এক
দরজায় ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। আমি তা শুনেও না-শোনার ভান করে থাকি। মগের মুল্লুক নাকি! বুড়ো দাঁড়িয়ে থাকুক বাইরে। বৃষ্টিতে ভিজুক। আজ দশটার আগে কিছুতেই দরজা খুলব না। আমি দ্রুত-হাতে দেয়ালে 'রেসিং পোষ্ট' পত্রিকা টাঙাতে থাকি। গতকালের লটারীর নম্বরগুলো বোর্ডে লিখি। হেড অফিসে ফোন করে আজকের খেলাগুলোর 'অড' জেনে নেই। দরজায় ঠকঠক চলতেই থাকে। আমি বুড়োর দিকে তাকাই, ঘড়ির দিকে ইঙ্গিত করে ইশারায় জানাই- এখনো দোকান খুলতে অনেক সময় বাকি। কিন্তু কে শোনে কার কথা! বুড়ো হাতের লাঠি দিয়ে দরজার কাঁচে ঠকঠক করতেই থাকে; আমাকে দরজা খুলতে বাধ্য করেই ছাড়বে আরকি!
'ভাগো এখান থেকে', আমি ঝটকা মেরে দরজা খুলে বুড়োকে কুকুর-তাড়া করি। বুড়ো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবার ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দেই। বুড়ো লাঠিতে ভর দিয়ে কিছুক্ষণ সেকেণ্ড-ব্রাকেট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এক পা কবরে রেখে জুয়ার দোকানের সামনে বুড়ো অপেক্ষা করে।
আবার ঠকঠক শব্দ ওঠে দরজায়। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা অসহ্য বুড়োটিকে ভস্ম করে দেবার মতো অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করি। অন্য যে কেউ হলে এতক্ষণে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যেত। কিন্তু আমাকে জ্বালাবে বলেই বুড়ো বাইরে পিনপিনে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। ঠকঠক শব্দের তালেই আমি বেটিং স্লিপ আর নীল বামনাকৃতির বলপয়েন্ট কলম টেবিলে সাজাতে শুরু করি। সব কাজ শেষ হলে দোকানের টিভিপ্যানেল অন করে কফিতে চুমুক দেই; বাইরে তাকাই। মানুষের মাথায় ছাতা, হাতের দড়িতে বেঁধে রাখা কুকুর, তরুনীর মাথায় হুড তোলা জ্যাকেট, পাশের মদের দোকানের কারাওকির বিজ্ঞাপন, আর আমার নাছোড় বুড়ো বৃষ্টিতে ভিজছে। লণ্ডনের বৃষ্টি- বিমর্ষ আকাশের বিরক্তিকর পানি-বর্ষন।
বুড়োকে ভস্ম করে দেবার সামান্য আগে, কিংবা ঠিক দশটায় আমি দোকানের দরজা খুলে দেই। বুড়ো দোকানে ঢোকে, বৃষ্টির সাথে যৌন-সম্পর্কিত একটা গালি দেয়। এ শহরের সবাই এ ভাবেই কথা বলে। খুব ভাল, কিংবা খুব খারাপ, অথবা ভাল-খারাপ কিছুই না- এমন কিছু বোঝাতে, যৌনকার্য কথাটির কোন বিকল্প নেই। শুধু বিশেষণ আর ক্রিয়াপদ হিসেবেই না, অব্যয় হিসেবেও এটিকে ব্যবহার করা যেতে পারে।
'শুকরিয়া', বুড়ো আমাকে সুপ্রভাত জানায়। আমি খেকিয়ে উঠি, বলি, 'আমি ইণ্ডিয়ান না।'
- 'তোমরা কি বল তাহলে?'
- 'তা জেনে তোমার কি! জুয়ার দোকানে ভাষা-সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা না করলেই প্রীত হব। আর আমার সামনে শুকরিয়া শব্দটা উচ্চারণ করবে না। মনে থাকবে?'
- 'গুড মর্নিং-কে তোমাদের ভাষায় শুকরিয়া বলেনা!'
- 'না, বলেনা।'
- 'তাহলে কি বলে?'
