জানালার পর্দা ভেদ করে বিছানায় এসে পড়লো সূর্যিমামার আলো।সকালের ঘুমটা এতো তারাতারি ভাঙ্গতে ইচ্ছে করছিলো না। আরো কিছু সময় ঘুমাতে পারলে খুব ভালো লাগতো। কিন্তেু রাফির প্রতিদিনের ফোন দিয়ে ঘুম ভাঙ্গানোর অভ্যাসে আর তা হলো না মালিহার। ঘুমার্ত কণ্ঠেই রিভিস করে বললোঃ হ্যালো
আজ তারপরও একটু দেরীতে ফোন দিয়ে ডেকে দিয়েছে। প্রতিদিন ঠিক ৮.০০ টায় তাকে ফোন দিয়ে উঠিয়ে দিবে রাফী। কিন্তু আজ একটু দেরীতে উঠবে তা রাফীকে বলেই রেখেছিলো মালিহা। তাই ৮.৩৮ ফোন দিয়ে ঘুম ভাঙ্গালো প্রতিদিনের থেকে একটু দেরীতে। অন্য কোন কাজে বেড়িযে না গেলে প্রতিদিন প্রথম কথা রাফী মালিহার সাথেই বলে দিনটা শুরুর চেষ্টা করাই যেন তার ভাললাগা। আজও একটু দেরি হলেও ফোন দিয়ে ঘুম ভাঙ্গালো মাহিলার। বেশ খানিকক্ষন কথা বলতে বলতে সে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। বেশ কয়েকবার রাফী ডাকলেও সে কখন ঘুমিয়ে গেলো জানেনা। খানিকের ঘুমের মাঝে তার শরীরে এসে লাগলো ভোরের মিষ্টি আলো। আবার ঘুম ভেঙ্গে গেলো মালিহার। চোখে মেলতেই বুঝলো সে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে গিয়েছে। সাথে সাথেই ফোন দিলো রাফীকে।
ভোরের আলোয় ইতিমধ্যেই পুরো ঘর হয়ে গিয়েছে আলোকিত। প্রতিদিনই তা হয়, পূব আকাশে সূর্য মামা উঠেই তার রুমটাকে এসে আলোকিত করে জানালা দিয়ে। রোদের কিরণ বাড়তে থাকলে শুয়ে থাকা কঠিন কিন্তু শীতের ঘনঘটা দেখা দিয়েছে আবহাওয়ায় বেশ কিছুদিন আগেই, তাই সকালে মিষ্টি রোদে শুয়ে বেশ ভালোই লাগে মালিহার। তাই খুব ভোড়ে ক্লাস না থাকলে তারাতারি না উঠে শুয়ে শুয়ে গায়ে রোদ লাগায়। এরজন্য অবশ্য প্রায়ই তার মার বকা আর ছোট ভাইর ধাক্কা খেতে হয়। দ্বিতীয় বার ঘুম ভেঙ্গে মিষ্টি রোদের আমেজে ভাসছিলো সে।
এবার মালিহাই ফোন দিলো রাফীকে। রিসিভ করলে সে যে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো তা বলতেই রাফী উত্তর দিলোঃ আমি তা বুঝেছিলাম কয়েকবার ডাকার পরও তোমার সাড়া না পাওয়ায় তাই কেটে দিয়েছিলাম কলটি। বুঝবে না কেন সে, প্রতিরাতেই মালিহার যখন ঘুম আসেনা চোখে তখন গল্প শুনায় রাফী আর গল্প শুনতে শুনতে সেভাবেই ঘুমিয়ে যায় মাহিলা। এবার আর শুয়ে থাকতে পারলো না মালিহা। রাফীর অনুরোধে উঠতে হলো তাকে। সে না উঠে নাস্তা করতে না গেলে ছেলেটাও বসে থাকবে কিছু খাবেনা তাই উঠতে হলো। জোর করেই বিছানায় বসে মনটা ভালো হয়ে গেলো তার। জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে চোখ চলে গেলো বাহিরে। ভোরের স্নিগ্ধ আলোতে সবকিছু ঝলমল করছে যেন। ধন্যবাদ দিলো রাফীকে জোর করে উঠনোর জন্য। না হলে সকালের এই সবুজ সুন্দর পরিবেশটা মিস করতো সে।
