সম্প্রতি প্রাচীন ভারতীয় সাধুদের সম্পর্কে কিছুটা পড়াশুনার চেষ্টা করেছিলাম। এই সাধুদের রহস্যময় জীবন সম্পর্কে জানতে গিয়ে দেখেছি, তাদের একটি অংশ জাগতিক সকল স্বাভাবিক চাহিদা থেকে নিজেদের দূরে রেখে শুধু মাত্র ঈশ্বরের সন্তুষ্টির জন্য সাধনা করেন এবং আরেকটি অংশ ততটাই অস্বাভাবিক জীবনযাপনের মাধ্যমে আলৌকিক ক্ষমতা লাভের জন্য শয়তান বা কালোশক্তির সাধনা করেন। ইন্টারনেটে এই সংক্রান্ত তথ্য যতই জেনেছি ততই শিহরিত হয়েছি তাদের কার্যকালাপে, তাদের সাধনাতত্ব নিয়ে। এদের আবার অনেক শ্রেনী বিন্যাসও আছে। যেমন, এক শ্রেনীর সাধু আছেন যাদেরকে অঘোরী বলা হয়। তারা মুলত ব্ল্যাক ম্যাজিকের চর্চা করে থাকেন। এই বিষয়ে তারা অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা লাভের জন্য নানারকম পুজা এবং কিছু বিভৎস কার্যালাপ (ritual) করে থাকেন। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো, কোন মৃত প্রানীর মাংস ভক্ষন করা বা ক্ষেত্র বিশেষে মৃত মানুষের মাংস খাওয়া এবং সাধনার একপর্যায়ে মৃত কোন তরুনীর সাথে যৌনকার্যক্রম করা ইত্যাদি। বলতে পারেন আমাদের অস্বাভাবিক চিন্তা যেখানে শেষ, তাদের চিন্তার শুরুটা সেখান থেকেই।
তবে আজকে এই আঘোরীদের সম্পর্কে বেশি কিছু বলব না আজকে আপনাদের সামনে তুলে ধরব প্রাচীন ভারতবর্ষ এবং জাপানের কিছু সাধুদের কথা। যারা তাদের সাধনার অংশ হিসেবে নিজেদেরকে জীবন্ত অবস্থায় মমিতে পরিনত করতেন। প্রাচীন ভারতে বৈষ্ণব ধর্মাবলি সাধু সন্নাসীদের একটা অংশকে মহাদেব নামে ডাকা হতো। এই মহাদেব সাধুরা এই সাধনাকে “বৃন্দাবনে প্রবেশ”(Brindavana Pravesha)হিসেবে আখ্যা দিয়ে পালন করতেন। জৈন রীতিতেও সাল্লেখানা (Sallekhana) নামে প্রায় একই ধরনের একটা সাধনা ছিল, সেখানে একজন সাধু আমৃত্যু উপোস করে থাকতেন। বিশ্বাস করা হতো এতে ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ করা যায় এবং সহজে স্বর্গে যাওয়া যায়।
তবে প্রাচীন তিব্বত, চীন এবং জাপানে সিনগন (Shingon)নামের বৌদ্ধ সাধুরা নিজেরাই জীবিত অবস্থায় নিজেদেরকে মমিতে পরিনত করতেন। ইতিহাসবিদদের মতে, সিনগন (Shingon)গোত্রের প্রতিষ্ঠাতা কুকাই (Kukai) চায়নার ট্যাং প্রদেশে প্রথম এই জীবিত মমি হবার রীতি চালু করেন। তাদের কাছে এটা ছিল পবিত্র আধ্যাতিক জগতে প্রবেশের এক সম্মানিত পন্থা। যারা এই কাজে সফল হতেন, তাদেরকে বলা হত “সকোশিবাতসু” (Sokushibutsu)। জাপানের হনসু (Honsu) দ্বীপের তহকু (Tohoku) নামের সাধুরা এই সাধনা করতেন। নিজেদেকে মমি বা জীবনামৃত করার যে রীতি ভারতীয় সাধুরা অনুসরন করতেন তার সাথে এই চৈনিক ও জাপানি সাধুদের খুব বেশি একটা মিল ছিল না। মিল বলতে এইটাই ঈশ্বরের তুষ্টির জন্য নিজের শরীরকে উৎসর্গ করা।
