ছোটগল্পঃ হেমিংওয়ের বরশি
এক
ফুলহ্যাম স্টেশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় এগারটা বেজে গেল। একটু রাত বাড়লেই এলাকাটা কেমন নিশ্চুপ হয়ে যায়, অচেনা মনে হয়। অথচ এখানে আমি প্রায় প্রতিদিনই আসি। আর্লস কোর্ট অডিটোরিয়ামকে হাতের ডানে রেখে মিনেট বিশেক সোজা হেঁটে গেল ছোট যে স্ট্রিট-মার্কেটটি পড়ে, ওখানে একটি দোকানে কাজ করি আমি; অনেকদিন ধরেই কাজ করছি সেখানে। আমি দিনে ছাত্র, রাতে দোকানী। ক্লাস শেষে নাকে-মুখে কিছু গুজেই ফুলহ্যামে আসতে হয় আমাকে। গ্রীষ্মে, শীতে, আর যে দুই-একদিন লণ্ডনে তুষার পড়ে সে সময়েও আমি ডিস্ট্রিকলাইন ট্রেনের অবধারিত যাত্রী। এই আসা-যাওয়ার পথে কারো কারো মুখ চেনা হয়েছি, কিছু মুখ চিনেছি। হাঁসের সাথে পানির সম্পর্ক যেমন- স্পর্শ করে, কিন্তু কোন দাগ রাখেনা, এ পরিচয়গুলো তেমনই। ব্রাডলি সালটনের সাথে আমার এমনই জলদ আর হংসের সম্পর্ক ছিল।
আমি স্টেশনে ঢুকেই দেখলাম ব্রাডলি দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে, ঝিমুচ্ছে। লক্ষ্য করলাম- স্টেশন মাস্টারের চেয়ারটি ফাঁকা; তার মানে আজ ভিতরে ঢুকতে আধবুড়ো লোকটির কোন সমস্যা হয়নি। আমি ঢিলে হয়ে যাওয়া জুতোর ফিতেয় শক্ত গেড়ো দিতে দিতে তাকে বললাম, 'আজ ভিক্ষের খবর কি?' ব্রাডলি আমার দিকে না তাকিয়েই চোখ বুজে মুখস্ত উত্তর দিল, 'আমি বাস্কার, গান গাই; ভিক্ষে করিনা।'
- 'কোনদিনতো গাইতে শুনলাম না! গীটারে কয়টা তার থাকে জানো?'
- 'গীটারের তার গুনে গাধারা। ওটি তোমার কাজ।'
- 'তারপর?'
- 'আমার স্যাণ্ডউইচ দাও।'
- 'দাম দিতে হবে কিন্তু!'
- 'আমার সামনে পয়সা পয়সা কোরো না, ওটি ছোটলোকদের কাজ।'
- 'খাবারের জন্য রোজ রোজ হাত পাতো, লজ্জা করেনা?'
- 'খুব খিদে পেয়েছে, স্যাণ্ডউইচ দাও। খেতে খেতে পেট পুরে লজ্জা পাওয়া যাবে।'
আমি ব্যাগ থেকে স্যাণ্ডউইচ বের করে ব্রাডলির হাতে দেই, সেটি উল্টে পাল্টে দেখে সে। তারপর চোখ কুচকে কপট রাগের ভান করে বলে, 'মাত্র ঊনিশ পেন্সের স্যাণ্ডউইচ খাওয়াচ্ছো আমাকে?' আমি বলি, 'এই পচা স্যাণ্ডউইচ খেয়েই আল্লাহর কাছে শোকর করো।' আধবুড়ো ইংরেজটা প্যাকেট খুলে স্যাণ্ডউইচে কামড় বসায়। এক কণা চিজ রুটির গুড়োর সাথে মিশে তার বড় বড় গোঁফের সাথে ঝুলে থাকে। ব্রাডলি আমার দিকে কাঙালের মতো তাকিয়ে বলে, 'খিদেতো বেড়ে গেল মনে হচ্ছে!' 'এবার পেট ভরে পানি খাও', আমি সমাধান দেই। 'দেখ না বাপ, আর কিছু খাবার আছে কি-না ব্যাগে?' ব্রাডলি জিজ্ঞেস করে। আমি ডানে বামে মাথা ঝাঁকাই, 'না নেই। আল্লাহ তোমার জন্য ঠিক ঊনিশ পয়সার খাবারই বরাদ্দ রেখেছে আজ।' কাঁচা-পাকা দাড়ি-গোঁফের ফোকর দিয়ে ব্রাডলি বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ওল্টায়, বলে, 'তোমার আল্লাহ খুব কড়া মনে হচ্ছে!' কথা বলতে বলতে সে পাশের পাবে ছুটে যায়। আমি হই হই করি। ব্রাডলি ছুটতে ছুটতে বলে, 'মদ না, পানি খেতে যাচ্ছি।' যে খাবারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে একটু পরেই, সেগুলো দোকান বন্ধ করার আগে নামমাত্র দামে বিক্রি করে সুপার মার্কেটগুলো। মাঝে মাঝে হাতে পয়সা থাকলে তেমনি এক দোকান থেকে ব্রাডলির জন্য আমি খাবার কিনি। একদিন ডাস্টবিনে খাবার খুঁজতে দেখে জোয়ান-মর্দ এই লোককে আমি স্যাণ্ডউইচ কিনে খাইয়েছিলাম, এরপর থেকে আমাকে দেখলেই তার স্যাণ্ডউইচের খাওয়ার সাধ জাগে।
