আমার অফিসের এক সহকর্মীর বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছি। গন্তব্য রাজশাহী। তাদের পরিকল্পনা ছিল মেয়ে দেখতে যাবে, কথাবার্তা ঠিক হয়ে গেলে তারা বিয়ে পড়িয়ে চলে আসবে। নিতান্তই একটা পারিবারিক ব্যাপারে আসলে আমি যেতে চাচ্ছিলাম না, তাছাড়া যখনকার কথা বলছি, তখন দেশে একটা শৈত্যপ্রবাহ চলছিল। এই ব্যাপক ঠান্ডার মধ্যে উত্তর বঙ্গে যেতে হবে, এই আতংকও ছিল আমার না যেতে চাওয়ার অন্যতম কারন। কিন্তু সেই সহকর্মীর চাপাচাপিতে শেষমেষ রাজি হয়ে গেলাম।
আমরা অল্প কয়েকজন মানুষ। একটা মাইক্রোতেই জায়গা হয়ে যেত, কিন্তু মুরুব্বিদের সাথে বোরিং জার্নির আশংকায় আমি আমার গাড়িটা নিয়ে নিলাম । কথা ছিল সকাল ১০টায় রওনা হব, কিন্তু রওনা দিতে দিতে প্রায় দুপুর ১ টা বেজে গেল। শীতের বেলা বিকেল না হতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। তার উপর আবার ঘন কুয়াশা। সব মিলিয়ে আমাদের পৌছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা ৮টা বেজে গেল।
আমরা সরাসরি মেয়ে পক্ষের বাড়িতেই গেলাম। তারা চিন্তিত হয়ে আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। যাওয়া মাত্রই আমাদের জন্য কয়েক রকম শরবতের ব্যবস্থা হল। সেই সাথে নাস্তাও পরিবেশন করা হল। চালের রুটির সাথে হাঁসের ভূনা মাংস, নানা রকম পিঠা, পায়েস ইত্যাদি সব মিলিয়ে আতিথিয়তার চূড়ান্ত করলেন তারা।
হঠাৎ দেখি পাত্রপক্ষের এক মুরুব্বী আমাকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। আমি কাছে যাওয়ার পর তিনি আমার কানে কানে ফিসফিস করে বললেন, ' ভাইসাহেব অবস্থা কিন্তু সুবিধার মনে হচ্ছে না, আপনি রেডি থাকবেন। আমি ইশারা দিলেই সোজা রাসেলকে নিয়ে গাড়িতে উঠে যাবেন। রাসেল হচ্ছে আমার কলিগের নাম। আমি কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কিসের লক্ষন ভালো না?' তিনি ষড়যন্ত্রকারীদের মত মুখটা আমার কানের আরো কাছে এনে বললেন, পাত্রীর অবস্থা মনে হয় না সুবিধার, দেখেন না কেমন বেশি বেশি খাতির যত্ন করছে?।
আমার তো শুনে পুরাই আক্কেল গুড়ুম! বলে কি এই লোক। খুব ইচ্ছা করছিল লোকটাকে প্রচন্ড একটা ধমক দিই। কিন্তু সাতপাঁচ ভেবে আর দেয়া হলো না। আমি বিরক্ত হয়ে আমার চেয়ারে এসে বসলাম।
যাই হোক, কিছুক্ষন পর আমরা পাত্রীর মুখোমুখি হলাম। বলাবাহুল্য, পাত্রী যথেষ্ট রুপবতী। পরিচয় হলাম। টুকটাক কথা জিজ্ঞেস করলাম। যথেষ্ট আধুনিক এবং স্মার্ট একটা মেয়ে। এই মেয়ে পছন্দ না হবার কোন কারনই নেই। বড় কথা রাসেল ভাই এর পরিবারের সবার অনেক অনেক ভালো লেগেছে। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মেয়ে দেখার সেই প্রাথমিক প্ল্যানটি বিয়ে পর্যন্ত গড়ালো এবং দেখতে দেখতে রাত ১১ টার মধ্যে বিয়ে পড়ানো হয়ে গেল। আমাদের প্ল্যান ছিল আমরা রাতেই রওনা দিয়ে ঢাকায় চলে আসব, কিন্তু প্রবল কুয়াশার কারনে সে প্ল্যান বাদ দেয়া হলো। ঠিক হলো রাতটা এইখানেই কাটিয়ে সকালে আমরা রওনা দিব।
