বৈদ্যের ছিপিতে বিমর্ষ মাছ
মৌসুমী কাদের
(আমার দাদা কুলদা রায়’কে…………)
পড়ন্ত বিকেল। ব্রামটন সেন্টেনিয়াল পার্কের লেকটা খুব বড় নয়। গভীর কিনা তাও বোঝার উপায় নেই। তবে তাতে অনেক সাদা হাস ঝাঁকে ঝাঁকে ভাসছে। রবার্ট বৈদ্য মাছ ধরতে চাইছে উঠছে বক। তাও প্লাস্টিকের, বাতাস খসে যাওয়া বকের অবশিষ্টাবলী।কায়কোবাদ তুলছে ব্যাঙ কিন্তু সেটা সত্যিকারের ব্যাঙ। মাছ যদি না পাওয়া যায় তবে ব্যাঙ ভাজি ছাড়া উপায় নেই। এইরকম পরিকল্পনা যখন মাথায় ঘুরছে তখনই সোরগোলটা বাঁধলো। বৈদ্যের ছিপিতে কি যেন একটা ধরা পড়েছে, তার ভার সে বইতে পারছেনা। পেছন থেকে পার্কে যারা খেলছিল তারাও এসে জড় হোল। নির্ঘাত কোন বিশাল মৎস!! কেউ কেউ বলছে বড় সাপও হতে পারে। সবাই উত্তেজিত।
মেয়েরা ততক্ষনে বারবিকিউ মেশিনে, সসেজ আর মুরগীর ঠ্যাংগুলো পোড়াতে দিয়েছে। ভোস ভোস করে তার ধোঁয়া উড়ছে আর বৈদ্যের জিভ রসে টইটুম্বুর হয়ে উঠেছে। এমন আনন্দঘন পরিবেশে এরকম একটা বিতিকিচ্ছিরী কান্ড! দূর থেকে এইসব দেখে ব্যায়ামরত সাদা এক কুস্তিগীর তার বিশাল শরীরটা মোচড় দিতে দিতে জলের কাছে নেমে এলো। ছিপির সুতোটা হাতে পেচিয়ে দিল একটা হ্যাচকা টান! ছিপের মাথায় বাক্স জাতিয় একটা কিছু শূন্যে উড়তে উড়তে এসে হুড়মুড় করে পড়ল টেনিস কোর্টের পাশে। আর ছোট বড় সকলেই হই হই করতে করতে ছুটলো তার পেছনে। বাক্সটি রুপার বা তামার হবে বেশ বড় সাইজের তাই এত ভার। ভারতীয় কারুকাজ তার সারা গায়ে। জলে ডুবে শ্যাওলা পড়ে ওড় রঙ কালচে সবুজ হয়ে গ্যাছে।বাক্সটায় বিশাল এক তালা লাগানো। উৎসুক জনতার সন্দেহ, নির্ঘাত এর ভেতর সোনাদানা বা মহামূল্যবান কিছু আছে, নইলে এত শক্ত তালাই বা লাগানো হোল কেন? লোকজন যখন বাক্সটি খুলবার জন্যে উদ্যত হয়েছে তখনই বৈদ্য চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘এটা আমার ছিপিতে উঠেছে, এটা আমার’। তোমরা কি চাও এখানে??? কিন্তু লোকজন কি আর এতসহজে ছাড়বার পাত্র? কেউ কেউ বলে উঠলো, ‘ইস, বললেই হোল এটা তার, ছিপি ধরেতো টান দিল, জেকব। তাহলে বাক্সটা তারই পাওয়া উচিত। জনতার দল বাক্সের লোভে পরে দু্ভাগে ভাগ হয়ে গেল। ততক্ষনে কে একজন পুলিশকে ডেকে ফেলেছে। কালোপোশাকধারী পুলিশ পরিস্থিতি দেখে হলুদ পোশাকধারী তেজষ্ক্রিয়া নেভানোর লোকদের ডাকলো, দারুন সার্কাস শুরু হয়ে গ্যাছে, জনতা ততক্ষনে আতংকগ্রস্ত। বৈদ্য ব্যাটা ভাগার তালে বেতাল। হলুদ পোশাকের দুটো লোক এসিড দিয়ে বাক্স খুললো, হা ইশ্বর, বাক্সের ভেতর একটা প্লাস্টিক ব্যাগে কিছু লেখা কাগজ। এছাড়া আর কিচ্ছু নেই। জনতা বিমর্ষ ।
-পুলিশ বৈদ্যকে ডেকে কাগজগুলো দেখিয়ে বললো, ‘ডু ইয়ু নো দিস ল্যাংগুয়েজ?’