ব্রাডলির সাথে আমার পরিচয় মাস ছয়েকের। কাজ শেষে আমি যখন ঘরে ফেরার ট্রেন ধরি, সেও একই ট্রেনে বাড়ী ফেরে। আমাদের গন্তব্যও একই- হোয়াইটচ্যাপল, পূর্ব লণ্ডনের বাঙালী পাড়া- ব্রিক লেনের গা ঘেষে গড়ে ওঠা বাংলাদেশী অভিবাসীদের বসতি। ব্রাডলি হোয়াইটচ্যাপলকে বলে 'সিলেট'। সে কারো কাছে সিলেট শহরটির নাম শুনেছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে সে তেমন কিছুই জানেনা; জানার কোন আগ্রহও নেই। অবশ্য জগতের কোনো বিষয়ে তার আগ্রহ আছে বলে আমার মনে হয়না। পরিচয়ের প্রথমদিন সে নিজেকে 'বাস্কার' বলে পরিচয় দিয়েছে, যদিও আমি তাকে কোনদিন গান গাইতে শুনিনি। সে ফুলহ্যাম স্টেশনের বাইরে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকে, তারছেঁড়া একটা গিটার, আর একটা টুপি উল্টো করে সামনে পেতে রাখে, আসা-যাওয়ার পথে কেউ কারো খুচরো পয়সা ছুড়ে দেয়ার অপেক্ষায় থাকে। আর রাতে, বাড়ী ফেরার সময় কোনো যাত্রীর কাছ থেকে টিকেট ভিক্ষে চায়। কপাল ভালো হলে টিকেট জোটে, আর না হলে রেলের লোকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে স্টেশনে ঢুকে যায়। আর যেদিন কপাল খুবই খারাপ থাকে, সেদিন পয়সা দিয়ে টিকেট কেনে।
ট্রেন আসার সময় হয়ে যাচ্ছে, ব্রাডলি পাব থেকে ফিরছে না। ব্যাটা নিশ্চয় মদ গিলছে। আমি দ্রুত রাস্তা পার হয়ে মদের দোকানটিতে উঁকি দেই এবং বুঝে যাই- ফুলহ্যামের কথিত বাস্কার সেখানে গোল পাকিয়েছে। আমাকে দেখেই ব্রাডলি ছুটে আসে, বলে, 'বেজন্মাগুলোর মুখে পেচ্ছাব করে দাও। স্টেশনের গেটে জলত্যাগের কাজটি করে ফেলেছি বলে হারামজাদাদের মুখ এখনো শুকনো আছে। বলে কিনা, পয়সা দিয়ে পানি খেতে হবে!' আমি কিছু বলার আগেই পাবের বাউন্সার তাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় বের করে দেয়। ব্রাডলি সিকিউরিটির লোকটির দিকে তেড়ে যায়। আমি পেছন থেকে তার ময়লা জ্যাকেটটি টেনে ধরি, বলি, 'এই বুড়োকালে মারামারি করছো, লজ্জা করেনা!' ব্রাডলি আমার কথায় কান দেয়না, রাস্তা পার হতে হতে পাবের লোকদের গুষ্ঠি উদ্ধার করে। আমি বিরক্ত হই।
একসময় ট্রেন আসে। ব্রাডলি মুখ ভোতা করে ট্রেনে ওঠে, পাতাল রেলের অন্ধকার সুড়ঙ্গের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর ট্রেনটি আর্লস কোর্টে এলে আমরা সেখানে নেমে পড়ি; আপমিনিস্টারের রেলের জন্য আমরা অপেক্ষা করি। কাজ শেষে ঘরে ফেরা পূর্ব লণ্ডনের মানুষেরা ঘুম ঘুম চোখে সাদা রেলগাড়িটির জন্য স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। নানা রং-এর জ্যাকেটের গলা জড়িয়ে টেসকো, সেইন্সবারি, ম্যাকডোনাল্ডসের শার্টগুলো উঁকিমারে। বড় সুপার মার্কেট আর খাবারের দোকানগুলোই লণ্ডনে বিদেশী ছাত্রদের টিকিয়ে রেখেছে।
আমি ব্রাডলিকে বলি, 'ফুলহ্যামে তোমার ভিক্ষে করা এবার বন্ধ হলো।' ব্রাডলি আমার দিকে তাকায়, তারপর বলে, 'শব্দটি ফুল-হ্যাম নয়, ফুল্যাম।' আমি বলি, 'মাঝরাতে ধ্বণীতত্ত্ব শেখাচ্ছ যে!' ব্রাডলি আমার কথায় পাত্তা দেয়না। সে পিঠের জন্মসঙ্গী ব্যাগটিকে ধপাস করে স্টেশনের মেঝেতে ফেলে দিয়ে তার ওপর বসে পড়ে, নোংরা আঙ্গুলে নাক খুঁটে, শব্দ করে থুথু ফেলে এবং এক পর্যায়ে স্টেশনের মেঝেতে চিত হয়ে শুয়ে পড়ে; এরপর কী হয়- দেখার জন্য কেউ কেউ তার দিকে তাকিয়ে থাকে। আবার কয়েকজন কিছুই হয়নি, কিছুই দেখেনি ভাব নিয়ে দেয়ালে সাটানো পোষ্টার পড়ে। আমি ব্রাডলিকে বলি, 'ঢং