আমি শুধু পেশায় যাযাবর নই ব্লগে লিখিয়ে হিসেবেও যাযাবর। শেষপোষ্ট দিয়েছি অনেক আগে। জাহাজে থাকতে ঠিকমতো ব্লগে ভিজিট করা সম্ভব হতো না। সময় পেলে অনুসারিত ব্লগে ঢুকে একটু দেখে নিতাম কে কি লিখছে। নির্বাচিত পাতায় দেখতাম ব্লগারদের মিথস্ক্রীয়া অনেক বেড়েছে ইদানিং। একঝাঁক নতুন ব্লগার ব্লগ মাতাচ্ছে। এবং পুরাতন অনেকে নিয়মিত হয়েছে। আমি যদি সময়ও পাই তবু তাদের সাথে মাততে পারিনা। ব্লগে তিন বছর পার করলেও এমন কোন ভূমিকা রাখিনি যে কেউ আমাকে নামে চিনবে। তাই সল্প সময়ে কারো সাথে ভাল বোঝাপড়া হয় না। তাই মাঝে মাঝে উকিঝুকি মেরে নতুন পুরাতনদের মাতামাতি দেখি। দেখি গত বছেরের তুলনায় এখন ব্লগবাড়িটি বেশ রমরমে। বিশেষ করে সামুর নতুন ভার্সনটি চালু হবার পরে ব্লগ ব্যবহার অনেক সহজ হওয়াতে এখন আর ব্লগে সময় কাটাতে কারো বিরক্তি লাগেনা বুঝি। তবে আমি ব্লগে বেশী সময় দিতে পারি না। নতুন নতুন দেশে দু এক দিনের জন্য নেটওয়ার্ক পেলে নেট কানেকশন নিয়ে পিসির সামনে বসে ব্লগিং করার মতো সুযোগ হয়ে ওঠে না। যা একটু সুযোগ পাই মোবাইলে প্যাকেজ নিয়ে ফ্যামিলির সাথে যোগাযোগ রাখতেই চলে যেত। বুঝতেই পারছেন ফ্যামিলি থেকে দুরে থাকলে হোমসিকনেসটা বাড়ে। বিশেষ করে আমাদের মতো নেটওয়ার্ক বিহীন অবস্থায় থাকলে।
হয়তো অনেকের মনে হতে পারে তাহলে আমার জাহাজে থাকা সময় গুলো কিভাবে কাটে? হ্যা যেখানে ইন্টারনেট নেই পরিবার নেই সেখানে একজন মানুষের সময় কিভাবে কাটে সেটা অবশ্যই প্রশ্ন হতে পারে। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর দেয়াটা কঠিন। আমার মতো অনেক জাহাজী ব্লগার, লেখিয়ে আছে যারা প্রচুর জাহাজী জীবনের গল্প লিখেছেন। কিন্তু আমার কাছে সেগুলোর কোনটিই বস্তুত জাহাজী জীবনের গল্প নয়। আমরা যখন বিভিন্ন পোর্টে যাই ঘুরি ফিরি এবং সেগুলোর ছবি তুলে আপ্লোড দিই সেটা হয় জাহাজীর ঘোরাঘুরির গল্প। কিন্তু জাহাজে একজন জাহাজীর জীবনের গল্প কেউ লিখিনা। জাহাজে রুটিন করা খাওয়া আর ডিউটি করা ছাড়াও অনেক কিছু হয়, সেগুলো নিয়ে তেমন কিছু লেখা হয়নি কারো। তাই জাহাজের জাহাজী জীবনের গল্পটা সাধারণের কাছে অজানাই থেকে গেছে।
দেখি তেমন গুছিয়ে কিছু লিখতে পারি তবে সবার সামনে নিয়ে আসবো। তবে এটুকু বলি যে আর যাই হোক নিভৃতে লেখালেখিটা আমার হয় না। যদিও একসময় মনে হতো জাহাজের নিভৃত জীবনটা আমার লেখালেখির ইচ্ছেটা জিইয়ে রাখবে। কিন্তু সেটা করেনি। বরং ডিউটি শেষ করে যখন রুমে আসি তখনও অবচেতন মন চিন্তা করতে থাকে আমার নির্দেশিত রুট ধরে জাহাজটি নিরাপদে চলছেতো?
