একবার একটা লোক খুব ঝাঁপসা হয়ে গেল। আমরা ইরেজার দিয়ে ঘষে ঘষে মানুষটিকে ঝাঁপসানো থেকে বাঁচালাম। লোকটির মুখ ছিলনা। আমরা সেটি মুছে দিয়েছিলাম। ইচ্ছে করে নয়, মুছে ফেলার ঝোঁক চেপে বসলে কে-ই বা মানুষের মুখ মনে রাখে? তবু কে যেন কাঠকয়লা দিয়ে লোকটির চোখ এঁকেছিল। গোল গোল চোখ; একটা ছোট, একটা বড়। চোখ দুটো একটু বিচ্ছিরি হলেও ভ্রু আঁকার কাজটি ছিল বেশ নিখুঁত। বিউটি পার্লারের মেয়েরা ভ্রু প্লাক করে তাতে আবার যেমন করে ভ্রু এঁকে দেয়, ঠিক তেমন। বেশ সুন্দর; অনেকটা রুনা লায়লার মতো! অতএব কপালগামী টানা টানা ভ্রুর নীচে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া লোকটির আর কোনো কাজ ছিলনা। উপায়ও ছিলনা। গোল গোল চোখ, আর টানা টানা ভ্রু নিয়ে লোকটি পাড়ার বউ-ঝিদের দেখত, ছেলেপুলেদের দেখত, সামাদ মিয়ার মাদি কুকুরটাকে দেখত, মেঘ মেঘ আকাশ দেখত, এক ঝাঁক জালালি-কবুতর দেখত, আর দেখত করমচা ঝোঁপের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছিপছিপে একটা সুপুরিগাছ।
ভ্রুর কারসাজিতে লোকটি সবকিছু দেখত বিস্ময় নিয়ে। সে মানুষের ডান হাতের পাঁচ আঙ্গুল দেখে অবাক হতো, বা হাতের পাঁচ আঙ্গুল দেখেও অবাক হতো। আবার নিজের দুই হাতের দশ আঙ্গুল দেখত চরম বিস্ময় নিয়ে, যেন মানুষের আঙ্গুলের মতো অদ্ভূত বস্তু জীবনেও সে দেখেনি।
লোকটির অবাক হওয়া দেখে দেখে একসময় আমরা বিরক্ত হয়ে পড়লাম।
কপালগামী ভ্রুর হাত থেকে বাঁচতেই কে যেন তার চোখে একটা সানগ্লাস এঁকে দিল। কালো । সানগ্লাসের আড়ালে লোকটির বিস্ময় ঢেকে- আমরা রোদ খুঁজলাম। মিকাইলের কালো ভেড়ার পাল তখন পশ্চিমের খোঁয়াড়ে ছুটছিল। মেঘ মেঘ আকাশ। এমন বৃষ্টির দিনে সানগ্লাস বোধহয় বেমানান। আমরা তাড়াতাড়ি ইরেজার দিয়ে আকাশের কালো মেঘ মুছে দিলাম। সানগ্লাসের সাথে মানানসই ঝক ঝকে রোদ চাই।
মেঘ মুছে ফেলতে ফেলতে নীল আকাশও মুছে গেল খানিকটা। ইচ্ছে করে নয়, মুছে ফেলার ঝোঁক চেপে বসলে কে-ই বা আকাশের কথা মনে রাখে? কেউ কেউ বলল, ওগুলো ওজন স্তরের ফুটো, আছে থাকুক। তবু কার যেন নিখুঁত একটা আকাশের জন্য মন কেমন করে উঠল। সে বেশ যত্ন করে কাঠকয়লা দিয়ে আকাশ আঁকল, একটা সূর্যও আঁকল দিগন্তের কাছাকাছি, যেখানে একঝাঁক পাখি উড়ছে।
সানগ্লাসের উপযুক্ত রোদ হলেই চলত আমাদের; ফুল-পাখি-লতা-পাতার কোনো দরকার ছিলনা। কে যেন ‘'মরা রোদ'’ বলে মাঝ আকাশে আরেকটা সূর্য এঁকে- দিগন্তের সূর্যটাকে আঙ্গুল দিয়ে ঘষে ঘষে মুছে দিল। ছোটবেলায় অংক-খাতার পৃষ্ঠা কাটাকুটি আর মোছামুছিতে যেমন ফেঁসে যেত, আকাশটার দশাও তেমন হলো একসময়। দিগন্তের ফুল-পাখি আর মাঝ আকাশের সূর্যের নীচে লোকটি সানগ্লাস চোখে বসে রইল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মতো। এই বেশ ভালো; কেউ সারাক্ষণ কপালে ভ্রু তুলে বসে আছে- দেখতে হচ্ছেনা!
