১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে টাঙ্গাইল এলাকায় হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দু'টি অস্ত্রবোঝাই জাহাজ দখল ও ধ্বংসের ইতিহাস এখনো সেই এলাকার মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। যুদ্ধের সময়কার প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ১১টি সেক্টরের বাইরে স্বতন্ত্রভাবে গঠিত কাদেরিয়া বাহিনীর বীরত্বপুর্ণ ও দুঃসাহসী যুদ্ধের কথা বাঙালি জাতি চিরকাল স্মরণ করবে।
যুদ্ধের সময়কার কাদেরিয়া বাহিনীর বেসামরিক প্রশাসন প্রধান এনায়েত করিম দীর্ঘদিন পরে চলতি বছরের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশার্থে সেসব দিনের কিছু স্মৃতি বিধৃত করেন। জাহাজ ধ্বংসের কাহিনী স্মরণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, "তখন আগস্ট মাস। বর্ষাকাল। মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করতে মরিয়া। যেখানে হানাদার বাহিনী সেখানেই আমরা। আমি ছিলাম টাঙ্গাইলের পশ্চিম এলাকার দায়িত্বে। যমুনা নদীর পাড় এলাকার দায়িত্বে ছিল খোরশেদ। আগস্ট মাসের প্রথম দিকের কথা। পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্রবাহী সাতটি জাহাজ যাচ্ছিল যমুনা নদী দিয়ে দেশের উত্তর সীমান্ত এলাকায়। উদ্দেশ্য, ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় তাদের শক্তি বৃদ্ধি করা। জাহাজগুলো আসছিল ঢাকা সদরঘাট ইপিআর জেটি থেকে।
যুদ্ধশেষে কাদের সিদ্দিকী নিজের অস্ত্রটি বঙ্গবন্ধুর কাছে জমা দিচ্ছেন
কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকী তাঁর নিয়োজিত গোয়েন্দা, গুপ্তচর ও স্বেচ্ছাসেবক মারফত জানতে পারেন যমুনা নদী দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্রবাহী জাহাজ আসছে। এদিকে আবুল কালাম আজাদ ও নজরুল ইসলাম বাবুকে গ্রেনেড হামলা করার জন্য যমুনার চর দিয়ে টাঙ্গাইল পাঠানো হয়। তাঁরা যমুনার পারে পাকিস্তানিদের জাহাজ আসার খবর জানতে পারেন। আবুল কালাম আজাদ চিঠি লিখে এ খবর আমাকে জানান। সঙ্গে সঙ্গে লতিফকে মেসেজ দিয়ে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর কাছে এ খবর পাঠানো হয় এবং জাহাজ ধ্বংসের পরিকল্পনার কথা তাঁকে জানানো হয়। তিনিও ওয়ারলেসে খবর পেয়ে জাহাজ ধ্বংসের নির্দেশ দিয়ে ফিরতি মেসেজ পাঠান।
খোরশেদ জাহাজ ধ্বংসের অপারেশনে সাহস না পাওয়ায় পার্শ্ববর্তী নারান্দিয়া থেকে হাবিবুর রহমানকে এনে জাহাজ আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। জাহাজের গতিবিধি খেয়াল করার জন্য কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ছদ্মবেশে জাহাজের কাছে যান। তাঁদের চিনতে না পেরে পাকিস্তানি সেনাদের কয়েকজন নেমে এসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে। এই সুযোগে জাহাজের বহর সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নেন মুক্তিযোদ্ধারা। পাকিস্তান নৌবাহিনীর ওই দুই জাহাজের নাম ছিল যথাক্রমে "এস.