পথের পাশে সাদা দালান। দালানের কার্নিশ ছুঁয়ে একটা বামন বট- হুমায়ূন আহমেদের বটবৃক্ষ। আমরা বন্ধুরা এই বটতলাতে আড্ডা দিতাম, কেরোসিনের স্টোভে পুড়তে থাকা তিটকূটে চা খেতাম, সিগারেট হাত বদল করতাম, হিন্দি ছবির গান গাইতাম, আর মা-মাসীদের পাহারায় নিউমার্কেটগামী মেয়েদের দেখতাম। আমাদের ছেলেবেলা হঠাৎ কোনো এক ছুটির বন্ধে বটতলায় হাজির হয়। এসব ছুটির দিন বাটার স্যাণ্ডেল পায়ে ঘরে ফেরে। এমন দিনেই বনশাই পুরুষেরা রসাল হয়ে ওঠে, স্বর্ণলতিকারা মনোহারী দোকানে ভীড় বাড়ায়।
আমি যে গ্রামটি ছেড়ে এসেছিলাম, সেটি মফস্বল নাম নিয়ে তখনই জবুথবু দাঁড়িয়ে ছিল; আর এখন তা শহর হয়ে দু’পেয়ে কুকুরের মতো ড্রেনে পড়ে আছে। তবুও একটা পাকুর গাছ, লাল ইটের কোর্ট বিল্ডিং আমাকে একযুগ পেছনে টেনে আনে- যখন সারদা সুন্দরী কলেজের মেয়েরা ক্লাস শেষে- ঘরে ফেরা শুরু করলে- আমরা বটতলামুখী হতাম। সে সময় বেগম রোকেয়ারা বুকে বই চেপে শুকনো মুখে রিক্সা খুঁজতো।
এ শহরে ফিরলে, আমার ছায়া মাড়ানো বিকেল বেলা- দশদিক থেকে ছুটে আসে। পথে মুখোশ পরে কে যেন হালুম কুশল জানায়। আমিও হালুম করি। গলায় মাফলার বাঁধা বুড়ো বাঘ জিজ্ঞেস করে, ‘খুব একটা দেখি না যে! কই থাকো এখন?’ কে কারে কি জিজ্ঞেস করে! আমি বিগলিত কণ্ঠে কোনো এক পায়ুপ্রধান হাভাতে নগরের নাম বলি। মফস্বলের অশিক্ষিত বাঘ- কথার সূতায় ঘুড্ডি ওড়ায়; মাঞ্জাহীন, গীট্টুপ্রধান সূতো; বলে, ‘হাসান তো বাংলামোটরে কাজ করে, চিনো নাকি?’ আমরা বাংলামোটর চিনি, হাসানকেও চেনা চেনা মনে হয়; বলি, ‘বাংলামোটর- মিরপুর থেকে খুব দূরে না!’ কথা আগায়, কাহিনী এগোয় না। বাঘ কাশে, কী বলবে ভেবে পায়না। আমিও ভাবতে থাকি, তারপর দমবন্ধ হয়ে ওঠার আগেই ঘোষনা দেই, ‘তাহলে আবার দেখা হবে!’ বাঘ নড়বড়ে থাবা রাখে আমার কাঁধে, লাজুক ভঙ্গিতে খানিক কাশে, গলা নামিয়ে বেড়াল-কণ্ঠে বলে, ‘সুলতানা তোমাদের কথা খুব বলে।’ আমি ঘড়ি দেখি, হুড তোলা রিক্সার আড়াল থেকে কে যেন আমাদের দেখে, আমি এসব দেখতে দেখতে বলি, ‘দেখি।’ ‘কাল আসো?’ লোকটা আমার হাত ধরে; যেন কবে আসব না জানালে খুলনার পাটকল শ্রমিকেরা আত্মাহুতীর ঘোষনা দিবে। আমি মাহিলা প্রধানমন্ত্রীদের মতো গালে তর্জনী ঠেকিয়ে রাখি, লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, চোখ নাচিয়ে জানতে চায়- কবে আসব? কে এই লোকটা? কে যেন! নামটা পেটে আসে, মনে আসেনা। সুলতানার ছোট মামা, নাকি বড় ভাই? নাকি আজিজ? আজিজ যেন কে? আসব আসব করেও নামটা মনে আসেনা। হয়তো আজিজই; ভাদ্রমাসে গলায় মাফলার প্যাঁচানো বাঘ। নাকি বাংলা মোটরের হাসান! হাসান? হাসান যেন কে?
