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:৫৮


গাজার প্রতিটি বিস্ফোরণে কেবল ধ্বংস হয় না —প্রতিধ্বনিত হয় একটি প্রশ্ন: মুসলিম বিশ্ব কোথায় ? মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির আয়নায় এই প্রশ্নটি এক খণ্ড অন্ধকার, যা শুধু আন্তর্জাতিক রাজনীতির ব্যর্থতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

লেখকের প্রাপ্তি ও সন্তুষ্টি

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১২:০০

একজন লেখক যখন কোন কিছু লিখেন, তিনি কিছু বলতে চান বলেই লিখেন। বলাটা সব সময় সহজ হয় না, আবার একই কথা জনে জনে বলাও যায় না। তাই লেখক কাগজ কলমের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ওয়াকফ: আল্লাহর আমানত নাকি রাজনীতির হাতিয়ার?

লিখেছেন শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু, ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৯:৫৯


"একদিকে আমানতের আলো, অন্যদিকে লোভের অন্ধকার—ওয়াকফ কি এখনও পবিত্র আছে?"

আমি ইকবাল হোসেন। ভোপালে বাস করি। আমার বয়স প্রায় পঁইত্রিশ। জন্ম থেকে এখানেই বড় হয়েছি, এখানেই আমাদের চার পুরুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×