সকালের অলস ঘুম চোখে নিয়ে এগাঁয়ের মানুষেরা যখন জেগে ওঠে- তখন গগন শিরিষের গাছ দু'টোতে পাখিদের হুটোপুটি, কিচির-মিচির কিংবা আমপারা পাঠের জমাট আসর। বাঁশঝোপের আঁড়াল ঘেঁষে পানাপুকুরে নতুন বৌ-ঝিদের প্রাতঃস্নান, রাস্তার পাশে শুকাতে দেয়া টিয়া রঙের শাড়ী, আর ভেঁজা পাটের গন্ধ পার হলেই পায়েচলা সরুপথ- এ গ্রাম ছেড়ে বেড়িয়ে গেছে আধপাকা ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে। সে আঁকা-বাঁকা পথ ধরে কিছুদূর হাঁটলে ভূঁইফোঁড় রোগা কয়েকটি বাবলা গাছ দৃষ্টিপথ আটকে দাঁড়ায়। ওখানে চাষের মৌসুমে খড়ের বেনীতে পিনপিনে আগুন জ্বলে, ক্ষেতে কাজ করা পুরুষেরা দু'দন্ড বিশ্রাম নেয়, আর তামাক টানে। এখান থেকেই দিগন্তরেখায় মিশে যাওয়া জংলা ভিটাটি চোখে পড়ে, এ গাঁয়ের মানুষেরা যাকে দেখেও-দেখেনা; এড়িয়ে চলে। শুধু ঘুমাতে দেরী করা শিশুদের ভয় দেখানো ছাড়া ওটিতে তাদের কোন প্রয়োজন নেই- দরকার পড়েনি। অদরকারের জঙ্গলে ফনিমনসা-তেতুল-চালতা কিংবা সেগুনের গায়ে গায়ে বসত। এগাছের বাহার ওগাছের কাঁধে লেপ্টেছে, গলায় ঝুলেছে, কোমরে জড়িয়েছে। গাছেদের বেহায়াপনায় পাখ-পাখালিরও মাথা খারাপ, তাদের কোরাসে ওখানে পরী নাচে মাঝদুপুরে। এ জঙ্গলের অনেক দুর্নাম।
জংলা ভিটায় রশিদ মিয়া যখন পা রাখলেন তখন পুবের আসমান লালচে হয়েছে, বাসক গাছের ঘনপাতার নীচে টুকরো ঘুমঘুম অন্ধকার। তিনি জঙ্গলে ঢুকে বুক ভরে শ্বাস নিলেন- কোথাও বুনো লেবুগাছে ফুল এসেছে। রশিদ মিয়া প্রতিদিন এপথে এই নির্জন বনভূমিতে প্রবেশ করেন, তবুও এখানে আজো নারীর সিঁথীর মতো কোন পদচিহ্ন গড়ে উঠেনি। একলা মানুষ পদচিহ্ন গড়তে পারে না। তবুও পথটি তার চেনা। গাছগুলো তার চেনা। গাছের প্রতিটি শাখা তার আশৈশব বন্ধু, এমনকি পাতারাও। তুলশী ঝোঁপের কাছে এসে রশিদ মিয়া হাটু মুড়ে বসেন, গাছের কাছে কয়েকটি তুলশীদানা ভিক্ষে চান, বলেন- 'দিবি নাকি?' তিনি হাত পেতে বসে থাকেন। বাতাসে পাতা কাঁপে। কৃপনের দানের মতো একটি তুলশীদানা তার হাতের তালুতে খসে পড়ে, রশিদ মিয়া গাছের সাথে ঠাট্টা করেন, বলেন- 'জংলা কিপ্পন।' সে জানে এই কৃপনতা ভালবেসে সব ঢেলে দেয়ার শুরুমাত্র। আরো কয়েকটি মিহিদানা হাতে জমা হলে রশিদ মিয়া সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে তুলশী গাছে হাত বুলিয়ে দেন, ওদের বিদায় জানান, বীজগুলো জিভের ডগায় ভিজিয়ে রাখেন। তারপর তার বসবার জায়গাটিতে পৌঁছালে জিভ থেকে আঙ্গুলে তুলে বীজগুলোকে মাটিতে পুঁতে দেন।