আমি ভেবেছি সারা রাত হাসি ঠাট্টা আর তামাশা করেই কাটিয়ে দেয়া যাবে ,কিন্তু প্রবল শীতের রাতে সদ্য বিবাহ করা একজন মানুষ অন্যদের সাথে হাসি ঠাট্টা করে সময় কাটাবে, এমনটা ভাবাই সবচেয়ে বড় ঠাট্টা বা তামাশা। তাই বাধ্য হয়ে আমি ঘুমাতে গেলাম। আমাদের থাকার স্থান হয়েছে অন্য একটা দালানে। বাড়ির মুল মেহমানখানা ছেলেপক্ষের মুরুব্বিদের দেয়া হয়েছে। আমার সাথে গেল রাসেল ভাই এর ছোট ভাই অভি। বাড়ির একজন কাজের লোক আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল।
একটা বিষয় না বললেই নয়, রাসেল ভাই এর শশুরবাড়ী একটি বনেদী যৌথ পরিবার। প্রায় পুরানো দিনের জমিদার বাড়ির মত বিশাল এই বাড়িতে তারা তিন পুরুষ ধরে বসবাস করছেন। অনেকটা ইংরেজী U শেপের মত বাড়িটা। সারা বাড়ি জুড়ে টানা বারান্দা আর তার সাথে লাগোয়া রুম। মাঝখানের উঠোনটা পাকা করা। উঠানের চারপাশে কেয়ারী করা ফুলের বাগান। বাড়ির সামনে দুইটা বিশাল পুকুর। তার মাঝখান দিয়ে একটা সংযোগ সড়ক প্রধান রাস্তা থেকে এই বাড়িতে এসে ঢুকেছে। রাস্তার দুপাশে বড় বড় গাছ।
যে লোকটি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তিনি এই বাড়ির একজন পুরানো কাজের লোক। তার নাম গফুর মিয়া । যে দালানের সামনে এসে আমরা দাঁড়ালাম, তা মূল বাড়ির একটু দুরে। বাড়ির সামনেই বাঁধান একটা পুকুর ঘাট। আমি আর অভি তো খুশি হয়ে গেলাম। চমৎকার একটা জায়গা। গফুর মিয়া রুমের ভেতরে আমাদের বিছানা ঠিক করছেন। আমি বারান্দায় এসে দাড়ালাম। বেশ ঠান্ডা একটা বাতাস বইছে। বাতাসে নাম না জানা ফুলের তীব্র গন্ধ। আমি সিগারেট ধরালাম। গফুর মিয়া রুম গুছিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন। কেমন যেন মনে হল কিছু একটা বলতে চাইছেন। জিজ্ঞেস করলাম, চাচা কিছু বলবেন?
তিনি কিছুটা ইতস্তত করলেন। তারপর মাথা নিচু করে বললেন, অনেক রাত হইছে, ঘুমাইয়া পড়েন। এত রাতে বাইরে ঘুরা ফেরা কইরেন না। সমস্যা হইতে পারে।
আমি কিছুটা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি ধরনের সমস্যা? চোর টোর আছে নাকি?
তিনি প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়ে বললেন, তালুকদার বাড়িতে চুরি করতে ঢুকবো এত বড় সাহস কারো নাই। তবে.. এই বলে তিনি থেমে গেলেন।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তবে?
তিনি মনে হয় কিছুটা হতাশ হলেন। বললেন, রাত বিরাতে এই সব কথা বলা উচিত না। আপনেরা শিক্ষিত মানুষ, এই সব বিশ্বাস করেন না। আমরা গ্রামের লোক, এই সব আমরা মানি।
এই বলে তিনি চোখ দিয়ে সামনের দিকে ইংগিত করলেন। আমি সামনে তাকালাম। কুয়াশার কারনে খুব বেশি কিছু দেখা যাচ্ছে না। পুকুরের ঐ পাশে একটা বাড়ির মত দেখা যাচ্ছে। তার সামনে একটা বাতি জ্বলছে। কুয়াশার কারনে ঠিকমত আলো বের হচ্ছে না।
আমি বুঝতে না পেরে কিছুটা হতাশ চোখে গফুর মিয়ার দিকে তাকালাম, কথা বলতে যাব এই সময়ে তিনি বলে উঠলেন, ঐ যে বিল্ডিংটা দেখতেছেন, ঐটা অনেক পুরানো আমলের একটা কবর। কার কবর বাপ চাচারা কেউ কইতে পারে না। তবে প্রতি বছর সেখানে একটা গরু দিয়া আসতে হয়। আমরা গরু দিয়াই চইলা আসি। না দিলে স্বপ্ন দেখায়, নানা রকম ক্ষতি হয়...