কোরোনা, পুলিশ আসার আগেই উঠে পড়ো।' ব্রাডলি শুয়ে শুয়েই বলে, 'কারবার দেখো, ছাদ দিয়ে আকাশ ঢেকে দিয়েছে।' ব্রাডলির কথা শুনে কয়েকজন স্টেশনের ছাদের দিকে তাকায়; তারা ছাদ দেখে, না-কি আকাশ খোঁজে- জানিনা, তবে আধবুড়ো লোকটি হো হো করে হেসে উঠলে- দেয়ালের ঘুলঘুলিতে বসে থাকা কয়েকটা পায়রা এদিক ওদিক উড়াল দেয়। আমি বলি, 'অনেক নাটক হয়েছে, এবার ওঠো!' স্টেশনের দু’জন অ্যাটেনডেণ্ট প্লাট ফর্মে কী হচ্ছে এক নজর দেখে যায়। ব্রাডলি শুয়েই থাকে, আমি দাঁত চেপে তাকে বলি, 'এই মূহুর্তে তামাশা বাদ না দিলে- তোমার সাথে আমি আর নেই।' স্যাণ্ডউইচের লোভেই হোক, ত্যাজ্য করার হুমকিতেই হোক, আমার কথা শেষ না হতেই সে উঠে বসে। তারপর, খুব মজা হয়েছে- এমন ভাব নিয়ে বলে, 'তিনটে টুনা মাছ ধরলাম, বিশ্বাস করবে না এত্তো বড় বড়!' ব্রাডলি দুই হাত ছড়িয়ে মাছগুলো কত বড় ছিল দেখায়। আশেপাশের কিছু মানুষ, যারা সবসময় মজা খোঁজে, তাদের একজন জানায়- ব্রাডলির মাছ শিকারের সে প্রত্যক্ষদর্শী। আমি লোকটির ফাজলামোতে অবাক হই, মাঝরাতে পাগল ক্ষ্যাপানোর কোন মানে হয়না।
স্টেশনে গাড়ী এসে দাঁড়িয়েছে। হুড়মুড় করে লোকজন এ কামরায় ও কামরায় উঠে পড়ে, সবারই বসবার জায়গা চাই। শুধু শনিবার রাতে- ক্লাব শেষে ঘরে ফেরা ছেলে-মেয়েদের খালি সীটের লোভ থাকেনা, তারা সঙ্গীদের গায়ে লেপ্টে লণ্ডনের পূর্ব-পশ্চিমে পাড়ি দেয়। যারা ক্লাবের নাচুনেদের খাবার দিতে দিতে হয়রান হয়েছে সারা সন্ধ্যা, তাদের যেন বসতেই হবে কোথাও। প্রবাসের দিনযাপনে এটুকু না পেলে তাদের মন খারাপের পাল্লায় আরেকটু অভিমান যোগ হয়। আমি ব্রাডলিকে টানতে টানতে ট্রেনে উঠি। সে চেচায়, 'এতো তাড়া কিসের?' 'আমি তোমার মতো হোমলেস না, আমার ঘরে ফেরার তাড়া আছে', আমিও গলা ফাটাই।
- 'কারা ঘরে ফেরে জানো?'
- 'যাদের ঘর আছে, যারা তোমার মতো উদবাস্তু না- তারাই ঘরে ফেরে।'
- 'উহু, যাদের মাথার ওপর আকাশ নেই, ছাদ আছে- তারা।'
- 'বুদ্ধিমানদের আকাশ থাকে খোলা মাঠে; আর তোমার মতো উজবুকদের থাকে শোবার বিছানায়।'
আমার কথা শুনে ব্রাডলি হাসে, বলে, 'এইতো কথা ফুটছে!' কথা বলতে বলতেই সে তার বড় বড় নখের ভেতরে আটকে থাকা ময়লা পরিষ্কারে মন দেয়। দৃশ্যটি অরুচিকর। ব্রাডলিকে কয়েকবার কথাটি আমি বলেছি; কিন্তু কে শোনে কার কথা!
লণ্ডনে ব্রাডলির স্থায়ী কোন ঠিকানা নেই; আজ এখানে, কাল ওখানে রাত কাটায়। বেশ কিছুদিন ধরে হোয়াইটচ্যাপেল আণ্ডারগ্রাউণ্ড স্টেশনে ঘুমাচ্ছে। আবহাওয়া খারাপ থাকলে স্টেশনের উল্টো দিকে হাসপাতালের বারান্দায় ঘুমাতে যায়। হাসপাতালের বারান্দা- মরা মানুষ, আর পুলিশদের দখলে থাকে বলে ওখানে শান্তি নেই। একটু ঝামেলা হলেই পুলিশ নাকি ধরে ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠায়। কথাটি শুনে আমি ব্রাডলিকে বলেছিলাম, 'অমন আশ্রয়কেন্দ্রইতো ভালো, থাকা খাওয়ার ঝামেলা নেই!'
- 'ওখানে কারা যায় জানো? যাদের মস্তিষ্কে ঘিলুর বদলে পাকস্থলি আছে- তারা যায়।'
- 'তোমার ঘিলুতো তোমাকে ফুলহ্যামে ভিক্ষে করাচ্ছে, হোয়াইটচ্যাপেলের রাস্তায় ঘুম পাড়াচ্ছে!'
- 'তাতে সমস্যাটা কোথায়? আমি রাণী এলিজাবেথের বংশবদ নই। ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্র ব্রিটেনের রাণী, আর ক্ষুধার্তদের জন্য বানানো হয়েছে; আমি ওখানে শান্তি পাইনা।'
- 'হোমলেসদের ব্যাপার-স্যাপার বেশ উচ্চ-মার্গীয় মনে হচ্ছে!'