তাতানো রোদে ভ্রুর বিস্ময় কালো কাঁচে ঢেকে দিয়ে আমরা আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম।
আরেকটু ঘষা-মাজা হলেই সাত আসমানের আরশ জয়তুন বানুর গোয়াল ঘরে আছাড় খাবে। আরশ বাঁচানোর জন্যই হোক আর জয়তুন বানুর গোয়াল ঘরের শোকেই হোক- আমরা আকাশের ফুটো মেরামতে মন দিলাম। কাজটি সকলে পারেনা; শুধু সুফিয়া কামালের মতো খালাম্মারাই নিখুঁত আকাশ সেলাই করেন।
সানগ্লাস চোখের মানুষটিকে খুব ভাল লাগল আমাদের। ঝামেলা কম।
দেখতে দেখতে কালো চশমার মানুষটি খুব রহস্যময় হয় উঠল আমাদের কাছে। কোন অভিব্যক্তি নেই, আনন্দ-শোক কিংবা বিস্ময় নেই; যেন কিছুতেই কিছু এসে যায়না তার; নির্ভেজাল নিঃস্পৃহ মানুষ। এইতো চাই! কালো চশমার আড়ালে লোকটি হয়তো সামাদ মিয়ার বউকে, অথবা তার মাদি কুকুরটাকে দেখল। আমরা সামাদ মিয়াকে আড় চোখে দেখলাম এবং সামাদ মিয়া কড়া চোখে সানগ্লাসওয়ালাকে দেখল। বিসম্বাদ ওটুকুতেই আটকে রইল দেখে- আমরা মনে মনে হাততালি দিলাম। সেদিনই সামাদ মিয়ার বউটি প্রথমবারের মতো চেলাকাঠের পিটুনি এড়িয়ে পুকুরে নাইতে গেল।
সামাদ মিয়া নিজের বউকে বিশ্বাস করত না, কিন্তু কুকুরটাকে বিশ্বস্ত ভাবত খুব।
একদিন লোকটির চোখের সামনে দিয়ে হরিনাথ ঘোষের বউ বাপের বাড়ী চলে গেল, জয়তুন বানুর লায়েক ষাঁড় রাতেও গোয়ালে ফিরল না এবং পরেরদিন ছাল-ওঠা এক সারমেয় সামাদ মিয়ার মাদি কুকুরে উপগত হলেও- সে চশমার আড়ালে চুপচাপ বসে রইল; যেন সে তিন তাসের জুয়ারী, চোখের পাতা এদিক-সেদিক হলেই তার টেক্কা মার খাবে রুহিতনের পাঞ্জার কাছে।
মানুষটির নির্বিকার সানগ্লাস আমাদের অসহ্য ঠেকল একদিন।
যার ভাল-মন্দে কিছুই এসে যায়না, তাকে কতক্ষণ সহ্য হয়? আমরাও বিরক্ত হয়ে উঠলাম একসময়। দরকার নেই বাবা তোমার নিঃস্পৃহতায়! অনেক হয়েছে! প্রতিক্রিয়াহীনতা একঘেয়ে হয়ে উঠলে প্রতিক্রিয়াশীলদের কাঁধে তুলে নেই আমরা। বিনোদন চাই, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার তীব্র-তীক্ষ্ণ বিনোদন।
একদিন ভরদুপুরে কে যেন লোকটার সানগ্লাস মুছে দিল। সানগ্লাসের সাথে সাথে লোকটির চোখও মুছে গেল আরেকবার। দরকার নেই ঝামেলার। চোখ মুছলেও লোকটির ডান চোখের ভ্রু খানিকটা রয়ে গেল কপালের কাছে। থাকুক। চক্ষুহীনরা ভ্রুহীন হবে- এমন কোনো কথা নেই। সব অন্ধদেরই ভ্রু থাকে।