ইউ. ইঞ্জিনিয়ারস্ এল সি- ৩" এবং "এস টি রজার।" হাবিব ও রেজাউল করিমকে (রেজাউল করিম ভারত থেকে এসে কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দেন) সঙ্গে নিয়ে জাহাজের এলাকা রেকি (পরিদর্শন) করা হয়। যতদুর জানা যায়, এ দুটি জাহাজই যমুনা নদীর চরে আটকে গিয়েছিল বা আটকে দেয়া হয়েছিল। আসলে জাহাজ মারার নেপথ্যের কৃতিত্বের দাবিদার হচ্ছেন জাহাজের সারেং ও সুখানীরা। তারাই দেশ প্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে জাহাজ গুলোকে নদীর চড়ায় আটকিয়ে দিয়ে মুক্তি বাহিনীকে খবর দেয়। তাদের নাম সংরক্ষণ করা হয়নি বলে আজ তা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে। তারা সকলেই নোয়াখালি অঞ্চলের অধিবাসী ছিল। কোন জায়গা থেকে আক্রমণ করলে জাহাজ ধ্বংস করা যাবে, সে স্থান চিহ্নিত করা হয়। তিনি তার কোম্পানী নিয়ে মাটিকাটা গ্রামে নদীর বাঁকে যুৎসই পজিশন নেন এবং সবাই সুযোগ বুঝে তিন ইঞ্চি মর্টার, এলএমজি ও রাইফেল চালিয়ে জাহাজের ইঞ্জিনভাগ ধ্বংস করেন। হাবিবকে বলা হলো সবগুলি অস্ত্র থেকে এক যোগে ফায়ার করার জন্য যাতে ওরা (পাকিস্তানিরা) মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের পরিমাণ বা ধরণ সম্পর্কে কোনোকিছু অনুমান করতে না পারে। জাহাজের সঙ্গে কয়েকটি স্পিডবোট ছিল। পরিকল্পনা মতো আক্রমণ করতে পারলে পাকিস্তানিরা ভয়ে পালিয়ে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস ছিল। আগস্টের ১২ তারিখ সকালে সুযোগ বুঝে জাহাজে আক্রমণ করা হয়।
অবিরাম গোলাগুলি। ৪০ থেকে ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা এ অপারেশনে অংশ নেন। গুলিতে জাহাজে থাকা প্রায় অর্ধেক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। বাকিরা স্পিডবোটে করে পশ্চিমে সিরাজগঞ্জের দিকে পালিয়ে যায়। পরে সন্ধ্যার দিকে জাহাজে গিয়ে দেখা যায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ। ভূঞাপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে শতাধিক নৌকা ও হাজারখানেক স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করে অস্ত্র, গোলাবারুদ সরানো হয়।"
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জেলা ওয়েবসাইট টাঙ্গাইল: জেলা তথ্য বাতায়ন থেকে জানা যায়, এসব অস্ত্র-শস্ত্রেরর বেশির ভাগই পাশের গ্রাম ফলদার বিভিন্ন গোয়ালঘর ও খড়ের স্তূপ ও মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা হয়। দুই জাহাজ ভর্তি সেসব অস্ত্র সম্পুর্ণভাবে সরানো সম্ভব না হওয়ায় বাকিগুলো সহ আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় জাহাজে। অস্ত্র, গোলাবারুদ ধ্বংস হওয়ার বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে আশপাশের গ্রামাঞ্চল। সে এক মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠান! কয়েকদিন ধরে জ্বলে জাহাজের আগুন। হাজার হাজার উৎফুল্ল লোকজন সে আগুনের শিখা বহুদূর থেকে প্রত্যক্ষ করে ও আনন্দে ফেটে পড়ে। পরে জাহাজের লগবুক ও মুভমেন্ট কভারের হিসেব থেকে জানা যায় যে, জাহাজে একলক্ষ বিশ হাজার বাক্সে ২১ কোটি টাকার অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিল।
জাহাজ ধ্বংসের খবরে পাকসেনারা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ১৭ নভেম্বর ভূয়াপুর সদর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ছাবিবশা গ্রামে গণহত্যা চালায়। ওই দিন গ্রামের ৩২ জন নারী-পুরষ ও শিশুকে হত্যা করে এবং পাক হানাদাররা ছাবিবশা গ্রামের প্রায় ৩৫০টি বাড়ী আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