আমার কথা শুনে ব্রাডলি হেসে উঠেছিল। তারপর জিজ্ঞেস করেছিল, 'ব্যাংকে তোমার কোনো ঋণ আছে? ক্রেডিট কার্ড আছে?' আমি মাথা নেড়ে- হ্যাঁ বলেছিলাম। লণ্ডনে আসার সময় বাবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন আমার জন্য, কলেজের বেতন যোগানোর জন্য ক্রেডিট কার্ডের টাকা খরচ করেছি। 'তোমার দেনা আরো বাড়বে। তারপর এসবের কারণে একদিন হাসপাতালে ভর্তি হবে', আমার দিকে তাকিয়ে ব্রাডলি আরো বলেছিল, 'তুমি যে হাসপাতালে যাবে আমি তার বারান্দায় নাক ডেকে ঘুমাবো।' জীবনের অনিরাপদ অনুষঙ্গ অনেকের মতো আমিও বাদ দিতে পারিনা। একথা সত্য আমার ঋণ আছে, ভবিষ্যতে তা বাড়তেও পারে। তাই বলে ভিখেরী কিংবা সাধুসন্তের মতো গৃহত্যাগী হতে হবে- একথা আমি মানতে পারিনা। তবে, ব্রাডলির কথা শুনে আমি বেশ চমকে গিয়েছিলাম। তার কথাটিও চট করে ফেলে দেয়া যায়না।
আমি জেনে আশ্চর্য হয়েছিলাম, ব্রাডলি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছে। একটা ব্যাংকে নাকি বছর কয়েক চাকরীও করেছে। উচ্চশিক্ষিত কোনো লোক চাকরী-বাকরী, ঘর-সংসার ছেড়ে স্টেশনে স্টেশনে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে- ব্রাডলিকে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না। অবশ্য ব্রাডলি সংক্রান্ত বিস্ময় কেটে গেছে আমার। রোজ রোজ দেখা হলে অদ্ভুত মানুষেরাও সাধারণ হয়ে ওঠে একদিন।
- 'তুমি ব্যাংকে চাকুরী করতে!'
- 'আরেক জন্মে করতাম; ইউনিভার্সিটি শেষ করেই ব্যাংকের কাজে ঢুকে ছিলাম।'
- 'ছাড়লে কেন?'
- 'ভালো লাগেনি।'
- 'মানে?'
- 'ময়লা টাকা গুনতে গুনতে নিজেকে কুষ্ঠরোগী মনে হতো। চাকুরী করার কোনো মানে হয়না; আর ব্যাংকে কাজ করাতো রীতিমত অপরাধ।'
একসময় ম্যাকডোনাল্ডসে ম্যাক-চিকেন ভাজতে ভাজতে, সুপার মার্কেটের ক্যাশিয়ারের কাজকে স্বপ্নের চাকুরী মনে হয়েছে আমার। আর এই লোক বলে কি-না ব্যাংকে কাজ করা অপরাধ! আমি আমার স্বজনদের ফেলে হাজার মাইল দূরে পড়তে এসেছি- যাতে দেশে ফিরে ভালো কোনো চাকুরী পাই। আমি অবিশ্বাস নিয়ে ব্রাডলির দিকে তাকিয়ে থাকি; বলে কী লোকটা! আমি ঠাট্টা করে বলি, 'অফিস থেকে তোমাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়নিতো?' আমার কথা শুনে ব্রাডলি শরীর দুলিয়ে হাসে, বলে, 'তুমি এসবের বাইরে কিছুই চিন্তা করতে পারো না, তাইনা? তোমার দোষ নেই, অধিকাংশ মানুষই জীবনকে আয়-ব্যয়ের ছকে দেখে শান্তি পায়।'
- 'ব্যাংকের কাজ পছন্দ না হোক, অন্য কাজ করতে?'
- 'দূর, সব কাজই এক, জেনে-শুনে কুষ্ঠরোগী হওয়া আর-কি!'
- 'তাহলে সবাই মিলে ভিক্ষুক হয়ে যাওয়াই ভাল, কি বল! তোমাদের রাণী ওয়েস্টমিনিস্টার স্টেশনে ভিক্ষে করছে, প্রধানমন্ত্রী আর্লস কোর্টে, তুমি ফুলহ্যামে- কী মজা!'
- 'তোমার রসবোধ অত্যন্ত নিম্নমানের, তা জানো?'