এখন লোকটি যেন পরিত্যক্ত ক্যানভাসে আঁকা একটা মুখোশের লে-আউট; যেন কোনো এক দুষ্ট বালক সেখানে আধখানা ভ্রু এঁকে পালিয়েছে। তাকে আমাদের একটুও ভাল লাগল না। ঘষা-মাজাতে তার চেহারাটি উত্তরোত্তর বাজে হয়ে উঠছিল- ভাল না লাগার ব্যাপারটি সেজন্য ঘটতে পারে। কিংবা আমাদের একজনের দেখাদেখি আরেকজনের মধ্যে অপছন্দের জ্যামিতি ঢুকে পড়েছিল হয়তো! তবে, একদিন লক্ষ্য করলাম, লোকটিকে ভাল লাগেনা, এই বিষয়টিই ভাল লাগে আমাদের। লোকটির মুখোশ, অথবা অর্ধেক ভ্রু আঁকা মুখের লে-আউট মনে নিয়ে আমরা সারাদিন ঘুরে বেড়াই, হরিনাথ ঘোষের ঘর পালানো বউ, জয়তুন বানুর গোয়ালে না ফেরা ষাঁড়, আর সামাদ মিয়ার বিশ্বস্ত মাদি কুকুরের গল্প করি।
তবু লোকটি বিরক্তিকর হয়ে উঠল ক'’দিন না যেতেই। রোজ রোজ একই মুখোশমুখো চেহারা দেখে আমরা ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলাম।
একদিন সবার ভাল লাগায় বৈচিত্র আনতেই বুঝি আমরা আবার লোকটির মুখ এঁকে দিলাম। ওষ্ঠ, অধর, চিবুক, মিটিমিটি হাসি, নাকের ফুটো, নাকের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে থাকা দু’টো লোম- মানে, চোখ ছাড়া কিছুই বাদ গেলনা। আমি চোখ আঁকার জন্য কাঠকয়লা তুলতেই অন্যরা রে রে করে উঠেছিল, বলেছিল, ‘ঝামেলার দরকার কী!’ তাইতো, চোখ নির্বিকার হলেও মুশকিল, বিস্মিত হলেও মুশকিল। আবার সেই চশমা আঁকো, সামাদ মিয়ার বউ পাহারা দাও, ভ্রু মোছ- নানান বাহানা। এরচেয়ে ডান কপালে অর্ধেক ভ্রু বরাদ্দ করে কাউকে চক্ষুহীন রাখা সোজা কাজ।
একজন লোকটির নাক আর ঠোঁটের মাঝখানে মোটা করে গোঁফ এঁকে দিল। চওড়া গোঁফ নিয়ে লোকটি শেখ মুজিবের মতো সুপুরুষ হয়ে উঠতেই কে যেন সেটি দু’পাশ থেকে ছেঁটে ছোট করে দিল এবং এই প্রথম টের পেলাম, ছোট গোঁফ আসলে একটা দারুণ ম্যাজিক। হিটলার, আর হাতে গোণা কয়েকজন বাদে আধা-গোঁফওয়ালারা নিতান্তই ভাল মানুষ, বাজি ধরে বলা যায়।
লোকটিকেও আমাদের ভাল মানুষ বলে মনে হল এইবার। এমন মানুষই খুঁজছিলাম।
অবশ্য লোকটিকে ভাল মানুষ বানানোর জন্য এত কিছু আঁকাআঁকির দরকার ছিলনা, হা-করার মতো একটা গাল বানালেই চলত তার।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমি যখন- গোঁফের আমি গোঁফের তুমি ভাবছিলাম, তখন লোকটির হা নড়ে উঠল, শব্দও বেরুল; প্রথমে খ্যাশখ্যাশে, তারপর স্পষ্ট। সে বলল, ‘'পানি খামু।'’ আখিরাতে বিবি ফাতিমা নেকদারদের পানি খাওয়াবে। সবাই ছুটল পানি খোঁজে। জলের দরে পূণ্যের আশা কে না করে? আমরা বেবাক মানুষ মিলে লোকটির পানি খাওয়া দেখলাম। ব্যাপারটা ঠিক জমল না। চক্ষুহীনের পানি পানে আলাদা কোনো বিশেষত্ব নেই।
লোকটা বলল, ‘'ভাত খামু, মাগুর মাছের মাখামাখা ঝোল দিয়া ভাত খামু।'’ লোকটির কথায় এ-ওর গায়ে ঢলে পড়ে সবাই হাসল, বলল, ‘'মাগুরের ঝোল দিয়া কী খাইবা?’'