সেবার কোনো এক চায়ের দোকানে আমাদের আড্ডা খুব জমে, সুলতানাদের বাড়ীতে যাওয়া হয়না। কোথা থেকে খবর পেয়ে পঙ্খীরাজে চড়ে নাইমুল আর অলক হাজির হয়। আমরা হাসি; হাসতে হাসতে খুন করি সুলতানা, কিংবা সুলেখাদের উঠোনে পড়ে থাকা অমল বিকেল, যার ক্ষেত্রফল জ্যামিতিক হারে বেড়ে ওঠছিল আমাদের অদর্শনে।
আরেক ছুটির বন্ধে, যেবার মেঘনায় লঞ্চ ডুবি হয়নি- আমি সুলতানাকে দেখতে যাই। পথে ঠাকুরের দোকানে মিষ্টি কিনি। আধ-খাওয়া সিগারেট রিক্সাওয়ালাকে টানতে দিয়ে কারো উঠোনে তাকাই- কার যেন জাফরান শাড়ী রোদ পোহাচ্ছে; পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়ানো একঝাড় পাতাবাহার, টিনের চালে উঁকি দেয়া নারকেল গাছ, তার গোড়ায় রোদ পোহানো একটা কুচে-মুরগী, পর্দা সরিয়ে জানালায় তাকিয়ে থাকা একটা মুখ- কার মুখ? এমন দুপুরে বেতফল কার জন্য নিরুদ্দিষ্ট তাকিয়ে থাকে?
দরজায় কড়া নাড়ি। রেডিওর অনুরোধের আসরে- অমি, রিমি, সিমি এবং মোহাম্মদ সেকেন্দার আলীর পছন্দের গান বন্ধ করে একজন দরজা খুলে দেয়, ঘুমিয়ে থাকা বেড়ালটা আড়মোড়া ভেঙে পাঁচিল টপকায়, ঘরের ভেতরে কে যেন বেদম কাশি থামিয়ে বলে, ‘কে, কে আসল?’ চৌকাঠে হাত রেখে দাঁড়ানোর ভঙ্গী দেখেই আমি সুলতানাকে চিনে ফেলি। চুলের একপাশে অগোছালো সংসার ঢেকে সুলতানা বলে, ‘একলা যে! বউ কোথায়?’ কেজি দুই আপেল, আর মিষ্টির প্যাকেটে সংসার বৃত্তান্ত চাপা দিয়ে আমি ঘরে ঢুকি; ছিপছিপে কে যেন ছুটে এসে আমাকে সালাম করে, সুলতানা জানায়, ‘বড় মেয়ে’; মাফলার গলায় সেদিনের বুড়ো বাঘটা ধরমর করে উঠে বসে, তারপর গলা উচিয়ে কাকে যেন ডাকে, ‘ও ইমরান, শুনে যা।’ শ্যামলা লিকলিকে এক কিশোর ঘরে ঢোকে, বাঘ কাশতে কাশতে বলে, ‘সালাম কর!’ সুলতানা বলে, ‘কয়েকদিন থেকে জ্বর’ এবং জ্বর প্রমান করতেই হয়তো গলায় মাফলার বাধা বাঘ আবার কাশে, বলে, ‘ও শিলু, চিনো নাকি এনারে?’ মেয়েটি হাসে- যেন সে চেনে, ছেলেটি তাকিয়ে থাকে।
সুলতানা আলমারি খুলে ফুল আঁকা কাঁচের গ্লাস বের করতে করতে বলে, ‘এক্ষুনি আসছি!’ অবিকল মায়ের মতো হাত নেড়ে মেয়েটি বলে, ‘ফ্রিজের পানি আনি? মিতুলের মা বলেছে, লাগলে...’, সুলতানা মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি বাঘের সাথে ছেঁড়া কথা জোড়া লাগাই।
- ‘এদিকে তো আর আসোনা!’
