(সুত্রঃ সম্পাদকীয়, দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ১৮ মার্চ ২০১৯, সোমবার, চট্টগ্রাম।
( অনলাইন পত্রিকা সংস্করণ- জাগোনিউজ২৪ডটকমঃ Click This Link )
ঘটনাটা শোনার পর এবং অপরাধীর দ্বারা ধারণকৃত ভিডিও দেখার পর সম্ভিত হারিয়ে বেশ কিছুক্ষণ শব্দহীন বসেছিলাম। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এই ভেবে যে, এটা কি সত্যি সত্যি ঘটনার কোন তথ্যচিত্র, না কোন ভিডিও গেমের ক্লিপ। বারবার মনে হচ্ছিল হায় আল্লাহ, এই ঘটনার শিকারতো আমিও হতে পারতাম! ২০১৮ সালের সামার সেশনে ক্রাইস্টচার্চর কেন্টাবেরী ইউনিভার্সিটিতে আমার যাওয়ার কথাছিল এমবিএ করতে। অফিস শেষে রাতে বাসায় বসে ভিডিও ইন্টারভিউও দিয়েছি এর জন্যে। পরে নানাবিধ কারণে বিবাহিত পারিবারিক জীবনে স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে একা যাওয়ার কথা ভেবে যাওয়া হলো না আর। নিউজিল্যান্ড শান্তিপূর্ণ দেশ বলে জনরব আছে। জনসংখ্যার আধিক্যতা না থাকায় সর্বত্র শুনশান নিরবতা। বস্তুত মানুষজন শান্তি প্রিয়। অপরাধ প্রবণতা কম থাকায় সবখানে সচরাচর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি দেখা যায় না বা প্রয়োজন পড়ে না। আমি জাপানেও তাই দেখেছি। ওসাকার মতো একটা আধুনিক ও ব্যস্ততম শহরে আমি ১৫দিনের একদিনও কোথাও কোন পুলিশ বা ট্রাফিক দেখতে পাইনি। শব্দহীন পুরো যান্ত্রিক শহর। সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। ক্রাইস্টচার্চর মতো শহরে তারই চিত্র প্রতীয়মান। তাই ঐ সন্ত্রাসী হামলা বা গণহত্যার ১৭ মিনিটের মাথায়ও পুলিশের উপস্থিতি আমরা দেখতে পাইনি। তবে সব যুক্তির উর্ধ্বে প্রশ্ন হচ্ছে টেস্ট ম্যাচ খেলতে যাওয়া একটা আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট দল বাংলাদেশ টীমকে কেন তারা পুলিশি পাহারা ছাড়া মসজিদে যেতে দিল তা আমার মাথায় কিছুতেই খেলছে না। অস্ট্রেলিয়া কতোইনা টালবাহানা করেছে বাংলাদেশে খেলতে আসবে বলে নিরাপত্তার প্রশ্নে তা আমরা বাঙ্গালীরা ভুলে যাইনি। বাংলাদেশে খেলতে আসা সকল আন্তর্জাতিক দল এমনকি বাংলাদেশ দল যখন দেশের ভিতরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় খেলতে যায় কি নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা প্রদান করা হয় তা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। নিউজিল্যান্ড কর্তৃপক্ষের কাছে বিসিবির এ ব্যাপারে জোরালো জবাব চাওয়া উচিত।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুইটি মসজিদে গত শুক্রবার জুমার নামাজের সময় বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৫০ হয়েছে বলে জানান পুলিশ কমিশনার মাইক বুশ। ডিন্স এভিনিউর আল নূর মসজিদে ৪১ জন এবং লিনউড এলাকার অন্য মসজিদে সাত জন নিহত হয়েছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরো একজন মারা গেছেন। নিহতদের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি রয়েছেন। হামলায় আহত অন্তত ৪৮ জন ক্রাইস্টচার্চ হাসপাতাল চিকিৎসাধীন আছেন বলে নিশ্চিত করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ছাত্র জীবনে আমার পাখি শিকার করার একটা রাইফেল ছিল। আমার বাবা সেটা দুবাই থেকে এনেছিলেন নব্বইয়ের দশকে। খুব একটা ব্যবহার করতে পারিনি বন্দুকটা। যতোবারই পাখি শিকার করতে গেছি ততোবারই মনে হয়েছে একটা নিষ্পাপ প্রাণ হত্যা করছি। মনে আছে দু‘একটা কাক শিকার করতে পেরেছিলাম বড়োজোর। দেখা যেত কাকের গায়ে বন্দুক লাগুক আর না লাগুক গুলির শব্দে সবগুলো কাক একসাথে সমস্বরে কা-কা ডাক দিয়ে একে অন্যকে জানান দিত কিংবা প্রতিবাদ করতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি ক্রাইস্টচার্চের গণহত্যার ঘটনায় কয়েকটি সংগঠন বা দেশ ছাড়া বাকি অন্যসব রাষ্ট্র এর প্রতিবাদে খুব একটা সোচ্চার হয়নি। এতো কোন পাখি হত্যা নয়, বরং