এ বিষয়ে ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই। আমি যে র্যাঙ্কে জব করি আমার দায়িত্ব জাহাজের রুট প্লান করা এবং সেই রুটকে জিপিএসএ ইনপুট করে নির্দিষ্ট পথে জাহাজ চালনা করাতে ওয়াচ অফিসার কে সহায়তা করা। এখন আমি নিজে ওয়াচ অফিসার থাকি আট ঘন্টা। এই আট ঘন্টায় আমার বানানো রুটের প্রতিফলন আমি নিজে দেখে দেখে জাহাজ চালাচ্ছি। এখানে যদি আমার কোন ভূলও হয়ে থাকে রুট তৈরি করার সময় তবে আমি সুধরে নিতে পারছি। কিন্তু বাকি ষোল ঘন্টা? কিছুদিন আগে আমার কোম্পানির এক্টা জাহাজে এমন এক্টা ভুল রিপ্লেশন হয় রাডারে এবং একজন অফিসার তার ওয়াচে নিজের দায়িত্বে অবহেলা করে অন্ধের মতো সেই ভুল রিফ্লেশন দেখে জাহাজ চালিয়ে জাহাজকে এক্টা ডুবো পাহাড়ে উঠিয়ে দেয়। এই ঘটনায় ও সময় দায়িত্বে থাকা অফিসার সহ আমার র্যাঙ্কের ঐ অফিসারটিরও চাকরি যায় । এই কারনেই আমি যখন অফ ডিউটিতে থাকি তখনও আমার টেনশন চলতেই থাকে। এটা তো গেল এক্টা দিক। এমন আরো অনেক আছে। যার কারনে জাহাজে বস্তুত নিভৃত সময় আমার পাওয়া হয়ে ওঠে না।
যদিও আজকে জাহাজী জীবনের ইতিকথা লেখা আমার লেখার বিষয়বস্তু না। এই লেখাটির উদ্দেশ্য ওয়েলকাম ব্যাক রাইটিং। গত তিন বছরে ব্লগে কোন নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে লিখে স্থির হতে পারিনি। শুরুটা করেছিলাম কবিতা লিখে। মাঝে কিছু গল্প লিখেছি। এবং লিখেছি জাহাজী জীবনের গল্প। মাঝে মাঝে রাজনীতি ও সামাজিক বিষয়াদি নিয়ে লিখেছি। কিন্তু এবার অনেকদিন পরে আবার কি নিয়ে লেখা শুরু করবো এটা নিয়ে বেশ খানিকটা চিন্তায় থাকতে থাকতে জাহাজ থেকে নেমে প্রায় একমাস কাটিয়ে দিলাম ভরপুর নেটওয়ার্কে থেকেও। ভাবলাম একটা কবিতা পোষ্ট দিই। আবার ভাবি না সমসাময়িক বিষয়াদি। তবে কোন কিছুই দিতে পারলাম না ভয়ে। জানিনা ব্লগে যারা আমার প্রিয় ছিল, বা আমি যাদের পরিচিত ছিল তারা আমাকে ভুলে গেছে কিনা, কিংবা এতদিন পরে তারা আবার আমাকে কিভাবে গ্রহন করবে? তাই একটা জবাবদিহীতার প্রয়োজন বোধ করছিলাম। জবাবদিহীতা আমার এই অনুপস্থিতির, জবাবদিহীতা ব্লগে আমার এই যাযাবরীয়তার। আমি পেশায় নিজে যাযাবর, তাই আমার ব্লগটি একটি যাযাবরের ব্লগ, এবং আমি ব্লগের একজন যাযাবর। এই যাযাবরের এইভাবে হারিয়ে যাওয়া এবং আবার ফিরে আসাটার জন্য একটা জবাবদিহীতার প্রয়োজনতো বটেই।
