পিপড়াকান্দি গ্রামের কাদের আলী কোন এক কার্ত্তিক মাসের শেষে মরার প্রবল ইচ্ছা পোষন করা সত্ত্বেও মাঝ ভাদ্রের এক কাঠফাটা দুপুরে তার অতি প্রিয় গান উকিল মুন্সীর –“আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি’’ গাইতে গাইতে কার্ত্তিকের শেষ হতে প্রায় মাস দেড় আগে আচানক মরে গেল। মৃত্যুর কারন হিসেবে ভর দুপুরের নিয়ম না মেনে চলাফেরার কথাই গ্রামবাসীর বিভিন্ন অলস আলোচনায় জাবর কাটা হয়। কোন মান-চিন না রেখে কাইটন শেখের পরাবাড়ির বেতগড়ার চাপা পথে যার থেকে শ’খানেক গজ দূরে হারু শেখের কবর; তার থেকে উত্তরমুখা হয়ে গাইতে গাইতে পেশাব করতে বসা আর সেই সময় বেতগড়া থেকে যে কালোর চেয়ে কালো দাঁড়কাক-হারু শেখের কবরের পাহারাদার; উড়ে যেতে যেতে ডানার ছায়া দিয়ে কাদেরের মাথা কিংবা কানে আঘাত করে, আর সেই আঘাতের দাগ বসে যাওয়া কাদেরের মুখের বাম অংশ কিংবা আঘাতের চোটে নাক মুখ দিয়ে বের হয়ে আসা রক্তের কাহিনী সবই পিপড়াকান্দির বাতাসে ওড়াওড়ি করতে লাগল।
শেখদের এই পরাবাড়ির বেতগড়ায় এর আগে এই ধরনের কোন ঘটনা না ঘটলেও পিপড়াকান্দির লোকজন কাদেরালীর মৃত্যুর সাথে হারু শেখের কবর কিংবা আবার হারুর জেগে উঠার সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলে। শেখদের পরাবাড়ি থেকে হারু শেখ কিংবা তার কবর জ্যান্ত হয়ে উঠে দেড়শ বছর পর।
পিপড়াকান্দির শেখদের বাড়ি হারুর মামার বাড়ি। হারুর বয়স তখন ১০ কি ১২। টগার হাওড় তখন যৌবনে টগবগ করে, শীত-বাইস্যা-কাতি সব সময়। ছয় দাঁড়ের নাও ছাড়া টগা পাড় দেয়া হতো স্বপ্ন দেখা। সে সময়ে বাঘেরা মানুষের চেয়ে ঘন বসতিতে ছিল আসেপাশের বন-বাগে। তারও ১০০ কি ১৫০ বছর আগে, টগার পানিতে কিভাবে যেন মুখ দিয়ে দেয় ন্যাংটাবাবার পোষা ১২ ফুটি বাঘটি। তার মুখ থেকে সব বিষ মিশে যায় টগার পানিতে। সে তো যে সে বিষ না। আবার সেই বিষ নাকি খেয়ে নেয় এই হাওড়ের শিং মাছেরা। এখনো আশেপাশের ১০ গাঁয়ের মানুষ বিরত থাকে টগার হাওড়ের শিং মাছ ধরা থেকে। কিন্তু দশ-বারোর হারু মাছ ধরতে গিয়ে ধরে আনে টগার শিং। বাবার শত নিষেধ সত্বেও হারু শিং মাছখানি ছাড়তে রাজি হয় না। ছেলের আবদারে শিংমাছ খানি কাটতে গিয়ে কাটা বিঁধে হারুর মায়ের হাতে। সাড়ে ষোল দিন অসহ্য যন্ত্রণা শেষে মারা যায় হারুর মা। তার মাস তিন পড়ে টগাতেই আচমকা ঝড়ে নৌকা ডুবে মারা যায় হারুর বাবা। লোকে বলে ল্যাংটাবাবার বাঘের বিষ খাওয়া শিং মাছের প্রতিশোধ। আর সেই ১০/১২ বয়স হতেই হারু তার মামাদের কাছে পিপড়াকান্দির শেখ বাড়িতে বাকি জীবন কাটাতে লাগল।
হারুর মামার বাড়িতে আশ্রয় নেয়ার ঘটনাও এখন দেড় শতক পাড় হতে চললো। কখনো কোন কাজ কিংবা লেখাপড়া হারু শেখ করেনি। মামাদের আশ্রয়ে ভবঘুরে জীবন কাটাতে কাটাতে যৌবনে পা দেয় সে। সাথে তার মনে নিয়ে রইল ন্যাংটাবাবার প্রতি প্রতিশোধ নেয়ার জিদ। ন্যাংটাবাবা যদি তার ১২ ফুটি বাঘেরে না ছাড়তো… পোষা বাঘ তার… তারে পানি খাওয়াইতে ছাড়ে কিনা টগার হাওড়ে… তোমার বাঘের বিষ হাওড়ের পানিতে মিশে তা যদি তুমি বুঝতে না পারো তাইলে তোমার কিসের পীরালী! কেমন পীর তুমি?