মালিহা সবসময় প্রকৃতিপ্রেমী। প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে তার ভালো লাগে। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেকে দূর আকাশে হারিয়ে ফেলতে ভালোবাসে। নদীর দিকে তাকিয়ে দূর দেশে ভেসে যেতে ইচ্ছে করে। বন বনানী, গাছ পালা, বাগানের মাঝে ছুটে বেড়াতে ভালো লাগে। প্রকৃতির গভীরে সে মাঝেমাঝে আনমনে হারিয়ে যায়্।
জানালার আরেকটু কাছে গিয়ে পর্দাটা সড়িয়ে দিয়ে সে। এবার পুরো ঘর আলোয় আলোকিত হয়ে পড়লো তেজহীন নির্মল আলোতে। চারিদিকটা অসম্ভব সৌন্দর্য সাজিয়ে নিয়েছে প্রকৃতি, সবুজের আবরণে সবুজাভ রং ধারণ করেছে সে।হালকা শিশিরে গাছের পাতাগুলো ধুয়ে গিয়েছে, তা সকালের স্নিগ্ধ রবির কিরণ পড়ায় পাতাগুলো করছে চিকমিক, সেখানে প্রতিবিম্ব তৈরী হচ্ছে রোদের। এখনো সমগ্র প্রকৃতিতে সূর্যের আলো পৌছেনি বলে আলো ছায়াঘেরা নির্মল পরিবেশে পরিবেশ হয়েছে আরো সুন্দর।
জানালার পাশের বড়ুই গাছটাতে এখনি এসে উড়ে বসলো এক জোড়া চড়ুই, এসেই তারা কিচির মিচির করে সুন্দর পরিবেশটাকে আরো মাতিয়ে তুললো। সে তাদের কিচির মিচিরে ভাষায় নিজেকে ডুবিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো। তারা কি খাবার সংগ্রহ করতে এসেছে তার প্লান করছে নাকি নীড়ের ভালবাসা শেষে ঘুরতে বেড়িয়েছে নাকি অন্য কোন সখির সাথে বেড়াতে এসেছে? আর পাশের পেয়ারা গাছে আগে থেকেই এক জোড়া শালিকেরা ভাবের বিনিময় করে যাচ্ছে। ভাবনায় রাজ্যে পেয়ে বসলো মাহিলাকে…… কত সুন্দর ওদের জীবন? যখন যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে উড়ে চলে যেতে পারে, কোন বাঁধা নেই। কিচির মিচির করে গান গেয়ে যেতে পারে, ভাবের বিনিমিয় করতে পারে। পাখি হয়ে আকাশে উড়তে পারলে কতই না ভালো হতো?
আরো কিছুক্ষন বসে থেকে নির্মল দক্ষিনা বাতাসের সন্ধানে শরীরের আড়মোড়া ভেঙ্গে নেমে আসলো বিছানা থেকে। ঘরে আজ কেউ নেই, সে শুধু একা আর তার সাথে ফোনের ওপ্রান্তে আছে রাফী। তার সাথে সাথেই ঘুরে বেড়াচ্ছে এঘরে সেঘরে। ড্রয়িং রুমের জানালার পর্দা সড়াতেই খেয়াল করলো এবার বড়ুই খেতে গাছে চড়তে হবেনা। বড়ুই ডালগুলো জানালার দিকে হেলে পড়ায় জানালায় বসেই হাতে পাড়তে পারবে বড়ুইগুলো। একহাতে বড়ুই ছিড়বে অন্য হাতে লবন মরিচ রেখে সবুজ ফলগুলোতে কাঁমড় বসাবে। রাফীকে অগ্রীম বড়ুইর দাওয়াতও দিয়ে রাখলো মালিহা। রাফীও অগ্রীম নিমন্ত্রনে যারপরনাই খুশি।
ঘরের মাঝে উড়ে বেড়াচ্ছে একটি রাজা ফড়িং। সুন্দর ডানা ঝাপটিয়ে এখন থেকে সেখানে উড়ে যাচ্ছে। কখনো আবার হেলিকাপ্টারের মতো ল্যান্ড করেছে বিভিন্ন জায়গায়। মালিহা বারবার ধরতে চাচ্ছিল ফড়িংটাকে কিন্তু তার চেষ্টা সফল হচ্ছিল না।