একজন সাধুকে একজন সফল “সকোশিবাতসু” হওয়ার জন্য মোট দশ বছরের একটি কঠিন সাধনার মধ্যে দিয়ে যেতে হত এবং সর্বশেষ ধাপে তিনি নিজেই জীবিত অবস্থায় নিজেকে একটি কবর সমতুল্য ছোট্ট গুহায় প্রবেশ করাতেন এবং সেখানেই তিনি মারা যেতেন। তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় এটা অনেক সম্মানের এবং গৌরবের একটি বিষয় ছিল।
‘সকোশিবাতসু’ সাধনার প্রথম ধাপটি ছিল তিন বছরের। এই ধাপে সাধুরা তাদের ওজন নিয়ন্ত্রন করা শিখতেন। এজন্য তারা তাদের খাদ্যভাস সম্পূর্নরুপে পরিবর্তন করে ফেলতেন। তাদের খাদ্য তালিকায় থাকত শুধু মাত্র অল্প কিছু বাদাম এবং ফল জাতীয় খাবার। এই ধরনের খাদ্য নিয়ন্ত্রনে শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় চর্বি ঝরে যেত। পরের তিন বছর তারা বিশেষ কিছু গাছের ছাল এবং কিছু নির্দিষ্ট গাছের মুল খেতেন যার মাধ্যমে তারা তাদের শরীরের অতিরিক্ত আদ্রতা বের করে দিতেন যাতে মমি বানাতে সুবিধা হয়। উল্লেখ্য যে, মমি বানানোর জন্য আদ্রতা কম থাকা বাঞ্চনীয়। আদ্রতার পরিমান বেশি হলে শরীর দ্রুত ক্ষয়ে যাবে এবং মৃত্যুর পর তা দিয়ে ভালো মমি বানানো যাবে না। সাধুরা এই তিন বছর খুব নিয়মকানুন এবং আত্মনিয়ন্ত্রনে থাকতেন। তারা খাবারের পরিমান আগের চাইতে আরো কমিয়ে দিতেন এবং বেশি বেশি পরিশ্রমের কাজ করতেন যেন শরীরে অবশিষ্ট বাকি চর্বিগুলোও দ্রুত ক্ষয় হয়ে যায়।
‘সকোশিবাতসু’ সাধুরা তাদের সাধনার শেষ পর্যায়ে এসে বেশ কিছু অদ্ভুত কাজ করতেন, যেমন শরীর থেকে দ্রুততার সাথে পানি বের করে দিতে তারা ‘বমি’ করতেন। উরশি নামের গাছের ছাল দিয়ে এক বিশেষ প্রকার চা বানিয়ে খেতেন। এই হার্বাল চা ছিল কিছুটা বিষাক্ত। এই চা পান করলে একজন মানুষের প্রচুর বমি হয় এবং শরীর খাবার থেকে কোন চর্বি গ্রহন করত না। আধুনিক কালে যে বিশেষ হার্বাল টি পানের মাধ্যমে মানুষ ওজন কমায় তা সেই উরশি গাছের ছাল থেকেই প্রস্তুত। এই জাতীয় বিষাক্ত চা পানের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির শরীরে কোন প্রকার ব্যাকটেরিয়া বা জীবানু সহজে বাসা বাধতে পারে না, ফলে মৃত্যূর পর সহজে দেহক্ষয় হয় না।