এবার শরীর দুলিয়ে আমার হাসার পালা। আমি ব্রাডলির বারোমেসে জ্যাকেটে চাপর দিই, তারপর হাতে ময়লা লেগে গেছে এমন ভাব করে নিজের প্যাণ্টে হাত মুছি। ব্রাডলি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, ঠোঁট কামড়ে ধরে ডানে-বায়ে মাথা নাড়ে, তারপর বলে, 'তুমিও অধিকাংশ মানুষের মতোই মূর্খ।'
ব্রাডলির সাথে আমার পরিচয়ের দিনটি বেশ মজার। শুরুতে তাকে আমি ভয় পেতাম। আমি আশংকায় থাকতাম- এমন নীরব স্টেশনে একলা পেয়ে ব্যাটা হয়তো একদিন ছিনতাই-টিনতাই করবে। অন্ততঃ তার পোশাক আর চেহারা দেখে এমন আশংকা যে কারোরই হতে পারে। কাঁধ অব্দি চুল, পোড়া তামাকে হলদে হওয়া দশাসই গোঁফ, একমুখ কাচা-পাকা দাড়ি, চওড়া কপাল, আর রুক্ষ লালচে মুখ দেখে- আমার মতো যে কেউ তাকে দেখে ভড়কে যেতে পারে। 'শুভ সন্ধ্যা; জনাবের কি হোয়াইটচ্যাপল থাকা হয়?', প্রথমদিন ব্রাডলি ভাববাচ্যে আমাকে সম্বোধন করে কাছে এগিয়ে এসেছিল, আমি ভয় পেয়েছিলাম। আমি পকেটে যা আছে, ইংরেজ দুবৃত্তের হাতে তুলে দেবার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। উজবুকের দল দু'শ বছর আমাদের দেশে ডাকাতি করেছে, এখন ছিনতাই করবে- তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, আমি স্বর্বশান্ত হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলি। লোকটি তার দশাসই ডান হাতটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, 'অধমের নাম ব্রাডলি সালটন। আমি কি আপনার নাম জানতে পারি?' ততোক্ষণে পকেটে থাকা পাঁচ পাউণ্ডের নোটটি আমার হাতে চলে এসেছে; সেটি আমি তার দিকে বাড়িয়ে দিতেই সে বলেছিল, 'জনাব কি আমাকে ভিক্ষুক ভেবেছেন? না-কি আপনার নাম- পাঁচ পাউণ্ড? যাহোক, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। পাঁচ পাউণ্ড নামটি সুন্দর। স্যার, 'ফিফটি সেণ্ট' কি আপনার আত্মীয়?' ব্রাডলির রসিকতা, আর নিজের বোকামীতে সেদিন লজ্জা পেয়েছিলাম; আমতা আমতা করে বলেছিলাম, 'পাঁচ পাউণ্ডের খুচরো হবে?'
এরপরে দেখা হলে আমি তার কুশল জিজ্ঞেস করতাম। সে থেকেই আলাপ। ব্রাডলি কথায় কথায় মজা করে। আমি তাকে ঠেস দিয়ে কথা বলি। ব্রাডলি তাতে মজা পায়, পাল্টা ঠেস মারে, কথার প্যাঁচে ফেলে। ট্রেনে আমরা যখন গল্প করি, আশেপাশের লোকজন তাকিয়ে থাকে, ভাবে এই লাগল বলে! ব্রাডলি আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকা লোকদেরও বোকা বানানোর চেষ্টা করে; বলে, 'ফিফটি সেণ্টকে চেনো? ওই যে, হিপহপ গায়ক; এককালের গ্যাংস্টার', তারপর আমার দিকে ইশারা করে বলে, 'ইনি ফিফটি সেণ্টের বড়ভাই, জনাব ফাইভ কুইড, ওরফে পাঁচ পাউণ্ড।' মাঝরাতে কাজ শেষে ঘরে ফেরা মানুষেরা ফিফটি সেণ্ট, কিংবা পাঁচ পাউণ্ডকে নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না, তারা ট্রেনের মেঝেতে পড়ে থাকা মেট্রো পত্রিকা হাতে তুলে নেয়, পাতা ওল্টায়।
হোয়াইটচ্যাপল আণ্ডারগ্রাইণ্ড থেকে বেরিয়ে আমি ব্রাডলিকে বলি, 'আগামী দু'দিন তোমার স্যাণ্ডউইচ বন্ধ থাকবে।' ব্রাডলি আমার কথা শুনে হায় হায় করে বলে, 'আর্লস কোর্টে তুচ্ছ মাছ ধরার অপরাধে এত বড় শাস্তি দেবে!' ব্রাডলির কথায় নাটকিয়তা থাকে, আর থাকে লাগসই রস। আমি হাসতে হাসতে তাকে জানাই, 'থিসিসের কাজে ব্রাইটন যেতে হবে। ব্রাইটন সী-বিচে আমি যখন আপেল পাতায় লজ্জা লুকানো ইভকে দেখবো, তুমি তখন আর্লস কোর্টে টুনা শিকার কোরো।' আমি ব্রাইটন যাচ্ছি শুনে ব্রাডলির চোখ চকচক করে।
- 'ওটাতো আমার শহর! আমার মা থাকে ওখানে।'
- 'তোমার মতো বুড়ো-দামড়ার আবার মাও আছে!'
- 'কী আশ্চর্য, মা থাকবে না কেন?'
- 'তোমার মা বেঁচে আছে?'
- 'নিশ্চয় আছে।'
- 'সেও কি তোমার মতো স্টেশনের মৎস্য শিকারী?'