মাহিলা গিয়ে দাড়ালো দক্ষিনের ছোট্ট ব্যালকনিতে। জায়গাটাকে ব্যালকনি বললে ভুল হবে, মেঝের সাথে বাড়তি করে নিচতলার সানসেট হিসেবে এক প্রস্থ জায়গা তৈরী করা হয়েছে। কোন দেয়াল বা গ্রীলের ব্যবস্থা ছাড়া ভালোই ঝুকিপূর্ন জায়গাটা। একজন মানুষ হাঁটার পথ না থাকলেও সেখানটাকেই ছোট্ট ফুলের বাগানে রূপ দিয়েছে বেশ অনেকগুলো টব দিয়ে। দেয়াল ঘেষেই সুপারি, আম সহ অনেকগুলো গাছের কারণে কিছুটা নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরী হলেও অনভ্যস্ত কেউ এখানটা যাওয়া ভীতিকর। কিন্তু তবুও এ জায়গাটাই মালিহার বাসার প্রিয় স্থানগুলো একটি। প্রতিদিন সকালে বিকালে সে ফুলের বাগানে প্রবেশ করে, ঘুরে বেড়ায়। টবগুলোতে পানি দেয়, গাছগুলোর যত্ম নেয়, আগাছা পরিস্কার করে, নির্মল বাতাসে জোড়ে নিঃশ্বাস নেয়।
কদিন আগেও যখন মালিহার বান্ধবীরা বাসায় এসেছিলো এখানে দাড়িয়ে তারা মজা করেছে, গল্প করেছে, স্মৃতির পাতায় ধারণ করার ছবি তুলেছে। তার এই ছো্ট্ট ব্যালকনির বাগানটিতে শোভা পেয়েছে লাল, সাদা, গোলাপীসহ বেশ কয়েক ধরনের গোলাপ। আছে নয়নতারা, সূর্যমূখী, জবা একেবারে শেষ মাথায় বালতিতে আছে মাঝারি সাইজের মরিচ গাছটিও। দরজার পাশেই ছিকায় ঝুলানো আছে আরেকটি গাছ। দরজা খুলে সেখানটাতে দাড়াতেই চোখে পড়লো একটি সদ্য ফোটা হালকা লাল গোলাপ আর একটি নয়নতারা ফুল। ছোট্ট ব্যালকনিটাকে করেছে আলো সুন্দর। আস্তে গিয়ে গোলাপের ঘ্রান শুকলো মালিহা। গোলাপের ঘ্রানে মাতোয়ারা আশেপাশের পরিবেশ। সে তার ফুলের বাগানে দাড়িয়ে ফুলের সুবাস গ্রহন করছে আর ফোনের ওপ্রান্তে তখন রাফীও শরীক হচ্ছে সে সুবাসের সাথে বহুদূর থেকে।
মালিহা যদি সবুজ, সুন্দর, নির্মল, সকালটাতে ঘুমিয়ে কাটাতো তাহলে হয়তো অনেক কিছুই মিস করতো। আলো ঝলমলে এ ভোরে অনেক কষ্টের মাঝে মানসিক প্রশান্তি খেলে গেলো তার দেহ, মন স্বত্তায়। এ নির্মলতায় কোন কৃত্রিমতা নেই, নেই কোন বাড়াবাড়ি, আছে শুধুই আপন করে প্রকৃতিকে সাজিয়ে নেয়ার প্রকৃতিকে সাজিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা। আর এ প্রচেষ্টা প্রতিটি দিনই নতুন নতুন রূপ ধারন করে। প্রকৃতির এ খেলায় নেই শহুরে প্রভাব, নেই যান্ত্রিকতা ছোঁয়া, নেই নেই কোন তারাহুরা। আছে শুধুই মায়ময়তা, নির্লিপ্ততা, সৌন্দর্যের ডালিবাধা।
এভাবে প্রতিটি সকাল হোক সুন্দর, প্রতিটি ভোর হোক নতুন ভোরের ঝলমলতায় উজ্জল মনে সে কামনা নিয়ে ফ্রেস হয়ে নাস্তার টেবিলে গেলো মালিহা আর তার সাথে দূর থেকে শরীক হলো রাফী। একটি সুন্দর সবুজাভ সকালে দুজনেই হারিয়ে গেলো নির্মল সবুজতায়।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৩ দুপুর ১২:০১