জাহাজ আক্রমণে সফল নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে হাবিবুর রহমান 'জাহাজ মারা হাবিব' হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। সেই সঙ্গে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের শিবির। জাহাজ ধ্বংসের পুরো অপারেশনে সবচেয়ে বেশি সম্পৃক্ততা এবং সহযোগিতা ছিল নুরুল ইসলাম, বুলবুল খান মাহবুব, মোয়াজ্জেম হোসেন খান ও আবদুল হামিদ ভোলা'র।
বিমান থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে যৌথবাহিনীর প্যারাট্রুপার নামছে টাঙ্গাইলের মুক্তাঞ্চলে
ভূঞাপুরের মাটিকাটায় জাহাজ ধ্বংস ও অস্ত্র উদ্ধারের খবর শুনে ছুটে আসেন কাদের সিদ্দিকী। এদিকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ হারিয়ে মরিয়া হয়ে ওঠে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তারা চারদিক থেকে ভূঞাপুর আক্রমণ করে। তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধারা। গেরিলা কায়দায় তাদের গতিরোধ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানিদের ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলে পিছু হটে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। পাকিস্তানিদের চতুর্মুখী আক্রমণে পড়ে মাকড়াইর যুদ্ধে কাদের সিদ্দিকী নিজেও আহত হন এবং চিকিৎসা গ্রহণের উদ্দেশ্যে ভারতে চলে যান। পরে কাদেরিয়া বাহিনীর চীফ কমান্ডারের দায়িত্বগ্রহণ করেন বাহিনীর বেসামরিক প্রশাসন প্রধান আনোয়ারুল আলম (শহীদ)। মুক্তিযোদ্ধারা আরো শক্তিশালী হয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত জয় মুক্তিযোদ্ধাদের হয়।
ভূঞাপুরের সিরাজকান্দি মাটিকাটার জাহাজ ধ্বংস ও অস্ত্র উদ্ধারে দেশব্যাপী গোটা মুক্তিযুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা। কাদের সিদ্দিকী যুদ্ধের শেষদিকে ভারতে গিয়ে মিত্রবাহিনীর সেনানায়কদের কাছে সামগ্রিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন এবং তার উপর ভিত্তি করেই অগ্রবর্তী দল হিসেবে টাঙ্গাইলে হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমান থেকে হাজার হাজার প্যারাট্রুপার (ছত্রীসেনা) নামানো হয়।
সেই যুদ্ধে যার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে তিনি হচ্ছেন হাবিবুর রহমান তথা "জাহাজ মারা হাবিব"। তার বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলায়। আব্দুল কাদের সিদ্দিকী'র নিয়ন্ত্রণাধীন ৯৭ কোম্পানী বিশিষ্ট প্রায় ১৫ হাজার যোদ্ধার এক অভিনব বাহিনীতে এই হাবিবুর রহমান ছিলেন অন্যতম একজন কোম্পানী কমান্ডার। স্বাধীনতার পর তাকে 'বীরবিক্রম' খেতাবে ভুষিত করা হয়। আর কাদের সিদ্দিকী পান 'বীরোত্তম' খেতাব।
টাঙ্গাইলের নাগরপুর শহীদ স্মৃতিসৌধ
কাদেরিয়া বাহিনীর হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন এরকম ১৮৯ জন মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতাযুদ্ধের ন'মাসে শহীদ হন এবং আরো প্রায় ৫০০ জন আহত হন। সেই দিগ্বিজয়ের ইতিহাস সৃষ্টিরও বহু বছর পর অনেকের মতো ঘটনার নায়ক মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান বীরবিক্রম ওরফে "জাহাজ মারা হাবিব" হতদরিদ্র ও নিঃস্ব অবস্থায় রোগে-শোকে ভুগে-ভুগে বিনা চিকিৎসায় মারা যান বছর তিনেক আগে। আমরা যেন ভুলেই গেছি তাঁর নাম আর বীরোত্বগাঁথা।
*জাহাজ মারা হাবিবের কোনো ছবি জোগাড় করা সম্ভব হয়নি।
তথ্যসূত্র: কালের কণ্ঠ | টাঙ্গাইল: জেলা তথ্য বাতায়ন | বাংলা গ্যালারী
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ২:১২