- 'আমার মাকে নিয়ে বাজে কথা বলোনা।'
পৃথিবীর সব দেশের মানুষই মা সংক্রান্ত আলোচনায় কিছুটা স্পর্শকাতর। অন্যের মায়ের শ্রাদ্ধ করলেও, নিজের মাকে নিয়ে নিরীহ ঠাট্টাও সহ্য হয়না; এমন কি মায়ে খেদানোদেরও না।
আমি জিজ্ঞেস করি, 'শেষ কবে মাকে দেখেছো?' আমার কথা শুনে ব্রাডলি মাথা চুলকায়, তারপর আস্তে আস্তে বলে, 'বছর দশেক হলো মাকে দেখিনি।' আমি অবাক হই তার কথা শুনে, 'এমন কী রাজকর্ম করছো যে, এক ঘণ্টার পথ পেরিয়ে মাকে দেখে আসা যায়না!' বাক্যবাগিশ মাঝবয়সী লোকটি কী বলবে ভেবে পায়না। আমি তাকে বলি, 'ঠিক এগারটার সময় ভিক্টোরয়া স্টেশনে থেকো, দেরী হয়না যেন, আমি কিন্তু তোমার জন্য অপেক্ষা করব না।' আমার কথা শুনে ব্রাডলি একগাল হাসে, তারপর কাঁধের ব্যাগটিকে মাটিতে ছুড়ে দিয়ে বলে, 'আজ রাতে আমার ঘুম হবেনা।'
দুই
ভিক্টোরিয়া রেল স্টেশনে আমি অপেক্ষা করছি। বেলা এগারটায় ব্রাডলির এখানে থাকার কথা; এখন প্রায় একটা বাজে, অথচ আধবুড়োটার কোন দেখা নেই। আর অপেক্ষা করার মানে হয়না, ছন্নছাড়াটা আসবে না, আমি দক্ষিণমুখী ব্রাইটনের ট্রেনে উঠে বসি। লিভারপুল স্টেশন পেরিয়ে ট্রেনটি ক্রলির পথ ধরে। শীতের প্রস্তুতি নিচ্ছে গাছগুলো, পাতা ঝরা শুরু হয়েছে তাদের। হলদে পাতার ফাঁকে ন্যাড়া ডালগুলো উঁকি দিচ্ছে, ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজছে খামারের গরুগুলো, কয়েকটি ঘোড়া আর একপাল রাজহাঁস। আমি লণ্ডনে এসেছি বছর তিনেক, তবুও এখানকার এই বৃষ্ট এই ঠাণ্ডা আবহাওয়ার সাথে তাল দিতে পারিনা। শার্টের নীচে দুটো গেঞ্জী, উপরে মোটা পুলওভার, তার উপরে ভারী জ্যাকেট চাপিয়েও আমার শীত যায়না; শীতের শুরুতেই আমি ঠক ঠক করে কাঁপি- বিরক্ত লাগে। আসছে গ্রীষ্মের আগেই আমি ডেজারটেশন পেপার জমা দিচ্ছি, লণ্ডনের পাট তাড়াতাড়িই চুকে যাচ্ছে- এ ভাবনাতেই যা একটু উষ্ণতা পাই। ট্রেনটি আরেকটি স্টেশনে থামে, কয়েকজন যাত্রী ট্রেন ছাড়ে, কয়েকটি নতুন মুখ যোগ হয় এ কামরায়। একজন বৃদ্ধ আমার পাশের খালি সীটে বসেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসি, তিনিও হাসি ফিরিয়ে দেন, কিন্তু কোন কথা হয়না। কখনো কখনো মানুষে-মানুষে সম্পর্ক ট্রেনের কামরার সহযাত্রীদের মতো; মুখোমুখি কিংবা পাশাপাশি বসে থাকা, তবুও কিছুই তাদের স্পর্শ করেনা। এদের চোখ পড়ে থাকে হারিয়ে যাওয়া মেঘেরও ওপারে, কিংবা মেঘ ছাড়িয়েও আরো দূরে, ভুল করে ফেলে আসা কারো ঠিকানায়।
ব্রাইটন স্টেশনে নেমেই দেখি ঝুম বৃষ্টি। বুদ্ধিমানেরা বৃষ্টির সাথে ছাতাবাজি করে, ব্যস্তরা বৃষ্টি মাথায় রাস্তায় ছোটে; আমার ছাতা নেই, তাড়াহুড়ো নেই- আমি স্টেশন গেটে দাঁড়িয়ে থাকি। 'এই যে ভদ্রলোক, কয়টা বাজে!, কে একজন আমার কাছে জানতে চায়, না-কি আমার দেরী দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে- বুঝতে পারিনা। আমি ঘড়ি দেখি, তারপর লোকটির মুখের দিকে তাকাই এবং অবাক হয়ে আবিষ্কার করি- আমার সামনে ব্রাডলি দাঁড়িয়ে আছে; ছোট করে চুল ছাঁটা, দাড়ি-গোঁফহীন চকচকে চেহারার মাঝ বয়সী রোগা একজন মানুষ। 'তুমি! এখানে কী করছো?', আমি বিস্ময় চেপে রাখতে পারিনা।
- 'আগে আগে চলে এলাম।'
- 'তাতো দেখতেই পাচ্ছি। কোথায় ধরা খেয়েছিলে, দাড়ি কই?'
- 'ফেলে দিলাম।'
- 'পয়সা পেলে কোথায়?'