আমি মাঝপথে তাকে থামিয়ে দিয়ে হাহা করে অট্রহাসি দিয়ে উঠলাম। গফুর মিয়া বেশ আহত চোখে আমার দিকে তাকালেন। তারপর কিছু না বলে চলে গেলেন।
রুমে ঢুকলাম। অভি ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে। বাসায় ফোন দেয়া হয় নি। আমি ফোন নিয়ে বাইরে এলাম। ফোনে নেটওয়ার্ক পাচ্ছি না। দুরে আবার সেই বিল্ডিং এর উপর চোখ পড়ল। বেশ জোরেই বাতাস বইছে। ঘন কুয়াশাগুলো আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। টিম টিম করে জ্বলতে থাকা আলোটা কুয়াশার কারনে বেশ রহস্যময় লাগছে। কাছেই কোথাও যেন নাম না জানা একটা পাখি হঠাৎ হুমহুম করে ডেকে উঠল। আমি চমকে উঠলাম। হঠাৎ মনে হলো, দূর থেকে কে যেন আমাকে লক্ষ্য করছে। শরীরটা কেমন যেন শিরশির করে উঠল। আমি ঘরে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম।
মাঝরাত্রিতে হঠাৎ করে ঘুমটা ভেঙে গেল। মনে হলো কে যেন খুব করুন সুরের একটা গান গাইছে। মোবাইলে তাকিয়ে দেখি প্রায় রাত সাড়ে তিনটা বাজে। এত রাতে আবার গান কে গাইবে? এই ধরনের এইটি গাঁজাখুরি স্বপ্ন দেখার জন্য নিজেরে মনে মনে তিরস্কার করলাম। পাশে তাকিয়ে দেখি অভি বেশ নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। আমি আবার ঘুমাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এবার স্পষ্ট শুনতে পেলাম বাইরে কে যেন গুন গুন কন্ঠে গান গাইছে। ঘুম ঘুম চোখে দরজার দিকে চোখ পড়তেই আমার ঘুম ছুটে গেল। দেখি দরজা খোলা। আমি লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। যতদূর মনে পড়ে আমি দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়েছি। এমন তো হবার কথা নয়। নিজের খামখেয়ালীতে প্রচন্ড বিরক্ত হলাম। বিছানা থেকে নেমে দরজার কাছে গেলাম। দরজা লাগাতে যাব ঠিক এই সময় আবার গানের সুর শুনলাম। এবার নিশ্চিত হলাম যে আমি ঠিকই শুনেছি। শব্দটা বারান্দার সামনে থেকেই আসছে। আমি বারান্দায় উকি দিলাম। কোথাও কিছু নেই। চারিদিকে সুনশান। বাতাসে কুয়াশারা ছুটছে। আমি দরজার বন্ধ করতে যাচ্ছি এমন সময় চোখ পড়ল সামনের পুকুর ঘাটে। একটা মেয়ে বসে আছে। গানের শব্দটা সেখান থেকেই আসছে। প্রচন্ড অবাক হলাম আমি। গলা উচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কে ওখানে?
সাথে সাথে গানের শব্দ থেকে গেল। আমি বারান্দা থেকে নেমে এসে আবার জিজ্ঞেস করলাম, কে ওখানে?
এবার জবাব আসল, জী, আমি।
আমি পুকুর ঘাটে এগিয়ে গেলাম। অন্ধকারে চেহারা ঠিক পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। আমি ঘাটে এসে দাঁড়াতে মেয়েটা কেমন যেন ইতস্ত্বত করে উঠে দাঁড়াল। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কে আপনি? এত রাতে এখানে কি করছেন?
মেয়েটা কোন কথা বলল না। অন্যদিকে চেয়ে রইল। আমি কিছুটা বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, এত রাতে এখানে ঠান্ডার মধ্যে বসে আছেন?
-আমি যেখানে থাকি, সেখানে তার চেয়ে বেশি ঠান্ডা। তাই আমার ঠান্ডা লাগছে না। তাছাড়া এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয়, আমি এখানে প্রায় বেড়াতে আসি।
আপনি কি এই বাড়ির কেউ?