- 'আমরা কি বলি সেটি তোমার জানার দরকার নেই। এই দোকান দশটায় খোলে, প্রতিদিন দরজায় গুতিয়ে বিরক্ত করবার মানে কি? আর তোমার গায়ের দুর্গন্ধে মানুষ মারা যাবে; তোমার মতো হেলথ হ্যাজার্ড কাস্টমার আমি চাইনা। আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছ?'
- 'কি আশ্চর্য, তোমরা শুকরিয়া বলোনা!'
- 'দেখো, কথা ঘুরাবে না। এরপর যদি অসময়ে বিরক্ত কর, তোমাকে দোকানে ঢুকতে দেয়া হবেনা। কথাটা মনে রেখো।'
বুড়োকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমি নিজের ডেস্কে ফিরে আসি। মাস খানেক হলো বুড়োকে আমি দেখছি। আগে কোন বেটিং শপে সময় কাটাত কে জানে! নাকি জুয়া খেলার নেশাটা মাথায় নতুন চেপেছে বুড়োর?
প্রথম দিন বুড়োর মুখে 'শুকরিয়া' শব্দটি শুনে অবাক হয়েছিলাম। পূর্ব লন্ডনে ছোটখাট বাংলা শব্দ অনেকেই জানে। 'ভাইছাব, পাউন্ডে দুই বক্স', 'আফা, হালাল চিকেন'- লণ্ডনের বাঙ্গালী পাড়ায় ফুটপাথের বাজারে ইংরেজরা দোকানে খদ্দের টানতে বাংলা শব্দের তুবড়ি ফোটায়। এমন কি হাসপাতালের লিফটে মৃদু নারী কণ্ঠের রেকর্ড সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় বলে, 'দোতালায় উঠুনের লাগি দুই নম্বর বাটনে চাপ দিউক্কা।' আমি ভেবেছিলাম, বুড়োর শুকরিয়া শব্দটি পূর্ব লণ্ডনজাত এবং আমাকে খুশি করবার জন্য নিঃসৃত। প্রথম কয়েকদিন খুশি হলেও, বুড়োর জ্বালাতনে আমার বিরক্ত হয়ে উঠতে সময় লাগেনা। আমার ধারনা ছিল, বুড়ো হয়ত আরো দু' চারটে বাংলা কি হিন্দী শব্দ বলে আমাকে বিমোহিত করার চেষ্টা করবে। আমার কপাল ভাল ছিল যে, সে শুধু শুকরিয়া শব্দটির মধ্যেই আটকা ছিল।
লণ্ডন শহরের অলিতে-গলিতে মদ আর জুয়ার দোকান। মদ খেয়ে মাতাল হওয়ার আগে জুয়ার দোকানে ঢোক, আর জুয়ায় হারার দুঃখ ভুলতে খিস্তি করতে করতে মদের দোকানে চালান হও। সারাদিন-রাত কিছু মানুষ আছে এটা নিয়ে। আবার কেউ কেউ, যারা হালাল মাংশ ছাড়া জীবনকে অচল ভাবে, আর মদখোরদের দু'বেলা নরকে পাঠায়, তারাও আসে জুয়া খেলতে। ঘোড়া দৌড়ায়; কুকুর দৌড়ায়; চেলসি আর আর্সেনালের বাইশজন খেলোয়ার একটা বল নিয়ে কামড়া-কামড়ি করে; রজার ফেদেরার টেনিস খেলার ফাঁকে তোয়ালেতে মুখ মোছে; আমার হাতে বেটিং স্লিপ জমা হয়, বাক্সে টাকার স্তুপ বাড়ে; আর শ্বাসের রোগীদের মতো বুড়ো জুয়াড়ীরা 'কাম অন মাই বয়, কাম অন মাই বয়' করতে করতে সর্বশান্ত হয়।
দোকানে জুয়ারিরা আসতে শুরু করেছে। 'প্রথম রেসের ফেভারিট কে?' কে যেন জানতে চায়। আমি উত্তর দেবার আগেই পাশ থেকে কেউ একজন জানায়, 'ডেজার্ট রোজ।' প্রথমজন আবার জিজ্ঞেস করে, 'অড কত?' এক টাকা বাজি ধরলে কতটাকা জেতা যাবে, আমি তাকে জানাই। মরু গোলাপ, শেয়াল নারী, ঘোড়ামাছ, সুলতান, কালা জাদু- এইসব হেজিপেজি কিংবা কিমাশ্চর্যম নামের ঘোড়াগুলোর ওপর লোকজন বাজি ধরতে থাকে।