ন্যাংটার পীরালী সে দেখে নিবে এই আশায় সে দিন গুণতে থাকে। মামাদের গ্রামে ন্যাংটাবাবার কয় ঘর মুরিদ আছে, আর কোন এক সময় ন্যাংটাবাবা এই অঞ্চলেও ঘুরে গেছেন। তার নাকি আবার আসার সময় হয়েছে। লোকে বলে। পুব পাড়ার নুর মমিনের দাদার বাবা, কটু মুন্সী ছিল ন্যাংটা ফকিরের মুরীদ। সেও নাকি ন্যাংটার পীরালীকে দেখে নেয়ার জন্য ন্যাংটাবাবার মুখোমুখি দাড়িয়েছিল। ধারালো অস্ত্রে ন্যাংটাকে করেছিল ক্ষত-বিক্ষত। আহত ন্যাংটাকে তার অন্যান্য ভক্তরা নৌকায় তুলে নিয়ে যায়। খোলা হাওড়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রামের লোকেরা নৌকাটিকে দেখতে পায়। তারপর আজ পর্যন্ত আর কেউ সেই নৌকার কোন হদিস পায় নাই। কিন্তু সুস্থ্য শরীরে ন্যাংটাবাবা আবার সেই রাতেই ফিরে আসে পিপড়াকান্দি গ্রামে। কটু মন্সীর দরজায় কড়া নাড়ে। রাত তখন দ্বিপ্রহর। নির্ঘুম কটু মুন্সী ঘরের মধ্যে আনচান করতে ব্যস্ত। সারা শরীর দিয়ে আগুন ঠিকরে পড়ছে। শরীরে কোন কাপড় সে রাখতে পাড়ছে না। দরজা খুলে কটু মুন্সী দেখে ন্যাংটাবাবা তার দরজায় দাড়িয়ে। অক্ষত শরীর বাবার। তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে ন্যাংটাবাবা, কটু মুন্সীর মাথায় হাত রাখে। সাথে সাথে ঘটে সেই আশ্চয ঘটনাটি। কটুর সারা শরীর ঠান্ডা হযে যায়-বন্ধ হয়ে যায় কটুর ভিতরের উচাটনতা। কিছুটা সময় দাঁড়ানো অবস্থাতেই অচেতন ছিল কটু মুন্সী। চেতনা ফেরার পর তাকে ল্যাংটার পা জড়ানো অবস্থায় পাওয়া যায়। সেই দিনের পর থেকে ল্যাংটাপীরকে এই এলাকায় কেউ না দেখলেও নিশিরাতে কটু মুন্সীর সাথে ল্যাংটার দেখা হওয়া কিংবা কটু মুন্সী যে দিন ল্যাংটাকে আক্রমন করেছিল প্রতি বছর ভাদ্র মাসের সে দিন আক্রমনের যায়গায় বড় করে ওরস করা এখানে প্রায় রীতিতে পরিনত হয়েছিল। অনেকে নাকি গভীর রাতে ওরসের সময় ল্যাংটার ১২ ফুটি পোষা বাঘটিকে সেই স্থানের আশেপাশে দেখতে পেত।
ল্যাংটার প্রথম আবির্ভাবের ঘটনাটি এই অঞ্চলের লোকজনের মুখে এখনো মোটামুটি অবিকৃতই রয়ে গেছে। কিছু যে পরিবতন-পরিবধন হয় নি তা বলার জো নাই। তবুও অনেক বছর ধরেই সেই ঘটনার পরম্পরা মোটামুটি একভাবেই বয়ান হয়ে আসছে। তখনো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে ঢুকেছে কি ঢুকেনি; এই অঞ্চলে তার আঁচ লাগেনি। আর দশটা হাট বারের মতোই মধ্যনগর হাটে কোন এক শনিবার ময়লা শরীর-জটা চুলে উলঙ্গ এক পাগলকে দেখা যায়-দেখা যায় কাউকে ভ্রক্ষেপ না করে হাটময় ঘুরে বেড়াতে। কারো কোন কথাই তাকে স্পশ করছিল না। বেলা বাড়ার সাথে হাটে লোকজনও বাড়তে থাকে, আর বাড়তে থাকে উলঙ্গ অচেনা এক পাগলকে নিয়ে হাটুরে মানুষদের কৌতুহল। এরই মাঝে ঘটে যায় এক আচানক ঘটনা। যে লোক হাটের এতো মানুষের মাঝে অবলীলায় উলঙ্গ চলাফেরা করছে সে-ই তার লজ্জা স্থান দুই হাতে ঢেকে দৌড়ে পালাতে চাইছে হাটের অন্য কোন প্রান্তে! এই ঘটনা লোকজনের কৌতুহলকে আরো এক ধাপ বাড়িয়ে তুলে। রহস্যের কিনারা হয় যখন উলঙ্গ সে লোক হাটের সবচেয়ে বড় কাপড়ের দোকানে গিয়ে একটা গামছা টেনে নেয় আর তাতে ঢাকে তার লজ্জা। কৌতুহলি হাটুরে মানুষ যখন এই বিষয়ের শানে নযূল জানতে চায় তখন, সেই একবারই ন্যাংটাবাবা কথা বলে। বলে- দেখ…
আর তখনই; হাটের লোকজন তাদের চারিদিকে তাকিয়ে কোন মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পায় না। এমন কি নিজেকেও আবিষ্কার করে বিভিন্ন পশুর রূপে। কেউ কুকুর। কেউ বিড়াল, কেউ শেয়াল… শুধু ন্যাংটা অলৌকিক এক উজ্জ্বলতা নিয়ে সকলের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে আর দূরে হাটের অন্য প্রান্তে বংশৗকুন্ডা গ্রামের ক্বারী মৌলভী ইসমাইল উদ্দিনকে দেখা যায় মানুয়ের বেশে। যিনি কিছুক্ষণ আগে নৌকায় এসে হাটে নেমেছেন। এই একমাত্র মানুষের জন্য নিজের লজ্জা ঢাকতে ন্যাংটা হাটে এই কান্ড ঘটিয়েছেন। হাটেতো আগে কোন মানুষই ছিল না। আর পশুর সামনে মানুষের লজ্জা কি? সেই থেকে ন্যাংটা সকলের বাবা হয়ে এই অঞ্চলে অবস্থান করে যাচ্ছেন। তবে ন্যাংটাবাবার পোষা সেই ১২ ফুটি বাঘকে কেউ দেখেছে কি না তা আর এখন কেউ মনে করতে পারে না। শুধু শোনা যায়, মাঝে মাঝে; হয়তো অমাবস্যা কিংবা পূর্ণিমায় রাতের দ্বিপ্রহরের পরে বাঘটি নাকি অদ্ভূত নিরবতা নিয়ে ন্যাংটাবাবার পাশে বসে থাকতো। আর ন্যাংটা পরম মমতায় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। কেউ কেউ বলতো এটা আসলে বাঘ না, ন্যাংটার পোষা জ্বিন। আবার কেউ কেউ এটাকে ন্যাংটাবাবার ছেলে বলতো। কোন এক সময় জ্বিন রাজ্যের কোন এক পরীর সাথে ন্যাংটার বিয়ে হয়। তাদেরই ছেলে এই জ্বিনটি। মাঝে মাঝে বাঘের বেশে পূর্ণিমা-অমাবস্যার রাতে বাঘের বেশে বাপের সাথে দেখ করতে আসে। আর সেই বাঘের জন্য কি না হারু শেখ ন্যাংটার পীরালীকে অভিযুক্ত করার স্পর্ধা দেখায়…?
কিন্তু এই স্পর্ধা নিয়েই ন্যাংটার খোঁজে পিপড়াকান্দি গ্রামে মামাদের বাড়িতে হারু শেখের ১০ বছর কেটে যায়। তবুও হারু এখনো ন্যাংটা বাবার দেখা পায় নি। সেই সময় ভাদ্রের কোন এক রাতে ন্যাংটাবাবার ওরস চলাকালীন সময়ে পিপড়াকান্দি থেকে ডুলপুশি বিলের হিজলবাগে যে অংশ দেখা যায় সেখানে গ্রামবাসীদের কেউ কেউ নাকি আগুন জ্বলতে দেখে। কিন্তু দিনের আলোতে বিলের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা হিজলবাগে তার কোন চিহ্ন খোঁজে পায় না। পরপর কয়েক রাতে এইভাবে বিলের বুকে আগুন কিংবা অলৌকিক আলো গ্রামবাসীদের মধ্যে বিভিন্ন গল্প কিংবা সম্ভাবনার কথা জাগিয়ে তুলে। কেউ বলে “জায়গাটাতে দোষ ধরেছে”, কেউ বলে এইটা “আইগ্গা বইতালের” কাজ। আবার কেউ কেউ এর সাথে হারু ও ন্যাংটার ঘটনার সম্পৃক্ততা জাগিয়ে তুলে। ন্যাংটার পীরালী দেখে নেয়ার যে বাজি হারু শেখ ১০ বছর আগে ধরেছিল তাকে সফল করতেই নাকি ন্যাংটার ওরসের সময় হারু ন্যাংটাকে ডাকতে নিজেই “আইগ্গা বইতাল“ সাজে, যদি ন্যাংটা আসে-হারুর মুখোমুখি দাঁড়ায় তার পীরালী নিয়ে।
হারুর এইসব স্পর্ধা কিংবা কমবখ্ততা তার মামাদের স্নেহ-মমতা-র্ধৈয সব কিছুর শেষ সীমায় এনে দাঁড় করায়। হারুকে তারা এইবার গৃহস্থি দেখতে বলে। আসছে জ্যৈষ্ঠে হারুকে বিয়ে দিয়ে সংসারি করতে মনস্থির করে তার মামারা। আর মামাদের নেয়া এই সিদ্ধান্তের এক সপ্তাহ পর থেকে পরবর্তি ১২ বছর হারু শেখকে পিপড়াকান্দি গ্রামের লোকেরা আর দেখতে পায় নি। মামার বাড়ির লোকেরা সহ পিপড়াকান্দির সকলের কাছে হারু বিস্মৃত হতে হতে নিরুদ্দেশের ১২ বছর পর কোন সুবেহ সাদিকের সময় সূর্যের আগে কিংবা পরে কিংবা সাথে মামাদের পরাবাড়িতে কয়েকজন সংগীসহ উদয় হয়।পীর হারুকে চিনতে গ্রামের অনেকেরই প্রথম প্রথম কষ্ট হয়। কিছু সময় তাকিয়ে থাকতে থাকতে হারু শেখ গ্রামবাসীদের বিস্মৃতির অতল থেকে উঁকি দেয়; তারপর কারো কাছে ধীরে ধীরে আবার কারো কাছে ঝটকা দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠে। হারু শেখ হারু পীর হয়ে সল্প ভাষী হয়ে উঠে। মামাদের সাথে হয়তো ২/১টা কথা বলে। অন্যরা তার মুখ হতে শুধু “কূলে ওলী কূলে সাঁই, মুর্শিদ তুই বিনে আমার ভরসা নাই” ছাড়া আর কিছুই শুনতে পায় না।
আস্তে আস্তে দেখতে দেখতে হারু শেখ মোটামুটি ভাবে হারু পীর হয়ে উঠে। আশে পাশের ৮/১০ গ্রাম থেকে লোকজন বিভিন্ন মানতে তার কাছে আসতে থাকে। হারু সবাইকে পানি পড়া দেয়। তার পড়া পানিতে লোকজনের কাজ হতে থাকে। হারু পীর হওয়ার পরে শেখেদের পরাবাড়িতেই দিনরাত কাটাতে থাকে। “কূলে ওলী কূলে সাঁই, মুর্শিদ তুই বিনে আমার ভরসা নাই” বলে হারুর ফুঁ দেয়া পানি লোকজন ভিড় করে নিয়ে যায়। কেউ বলে হারু শেখ গত ১২ বছর ন্যাংটার হাওলায় ছিল। ন্যাংটাবাবা নাকি তাকে তুলে নিয়ে যায় জ্বিনের রাজ্যে। সেখানে সে ন্যাংটার মুরিদ হয়। ১২ বছর সাধনার পর ন্যাংটার সন্তুষ্টি লাভের পর সে পায় খেলাফত। তাইতো তার পড়া পানিতে লোকজনের মনোবাঞ্চা পুরা হয়। আবার কেউ কেউ বলে ন্যাংটার পীরালীকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যই ১২ বছর কামরুপ কামাখ্যায় সাধনা শেষে হারু এই অবস্থায় পৌঁছতে পেরেছে। তবে লোকে যাই বলুক বা মানুক হারুর পীরালীতে বিশ্বাস করে না তার মামারা। তাই হয়তো নিজেদের পরাবাড়ির পাশ দিয়ে নৌকা চালিয়ে যেতে যেতে হারু শেখের মামা আব্বাস আলী শেখ তার ভাই আসগর আলী শেখকে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে- “ভাই দেখ; আমরার হারুও পীর হইয়া গেছে…!”
এদিকে পীর হারুর উপস্থিতি এই অঞ্চলে ধীরে ধীরে ন্যাংটাবাবার আধ্যিপত্যকে ম্রিয়মান করে তুলতে থাকে। পিপড়াকান্দিতে ন্যাংটার ওরস আর আগের মতো জমজমাট হয় না। ন্যাংটাবাবার নামের তাবিজের চেয়ে হারু পীরের “কূলে ওলী কূলে সাঁই, মুর্শিদ তুই বিনে আমার ভরসা নাই” বলা পড়াপানিতে মানুষের ভরসা বেশি দেখা যায়। এইভাবে কোন এক ভাদ্রে আর ন্যাংটার ওরসের আয়োজন দেখা যায় না পিপড়াকান্দিতে। আর এটাই ন্যাংটা পীরের প্রতি হারু শেখের প্রতিশোধ কি না তা এই অঞ্চলের কেউই বুঝতে পারে না। যে ভাদ্রে ন্যাংটাবাবার ওরস বন্ধ হয় তার থেকে ৩ ভাদ্র পর কোন এক কাঠফাটা দুপুরে হারু শেখের কবর হয় পিপড়াকান্দির শেখেদের এই পরাবাড়িতে। হারুর পীরালীর প্রতি তার মামাদের অবিশ্বাস কিংবা অনাগ্রহই তাদের পরাবাড়িতে হারু শেখের পীরালী ও তার কবরকে ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের মানুষের স্মৃতি থেকে সরিয়ে দিতে থাকে।
হারু শেখের মুত্যুর প্রায় দেড়শত বছর পর কোন এক ভাদ্রের কাঠফাটা দুপুরে পিপড়াকান্দির শেখেদের পরাবাড়ির বেতগড়ার চাপা পথে যার থেকে শ’খানেক গজ দূরে হারু শেখের কবর; যা আজ আর চিহ্নিত করা যায় না সেখানে কাদের আলীর মৃত্যু অনেক গল্প ও সম্ভাবনা নিয়ে হারু শেখ কিংবা তার কবরকে জাগিয়ে তুলে।
পিপড়াকান্দি গ্রামের কাদের আলী কোন এক কার্ত্তিক মাসের শেষে মরার প্রবল ইচ্ছা পোষন করা সত্ত্বেও মাঝ ভাদ্রের এক কাঠফাটা দুপুরে তার অতি প্রিয় গান উকিল মুন্সীর –“আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি’’ গাইতে গাইতে কার্ত্তিকের শেষ হতে প্রায় মাস দেড় আগে আচানক মরে গেল। মৃত্যুর কারন হিসেবে ভর দুপুরের নিয়ম না মেনে চলাফেরার কথাই গ্রামবাসীর বিভিন্ন অলস আলোচনায় জাবর কাটা হয়। কোন মান-চিন না রেখে কাইটন শেখের পরাবাড়ির বেতগড়ার চাপা পথে যার থেকে শ’খানেক গজ দূরে হারু শেখের কবর; তার থেকে উত্তরমুখা হয়ে গাইতে গাইতে পেশাব করতে বসা আর সেই সময় বেতগড়া থেকে যে কালোর চেয়ে কালো দাঁড়কাক-হারু শেখের কবরের পাহারাদার; উড়ে যেতে যেতে ডানার ছায়া দিয়ে কাদেরের মাথা কিংবা কানে আঘাত করে, আর সেই আঘাতের দাগ বসে যাওয়া কাদেরের মুখের বাম অংশ কিংবা আঘাতের চোটে নাক মুখ দিয়ে বের হয়ে আসা রক্তের কাহিনী সবই পিপড়াকান্দির বাতাসে ওড়াওড়ি করতে লাগল।
শেখদের এই পরাবাড়ির বেতগড়ায় এর আগে এই ধরনের কোন ঘটনা না ঘটলেও পিপড়াকান্দির লোকজন কাদেরালীর মৃত্যুর সাথে হারু শেখের কবর কিংবা আবার হারুর জেগে উঠার সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলে। শেখদের পরাবাড়ি থেকে হারু শেখ কিংবা তার কবর জ্যান্ত হয়ে উঠে দেড়শ বছর পর।
পিপড়াকান্দির শেখদের বাড়ি হারুর মামার বাড়ি। হারুর বয়স তখন ১০ কি ১২। টগার হাওড় তখন যৌবনে টগবগ করে, শীত-বাইস্যা-কাতি সব সময়। ছয় দাঁড়ের নাও ছাড়া টগা পাড় দেয়া হতো স্বপ্ন দেখা। সে সময়ে বাঘেরা মানুষের চেয়ে ঘন বসতিতে ছিল আসেপাশের বন-বাগে। তারও ১০০ কি ১৫০ বছর আগে, টগার পানিতে কিভাবে যেন মুখ দিয়ে দেয় ন্যাংটাবাবার পোষা ১২ ফুটি বাঘটি। তার মুখ থেকে সব বিষ মিশে যায় টগার পানিতে। সে তো যে সে বিষ না। আবার সেই বিষ নাকি খেয়ে নেয় এই হাওড়ের শিং মাছেরা। এখনো আশেপাশের ১০ গাঁয়ের মানুষ বিরত থাকে টগার হাওড়ের শিং মাছ ধরা থেকে। কিন্তু দশ-বারোর হারু মাছ ধরতে গিয়ে ধরে আনে টগার শিং। বাবার শত নিষেধ সত্বেও হারু শিং মাছখানি ছাড়তে রাজি হয় না। ছেলের আবদারে শিংমাছ খানি কাটতে গিয়ে কাটা বিঁধে হারুর মায়ের হাতে। সাড়ে ষোল দিন অসহ্য যন্ত্রণা শেষে মারা যায় হারুর মা। তার মাস তিন পড়ে টগাতেই আচমকা ঝড়ে নৌকা ডুবে মারা যায় হারুর বাবা। লোকে বলে ল্যাংটাবাবার বাঘের বিষ খাওয়া শিং মাছের প্রতিশোধ। আর সেই ১০/১২ বয়স হতেই হারু তার মামাদের কাছে পিপড়াকান্দির শেখ বাড়িতে বাকি জীবন কাটাতে লাগল।
হারুর মামার বাড়িতে আশ্রয় নেয়ার ঘটনাও এখন দেড় শতক পাড় হতে চললো। কখনো কোন কাজ কিংবা লেখাপড়া হারু শেখ করেনি। মামাদের আশ্রয়ে ভবঘুরে জীবন কাটাতে কাটাতে যৌবনে পা দেয় সে। সাথে তার মনে নিয়ে রইল ন্যাংটাবাবার প্রতি প্রতিশোধ নেয়ার জিদ। ন্যাংটাবাবা যদি তার ১২ ফুটি বাঘেরে না ছাড়তো… পোষা বাঘ তার… তারে পানি খাওয়াইতে ছাড়ে কিনা টগার হাওড়ে… তোমার বাঘের বিষ হাওড়ের পানিতে মিশে তা যদি তুমি বুঝতে না পারো তাইলে তোমার কিসের পীরালী! কেমন পীর তুমি?
ন্যাংটার পীরালী সে দেখে নিবে এই আশায় সে দিন গুণতে থাকে। মামাদের গ্রামে ন্যাংটাবাবার কয় ঘর মুরিদ আছে, আর কোন এক সময় ন্যাংটাবাবা এই অঞ্চলেও ঘুরে গেছেন। তার নাকি আবার আসার সময় হয়েছে। লোকে বলে। পুব পাড়ার নুর মমিনের দাদার বাবা, কটু মুন্সী ছিল ন্যাংটা ফকিরের মুরীদ। সেও নাকি ন্যাংটার পীরালীকে দেখে নেয়ার জন্য ন্যাংটাবাবার মুখোমুখি দাড়িয়েছিল। ধারালো অস্ত্রে ন্যাংটাকে করেছিল ক্ষত-বিক্ষত। আহত ন্যাংটাকে তার অন্যান্য ভক্তরা নৌকায় তুলে নিয়ে যায়। খোলা হাওড়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রামের লোকেরা নৌকাটিকে দেখতে পায়। তারপর আজ পর্যন্ত আর কেউ সেই নৌকার কোন হদিস পায় নাই। কিন্তু সুস্থ্য শরীরে ন্যাংটাবাবা আবার সেই রাতেই ফিরে আসে পিপড়াকান্দি গ্রামে। কটু মন্সীর দরজায় কড়া নাড়ে। রাত তখন দ্বিপ্রহর। নির্ঘুম কটু মুন্সী ঘরের মধ্যে আনচান করতে ব্যস্ত। সারা শরীর দিয়ে আগুন ঠিকরে পড়ছে। শরীরে কোন কাপড় সে রাখতে পাড়ছে না। দরজা খুলে কটু মুন্সী দেখে ন্যাংটাবাবা তার দরজায় দাড়িয়ে। অক্ষত শরীর বাবার। তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে ন্যাংটাবাবা, কটু মুন্সীর মাথায় হাত রাখে। সাথে সাথে ঘটে সেই আশ্চয ঘটনাটি। কটুর সারা শরীর ঠান্ডা হযে যায়-বন্ধ হয়ে যায় কটুর ভিতরের উচাটনতা। কিছুটা সময় দাঁড়ানো অবস্থাতেই অচেতন ছিল কটু মুন্সী। চেতনা ফেরার পর তাকে ল্যাংটার পা জড়ানো অবস্থায় পাওয়া যায়। সেই দিনের পর থেকে ল্যাংটাপীরকে এই এলাকায় কেউ না দেখলেও নিশিরাতে কটু মুন্সীর সাথে ল্যাংটার দেখা হওয়া কিংবা কটু মুন্সী যে দিন ল্যাংটাকে আক্রমন করেছিল প্রতি বছর ভাদ্র মাসের সে দিন আক্রমনের যায়গায় বড় করে ওরস করা এখানে প্রায় রীতিতে পরিনত হয়েছিল। অনেকে নাকি গভীর রাতে ওরসের সময় ল্যাংটার ১২ ফুটি পোষা বাঘটিকে সেই স্থানের আশেপাশে দেখতে পেত।