-বৈদ্য খুব ভালো করে কাগজগুলো নেড়েচেড়ে বোলল, ‘ইয়েস, দিস ইজ বেংগলী, আই নো’।
এরপর পুলিশ বাক্স নিয়ে চলে গেল।
ঘটনা এইখানে ইতি হইলে বৈদ্যসাহেব খুশী হইতেন। কিন্তু তাহা হইলনা। অচিরেই পুলিশ বৈদ্যসাহেবকে আবার থানায় ডাকিলেন।
পুলিশঃ মিস্টার বৈদ্য, এই চিঠিগুলো তোমার ঠিকানায় লেখা, তাই তোমাকে আমরা ডেকে আনতে বাধ্য হয়েছি।
বৈদ্যের ভুরুদুটো কপালে উঠে গেল!! গলা দিয়ে যেন স্বর বেরুতে চাইছেনা। চি চি করে বললো,
ঃ ইট ক্যান্ট বি’ তোমাদের নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হয়েছে।
ঃ লেট মি শো ইয়ু দি ডকুমেন্টস…
বৈদ্য সাহেবের আক্কেল গুরুম। কারন সব চিঠিই তার বাড়ীর ঠিকানায় লেখা। তবে ভাগ্য ভালো যে সেখানে অন্য নাম লেখা। নইলে এজীবনে সংসার আর করা যেত বলে মনে হয়না।
পুলিশ সাহেব যে চিঠিগুলো দ্যাখালো তাতে লেখা,
এক।
আমি একা থাকি। বাবাকে বলেছিলাম বাড়ীতে বন্ধুদের আসতে দিতে। বাবা রাজী হননি। আমি আর বাবা এক বাড়ীতে থাকি। আমার মা কোথায় আমার তা জানা নেই। বাবা বলেন, মা বেঁচে আছেন কিন্তু তার কথা মুখে আনা যাবেনা। তাই আমি মায়ের কথা মনে করিনা। কিন্তু মাকে আমার দেখতে ইচ্ছে হয়। ভীষন ইচ্ছে হয়।
আমার দুটো বাগান আছে। একটি ইচ্ছে বাগান। আরেকটি অনিচ্ছে বাগান।
ইচ্ছে বাগানে আমি আমার মাকে ফুল তুলতে দেখি। নয়নতারা ফুল। ভোর বেলায় ঘুম ভেঙ্গেই দেখি মা দাঁড়িয়ে আছে আমার বিছানার সামনে একগাদা ফুল নিয়ে।
অনিচ্ছে বাগানে দেখি, বাবা ক্রমাগত মদ খাচ্ছে আর আমাকে বলছে, খোকন, তুই মদ খাসনে। মদ খেলে মানুষ শূন্যে হারিয়ে যায়, আর কোন স্বপ্ন দ্যাখেনা।
বাবা, আমি শুন্যে হারিয়েই আছি, মদ খেলেও আমার আর কিচ্ছু যায় আসেনা।
দুই।
‘আমার জীবন ও মরনের একমাত্র সংগী তুমি। তোমার জন্য আমি পৃথিবীর এপ্রান্ত থেক ও প্রান্তে ঘুড়ে বেড়িয়েছি, শুধু একবার তোমাকে দেখবো বলে, কিন্তু যখন সত্যিই আমাদের দেখা হোল তুমি তখন অন্য মানুষ। মাইনাস ফোর পয়েন্ট ফাইভ সিলিন্ডার চশমায় আমাকে তোমার চিন্তে কষ্ট হোল। তুমি দ্রত চলে গেলে আমায় ছেড়ে, ভুলে গেলে তোমার অতীত এবং যাবতীয় বিলাসী প্রতিজ্ঞা।
আমি যেন তত বেশী নিজের ব্যার্থতা কান পেতে শুনলাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম, আর নয়। কোন জমা খরচের দিন তালিকায় আমি আর থাকবোনা।
তিন।
নাম লিখেছি একটি তৃণে
আমার মায়ের মৃত্যুদিনে (জয় গোস্বামী)
চার।
মধ্যরাত্রি।
পৌরানিক দৃশ্যে মৎস
তুমি বা আমি এই কূল-সর্বস্বসংসারে নির্বংশ
নৈমিত্তিক বন্ধনহীন জীবন
আপাততঃ অচিহ্নিত গোগ্রাসে বিলীন
পরবাসী ধুলোয় মিটিয়ে দিলাম আমার এই জীবন।