'তোমার মনে হয় কোন ঘোড়াটা জিতবে?' কে যেন আমাকে প্রশ্ন করে। আমি কাউণ্টারের জুয়াড়ী-জটলায় চোখ রাখি। অসময়ে এসে দরজা-গুতানো বুড়ো আমার দিকে তাকিয়ে আছে, প্রশ্নের উত্তর চাইছে। আমি বুড়োর দিকে আঙ্গুল দিয়ে দু'বার দেখাই, তারপর বলি, 'দৌড়াতে পারলে তুমিই জিততে।' জুয়াড়ীদের ভিড়ে হাসি ওঠে। সাতসকালেই যাদের গায়ের কম দামী মদের গন্ধে এলাহী অবস্থা, তারা হেসে কুটিপাটি হয়। বুড়োও শব্দ করে হেসে ওঠে, যেন এমন মজার কথা সে আর শোনে নি।
একসময় বাজি ধরার শেষ সময়ের সংকেত বাজে। ঘোড়দৌড় শুরুর অপেক্ষায় জুয়াড়ীরা হাত কচলায়, আঙ্গুল মটকে কেউ কেউ আড়মোড়া ভাঙ্গে, যেন ঘোড়ার সাথে সাথে তাদেরও দৌড়াতে হবে এমাথা-ওমাথা।
'আমি কুইনের নামে বাজি ধরতে চাই', বুড়ো কোন ঘোড়ার নামে কত টাকার বাজি খেলবে একটা কাগজে লিখে আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়।
- 'বাজি ধরার সময় শেষ হয়ে গেছে।'
- 'তাই নাকি!'
- আমি লক্ষ্য করেছি, সময় শেষ হওয়ার পরে তুমি বাজি ধরতে আস। জ্বালাতন করার জন্যই তুমি এসব কর নাকি?'
আমার কথা শুনে বুড়ো একটু অপ্রস্তুত হয়। তারপর শেষ হয়ে যাওয়া সময়ের নামে বিড়বিড় করে গালি দেয়। আর একটু পরেই রেসের ঘোড়াগুলো দৌড়াতে শুরু করে। ব্লাক ম্যাজিক নামের ঘোড়াটা শুরুতেই সবাইকে ছেড়ে এগিয়ে যায়। যারা কালো এই ঘোড়াটার নামে বাজি ধরেছে, তারা 'কাম অন মাই বয়, কাম অন' বলে চিৎকার করতে থাকে। অন্য জুয়াড়ীরা টেবিলে দমাদম ঘুষি মেরে তাদের বাজির প্রাণীগুলোকে তাড়া করে; যেন ছোট এই জুয়ার দোকান থেকে ইয়র্কশায়ারে দৌড়ানো ঘোড়াগুলো উৎসাহ পাচ্ছে দৌড়ে। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বুড়ো বলে, 'ব্লাক ম্যাজিক পারবেনা আজ; ও শুরুতেই সব শক্তি নষ্ট করে ফেলেছে।' আমি না শোনার ভান করে টেলিভিশনে ঘোড়ার দৌড় দেখি। যে ঘোড়াই জিতুক, আমার কিছু এসে যায় না।
সত্যি সত্যি ব্লাক ম্যাজিক পিছিয়ে পড়ে, ডেজার্ট রোজ এগিয়ে যায়। ব্লাক ম্যাজিকের বাজিকররা গলা ফাটায়। ডেজার্ট রোজের জুয়ারিদের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। হাতে ধরে রাখা বেটিং স্লিপের কোমর টিপে ধরে সি-হর্সের জুয়াড়ীরা গলার রগ ফুলিয়ে, 'সি-হর্স, সি-হর্স' শ্লোগান তুলে। জুয়াড়ীদের দিকে তাকিয়ে বুড়ো বলে, 'ডেজার্ট রোজও পারবে না।' আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, বুড়োকে ধমক দেই, 'তাতে তোমার কি? তুমি তো আর খেলছো না!' বুড়োর মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়না।