একসময় সূর্যের আলো পাতার ফাঁক দিয়ে এই জংলা ভিটাতে ঢুকে পড়ে, গাছের পাতায় চিকচিকে আলো ছড়ায়, মাটিতে বরফি কাটে, সরু সরু আলোর নল এখানে ওখানে কাটাকুটি খেলে। সবচেয়ে অলস লতানো গাছও আড়মোড়া ভেঙ্গে কামরাঙ্গা গাছের কোমর জড়িয়ে ধরে এ সময়। রশিদ মিয়া ওদের পাতায় হাত রাখেন, জমে ওঠা মাকড়সার জাল দরদ দিয়ে খুলে দেন, ভয় পাওয়া অষ্টপদী প্রাণীগুলোকে হাসতে হাসতে বকাবকি করেন। এভাবে বেলা বাড়ে, রশিদ মিয়ার ভাললাগাও বাড়ন্ত হয়। পাখির মমতা, খসেপড়া পাখির পালক কিংবা হলুদ পাতার অভিমান, লতানো গাছের আকর্ষির আদর তাকে গভীরে টানতে থাকে- বুকের অন্তহীন গভীরে। রশিদ মিয়ার চোখ পড়ে সেগুন গাছটার দিকে। তিনি ওটির গুড়িতে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। সেগুলের বড় বড় পাতারা বাতাসে দোল খায়, রোদের সাথে উবু-দশ-বিশ খেলে। 'তুই এ জংলার রূপ বাড়াবি', রশিদ মিয়া সেগুন গাছের সাথে কথা বলেন, 'আবার অনেক ঝামেলাও আনবি।'
'কে ঝামেলা বাড়াইব?'
রশিদ মিয়া জোড়ে হেসে ওঠেন, বলেন- 'তুই!' তারপর তিনি সেগুনের কান্ডে হাত বুলিয়ে দেন। 'কার সাথে কথা কও?' রশিদ মিয়া এ প্রশ্নে বিভ্রান্ত বোধ করেন; কে কথা বলে? সেগুনের ডালে বসে থাকা কি একটা পাখি ফুরুৎ করে উড়ে যায়, শিলকড়ই গাছের তলায় বেড়ে ওঠা ঘাসে সরসর শব্দ হয়। 'পাগল হইয়া ভালোই হইছে তোর', কেউ একজন মানুষের স্বরে রশিদ মিয়াকে ঠাট্টা করে। তিনি চমকে পেছেন ফেরেন। হারুন মন্ডল দাঁড়িয়ে আছে।
রশিদ মিয়া ধরমর করে উঠে বসেন, হারুন মন্ডলের দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হাসেন- কি করবেন বুঝে উঠতে পারেন না। এ বনভূমিতে সে মিশে থাকে শিলকড়ই-এর বেড়-না-পাওয়া স্ফিত কান্ডে, বাড়ন্ত হিজলের লিকলিকে ডালে, ঘাসে বা পাখির ধুসর পালকে- সেখানে মানুষ নেই, তিনিও যেন মানুষ নন- মানুষের প্রচ্ছায়া মাত্র। হারুন মন্ডলের উপস্থিতিতে বড়ই অকিঞ্চিৎকর হয়ে ওঠেন রশিদ মিয়া। তার ডানা গুটিয়ে আসে, চামড়ার নীচে তলিয়ে যায় পালক, বদলে যায় বুকের ভেতর পাখালী ধুকপুক- রশিদ মিয়া মানুষ হয়ে ওঠেন- বৈশিষ্ঠ্যহীন, শীর্ণ, সামন্য মানুষ।
'কি কর এই জঙ্গলে?' হারুন মন্ডল জিজ্ঞাসা করে। রশিদ মিয়া এই প্রশ্নের উত্তর জানেননা, তিনি চুপ থাকেন। হারুন মন্ডল দু'বার চোখ নাচায়, প্রশ্নের উত্তর চায়। রশিদ মিয়া বামাল ধরা-খাওয়া অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকেন। 'পাগল হইয়া বেশ ভাল আছ তুমি', হারুন মন্ডল ঠাট্টার সুরে কথা বলে, গাছগাছালি দেখে, নিশিন্দার পাতা ছেড়ে, 'কয় বিঘা জমি হইব এই জঙ্গলে- কোন আন্দাজ আছে তুমার?' রশিদ মিয়া মাথা চুলকায়। হারুন মন্ডল বলে চলে, 'বিঘা পঞ্চাশেক হইতে পারে, কি বল? মেহগনি গাছ কয়টা আছে জান নাকি?' রশিদ মিয়ার মাথা চুলকানো থামেনা, অবিন্যস্ত চুল হাস্যকর হয়ে ওঠে। এত বছর তিনি এই জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছেন তবু এর হিসাব-নিকাশ জানেন না; তিনি ফেল করা ছাত্রের মতো পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে মাটি খোঁড়েন, মাটিতে লাল পিপঁড়ের সারির দিকে তাকিয়ে থাকেন।
রশিদ মিয়া নামের অর্থহীন ছায়াসঙ্গীকে নিয়ে হারুন মন্ডল ঘুরে ঘুরে জঙ্গলটা দেখে, নিজের মনে কথা বলে। রশিদ মিয়া ভেবে পায়না এতদিনের পতিত জংলাটায় হারুন মন্ডলের হঠাৎ এত আগ্রহের কারন কি। কথাটা তার জিজ্ঞাসাও করা হয়না। হারুন মন্ডলের আছে বলেই জঙ্গলটাকে খুব সাধারন বলে মনে হয় তার, শিমুল গাছের পাশে বাসক ঝোঁপটিকে নিতান্ত বেমানান আর অর্থহীন লাগে। তার খিদে পায়, বুকে তেষ্টা জমে- সাধারন মানুষের মতো। জংলা ভিটে ঘুরে দেখা শেষ হলে হারুন মন্ডল বলে, 'গাছগুলারে পাহারা দিবা, মানুষের নজর লাগছে। পারবা না?' রশিদ মিয়া মাথা চুলকে লাজুক জবাব দেয়, 'পারুম।' হারুন মন্ডল বাড়ীর পথে পা বাড়ায়, রশিদ মিয়া পেটে খিদে নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন।
তিনি বাসক ঝোঁপের কাছে ফিরে আসেন। শিমুলের কান্ডে হেলান দিয়ে বাসকের গাঢ় সবুজ পাতার দিকে তাকিয়ে থাকেন, নিজেকে অপরাধী মনে হয়- এতক্ষণ তিনি ওদের ভুলে ছিলেন। তিনি বাসকের সরু শাখায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেন, একগোছা পাতা গালে চেপে ধরেন, বিরবির করে কথা বলেন। বাতাসে গাছের শাখারা দুলে ওঠে, যেন ওরা বলে- 'এতকাল তুমি আমাদের ভুলে ছিলে!' রশিদ মিয়া হাতজোড় করে মাটিতে বসে পড়েন, বনভূমির কাছে নত মস্তকে সারাটা বিকেল পার করে দেন। তার ক্ষুধা-তৃষ্ণা উবে যায়। সন্ধ্যায় পাখিরা ঘরে ফেরা শুরু করলে রশিদ মিয়া পৃথিবীর সকল গ্লানি বুকে নিয়ে গাঁয়ের পথে পা বাড়ান; পেছনে পড়ে থাকে পাখিদের সান্ধ্য-কোরাস, নিশ্চুপ বৃক্ষরাজি।
দুই
পানাপুকুরে রশিদ মিয়া হাতমুখ ধুয়ে ঘাটের কোণায় জমে-ওঠা শেওলার দিকে অকারন তাকিয়ে থাকেন। একটা ঢোরা সাপ একেবেঁকে পুকুর পাড়ি দেয়, আয়েশা বানুদের কয়েকটা পাতিহাঁস পানি ছেড়ে ডাঙ্গায় উঠে আসে, একটা রাতচরা পাখি পুকুর পাড়ে এসে বসে- তার ভাল লাগে।
'রশিদ নাকি? এট্টু শুইনা যাও।' আমিন মন্ডল রশিদ মিয়াকে ডাকে। আমিন মন্ডলের ডাকে রশিদ মিয়া আবার শীর্ণ মানুষে রূপান্তরিত হন। সারাদিন না-খাওয়া পেটে ক্ষুধা মোচর দিয়ে ওঠে, তেষ্টা পায়। রশিদ মিয়া লুঙ্গীতে হাত-মুখ মুছেন, লুঙ্গির গিঁট খুলে আবার শক্ত করে বাঁধেন, ঘাটেপাতা তালেরগুড়িতে ডলে ডলে পা ঘষেন, তারপর পুকুরের ঢাল বেয়ে রাস্তায় উঠে আসেন। 'আইজ এত দেরী যে', আমিন মন্ডল রশিদ মিয়াকে জিজ্ঞাসা করেন, 'সারাদিনে খাইছো কিছু?' রশিদ মিয়া ডানেবায়ে মাথা নাড়ান। 'বাড়িতে আসো, তুমার সাথে কথা আছে।' আমিন মন্ডলের 'কথা আছে' কথাটিতে এলোমেলো চুল-দাড়ির রশিদ মিয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন।
'হারুন নাকি আইজ তুমার জংলা ভিটায় গেছিলো?'
'হ।'
'কি কয় সে?'
'জমির হিসাবপাতি করল।'
'ওই জমির মালিক কে তুমি জানো?'
'ওইটাতো এজমালী জমি।'
'সরকারি জমি। হারুন নাকি লিজ নিবো। কিছু কইলো নাকি?'
'আমারে গাছ-গাছালি দেখভাল করতে কইলো।'
'তহশীল অফিসে ঘুষ খাওয়াইছে। আমার কাছে খবর আছে।' রশিদ মিয়া চোখ বড় বড় করে আমিন মন্ডলের কথা শোনেন- কিছু কথা তিনি বুঝতে পারেন, কিছু দুর্বোধ্য লাগে। তারপর মন্ডল বাড়ীর কাচারী ঘরের মেঝেতে বসে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতে ঝোল মাখতে শুরু করলে আমিন মন্ডল বলেন, 'গরমেন্ট ওই জমির আসল মালিক না। আসল মালিক কিডা জানো?'
'এই না কইলেন ওইডা সরকারি জমি!'
'জমি যে ভোগ করে সেই মালিক। গরমেন্ট তো আর ওই জমির আম-জাম খাইতে আসেনা! ওই জমির ফল-ফালালির মালিক তুমি, জমির মালিকও তুমি।'
আমিন মন্ডলের জমি বিষয়ক সহজ সমাধান রশিদ মিয়ার মাথায় ঢোকেনা। এ গ্রামের সবাই হারুন আর আমিন মন্ডলের বিবাদের কথা জানে, রশিদ মিয়াও জানেন। তবু সবকিছু নিয়ে দুই ভাইয়ের মারমুখি ঝগড়া-ফ্যাসাদের কারন রশিদ মিয়া ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। আমিন মন্ডল তাকে বোঝায় হারুন কেন আজ জংলা ভিটায় গিয়েছিল। রশিদ মিয়া চুপ করে সব কথা শুনেন। মুখে-পোরা ভাত তিনি চিবাতে ভুলে যান। হঠাৎ করে তিনি জঙ্গলটার জন্য কাতর বোধ করেন, বুকটা খাঁ খাঁ করে ওঠে। রশিদ মিয়া হাতের আঙ্গুলে ভাত মাখেন, নাড়েন, নিখুঁত গোলাকার নলা বানান, আবার ভেঙ্গে ফেলেন। আমিন মন্ডল রশিদ মিয়ার কাঁধে মৃদু ঠেলা দেন, বলেন- 'আমি ছোটবেলা থিকা তুমারে ওই জঙ্গলা ভিটায় দেখি। ওইখানে সময় কাটাও বইলা তুমারে সবাই পাগল কইয়া ডাকে। ওই জমি তুমার না হইলে আর কার?'
এক সময় 'খিদা নাই' বলে পাতের ভাত শেষ না করেই রশিদ মিয়া উঠে পড়েন। আমিন মন্ডল বলেন, 'কই যাও? তুমার তো আর ঘরদুয়ার নাই- রাইতটা এখানেই কাটাইয়া দেও।' রশিদ মিয়ার বুকের কাছে একদলা কান্না জমে, আয়েশা বানুর কথা মনে হয়, কচি সেগুন গাছটার কথা মনে হয়। তার ভেতরের কষ্টগুলো বাষ্প হয়ে চোখের কোণে জমতে থাকে, বুকটা হু হু করে। তিনি জানেন এ কষ্ট তাকে পেতে হবেই- তিনি যে আজ বনভুমিতে ডুবে থেকেই তাকে বিস্মৃত হয়েছিলেন, অবহেলায় পা রেখেছিলেন স্নেহাস্পদের বুকে! 'আসি' বলে রশিদ মিয়া হন হন করে পথে পা বাড়ান।
রশিদ মিয়া ফিরে আসেন জংলা ভিটার জমাট অন্ধকারে- যেখানে নিঃশব্দে পাখিদের সাথে সাথে গাছেরাও ঘুমাচ্ছে। এই প্রথম রাতের চাদরে শরীর ঢেকে তার বনভূমিতে আসা। বনভূমিকে অন্যরকম লাগে তার, এ যেন অসংখ্য প্রাণ জড়াজড়ি করে একটি জীবে রূপান্তরিত হয়েছে এখানে। এখন তাল কিংবা হিজল গাছের সাথে একাকার হয়ে মিশে গেছে লাল পিপঁড়ে আর বউ-কথা-কও পাখির জীবন। এই জীবনের সাথে রশিদ মিয়াও মিশে যান টুপ করে। একটি আকাশমনীর বেড়ে ওঠা শরীর জড়িয়ে তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন। হাতের আঙ্গুলগুলো সরু আকর্ষির মতো আকাশমনীর গা জড়িয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। তিনি যেন এক লতানো গাছ, এ বৃক্ষের অবলম্বন ছাড়া তিনি অসহায়, অচল। রশিদ মিয়া নিঃশব্দে কেঁদে ওঠেন- এ বনভূমি তার। এ বৃক্ষরাজি, নিশিন্দার ঝোঁপে ইতস্তত উড়ে বেড়ান জোনাকিরা তার। ভাবতে ভাবতে রশিদ মিয়া পাখি হয়ে যান- পালকহীন, ডানাহীন এক বিরাট পাখি, যার শরীরে ভেতর জন্ম নিতে থাকে ছোট ছোট আরো অসংখ্য বিহঙ্গ। কিলবিল করে উড়তে থাকে তারা- পায়ের আঙ্গুল থেকে মাথায়, বুক থেকে হাতের তালুতে। যেন তারা সব ছিঁড়ে-ফুঁড়ে বেড়িয়ে আসতে চায়, শরীর থেকে ঝরে পড়তে চায় অবিরাম বর্ষনের মতো। পাখিবৃষ্টির অবিরল প্রাণ জন্ম নিতে থাকে তার শরীরে।
তিন
'রশিদ, মাইনষে কয়- তুমি নাকি আমারে দেইখা নিবা? তুমারে আমি জুতাপিটা করতে পারতাম। তুমি পাগল-ছাগল মানুষ বইলা মাফ পাইলা। তুমারে বুদ্ধি কিডা দেয় আমি জানি। সেই খবিশের নাম কও, তারে আমি জুতা পিটাকরি!' হারুন মন্ডল ভরা মজলিশে রশিদ মিয়ার বিচার শুরু করে। এ কথা সত্য যে, রশিদ মিয়া গ্রামের কাউকে কাউকে বলেছেন জংলা ভিটার একটা গাছের গায়েও তিনি হাত দিতে দিবেন না। গ্রামের মানুষেরা পাগলের এ কথায় আমোদ পেয়েছে, রশিদ মিয়ার আরো পাগলামি দেখার জন্য উস্কানি দিয়েছে। গ্রামের প্রায় সব ঘরেই রশিদ মিয়ার খাবার জোটে, উঠানের কোণে ঘুমানোর জায়গাও। এত মানুষের সামনে রশিদ মিয়া রুক্ষ মাথা আর দাড়িতে চুলকানো ছাড়া আর কোন কাজ খুঁজে পান না। রশিদ মিয়াকে এ অবস্থায় দেখে সবাই মজা পায়। মজমা জমে ওঠার আশায় মানুষগুলোর নড়েচড়ে বসে। আমিন মন্ডল বলে, 'আরে পাগল মানুষ, কি কইতে কি কইছে, ওরে ছাইড়া দেও। ওর মাথার ঠিক আছেনি!'
'পাগলের বুদ্ধি জুগায় কে?' হারুন মন্ডল আমিনকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়; তাকে ভস্ম করে দেবার জন্য অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
'সরকারী জমির লিজ নিয়া পাগলে কি বুঝবো?'
'পাগলে না বুঝলেও অন্যরা তো ঠিকই বুঝে! আমি রশিদের কাছে জিগাই- কিডা তারে বুদ্ধি দেয়?'
মজলিশ সত্যি সত্যি জমে ওঠে। রশিদ মিয়াকে ঘিরে দুই ভাইয়ের ঝগড়া সপ্তমে চড়ে। মুরুব্বিরা বলেন, 'তুমাগো বিবাদ তুমরা মিটমাট কর।' বিবাদ মিটেনা, ঘেয়ো কুকুরের অসুস্থ চামড়ার মতো দগদগে হয় ওঠে- তাতে অন্যরা জড়ায়, কামড়া-কামড়ি করে। সব কিছুর শেষ থাকার মতো এই বিবাদও এক সময় শেষ হয়। রশিদ মিয়ার দিকে চোখ পড়ে সবার, অর্বাচিন মানুষটি তখন পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে মাটিতে আঁকিবুকি করছিলেন। বিচারে খুব লঘু দন্ড হয় তার, সবার কাছে মাফ চেয়ে কানে ধরে ওঠ-বস করতে হবে পঞ্চাশবার। রশিদ মিয়া দাঁতকেলিয়ে হাসেন। কেউ একজন তাকে ধমক দেয়, কান ধরতে বলে। রশিদ মিয়া কানে হাত দেন, নিজের কানকে নিজের কাছে অচেনা লাগে তার- ওগুলো যেন মান্দারের কাঁটাওয়ালা বাকল। রশিদ মিয়া চোখ বন্ধ করেন। তার বুকের ভেতরে কেমন যেন এক মমতা জেগে মান্দারের রুখু কাঁটাগুলোর জন্য। মজলিশ থেকে দূরে দাঁড়ান শিশুরা হাততালি দেয়, রশিদ মিয়া ওঠ-বস শুরু করেন।
চার
সে রাতেই হারুন মন্ডল খুন হয়েছিল। পানাপুকুরের ঘাটে তার লাশ পড়েছিল পুলিশ আসা অব্দি। ভাইয়ের মৃত্যুতে আমিন মন্ডল পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে খুনের বদলা নেবে প্রতিজ্ঞা করেছিল। আমিন মন্ডলের লোকেরা জংলা ভিটায় রশিদ মিয়াকে পিটিয়ে মেরেছিল শোধ নিতে। কেউ দেখতেও যায়নি সে লাশ। শুধু খুটি উপড়ানো একটা সাদা গরু দড়ি টানতে টানতে সে জঙ্গলে মাঝদুপুরে ঘাস খেতে এসেছিল। আর কেউ ওমুখো হয়নি অনেক দিন।
আমিন মন্ডলের নামে জংলা ভিটার লিজ পাকাপোক্ত হওয়ার পর একদিন কয়েকজন মানুষ এসে দু'টো মান্দার গাছ কেটে নিয়ে গেল। গাছ কাটতে কাটতে ওরা বলাবলি করল- দু'টো খুনই নাকি আমিন মন্ডলের কাজ। অবশ্য কেউ কেউ আবার তা বিশ্বাসও করল না। যারা বিশ্বাস করল না তারা বলল, এই ভিটার অভিশাপ পড়েছিল হারুন মন্ডলের ওপর।
সে বছর গ্রামে পাখিবৃষ্টি হয়েছিল। অচেনা ছোট ছোট পাখি ঝরে পড়েছিল আকাশ থেকে। মন্ডল বাড়ীর টিনের চালায়, আয়েশা বানুদের উঠোনে, গ্রাম থেকে বের হওয়ার সরু আলপথে, পানাপুকুরের ঘাটে অবিরল পাখিবর্ষণে পা ফেলার জায়গাও ছিলনা।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০০৮ সকাল ১০:০২