যাইহোক অনেক কথা হল। আমার এই অচল কাসুন্দি ঘেটে শুধু শুধু সবার সময় নষ্ট করলাম। এখন আসুন আপনাদেরকে আমার শেষ জাহাজের কিছু ক্লিক দেখাই।
১। নেভিগেশন ব্রীজ থেকে তোলা জাহাজের সামনের ছবি।
২। আমি নিজে বৃশ্চিক রাশির জাতক। রাতের বেলা ব্রীজের অন্ধকারে আকাশে তাকিয়ে বৃশ্চিক খোঁজা আমার প্রিয় একটা কাজ। এটি আমার মোবাইলের একটা স্ক্রীনশট। স্টারফাইন্ডার এপস এর।
৩। নীল সাগরে কনটেইনার ভর্তী আমাদের জাহাজ।
৪। কিছুটা খারাপ আবহাওয়ায় খালি জাহাজ নিয়ে আমরা যাচ্ছি চায়নার সাংহাই জাহাজের ড্রাইডক করাতে। তাইওয়ান স্ট্রেইট পার হবার পরে আমাদেরকে পেল সুপার টাইফুন দুজুয়াব। তীর্যক ভাবে পাল্লা দিয়ে আমরা এবং দুজুয়ান এগিয়ে যাচ্ছিলাম নর্থ চাইনার দিকে। এবং আমাদের জন্য কোন শেল্টার ছিল না যেসময়। আমাদের যেখানে আশ্রয় নেবার অবস্থা ছিল টাইফুনের সম্ভাব্য আঘাত করার জায়গাও ছিল সেটি। তবে আমরা আমাদের জাহাজের গতি বাড়িয়ে তাকে পিছে ফেলে সাংহাই চ্যানেলে ঢুকে যেতে পেরেছিলাম। যদিও যতটা খারাপ সাগর পেয়েছিলাম ইতিমধ্যে সেটা ছিউ আমার জীবনের সবথেকে ভয়াবহ। সমস্থ জাহাজটিকে যেন এক কাগজের নৌকার মতো উল্টিয়ে পাল্টিয়ে ফেলছিল। কেবিন, স্টোর এবং নেভিগেশন ব্রীজের সব জিনিসের স্থান হয়েছিল ফ্লোরে। এবং সেগুলো প্রচন্ড গতীতে গড়াগড়ী খাচ্ছিল।
৫। বন্দরে ভিড়তে যাচ্ছি আমরা। এই মূহুর্তটি প্রত্যেকটা জাহাজীর খুব প্রিয়। তবে আজকাল কন্টেইনার জাহাজগুলোর পোর্টস্টে খুব কম হয়। হয়তো ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা। তাই সবসময় বাইরের শহর ঘুরতে যাওয়া বা শপিং করতে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না।
৬। জাহাজটি বন্দরের সাথে বাধা হলে ডেক ডিপার্টমেন্টের প্রথম কাজ থাকে গ্যাংওয়ে দেয়া। গ্যাংওয়ে হল বন্দর থেকে জাহাজে ওঠার একটা অস্থায়ী সিড়ি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে জাহাজের ডেকক্রুরা গ্যাংওয়ে সেট করছে এবং নীচে অপেক্ষামান পোর্ট অথরিটি সহ কার্গো সুপারভাইজাররা।
৭। কার্গো হোল্ডের কভার খোলা হচ্ছে গ্যান্টিক্রেন দিয়ে। কনটেইনারগুলো এই কার্গো হোল্ডে লোডিং হবে।
৮। বন্দরের গ্যান্ট্রিক্রেনগুলোর আলোয় জাহাজের চেহারাটা অন্যরকম লাগে।