'তোমার বুদ্ধি যে নীচু স্তরের, তা তোমার প্রশ্ন শুনলেই বোঝা যায়। খালি পয়সা পয়সা করো! এখন বলো, কেমন লাগছে?', ব্রাডলি আমাকে তার হাতের আঙ্গুলও দেখায়, নখও কেটেছে সে।
- 'শপ-লিফটারদের মতো লাগছে। মনে হচ্ছে, চুরি করে ধরা পড়েছিলে; লোকজন মাথা ন্যাড়া করে ছেড়ে দিয়েছে।'
আমার কথা শুনে ব্রাডলি গলা ফাটিয়ে হাসে; ছাতা মাথায় দেয়া লোকগুলো ঘাড় উঁচু করে আমাদের দেখে, কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি টোকা দেয় তাদের অন্যমনস্ক গালে। হাসি থামলে ব্রাডলি বলে, 'মার কাছে যাচ্ছিনা!' আমি বলি, 'মায়ের কাছে ফিরলেই বুঝি মানুষ হতে হয়?' ব্রাডলির নতুন চেহারা নিয়ে আমি ঠাট্টা করে যাই, সেও আমাকে কথার প্যাঁচে নক-আউট করার চেষ্টা করে। মায়ের কাছে ফেরার উছিলায় কেউ যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে, আমি খুশি হব।
এক সময় বৃষ্টি কমে। 'ইংল্যাণ্ডের বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করলে, সারা জীবন ঘরে বসে থাকতে হবে', কথা বলতে বলতে ব্রাডলি রাস্তায় নেমে পড়ে, সাথে আমিও।
'হঠাৎ মানুষ হওয়ার সুমতি হলো যে!', আমি ব্রাডলিকে জিজ্ঞেস করি। সে একই উত্তর দেয়, 'বললাম না, মার কাছে যাচ্ছি!' আমি আবার বলি, 'খোলস বদলের কারণ কি? তুমি যে আশেপাশে মানুষদের নিয়ে ভাবিত, তা তো মনে হয়না।'
আমরা ব্রাইটন সী-বিচের গা ঘেঁষে হাঁটতে থাকি। এখনো প্যাঁচপ্যাচে বৃষ্টি পড়ছে। সী-বিচ পায়ারটিতে কেউ নেই এখন; শুধু কয়েকজন চায়নিজ না-কি জাপানী সমুদ্রকে পেছনে রেখে, হাসি মুখ আর বুজে থাকা চোখের ছবি তুলছে। আমি ব্রাডলিকে জিজ্ঞেস করি, 'বাড়ীর পথ চেনোতো?' 'মুখস্থ পথ', সে সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়। আমি বলি, 'রাতে ঠিকানা মুখস্থ করেছো বুঝি?' ব্রাডলি সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, 'এ শহরে আমি জন্মেছি, বড় হয়েছি, এর প্রত্যেকটা গলির ল্যাম্পপোষ্ট আমার চেনা। ঐ যে সামনে হোটেলটা দেখছো, ওটার পাশ ঘেঁষে চোখ বন্ধ করে দশ মিনিট হাঁটলেই আমাদের বাড়ী।' ব্রাডলি আবার নিশ্চুপ হয়; আমি রাস্তার পাশে দোকানগুলো দেখি, মাথায় হুড আর হাতে ভারী ব্যাগ নিয়ে ছুটতে থাকা একজন তরুণীকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, দোকানে ঝুলানো বিজ্ঞাপন পড়ি, হঠাৎ করে বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পাইনা।
ব্রাডলির- চোখ বন্ধ করে দশ মিনিট হাটার পথ ফুরিয়েছে অনেক্ষণ, তবুও তার বাড়ীর দেখা পাইনি আমরা। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আর হাঁটতে ইচ্ছে করছেনা। আমি অধৈর্য হই, বলি, 'আর কতদূর?' ব্রাডলি উত্তর দেয়না, আমার কথা শুনতেই যেন পায়নি সে। 'মনে হয় তোমার দশ মনিট আজ আর ফুরোবে না। আমার খিদে পেয়েছে, আর হাটতে পারব না', আমি আবার বলি। ব্রাডলি বলে, 'তুমি খাও।'
- 'তুমি খাবে না?'
- 'খিদে নেই।'
- 'পয়সা নিয়ে ভেবোনা, আমি বিল দেব।'
ব্রাডলি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, 'তুমি টাকা গোনা কুষ্ঠরোগীদের মতো কথা বলছো।' আমি কথা বাড়াই না, খ্যাপার পেছন পেছন হাঁটতে থাকি। সময় পেরোয়, দূরে কোথাও থেকে বিকেল চারটের ঘণ্টা বাজে। আমরা ঘুরে ফিরে একই জায়গায় হাঁটছি। আমি বিরক্ত, ব্রাডলি চুপচাপ। সে একটা বাড়ীর সামনে থামে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাড়ীটাকে দেখে। লাল ইটের দেয়াল, বাড়ির সামনে আগাছা ভরা এক টুকরো বাগান, টালির ছাদের এক কোণায় সাদা চিমনি- এমন বাড়ী সারা ইংল্যাণ্ড জুড়েই ছড়িয়ে আছে। 'তোমার মা কি এখানেই থাকে?' ব্রাডলি ঘাড় নাড়ে, দীর্ঘ বিরতি নিয়ে সংক্ষিপ্ততম উত্তর দেয়, 'না', তারপর আবার হাঁটতে থাকে।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা আবার সমুদ্রের পাড়ে ফিরে আসি। কয়েকজন পথ হারানো ট্যুরিষ্ট সাল্ডিনে কিভাবে যেতে হয়, জিজ্ঞেস করে ব্রাডলিকে। ব্রাডলি চুপ করে থাকে, আমিও। লোকগুলো অজানা কী এক ভাষায় নিজেদের সাথে কথা বলে, সামনে এগিয়ে যায়। ব্রাডলি রাস্তার পাশে জমে থাকা পানিতে থুথু ফেলে, অন্যমনস্ক ভঙ্গীতে মাথা চুলাকায়, নাক খুঁটে। আমি তার দিকে আড়চোখে তাকাই; সে অপ্রস্তুতভাবে হাসে, বলে, 'অভ্যাস।' আমি বলি, 'অভ্যাস না, বদ খাসলত। তোমার চেহারা তেলতেলে করতে পারো, কিন্তু স্বভাবের তেলচিটে ভাব ছাড়তে পারবে না।' আমার কথা শুনে সে আবার শব্দ করে হাসে, তারপর আবার চুপ হয়ে যায়।
বৃষ্টি থেমে গেছে। আসলে এদেশে বৃষ্টি থামেনা, দু'বার ঝরার মাঝে বিরতী নেয় মাত্র। 'না গেলে কেমন হয়?', ব্রাডলি আবার কথা শুরু করে। 'কোথায়?', আমি জিজ্ঞাসা করি। ব্রাডলি নিরুত্তর। আমার কথার উত্তর না দিয়ে সে মনোযোগ দিয়েছে কান পরিস্কারে, কড়ে-আঙ্গুলে অ্যাক্রোব্যাট চালাচ্ছে কানের দুর্গম সুরঙ্গে; আমি না দেখার ভান করি।
- 'বললে না, কোথায় যেতে চাইছো না?'