-নাহ, আমি আপনাদের নতুন বউ এর বান্ধবী। একসাথে স্কুলে পড়তাম। বিয়ে উপলক্ষে এসেছি।
ওহ! তাই বলেন। অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, বাড়ির ভেতরে দেখা কোন মেয়েটা এটা। জিজ্ঞেস করলাম, তা আপনার বুঝি গানের অনেক শখ?
মেয়েটা জোরে হেসে উঠল। কেমন যেন একটা ঘোর লাগা হাসি। আমি কিছূটা চমকে উঠলাম। হাসছেন কেন?
-হ্যাঁ, অনেক শখ! তবে আমার গান সবার ভালো লাগে না। কেউ সহ্যই করতে পারে না। আমি এখন জলতন্তলের বাসিন্দাদের গান শুনাই।
জলতন্তল? সেটা আবার কি?
আমার প্রশ্ন শুনে মেয়েটি আবার জোরে হেসে উঠল। জলতন্তল মানে জানেন না?
না আমি জানি না। এর মানে কি?
-এর মানে হলো জলের অন্তহীন গভীর।
বাপরে! আমি এমন শব্দ কখনও শুনিনি।
মেয়েটা আবার জোরে হেসে উঠল। আমি আবারও চমকে উঠলাম। হাসিটা কেমন যেন খন খনে টাইপের।
-আমার হাসিটা ভালো না। সবাই এভাবেই চমকে উঠে।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কিভাবে বুঝলেন আমি হাসি শুনে চমকেছি?
মেয়েটা আবার হেসে উঠল। দূরে কোথায় যেন একটা কুকুর ডেকে ডাকছে। আমার কাছে কেমন যেন করুন শোনাল ডাকটা। থেমে থেমে বাতাস বইছে। আস্তে আস্তে কুয়াশা কেটে যাচ্ছে। দূরে পুকুর পাড়ে চোখ পড়ল। মিটমিট করে সেই বাড়িটা আরো অনেক বেশি রহস্যময় লাগছে। কুয়াশা কেটে যাওয়ায় বেশ ঠান্ডা পড়েছে। আমি পকেট হাতড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। দেখলাম, মেয়েটা কিছুটা দুরে সরে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, দুঃখিত আপনার কি সিগারেটে সমস্যা হয়?
নাহ! আমার কোন কিছুতেই সমস্যা হয় না তবে আগুন ভালো লাগে না।
-বলেন কি? শীতের রাতে মানুষ তো আগুনই পছন্দ করে।
অনেকটা কঠিন স্বরে মেয়েটা বলল, নাহ! আমার ভালো লাগে না।
হঠাৎ একটা শব্দ শুনলাম, পানিতে কিসের যেন হুটপুটি করছে। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে পানির ধারে গিয়ে বসল। এই প্রথম মেয়েটাকে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম। এত শীতের রাতে শুধু একটা সেলোয়ার কামিজ পড়েই বসে আছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা আপনার কি সত্যি শীত লাগে না।
-বললাম না, আমি যেখানে থাকি, সেখানে আরো বেশি ঠান্ডা। তাই আমার কাছে ঠান্ডা লাগছে না।
কোথায় থাকেন আপনি?
বলা যাবে না। আমি টের পেলাম মেয়েটা হাসছে। শুনলাম মেয়েটা গান গাইছে,
ছায়াও মতনও মিলায়ও ধরনী
কুল নাহি পায়, আশাও তরনী
মানষ প্রতিমা ভাসিয়া বেড়ায়
আকাশে আকাশে
আমি কেবলই স্বপনও করেছি বপনও
বাতাসে আমি।
-আপনি তো চমৎকার গান করেন। আমি মুগ্ধ হয়ে বললাম।
আবারও হাসল মেয়েটা। তারাও বলে।
-কারা বলে?
মাছেরা।
মাছেরা!!! আচ্ছা ফাজিল মেয়ে তো। আধপাগলি একটা মেয়ের সাথে এত রাতে কথা চালিয়ে যাবার কোন কারন নেই। আমি সিগারেট শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম। আচ্ছা আমি যাই। আপনিও ঘুমিয়ে পড়ুন।
আমি তো সেই কবে থেকেই ঘুমিয়ে আছি। আর কত ঘুম?