ছয় বছর এই ধরনের কঠিন সাধনার পরে একজন সাধুর শরীরে হাড্ডি ছাড়া আর তেমন কিছু থাকে না। এই পর্যন্ত যদি কোন সাধু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তাহলে তিনি পরের ধাপে প্রবেশ করেন। এই ধাপে একজন সাধু নিজেই নিজের পছন্দমত একটি ছোট পাথুরে কবর বেছে নেন বা প্রস্তুত করেন যেখানে শুধুমাত্র খাপে খাপে তারই যায়গা হবে। এই কবরে প্রবেশ করে সাধুরা পদ্মাসন গেঁড়ে বসেন। একবার এইভাবে আসনগ্রহন করার পর মৃত্যুর পূর্বে তিনি কোন ভাবেই সেই কবর বা সেই স্থান ত্যাগ করতে পারবেন না।
একজন সাধু কবরে আসন গ্রহন করার পর তার কবরটি পাথর বা মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হত। কবরে একটা বিশেষ ফাঁপা বাঁশ থাকত যা দিয়ে ঐ সাধু নিশ্বাস নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বাতাস পেতেন এবং প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঐ বাঁশের সাথে আটকানো একটা ঘন্টা বাজাতেন যেন অন্য সহসাধুরা বুঝতে পারেন তিনি বেঁচে আছেন। যেদিন থেকে ঘন্টার শব্দ আর শুনতে পাওয়া যেত না, ধরে নেয়া হত তিনি দেহত্যাগ করেছেন। তখন সেই বাঁশটি তুলে ফেলে ঘন্টাটিকে মন্দিরে স্থাপন করা হত এবং সেই কবরটিকে পুনরায় মাটিচাপা দেয়া হত। কথিত আছে কোন কোন সাধু দীর্ঘদিন পর্যন্ত বেল বাজিয়ে যেতেন। তবে এই ব্যাপারে কোন আক্ষরিক দলিল পাওয়া যায় নি।
এই পর্যায়ে এসে অন্য সাধুরা ১০০০ দিনের একটি ধর্মীয় রীতি রেওয়াজ পালন করতেন এবং ১০০০ দিন পর তারা কবর খুড়ে দেখতেন আসলেই ঐ সাধুটি মমি হতে পেরেছেন কিনা। যদি কবর খুড়ে দেখা যেত, সাধুটি মমিতে পরিনত হয়েছেন তখন তার মমিকে মন্দিরে দর্শনার্থীদের জন্য স্থাপন করা হত এবং তাকে বুদ্ধ হিসেবে ঘোষনা করে তার প্রতি সবাই সম্মান স্থাপন করত।
জাপানের ইয়ামগটা (Yamagta) প্রদেশে প্রায় এক হাজারের বেশি সাধু এই সাধনা করেছেন তার মধ্যে মাত্র ২৪ জন সফল হতে পেরেছেন। উল্লেখ্য এখানে অনেক ভারতীয় সাধুও ছিলেন যারা পূর্নাত্মার সন্ধানে তিব্বত, চীন এবং জাপানে দীক্ষা গ্রহন করতে গিয়েছিলেন।
১৮শ শতাব্দীর শেষের দিকে জাপান সরকার এই জীবিত মমি হবার এই ধার্মিক রীতিকে ধার্মিক আত্মহত্যা হিসেবে উল্লেখ্য করে তা নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন।
চলুন কিছু ‘সকোশিবাতসু’ সাধু দেখে আসি।
** অধিকাংশ তথ্য এবং ছবি ইন্টারনেটর বিভিন্ন পেজ এবং কিছু বই থেকে থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে এই সংক্রান্ত যে দুটো বই আপনারা চাইলে পড়ে দেখতে পারেন তা হচ্ছে এক লিভিং বুদ্ধাসঃ দি সেলফ মমিফাইড মনস অফ ইয়ামাগাটা। বইটি লিখেছেন, কেন জেরেমিহ
আঘোরা, দ্যা লেফট হ্যন্ড অব গড, লেখক, রবার্ট সুভদ্র
** ব্লগার তালেব মাস্টারের অনুরোধে নামগুলো সংযোজিত করেছি।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০১৪ ভোর ৬:৩৩