- ‘আসা হয়না।’
- ‘ওরা তোমাদের কথা খুব বলে।’
- ‘ও! জ্বর কতদিন?’
- ‘এইতো!’
- ‘আগের বাড়ীটা বিক্রি করলেন কেন?’
- ‘একটু সমস্যা ছিল।’
- ‘ও!’
- ‘হাসানতো বাংলামোটরে থাকে, চিনো নাকি?’
- ‘বাংলামোটর- মিরপুর থেকে খুব দূরে না!’
ঘুরে ফিরে একই প্রসঙ্গ আসে, কথারা হামাগুড়ি দেয়, বিশ্রাম নেয়, অবসর চায়। এরই ফাঁকে গ্লাস ভর্তি লেবু ঘ্রান নিয়ে সুলতানা দাঁড়ায়; শিলু, এমরান, আর মাফলার জড়ানো বাঘ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। গ্লাস বেয়ে একফোঁটা পানি গড়িয়ে নামে, তৃষ্ণার জল তারপাশেই ধোঁয়াশা জমায়। খুব গরম পড়েছে। সুলতানা পাখা খোঁজে। বাঘের গলায় রাগফোটে, কিংবা একটা কথার লেজ জন্ম নেয়, বলে, ‘এখন পাখাটাও পাওয়া যাবেনা!’ নীল মশারির ভাঁজে, গোটা পাঁচেক বালিশের গোপন আস্তানায়, আর খাটের তলায় খানাতল্লাশি চলে। বেহদিশ হাতপাখা আত্মগোপনে দুপুর পার করে। নাছোড় বাঘ বলে, ‘শিলু দেখতো, মিতুলদের বাড়ীতে কোনো পাখা পাওয়া যায় কিনা?’ মেয়েটি বলে, ‘টেবিল ফ্যান আনি? মিতুলের মা বলেছে, লাগলে...’, বুড়ো বাঘ শিলুর দিকে তাকিয়ে থাকে।
একসময় সাব্যস্ত হয়- দুপুরে খেয়ে যেতে হবে। তুমুল তোড়জোড়ে বাঘ আর এমরান মুরগী শিকারে নামে। শিলু বলে, ‘আম্মা, আদুরীকে না!’ সুলতানা বলে, ‘এটাতো ডিম পারেনা, কুচে!’ রোদে বসে থাকা একটা লাল মুরগী ছটফট দৌড়ে ঘরে ঢোকে, আরেকবার জানালার শিক গলে রাস্তায় ছোটে। শিলু চোখ মোছে, সুলতানা দাঁড়িয়ে থাকে, আমি রাজ্যের অস্বস্তি নিয়ে গরমে ঘামি। একসময় বাঘ মুরগী শিকারে অবসর নিয়ে বাজারে ছোটে, শিলু তি তি করে আদুরীকে ডাকে এবং বোকা পাখিটা কোনো এক কিশোরীর হাতে শেষবারের মতো খুদ-চাল খেতে আসে।
‘সাদিয়া কী করে এখন?’, সুলতানা জিজ্ঞেস করে। আমি সাদিয়ার কথা বলি। সুলতানা আমার অন্যান্য ভাই-বোনের খোঁজ নেয়, বাবা-মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে। ‘সাদিয়া এখনো গান গায়?’ সুলতানার প্রশ্নে আমি হাসি। এসব আরেক জন্মের কথা। সে জন্মে সুলতানাদের ছাদে বিকেলগুলো দ্রুত নিঃশেষ হতো, অতসী গাছের নীচে একেকটা দীর্ঘ দুপুর শুয়োপোকা হয়ে ঘুরে মরতো, আর সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা অর্থহীন ফুটে থাকতো এপাড়ায় ওপাড়ায়। কার বেণীর ফাঁসে কে ঝুলে আছে- সে খবর বুড়ো বাপদের