উফ! আবারও সেই হেয়ালী। আমি বিরক্ত হয়ে চলে আসছিলাম। মেয়েটা মন হয় কিছুটা লজ্জিত হল। চলে যাচ্ছেন রাগ করে? আমি তো সত্য কথাই বলেছি।
-রাগ করব না তো কি? খুব সত্য কথা বলছেন যে। আপনার নামটাই তো বললেন না।
মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে মাথা তুলে তাকাল। অন্ধকারের মাঝেও চোখগুলো কেমন যেন জ্বল জ্বল করছে। দূর থেকে যে আলো আসছে তাতে অস্পষ্ট ভাবে দেখলাম, মেয়েটার মুখটা অস্বাভাবিক রকমের ফ্যাকাসে। মৃদ্যু হাসল। হেসে বলল, আমার নাম জানেন না? আমার নাম রুনু।
এই বলে দেখলাম মেয়েটা পানির মধ্যে দুই পা চুবিয়ে দাঁড়াল। হাত দিয়ে পানি নিয়ে খেলতে লাগল। প্রচন্ড শীতের রাতে এই ধরনের আচরন স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়ার কোন কারনই নাই।
-কাছে আসুন, পানিটা ধরে দেখুন। শীতের রাতে পুকুরের পানি গরম থাকে। এটা জানলে আর এত অবাক হতেন না।
আমি অবাক হলাম না। বুঝতে পারছি মেয়েটা কোন ভাবে আমার মনে কথা বুঝতে পারছে পারছে। সামগ্রিক ব্যাপারটাই অস্বাভাবিক। হঠাৎ করে গফুর মিয়ার কথাগুলো মনে পড়ল। এই শীতের রাতেও আমার মেরুদন্ডের মধ্যে দিয়ে একটা ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গেল। সাথে সাথে শুনলাম তীক্ষ্ণ হাসির শব্দ। আমি দু হাতে কান ঢেকে ফেললাম। মেয়েটা কেমন যেন হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর অনেকটা চিবিয়ে চিবিয়ে হিসহিস কণ্ঠে বলল, গফুর মিয়াটা বড় বাড় বেড়েছে। মাছগুলোকে কোন খাবারই ঠিক মত দেয় না। অন্য কেউ ব্যবস্থা করুক সেটাও দিবে না। আমাকে দিয়ে আর কত?
আমি চমকে উঠলাম, জিজ্ঞেস করলাম আপনাকে দিয়ে আর কত মানে?
-কাছে আসুন, আপনাকে দেখাচ্ছি, আপনিও তাহলে বুঝবেন। এই বলে মেয়েটা সামনের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল।
আমার মনের ভিতর কে যেন বলছে, না খবরদার! এই হাত তুমি স্পর্শ করবে না। খবরদার!
আমি সম্মোহিতের মত সামনে এগিয়ে গেলাম। আমার দুই পা স্পর্শ করল তীব্র ঠান্ডা পানি। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, মেয়েটা বুক সমান পানিতে নেমে গেল। বুক পানিতে দাঁড়িয়ে মেয়েটি আমার দিকে দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছে। চোখে প্রবল এক সম্মোহনী চাহুনী। আমি কোন ভাবেই এই দৃষ্টি এড়াতে পারছি না। আমার খুব ইচ্ছে করছে পানিতে নেমে যাই।
আমার অবচেতন মনে বার বার বলছে, বিপদ ভয়ংকর বিপদ। পালাও। কিন্তু আমি পালাতে পারছি না। ঠান্ডায় মনে হয় আমার পা জমে গিয়েছে। হঠাৎ দেখলাম, একটা মানুষ পানিতে উপুড় হয়ে ভাসছে। ভালো করে চেয়ে দেখি একটা যুবতী মেয়ের লাশ। মুখটা প্রচন্ড ফ্যাকাশে। মুখের চামড়া গুলো গ্রীষ্মের তপ্ত জমির মত ফেটে গিয়েছে, চোখগুলো আধো খোলা। মুখের একপাশে কিসের কামড়ে যেন ক্ষয়ে গিয়েছে। সেখান থেকে চোয়ালের হাড় দেখা যাচ্ছে। এ তো রুনি!!!!!
সাথে সাথে আবারও শুনলাম সেই ভয়ংকর তীক্ষ্ণ হা হা হাসির শব্দ। এক সময় তা পরিনত হল কান্নায়। হৃদয়নিংড়ানো হাহাকারের কান্না। আমার খুব মায়া লাগছে। রুনুর লাশের দিকে তাকাতেই রুনু কথা বলে উঠল, প্লীজ আমার হাতটা ধরুন। আমার এখানে অনেক ঠান্ডা। আমার ঠান্ডা ভালো লাগে না।
আমি চোখ বন্ধ করে প্রানপনে পানি থেকে আমার পা তুলে ফেললাম। প্রচন্ড ক্লান্তি লাগছে। তীব্র হাসির শব্দে আমার কানের পর্দা ছিড়ে যাচ্ছে। আমি দু হাতে কান ঢেকে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
...................