দেখতে দেখতে সি-হর্স নামের ঘোড়াটাকে পেছনে ফেলে দেয় কুইন নামের ঘোটকী। সি-হর্স আর ডেজার্ট রোজ গলায় গলায় দৌড়ে চলে। আমি বুড়োর দিকে তাকাই। বুড়ো আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচায়, 'কি, বলেছিলাম না!' বুড়ো পাত্তা পাবে ভেবে আমি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি। দৌড় জমে উঠেছে। সি-হর্স, ডেজার্ট রোজ আর কুইন সমানে সমানে দৌড়াচ্ছে। ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা জকিরা যেন পঙ্খীরাজে উড়ছে। জুয়াড়ীদের চিৎকার দ্বিগুন হয়ে রাস্তার মানুষদেরও দোকানে টেনে আনে। উত্তেজনায় কেউ কেউ বসে পড়ে; মাথার চুল খামচে ধরে কেউ বাকরুদ্ধ হয়; কেউ একজন কোনো এক ঘোড়ার নামে অশ্লীল গালি দেয়; এক বৃদ্ধ এক তরুনের কাঁধ খামচে ধরে; কেউ একজন জুয়ার ঘরে বেমানান স্বরে ঈশ্বরকে ডাকে; একবৃদ্ধা কাকে যেন বেজন্মা বলে গালি দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে যায়; সি-হর্স দৌড়ায়, দৌড়ায় আরো পাঁচটি ঘোড়া, অদ্ভুত অদ্ভুত নামে যারা বাজিকরদের হৃৎপিণ্ড নাচায়।
দৌড় শেষ হয়। সবাইকে অবাক করে দিয়ে নতুন দৌড়াতে আসা ফক্সি-লেডি নামের ঘোড়াটি জিতে যায়। দোকানের সিলিং-এ বেটিং স্লিপ ওড়ে, মেঝেতে জমে ছেঁড়া কাগজের পাহাড়। বাজিতে হারা বাজিকরদের শেষ আক্রোশ জমে জুয়ার খেলার কাগজে।
আমি বুড়োর দিকে তাকাই, এবার আমি চোখ নাচাই। বুড়ো আমার দিকে তাকিয়ে হাসে, বলে, 'একটু কফি খাওয়াও।' আমি চোখ সরু করে বৃদ্ধ মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকি।
দুই
কয়েকদিন হলো আমি বুড়োকে দোকানের ভেতর ঢুকতে দিচ্ছিনা। বুড়োর গায়ের বিকট দুর্গন্ধে শুধু আমারই না, মাতাল খদ্দেরদেরও ত্রাহি অবস্থা। বুড়ো তারপরও আসে; আগের মতো দোকান খোলার আগেই এসে হাজির হয়; আমাকে শুকরিয়া বলে সুপ্রভাত জানায়। দরজা খোলার সময়টুকু আমি দম আটকে রাখি। লণ্ডনের প্যাঁচপ্যাচে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বুড়ো দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে, দরজার ফাঁকে চোখ রেখে ভেতরের মানুষদের দেখে। যারা বুড়োর পরিচিত তারা তাকে বাড়ীতে থাকার পরামর্শ দেয়। আর যারা তাকে চেনে না, তাদের কেউ কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেছে- বুড়োকে কেন ভেতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছেনা। আমি বুড়োর ভয়াবহ দুর্গন্ধ আর ঘাড়ত্যাড়া বদ-খাসলতের বিশদ বিবরণ দেই; লোকজন মাথা ঝাঁকায়, আর চেহারায় 'এ ছাড়া আর কি করার আছে' ভাব ফুটিয়ে রাখে। ঘোড়া কি কুকুরের দৌড় শুরু হলে সবাই হয়ত বুড়োকে ভুলে যায়। আমার ডেস্কের উল্টো দিকে দোকানের দরজাটা বলে- বুড়োকে আমি ভুলতে পারিনা; আমাকে জ্বালানোর জন্যই যেন বুড়ো সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে।