৯। জাহাজীদের জীবনে অনেক কিছুই স্যাক্রিফাইস করতে হয়। কোন দিবস তাদের কাছে উৎযাপনীয় নাও হতে পারে। তবু মাঝে মাঝে যদি উপযুক্ত পরিবেশ থাকে আই মিন ক্যাপ্টেন যদি ভাল থাকে তবে সুযোগ পেলে পালন করা হয় কোন দিবস। আমার লাষ্ট জাহাজের হ্যাপি নিউইয়ার উৎযাপন।
১০। দুইজন ক্যাডেটের সহায়তায় একশটি বেলুন ফুলিয়ে পুরো মেসরুমের সিলিংটা সাজিয়েছিলাম আমি।
১১। প্লেইন এই কেকটির ওপর হ্যাপি নিউইয়ার লেখার চ্যালেঞ্জটা নিলেন চীফ ইঞ্জিনিয়ার সার। বাদাম ছিটিয়ে লেখা হচ্ছে হ্যাপি নিউইয়ার-২০১৬।
১২। ভলকানো পার্টি। পার্টি একরকম নামকনের পেছনে লম্বা কারন আছে। আমাদের জাহাজটি যখন ড্রাইডকে রিপেয়ারের জন্য ছিল তখন মালিকের একজন রিপ্রেজেন্টেটিভ ছিল জাহাজে। তার নাম ক্যাপ্টেন ভলগার। বৃটিশ এই ক্যাপ্টেন যতদিন আমাদের জাহাজে ছিল আমাদের সবার খাওয়া ঘুম সব হারাম ছিল। আমাদের জাহাজটির মালিক ছিল একজন গ্রীক। তিনি ইংল্যান্ড থেকে তার ব্যবসা পরিচালনা করেন। এবং জাহাজটির ম্যানেজমেন্টের জন্য সিঙ্গাপুরের ভি-শীপস্কে দায়িত্ব দেয়, ভি-শীপস্ বাংলাদেশের একটা মিনিং এজেন্সির মাধ্যমে আমাদেরকে জাহাজ চালনা করার নিয়োগ দেয়। কাজেই এখানে মালিকের কাছে আমাদের বাঙালিদের পারফর্মেন্স শো করার একটা ব্যাপার এসেই যাই। তাছাড়া ক্যাপ্টেন ভলগার খুবই বদমেজাজী একজন লোক ছিলেন। কারো কাজে সামান্য ত্রুটি পেলেই উনি নাকি তার চাকরী খেয়ে বসেন। তাই আমরা যতদিন ড্রাইডকে ছিলাম চোখ কান বন্ধ করে পারফর্মেন্স শো করার তালে আমাদের প্রাণ ওষ্টাগত ছিল। এবং ফাইনালি আমরা যখন ড্রাইডক থেকে সেইল করলাম তখন একটা পার্টি থ্রো করলাম ক্যাপ্টেন ভলগার থেকে মুক্তি পাবার আনন্দে। যার নাম অবধারিত ভাবেই ভলকানো পার্টি হয়ে গেল।
১৩। ভলকানো পার্টিতে আমাদের আনন্দ নৃত্য।
১৪। ভলকানো পার্টিতে গান পরিবেশন করছেন আমাদের ক্যাপ্টেন স্যার। আঞ্চলিক চিটাগাং থেকে শুরু করে এমন কোন গান ছিল না যে গানের সুর উনি উটাতে পারেন না। তার গানের সুরে প্রানবন্ত হয়ে উঠেছিল আমাদের পার্টি।
সবশেষে পার্টিতে থার্ড ইঞ্জি্নিয়ারের গাওয়া একটা ম্যাসআপ ভিডিও লিংক না দিয়ে পারলাম না।
এই এলোমেলো পোষ্টটি দিয়ে যাযাবরীয় ব্লগিং শুরু করলাম আবার।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:৩২