গণহত্যা, খুন। এটা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। নিঃসন্দেহে এটা একটা সন্ত্রাসী হত্যাকান্ড। যদিও নিউজিল্যান্ডে ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলায় দেশটির জনগণের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে ট্রাম্পের টুইটের শব্দচয়ন নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে টুইটারে। তার টুইটটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সাধারণত যেসব হামলায় মুসলিম কোনো ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা থাকে তাদের ‘সন্ত্রাস, সন্ত্রাসী হামলা’- ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে থাকেন ট্রাম্প, মার্কিনি এবং পশ্চিমারা। হামলার ঘটনায় কোনো মুসলিম জড়িত থাকলে সেই হামলাকে ‘ইসলামিক টেরোরিজম’ বলতেই পছন্দ করেন মার্কিন প্রশাসন। কিন্তু স্বঘোষিত শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থী সন্ত্রাসীর হামলাকে ‘শ্বেতাঙ্গ অধিপত্যবাদী আতঙ্ক’ বলতে নারাজ তারা। এমনকি হামলায় কে বা কারা জড়িত তাদের আদর্শিক পরিচয় কী- সে বিষয়েও কোনো ইঙ্গিত বা নিন্দা নেই তার টুইটে। অথচ ২৮ বছর বয়সী এই হামলাকারী শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের মৌলবাদী ও জঙ্গি মানসিকতার লোক ছিল। ওই ব্যক্তিকে অস্ট্রেলিয়ায় হাজতবাসও করতে হয়েছিল। সে মৌলবাদী, ডানপন্থি ও সহিংস সন্ত্রাসী। হামলাকারী তার মেনিফেস্টোতে অভিবাসীদের দিকে ইঙ্গিত করে উল্লেখ করে বলে, ‘ঐতিহাসিকভাবে ইউরোপের ভূমিতে বিদেশি দখলদারদের কারণে শত শত মানুষের মৃত্যুর পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে দখলদারদের ওপর এই হামলা চালানো হচ্ছে'। খ্রিস্টান জঙ্গিটি নিজেকে ঐতিহাসিক খ্রিস্টান জঙ্গির উত্তরাধিকারী হিসেবে জানান দিয়েছে। সুস্পষ্টভাবেই বুঝা যাচ্ছে, নিউজিল্যান্ডের হামলাটি নিরীহ মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটি 'জেনোসাইড' বা ‘গণহত্যা’র ছিলো। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন হামলা ছিলো না, বরং ঐতিহাসিক ভাবে মুসলিমদের উপর হামলার একটি ধারাবাহিকতার অংশ হিসাবে হামলাটি হয়েছে। আজ যদি এঘটনা কোন মুসলিম বিচ্ছন্নতাবাদী কর্তৃক ঘটে থাকতো তাহলে পুরো দুনিয়া তাকে টেরোরিস্ট বানিয়ে দিত। এখন অনেকে এই পুরো ব্যাপারটাকে নিয়ে মানসিক রোগ, পাবজি গেম, শুটিং গেম এর দোষ দিচ্ছে। মিডিয়াকে সুযোগ করে দিচ্ছে বিনা সাজাতে অপরাধীকে মুক্ত করে দিতে। ইতোমধ্যেতো অস্ট্রেলিয়ার সিনেটর ‘ফ্রাসের এনিং’ রবিবার দুপুরে মিডিয়া ব্রিফিংয়ে ক্রাইস্টচার্চের ঘটনার উসকানিমূলক ব্যাখা দিয়ে অভিবাসনের ফলে ইউরোপে মুসলিম আধিপত্যকে দায়ি করেছেন।
আমরা সাধারণ জনগণ কোন বর্ণবাদ, সন্ত্রাসবাদ, মৌলবাদ বা ধর্মবাদের পক্ষে নই। যখনই কোন মতবাদ হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয় তখনই তা রূপ নেয় সন্ত্রাসবাদে। হোক সে হত্যাকান্ড বাংলাদেশে, যুক্তরাষ্ট্রে, ফ্রান্সে, সুইডেনে, ইরাকে, সিরিয়ায় বা নিউজিল্যান্ডে- আমরা মানবতাবাদ তাকে ধিক্কার জানাই। কোন বেসামরীক নিরীহ, নিরাপরাধ প্রাণ কোন সন্ত্রাসবাদের মতো মতবাদের স্বীকার হোক মানবাতবাদের তা কখনই কাম্য নয়। আবার এটাও সত্য যে- কোন মতবাদ, ধর্মবাদ বা বর্ণবাদকে কোন একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তি কতকের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা বা কর্মকান্ড দিয়ে সামগ্রীক বিচার করলেও চলবে না। ঘৃণা নয়, হিংসা নয়, আমরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব দেখতে চাই। বন্ধ হোক সকল হেইট ক্রাইম, রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক, বর্ণবাদ, ধর্মবাদ, মতবাদ থেকে সৃষ্ট হত্যাযজ্ঞ। ‘সব্বে সত্তা সুখিতা ভবন্তু! ‘
লেখক: কলামিস্ট
ই-মেইল:[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:৪৫