দরজায় খট খট শব্দ ওঠে। আমি বিরক্ত হয়ে বাইরে তাকাই, দোকানের ভেতরের লোকগুলোও তাকায়- বুড়ো লাঠি দিয়ে দরজা গুতাচ্ছে। চোখের দিকে তাকাতেই বুড়ো হাত দিয়ে চা খাওয়ার ভঙ্গি করে। কেউ একজন বলে, 'বুড়ো চা-টা কিছু চাইছে।' লণ্ডনের সব জুয়ার দোকানেই জুয়াড়ীদের মাগনা কফি খাওয়ানোর ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু তা নিতান্তই বাছাই করা খদ্দেরদের জন্য। আমি অনিচ্ছা সত্বেও বুড়োর জন্য কফি বানাই। ঠাণ্ডা পানিতে দুধ-চিনি ছাড়া তিতকূটে কিছু একটা বানিয়ে বুড়োর হাতে ধরিয়ে দেই। বুড়ো বলে, 'শুকরিয়া।' আমি ঝাঁঝিয়ে উঠি, 'তোমাকে না শুকরিয়া বলতে বারণ করেছি?' বুড়ো কফিতে ছোট একটা চুমুক দেয়। আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি।
- 'কফির জন্য ধন্যবাদ।'
- 'বৃষ্টিতে না ভিজে, বাড়ীতে থাকলেইতো পারো!'
- 'বাড়ীতে থাকলে কেমন যেন অস্থির লাগে; ভাল লাগেনা।'
- 'তোমার সাথে আমি বাজে ব্যবহার করি, যাতে তুমি এখানে আর না আস। এই সামান্য বিষয়টা কি তুমি বুঝতে পারো?'
- 'কে বলল তুমি বাজে ব্যবহার কর? এইতো কফি দিলে! আচ্ছা, থ্যাংক ইউ-কে তোমরা কি বল?'
এই বৃদ্ধের মতো এমন বেশরম মানুষ আমি আর দেখিনি। আমি একদৃষ্টে বুড়োকে দেখি, চোয়াল শক্ত করে রাখি। বৃদ্ধের কোন ভাবান্তর নেই।
'এর আগে এক জুয়ার দোকানে আমাকে মেরেছিল। তোমরা তো আমাকে মারো-নি, শুধু দোকানে ঢুকতে নিষেধ করেছ।' বুড়োর একথার কি জবাব হতে পারে আমি খুঁজে পাইনা; বলি, 'কাল থেকে দোকানে আগে আগে এসে যদি ঝামেলা না কর, আর গায়ের দুর্গন্ধ যদি না থাকে, তবে ভেতরে আসতে দেব। এখন বাড়ী যাও।' বুড়ো আমার কথা শুনে আকর্ণ হাসি ছড়ায়। তার ফোকলা মাড়িতে ক্ষয়ে যাওয়া কয়েকটি দাঁত কোন রকমে ঝুলে আছে। বুড়ো আমাকে বলে, 'শুকরিয়া।' আমি কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। ভেতরে জুয়াড়ীদের চিৎকার শুরু হয়। বুড়ো হাতের লাঠি শক্ত করে ধরে, কাগজের কাপ উল্টে বুড়োর গায়ে কফি ছলকে পড়ে। কিন্তু বৃদ্ধ বিকারহীন, ভেতরে কি হচ্ছে তা দেখায় ব্যস্ত।
'গিভ মি সেভেন, গেভ মি সেভেন' বলে কে যেন চেচায়। আজকের লটারীর বিজয়ী নম্বর ঘোষনা হচ্ছে টিভিতে। ইশারায় একজন ক্রস আঁকে শরীরে; মহিলাদের কেউ কেউ আঙ্গুলের মধ্যমাকে তর্জনী দিয়ে পেঁচিয়ে সৌভাগ্য চিহ্ন বানায়। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বুড়ো দরজার ফাঁক দিয়ে গলা বাড়িয়ে দেয় জুয়ার ঘরে। আমি দেখি, বুড়ো স্থির তাকিয়ে আছে ভেতরের বাজিকরদের মুখের দিকে।
তিন
এরপর থেকে বুড়োর আর দেখা নেই। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। কিন্তু বুড়োকে মাথা থেকে তাড়াতে পারিনা। দরজা খুলে কেউ ঢুকলেই আমি তাকাই। কোথাও খুঁট করে শব্দ হলেও আমার চোখ দরজায় আটকে যায়।
আমার পরিচিত এক রোগীর খোঁজ নিতে যেদিন রয়েল লণ্ডন হসপিটালে গেলাম, সেদিন আবার বুড়োর সাথে দেখা হাসপাতালের গেটে। সে হুইল চেয়ারে বসে আছে। আমাকে দেখেই বুড়ো হাসে। আকর্ণ বিস্তৃত হাসি। তারপর ফ্যাসফেসে গলায় বলে, 'শুকরিয়া।' আমিও হাসি, বলি, 'মনে আছে, শুকরিয়া বলা যাবেনা!'
