৬.
ভাষা মাধ্যাকর্ষণ যেন।
যেন অদৃশ্য সুতো বেঁধে রাখে সব নগর দালান বৃক্ষশোভাগ্রাম মহাসড়ক সমুদ্র পাহাড় মানুষ। যেন পৃথিবী কেন্দ্রের আকর্ষণ ছিঁড়ে কোনো কিছুই ভেসে যেতে পারে না মহাশূন্যে, চিরশূন্যতায়। কেন্দ্রবিমুখী বল বস্তুর নিজস্ব ধর্ম, বস্তু যখন ঘোরে স্বয়ং ইহা উদ্ভূত হয়, যদিও নিশ্চল বস্তুতে কোনো যন্ত্র লাগিয়েই এর হদিস পাওয়া যায় না, এর আছে বিমূর্ত গাণিতিক মাপ। সেইরূপ ভাষা যখন বলা হয় তখন শ্রোতার দিকে সে যাত্রা করে বক্তাকে বোঝানোর দায় নিয়ে। একটা অদৃশ্য সজীব অর্গানিক সচল টানটান সেতু তৈরির আশায় সে যাত্রা করে শ্রোতার দিকে বাতাসের সমুদ্র সাঁতরে। মনের ভেতর ভাষা হলো নিশ্চল বস্তুর মতো, পালসহীন। মুখ থেকে নিঃসৃত হবার পরই, ব্যক্তির দিকে ছোড়া ভাষাবল্লমের নিচে জন্ম হয় সবুজ জীবন্ত অদৃশ্য কথার বীজ। তরঙ্গায়িত ওয়েভের আঘাতে হলুদাভ মগজের ওপর জন্ম নিচ্ছে চিন্তার পুষ্পক গাছ। ভাষা সে এক মহাকর্ষ, চিন্তা আর সংযোগের এপার-ওপার ধরে রাখে।
এই যে আজ এসে গেল আমাদের বাদলদিন, মনখারাপের দিন, বৃষ্টিভেজার আশায় বারান্দায় কাটানো হাঁস-ফাঁস দিন; বৃষ্টি, বুলেট, প্যারেডের কুচকাওয়াজ, মেঘের কামান গর্জে ওঠে, স্যাটেলাইট মাঠে ইথারশূন্যতায় ওজনহীন ফেরেশতাদের লাশ কল্পকাহিনির মতো অদৃশ্য, তবু বাস্তব; এই শহরের মেয়র আজ যেন রবীন্দ্রনাথ, ভেসে যায় ড্রেন, ঝরনার স্রোত স্রোত বেগে, মুগ্ধ গুনগুন, দৃষ্টিনন্দন কন্ডম, ব্রা, পেন্টি, লিপস্টিক রেড বা পিংক বা স্ট্রবেরি ভায়োলেন্স, প্যাড, রাংতা, মুখোশ, নারীজাতীয় সব আজ ভেসে ওঠে পুরুষপাঠকের জন্য আপনা-আপনি এই বর্ষায় অতিরিক্ত, যেন শিলাবৃষ্টি সবুজ মাঠে, ছড়ায়ে আছে সাদা কফ, যেন মদের সবুজ গ্লাসে ড্রাইজিনে ভেসে আছে সময়-জমা আইস, এমনও ঘোর বর্ষায়, আর আমাদের অভাব-আক্রান্ত দুই রুমের শীতাতপহীন নামকাওয়াস্তে ফ্ল্যাটের বাইরে মহল্লার লোকেরা যারা ভেজে না, ভেজা-শৌখিনতাহীনদেরও আজ বিষণ্ণ হতে চায় মন, তারাও আজ ব্যাকুল। আর সরকারি হাসপাতালের ব্যান্ডেজ পায়ে ক্ষুধাহীন মানুষের মতো দেখতে শরীর, পথকুকুরের মতো দেখতে শরীর, জানোয়ারের মতো দেখতে শরীরে জ্বর; তার তাড়না, গুপ্ত-এষণা, মেয়ে শরীরহীন জীবনের ’পরে ঝরে পড়ছে যেন সভ্যতার ফায়ার অ্যান্ড আইস রেইন, সে জানে না কাটা-পায়ের ইনফেকশন, অ্যান্টিবায়োটিক, বৃষ্টিনন্দন। শিলাবৃষ্টিতে তুমি আর আপনি দাঁড়ায়ে আছো মিরপুর। হোয়াইট ওয়াইন বৃষ্টি আজ, সুস্বাদু, দেহপাত্রে শিলাবৃষ্টিকুচিতে জমা হোয়াইট ওয়াইন কোথায় রেখেছ জানু, নেশা নেশা লাগে। লুক বয়, আই অ্যাম অলওয়েজ ওয়েট অ্যান্ড আ ওয়াইন হাউস, কান্ট ইউ স্মেল দ্য রোটেন ভাইন ইনসাইড মি বেব? অনন্ত পাত্রে ধরা আছে একটিমাত্র আঙুর, রোটেন ভাইন। কাঁচা ঝিনুকের উল্টানো পাত্রে মুখ রাখো, পাঁড়মাতাল হয়ে আজ বৃষ্টিতে অদৃশ্য ঘরে ফেরার পথ। এই ঘন বর্ষার পর্দায় জ্বলছে লেজার শো, দেখা যায় জলভেজা নরম শরীর। বৃষ্টিবুলেট, প্যারেড, কুচকাওয়াজ, মেঘের কামানগর্জন, বিদ্যুৎ, লেজার, রবীন্দ্রভাবাপন্ন মেয়রের নগরে মানুষের মতো দেখতে শরীর, পথকুকুরের মতো দেখতে শরীর, জানোয়ারের মতো দেখতে শরীর; ভিজে যাইছে প্রাণ আমার।
বৃষ্টির প্ররোচিত ভাষায় জেগেছে আজ গান, জেগেছে দেহ। যে ভাষা মরে যায় তা আর কোনো দিন জাগ্রত হয় না। জীবন্ত সচল ভাষা এপিকের দৈত্যে, যেন প্রটোজোয়া, তার সিকিউরিটি সিস্টেম স্বয়ম্ভু, সে বাফার, সর্বগ্রহণে সক্ষম, কাছিম-দীর্ঘ আয়ু তার। তাকে হত্যা করা যায় না। জীবনে ভাষায় চাই সহজতা। মানুষ ভ্রমণে সেই সমস্ত স্থানেই যায় যা কষ্টসাধ্য নয় অথচ আরামদায়ক, বর্ণনা করা যায় ব্যাপক ও ব্যাপ্ত ফেরার পর।
কাছিমের গ্রাম
প্রকাশক: চৈতন্য, একুশে বইমেলা ২০১৬
স্টল: ১৫৬
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৫:০০