কানে পৌঁছাতে সময় নিত একঝাড় ভাঁটফুলের আয়ুর সমান। আমরা বাঘে-ছোঁয়া বাওয়ালীর মতো পিতাদের ছায়াও স্পর্শ করতাম না হালুমের ভয়ে। সেসব দিনে বাবারা কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতো মাথাহেট করে মাগরিবের নামাজ পড়তে যেত এবং কোনো একদিন বাদজুম্মা মেয়েকে শ্বশুড় বাড়ীতে পাঠিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠত। তেমন দিনেই সুলতানা পালিয়ে বিয়ে করেছিল।
সাদিয়া গান গাইতো বলেই- সুনন্দা আর নাইমূলের প্রসঙ্গ ওঠে। ‘সুনন্দা নাকি মুসলমান হয়ে গেছে!’ সুলতানা কথাটি বলেই মেয়ের দিকে তাকায়, আমি দরজায় ঝুলে থাকা পর্দার দিকে। খুব গোপন যেন প্রসঙ্গটি, আমরা অপ্রস্তুত চেহারায় বাগাডুলির ছক তৈরী করি। কী এসে যায়! আমাদের সব বিশ্বাসের গোড়ায় কুনোব্যাঙ মুতে রাখে বলেই- রোদের দুপুরগুলো স্যাঁতস্যাতে হয়ে যায়; আর সেখানে ব্যাঙের ছাতা জন্ম দিয়ে ঈশ্বর আমাদের আব্রু রক্ষা করেন। বলি, ‘ওদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।’ সুলতানা নিঃশব্দ হাসে এবং ক্ষীণ-দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শিলু মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, আমাদের কথার সুতো আবার ভোকাট্টা হয়। আমি অন্তহীন দুপুরবেলায় কর্পূর হয়ে উবে যাই, ফের ঘনিভূত হই এক জোড়া চোখের সামনে। আমরা কাহিনীর বোঝা ঠেলে ঠেলে দু’ পা হাঁটি, আবার থামি- পেছনের অস্পষ্ট কোনো নামকে সঙ্গী করতে হাসফাস করি। যেন একটা বাদুর ঝুলে আছে বা কানে; আমি কঞ্চি হাতে বাদুর তাড়াই। কলা-বাদুর ডানা ঝাঁপটায়, কান খামচে ঝুলে থাকে- বাংলা মোটরের হাসানের মতো। হাসান আর সুলতানার ছাড়াছাড়ির সংবাদে সুনন্দাও কি নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল? হাসান যেন কে?
বটতলার আড্ডায় যে নারীদের নামে বাজী রাখতাম রাতের ঘুম, গালিবের পংক্তি- সেসব কে তুলে নিয়েছিলো কোচরে, ছুড়ে ফেলেছিল নিতান্ত অবহেলায়? হাসানই বুঝি! নাহলে আজো কেন সে রোদ পোহাবে বামন-বটের নিঃচিহ্ন গ্রামে, সুলতানাদের ঘরে! আমি আরো একবার বাজিতে হেরে যাই এবং সহজেই হাপিয়ে উঠি, বলি, ‘আজ যাই!’ ‘সে কী!’, সুলতানা বলে, ‘বাবা রাগ করবেন।’ আমি বলি, ‘অন্যদিন খাব, আজ যাই।’ সুলতানা তাকিয়ে থাকে, আমিও।
সময় দাঁড়িয়ে থাকে, দু’মুখো নদীর মতো।