'আমি কিন্তু তোমার কাস্টমার না এখন', বুড়ো জোরে হেসে ওঠে, যেন খুব মজার কথা বলেছে।
'কি হয়েছে তোমার, হুইল চেয়ারে এমন হাড়গোড় হয়ে বসে আছো কেন?' আমিও বুড়োর সাথে মজা করি।
'বুড়ো হলে যা হয় আরকি!' বুড়ো রগওঠা হাতের তালুতে বুক ঘষে। তার হাসি থামেনা। হাসপাতালে আসলে হাসির ব্যারাম হয় না-কি! বুড়োকে দেখে আমার ভাল লাগে।
'আমি ভাবলাম তোমার অভিমান হয়েছে, তাই জুয়া খেলা বাদ দিয়ে সন্ন্যাস নিয়েছ।' আমার কথা শুনে বুড়ো হাহহা করে হেসে ওঠে; বলে,
'আমি জুয়া খেলতাম নাকি? মাঝে মাঝে যে দুই-এক পাউণ্ডের বাজি ধরতাম, তা তোমাকে ভোলানোর জন্যই; যাতে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে দোকান থেকে বের না করে দাও।' খুব চালাকি করা হয়েছে, এমন ভাবে আড়চোখে বুড়ো আমার দিকে তাকায়।
'জুয়াড়ী হতে হলে কিপ্টেমি চলেনা, তা জানতো?' আমি বুড়োকে খোটা দেই। যে জুয়াড়ী জুয়া খেলতে এসে দিনে মাত্র দুই পাউণ্ড খরচ করে তাকে পছন্দ করার কোন কারণ নেই আমার। এদের পয়সা থেকেই আমার বেতন হয়, আমার বিগ বসদের মার্সিডিস চলে। বুড়ো আমার কথার উত্তর দেয়না। রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে, এর-ওর আসা-যাওয়া দেখে; তারপর বলে, 'জুয়াড়ীদের কথা খুব মনে পড়ে।' আমি বুড়োর দিকে তাকাই, তার কথা বুঝতে পারিনি। যতদূর মনে পড়ে, বুড়োর কোন বন্ধু ছিলনা। বৃদ্ধ সাদা হয়ে যাওয়া বুকের-রোমে আবার হাত ঘষে।
- 'তুমি কি রেসের সময় জুয়াড়ীদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছ কখনো? ওদের হাতের আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে দেখেছ?'
- 'আধ্যাত্মিক আলোচনা শুরু করবে না-কি?'