- 'মার কাছে।'
- 'কেন?'
- 'জানিনা।'
- 'সমস্যাটা কোথায়?'
- 'বছরের পর বছর মাকে দেখিনি। আমি তাকে যখন শেষবার দেখেছিলাম, তখন তার চুলে সবে পাক ধরেছে। আর দেখো, এখন আমারই চুল পেকে গেছে অর্ধেক।'
ব্রাডলি থামে, আকাশের দিকে তাকায়, যেখানে ধূসর মেঘ দল পাকাচ্ছে আবার বর্ষণের। আমি বলি, 'বুড়ো মাকে না দেখেই ফিরে যাবে?' ব্রাডলি বলে, 'আমি যখন ব্যাংকে কাজ করতাম, সে সময় আমার বাবা অসুখে পড়েছিলেন। নানান ধরনের অসুখ ছিল তার। বিছানায় পড়ে থাকতে থাকতে বাবার শরীরে পচন ধরে ছিল। সে সময় পচা মাংশের দুর্গন্ধে আমরা ঘরে ঢুকতে পারতাম না। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়ে ছিল যে, বাবার সামনেই আমাদের প্রতিবেশীরা তার মৃত্যু প্রার্থনা করত; আমিও করতাম। শরীরে অমন পচন নিয়েও বাবা কয়েক বছর বেঁচে ছিলেন। ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ করে মা চুপ করে বাবার পাশে বসে থাকত, প্রতিবেশীদের যন্ত্রণায় সে ওগুলো খোলারও সাহস করত না।' ব্রাডলি কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে শেষ করে নাক কুচকে বাতাসে কী যেন শুকে। আবার ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়। ব্রাডলি হা করে আকাশের দিকে মুখ তুলে রাখে, একটু পরে বলে, 'ওল্ড ম্যান এণ্ড দ্য সি'র সেই বুড়ো সান্তিয়াগোর গল্প জানো?' আমি ব্রাডলির কথার উত্তর দেইনা, সে আবার শুরু করে, 'বুড়ো জেলে সমুদ্রে বরশি ফেলে মাছের জন্য অপেক্ষা করত, অন্তহীন সময় ধরে অপেক্ষা করতেই থাকত; আর ঘুমালে সে স্বপ্ন দেখত সমুদ্র তীরে ঘুরে বেড়ানো সিংহের। আমার মাও বুড়ো সান্তিয়াগোর মতো বাবার বিছানার পাশে বসে বসে ভাবত- আবার একদিন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।' ব্রাডলি থামে, তারপর অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলে উঠে, 'রাস্তায় শুয়ে শুয়ে বৃষ্টির পানি খেয়েছো কখনো?' আমি বলি, 'তারপর?' আমি তার মায়ের কথা শুনতে চাই। ব্রাডলি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, এরপর বা হাতে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গী করে বলে, 'আমি ওই সময়েই বাড়ী ছেড়ে ছিলাম, কাজ ছেড়ে ছিলাম। সবকিছু অর্থহীন মনে হতো তখন। মনে হতো, আমরা সবাই বুড়ো হেমিংওয়ের বরশি হাতে নিয়ে বসে আছি কারো শিয়রে, মৃত্যুর প্রতিক্ষায়।' ব্রাডলি কথা থামায়, ইংলিশ চ্যানেলের নীল পানির দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে, 'আমি কী চাই জানো! চাই, মা বাবার পঁচে যাওয়া শরীরটা নিয়ে বসে থাকুক, আর অপেক্ষা করুক আমার জন্য।' ব্রাডলি গলা নামায়, খুব গোপন কথা বলছে এমন ভঙ্গীতে ফিসফিস করে বলে, 'ফিরে আসার কোনো মানে হয়না, কী বলো!'
একটা গাড়ী আমাদের গায়ে পানি ছিটিয়ে হুস করে বেড়িয়ে যায়, কালো কয়েকটা ছেলে নিতম্বেরও নীচে প্যাণ্টটাকে কোনমতে আটকে রেখে রাস্তা পার হয়, স্কুল শেষে ঘরে ফেরা শিশুরা সবাইকে চমকে দিয়ে ফুটপাতে দৌড়ায়, একজন বৃদ্ধ যাত্রীছাউনিতে বাসের জন্য অপেক্ষা করে, আর আমার সামনে হেমিংওয়ের বরশি হাতে এক মধ্যবয়সী মানুষ আকাশের দিকে মুখ তুলে রাখে, যে ফিরবে বলেও ফিরে আসেনা, যে সামনে সাগর রেখে পথে দাঁড়িয়ে থাকে।
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আত্মপোলব্ধি......
আত্মপোলব্ধি......
একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !
হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।
আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।
আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন