টেবিলে রাখা ঘড়িটা টিক টিক করে বেজে চলেছে। সকাল হয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না সবুজের। হাত বাড়িয়ে শুয়ে শুয়েই এলার্মটা অফ করলো। আরো কিছুক্ষন শুয়ে থাকবে সবুজ। দিনের বেলাতেও রুমে কেমন একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। সিলিঙ্গের দিকে তাকিয়ে আনমনে ভাবে, তার জীবনটা আর ৫/১০টা মানুষের মত সুন্দর না। তার জীবনে কোথাও যেন কেউ নেই। জন্মের পর পরই মা মারা গেছে। বাবাকেও হারিয়েছে শৈশবে। অনেক চড়াই-উতরাই করে জীবনটা পার করে চলেছে।
ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়াতে সবুজ বেশ ভালো ছিলো। মামার বাড়ি থেকে লেখাপড়া করেছে। স্কুলের শিক্ষকরা তার লেখাপড়ার আগ্রহ দেখে অনেক হেল্প করেছে। বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ, প্রাইভেট ফ্রি, বই-খাতা ইত্যাদি নানারকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তারা সবুজের উপকার করেছে। তাদের সাহায্যের বদৌলতে আজ সবুজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। তার জীবনের চাকা ঘুরে চলেছে অনবরত।
শুয়ে শুয়ে এতো কিছু ভাবছিলো সবুজ। ভাবনার ছেদ পড়লো রুমমেটদের চেচামেচির কারণে। ‘এই সবুজ, ওঠ, ওঠ... তোর না আজকে বার্থ ডে?’ সবুজ জানে না তার আসল বার্থডে কবে; স্কুলের সার্টিফিকেটে যেটা লেখা আছে, সেটাকেই সে বার্থডে বলে মনে করে। বিশেষভাবে কখনো বার্থ ডে উদযাপন করে নি সে। ভার্সিটিতে এসেই বন্ধুরা মিলে এটাকে বিশেষ করে তুলেছে।
এমন সময় অর্পিতার ফোন- ‘সবুজ তুই কই? আমরা সবাই টিএসসি তে তোর জন্য অপেক্ষা করছি। তুই তাড়াতাড়ি চলে আয়।‘ বলেই কলটা কেটে দিল। বন্ধুদের একটাই দোষ; কথা শেষ করতে না দিয়েই কল কেটে দেয়।
রুমমেট মাহিন বললো, ‘কিরে, অর্পিতার কল ছিল নাকি?’ মাথা নেড়ে সায় দেওয়াতে মাহিন খোচা দিয়ে বললো, ‘অর্পিতা মেয়েটা তোকে অনেক পছন্দ করে, রিলেশনটা করে ফেল না! আর কত দিন অসহায়ের মত একা একা থাকবি?’
মাহিনের ‘অসহায়’ কথাটা সবুজের মনে ধাক্কা দেয়। সত্যিই তো, সে অসহায়। ইচ্ছে থাকলেও আর পাঁচটা ছেলের মত রিলেশনে জড়াতে পারে না। অনেক অর্থকষ্টে চলে সারাটা বছর। যাদের পুরো মাস চলতেই টাকার টানপোড়েন চলে, তাদের আবার গার্লফ্রেন্ড! নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। নিজের অব্যক্ত কথাগুলো কাউকে জানায় না সে।
হাত-মুখ ধুয়ে হালকা ফ্রেশ হয়ে টিএসসি’র উদ্যেশে পা বাড়ালো। সাথে মাহিন, সুমন ও হিমু; ভার্সিটির বন্ধুগুলো যেন অন্যরকম- যা করবে, যা খাবে, যা দেখবে সব কিছুই শেয়ার করবে।
অর্পিতা সাথে কয়েকজন বান্ধবীসহ একটা কেক এনেছে। সবুজ তাদের আয়োজন দেখে অবিভূত! বছরের প্রতিটা দিন এ রকম আসে না কেন? সবাইকে নিয়ে বেশ হাসি-আড্ডার মধ্যে কিছুটা সময় পার করলো।
***
সন্ধ্যায় টিউশনী। টিউশনী কাজটা অনেকটা ‘খোয়া-ভাঙ্গা’ কাজের মত! ‘কাবিটা-কাজের বিনিময়ে টাকা’! অবশ্য এ মাসের টাকা টা দিতে দেরী করছে কেন সে বুঝতে পারছে না। মাসের ৬ তারিখ, এই কয় দিন বন্ধুদের কাছে ধার করে চলেছে। তাদের বলেছে, এ মাসের টাকা টা পেলেই শোধ দেবে।
পড়ানো শেষে আন্টিকে বিষয়টা জানাবে কি না ভাবলো। কিন্তু নাহ, মুখ ফুঠে চাইতে পারলো না। আজকেও নিরাশ হয়ে টিউশনীর বাড়ি থেকে বের হলো। টিউশনী বাড়ি থেকে তার রুমের দূরত্ব প্রায় ১ কিমি এর মত। রিকশায় যেতে ১০ টাকা লাগে। পকেটে হাত দিয়ে দেখলো মাত্র ১০ টাকা-ই আছে। টাকাটা পকেটে সযত্নে রেখে দিল। এবং পায়ে হাটা শুরু করলো।
রাস্তার ফুটপাত ধরে হেটে চলেছে। পাশ দিয়ে রিকশা, প্রাইভেট কার, গাড়ি সব ছুটে চলেছে। কিছু দূর যেতেই দেখলো বিশাল এক জ্যাম পড়েছে। সব আটকে গেল জ্যামে। সবুজের মনে হল তার জীবনেও বুঝি এই রকম জ্যাম পড়েছে। একটার পর একটা সমস্যা নিয়ে পথ চলতে হয়। একটু পরেই সবুজ বাতি জ্বলে উঠলো। আর সাথেই সব আগের মত চলতে আরম্ভ করলো। সে ভাবে, কবে যে সবুজের সবুজ বাতি জ্বলে উঠবে!