লোকটি ভাতের জন্য ঘ্যান ঘ্যান করল, মাগুরমাছের কষানো ঝোলের জন্য ঘ্যান করল, শরীর দুর্বল লাগে- বলে ঘ্যান ঘ্যান করল।
- ‘বইতে দিছি, শুইতে চাও?’
- ‘ভাত খাইতে মন চায়।’
- ‘আর কী খাইতে মন চায়? পুলাও খাইবা?’
- ‘শরীল কাহিল লাগে, মাগুরের ঝোল ভাত খাইতে মন চায়।’
- ‘ওরে আমার হাবাজাবা, অই মুখে আর কত খাইবা?’
- ‘ভাত খাইতে মন চায়।’
হা-ওয়ালা প্রাণীদের খাদ্যপ্রীতি আছে জানা কথা, তবে কারো খাই খাই-ই দেখতে ভাল লাগে না। উঠোনে পা মেলে বসে থাকা মানুষের শক্তির দরকারটা কী- আমরা ভেবে পাইনা।
যাহোক, অনেক কথা চালাচালি পরে ভাত আসে। এক থালা ভাত, তার কোণায় চিমটিখানেক নুন, দু'’টো কাঁচামরিচ, আর বেগুন-সীমের চচ্চড়ি আসে কারো বাড়ী থেকে। লোকটি যত্ন করে ভাত মাখে, লবনে ডলে ডলে মরিচ মাখে, আর একটানা কথা বলে যায়। কাঠকয়লায় হা-আঁকা লোকটির- মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে মাখানো ভাতের কথা, অনেক খিদে লাগার কথা, দুর্বল শরীরের কথা শুনে আমাদের হাসি পায়। আমরা শব্দ করে হাসি এবং আরো মজা দেখার আশায় তার দিকে তাকিয়ে থাকি।
একসময় আউশের লাল-মোটা-ভাতে বেগুন-সীমের চচ্চড়ি মাখা দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি এবং আমাদের খুব খিদে পায়। মনে পড়ে অনেকদিন এত আয়েশ করে ভাত মেখে খাওয়া হয়নি আমাদের। আর যেহেতু ভীষণ ক্ষুধার্ত হয়ে উঠি আমরা, সেহেতু আমাদের হাতে গোপনে উঠে আসে ইরেজার এবং গুটি গুটি পায়ে অর্ধেক ভ্রুওয়ালা চোখহীন মানুষটির দিকে এগিয়ে যাই। কে যেন ত্বড়িৎ হাত চালায় লোকটির মুখ বরাবর; তারপর ডানে-বায়ে, উপর আর নীচ থেকে অসংখ্য হাত নেমে আসে সেখানে।
ভাতের কিংবা মাগুরের ঝোলের কথা পুরোপুরি বন্ধ করে আমরা ইরেজারগুলো পকেটে তুলে রাখি।
সেদিন বাড়ী ফেরার পথে আমরা কেউ হরিনাথ ঘোষের ধ্বজভঙ্গ রোগ নিয়ে তামাশা করলাম না। সামাদ মিয়ার বউ কিংবা তার বিশ্বস্ত মাদি কুকুরটিকে নিয়ে টিটকিরি করার কথাও কেমন করে যেন ভুলে রইলাম সবাই। আমরা মনে মনে সেদিন ঢেঁকিছাঁটা লাল-মোটা-আউশ-চালের ভাত সীম-বেগুনের অলৌকিক চচ্চড়ি দিয়ে মাখতে মাখতে ঘরে ফিরলাম।
অনেকদিন পরে জেনেছিলাম- লোকটি পাড়ার বউ-ঝি, ছেলেপুলে, সামাদ মিয়ার মাদি কুকুর, মেঘ মেঘ আকাশ, এক ঝাঁক জালালি-কবুতর, আর করমচা ঝোঁপের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছিপছিপে সুপুরিগাছটিকে দেখতে দেখতে ঝাঁপসা হয়ে উঠেছিল।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ৯:৪০