- 'দীর্ঘদিন আমি কোন নেশা করিনি। কিন্তু এখন মনে হয়, আমি সবসময়ই প্রচণ্ড নেশাগ্রস্ত একজন মানুষ।'
বুড়োর কথা শুনে কী মন্তব্য করা উচিত আমি বুঝিনা, তার দিকে তাকিয়ে থাকি। বুড়ো থামে; দম নেয়; রাস্তার মানুষ দেখে। তারপর আবার শুরু করে, 'তোমাদের জুয়ার দোকানগুলোতে যাই জুয়ার নেশা থেকে নয়। অন্যকোন নেশার জন্য। এই হাসপাতালে এসে আমি টের পেয়েছি, তাড়িয়ে দেবার পরেও কেন তোমার দোকানের সামনে আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম। বৃষ্টিতে ভিজে নিউমোনিয়া হলেও, কেন আমি হ্যাংলা কুকুরের মতো দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কেন জান?' আমি চুপ করে থাকি। বুড়ো আমার দিকে তাকিয়ে থাকে; তারপর বলে, 'নেশা।'
নেশা শব্দটি দীর্ঘ এক বাক্য হয়ে বুড়োর চোখে ঝুলে থাকে। চিতল মাছের আঁশটের মতো তার চোখ জ্বলজ্বল করে। তারপর আবার শুরু করে, 'জুয়াড়ীদের চিৎকারে যখন গলার রগ ফুলে ওঠে, হাতের আঙ্গুলগুলো যখন তালু কেটে বসে যায়, বেটিং স্লিপগুলো যখন বাতাসে ভাসে, দপ করে নিভে যাওয়া চোখে যখন হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠে, মানুষগুলো যখন ভাসতে ভাসতে টুপ করে তলিয়ে যায়- তখন প্রাণের প্রকট নিরুত্তাপ আর প্রচণ্ড আগুন আমাকে মাতাল করে। কেউ দূর দূর করে তাড়ালেই আমার নেশা কাটে না।' বুড়ো থামে। হাপায়। আমি চুপ করে বুড়োর কথা শুনে যাই। এরপর কথা না-বলা-সময় দীর্ঘতর মনে হলে, আমি বলি, 'সুস্থ হলে দোকানে এসো।' আমার কথায় বুড়ো হাসে, মাথা ঝাঁকায়, বলে, 'তুমি না বললেও যাব।' আমি বুড়োর দিকে দিকে তাকিয়ে অবাক হওয়ার ভান করি, বলি, 'নাছোড় বান্দা!' বুড়ো তাড়াতাড়ি আমাকে শুধরে দেয়, বলে, 'নেশাগ্রস্ত।' তারপর অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলে, 'গুড মর্নিং-কে তোমরা কি বল? আমি অনেক চেষ্টা করেছি মনে করতে, পারিনি।'
- 'মানে বলতে চাইছো, তুমি এক সময় জানতে আমরা বাংলায় কি বলি?'
- 'তোমাদের অনেক শব্দই আমি জানতাম। মনে আছে, কাউকে পছন্দ না হলে, তাকে তোমরা শালা বলে গালি দাও।'
আমি বুড়োর কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠি। জিজ্ঞেস করি, 'বাংলা শিখলে কোথায়?' 'আমি তোমাদের দেশে মাসখানেক ছিলাম। রেডক্রস থেকে আমাকে ওখানে পাঠিয়ে ছিল', বুড়ো উত্তর দেয়। আমি অবাক হই; এ কারনেই বুড়ো এত শুকরিয়া শুকরিয়া করে! বুড়ো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে একমূহুর্ত, বলে, 'তোমাদের দেশের একটি ছেলেকে আমি দত্তক নিয়ে ছিলাম।' দত্তক কথাটা শুনলেই আমি কুকরে যাই। আমি আমার বাবা-মাকে দেখিনি, অন্যের বাড়ীতে মানুষ হয়েছি। আমি বুড়োকে জিজ্ঞেস করি, 'তোমার সেই ছেলে কোথায়?' বুড়ো বলে, 'ছেলেটিকে এদেশে আনার বছর দুয়েক পরেই আমি এলকোহলিক হয়ে পড়ি; বউয়ের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তখন ছেলেটিকে অন্য ফস্টার প্যারেণ্ট নিয়ে নেয়। তারপর থেকে ছেলেটি সম্পর্কে আর কিছুই জানিনা।'
বুড়ো আমার দিকে ঘোলা চোখে তাকিয়ে থাকে। কি দেখছে বুড়ো? আমার চিবুকের কাটা দাগ? আমি অস্বস্তিতে পড়ে যাই; বারবার ঘড়ি দেখি। তারপর বুড়োকে শুকরিয়া বলার সুযোগ না-দিয়েই 'উঠি' বলে পথে পা বাড়াই; পেছনে ফিরেও চাইনা। মানুষের নেশাগ্রস্ত চোখ দেখলেই আমি বিব্রত হই।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০০৮ সকাল ১০:৫১