হাসান ভাই, হাসান ভাই??
কে যেন আমাকে ডাকছে। দুচোখ খুলে দেখি অভি চিন্তিত মুখে আমার দিকে চেয়ে আছে। কি হয়েছে আপনার?
কোথায় আমি? দূর্বল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম।
কোথায় আবার? রুমে। আপনি স্বপ্ন দেখে চিৎকার করছিলেন। আমি ঘুম ভেঙ্গে দেখি আপনি হাত পা ছুড়ছেন। তাই আপনাকে ডাকলাম।
আমার প্রচন্ড পানির পিপাসা লাগল। মাথা ব্যাথা করছে। ভয়ংকর রকম বাজে একটা স্বপ্ন দেখলাম। ঘড়িতে চেয়ে দেখি ভোর সাড়ে পাঁচটা বাজে। অভিকে বললাম, একটু পানি খাওয়াতে পার?
অভি পানি এনে দিল। পানি খেয়ে কিছুটা ফ্রেস লাগল। হঠাৎ অভি জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া পানি ফেলে দিয়েছেন দেখি।
কোথায় পানি ফেললাম?
এই যে দেখেন, আপনার খাটের নিচেই তো পানি।
আমি খাটের নিচে তাকালাম। মনে হলো সেখানে কে যেন ভেজা কাপড় চিপে পানি ফেলেছে। আমি তাড়াতাড়ি কম্বল সরিয়ে দেখি আমার প্যান্ট হাটুর নিচ থেকে ভিজে চপচপ করছে।
এবার বাস্তবেই জ্ঞান হারালাম আমি।
দুপুর বেলা যখন হুস ফিরে এল, তখন দেখলাম রাসেল ভাই আর ভাবি আমার রুমে বসে আছেন। আমাকে চোখ খুলতে দেখে, তারা ছুটে এলেন। কেমন আছি ইত্যাদি জানতে চাইলেন। সত্যি অনেক ফ্রেস লাগছিল। সবাই আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল। তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া করে রেডি হলাম। গফুর মিয়াকে খুঁজছিলাম। কিন্তু চোখে পড়ছিল না। সবাই যখন গাড়ীতে উঠছে, তখন গফুর মিয়াকে চোখে পড়ল। আমি ছুটে গেলাম তার কাছে। জিজ্ঞেস করলাম, রুনি কে?
তিনি চমকে উঠলেন। আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বললেন, আপনাকে আগেই বলেছিলাম, রাত বিরাতে ঘর থেকে বের হবেন না। আপনি শুনেন নি আমার কথা।
আমি অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, রুনি কে?
-রুনি আপা ছিলেন আমাদের মিথিলা আপার বান্ধবী। তিনি এই বাড়িতে আসলে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াতেন। আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে রাতের বেলায় এই রকম ঘুরাঘুরি করতে গিয়ে তিনি নিখোঁজ হন। পরদিন দুপুরে তার লাশ পাওয়া যায় পুকুরে। সেই থেকে তাকে প্রায় রাতের বেলা সেই পুকুর ঘাটে দেখা যায়। আমরা অনেকেই দেখেছি। তিনি কারো ক্ষতি করেন না। আমি বন্দী করে রেখেছি।
হাসান ভাই!! চলেন সবাই অপেক্ষা করছে তো! অভির ডাকে আমি চমকে উঠলাম। গফুর চাচা আমার দিকে চেয়ে হাসছেন। এই ভরদুপুরেও আমার মেরুদন্ড বেয়ে ভয়ের একটা স্রোত বয়ে গেল। আমি চোখ বন্ধ করে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। আমরা সংযোগ সড়ক দিয়ে যাচ্ছি, শেষবারের মতন ঐ পুকুর ঘাটের দিকে তাকালাম। মনে হল, যেন আমাকে ফিস ফিস করে বলছে, প্লীজ আমার হাতটা ধরুন। আমার এখানে অনেক ঠান্ডা। আমার ঠান্ডা ভালো লাগে না।
-০-
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০১৪ ভোর ৬:৩৩