ল্যাংটার প্রথম আবির্ভাবের ঘটনাটি এই অঞ্চলের লোকজনের মুখে এখনো মোটামুটি অবিকৃতই রয়ে গেছে। কিছু যে পরিবতন-পরিবধন হয় নি তা বলার জো নাই। তবুও অনেক বছর ধরেই সেই ঘটনার পরম্পরা মোটামুটি একভাবেই বয়ান হয়ে আসছে। তখনো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে ঢুকেছে কি ঢুকেনি; এই অঞ্চলে তার আঁচ লাগেনি। আর দশটা হাট বারের মতোই মধ্যনগর হাটে কোন এক শনিবার ময়লা শরীর-জটা চুলে উলঙ্গ এক পাগলকে দেখা যায়-দেখা যায় কাউকে ভ্রক্ষেপ না করে হাটময় ঘুরে বেড়াতে। কারো কোন কথাই তাকে স্পশ করছিল না। বেলা বাড়ার সাথে হাটে লোকজনও বাড়তে থাকে, আর বাড়তে থাকে উলঙ্গ অচেনা এক পাগলকে নিয়ে হাটুরে মানুষদের কৌতুহল। এরই মাঝে ঘটে যায় এক আচানক ঘটনা। যে লোক হাটের এতো মানুষের মাঝে অবলীলায় উলঙ্গ চলাফেরা করছে সে-ই তার লজ্জা স্থান দুই হাতে ঢেকে দৌড়ে পালাতে চাইছে হাটের অন্য কোন প্রান্তে! এই ঘটনা লোকজনের কৌতুহলকে আরো এক ধাপ বাড়িয়ে তুলে। রহস্যের কিনারা হয় যখন উলঙ্গ সে লোক হাটের সবচেয়ে বড় কাপড়ের দোকানে গিয়ে একটা গামছা টেনে নেয় আর তাতে ঢাকে তার লজ্জা। কৌতুহলি হাটুরে মানুষ যখন এই বিষয়ের শানে নযূল জানতে চায় তখন, সেই একবারই ন্যাংটাবাবা কথা বলে। বলে- দেখ…
আর তখনই; হাটের লোকজন তাদের চারিদিকে তাকিয়ে কোন মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পায় না। এমন কি নিজেকেও আবিষ্কার করে বিভিন্ন পশুর রূপে। কেউ কুকুর। কেউ বিড়াল, কেউ শেয়াল… শুধু ন্যাংটা অলৌকিক এক উজ্জ্বলতা নিয়ে সকলের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে আর দূরে হাটের অন্য প্রান্তে বংশৗকুন্ডা গ্রামের ক্বারী মৌলভী ইসমাইল উদ্দিনকে দেখা যায় মানুয়ের বেশে। যিনি কিছুক্ষণ আগে নৌকায় এসে হাটে নেমেছেন। এই একমাত্র মানুষের জন্য নিজের লজ্জা ঢাকতে ন্যাংটা হাটে এই কান্ড ঘটিয়েছেন। হাটেতো আগে কোন মানুষই ছিল না। আর পশুর সামনে মানুষের লজ্জা কি? সেই থেকে ন্যাংটা সকলের বাবা হয়ে এই অঞ্চলে অবস্থান করে যাচ্ছেন। তবে ন্যাংটাবাবার পোষা সেই ১২ ফুটি বাঘকে কেউ দেখেছে কি না তা আর এখন কেউ মনে করতে পারে না। শুধু শোনা যায়, মাঝে মাঝে; হয়তো অমাবস্যা কিংবা পূর্ণিমায় রাতের দ্বিপ্রহরের পরে বাঘটি নাকি অদ্ভূত নিরবতা নিয়ে ন্যাংটাবাবার পাশে বসে থাকতো। আর ন্যাংটা পরম মমতায় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। কেউ কেউ বলতো এটা আসলে বাঘ না, ন্যাংটার পোষা জ্বিন। আবার কেউ কেউ এটাকে ন্যাংটাবাবার ছেলে বলতো। কোন এক সময় জ্বিন রাজ্যের কোন এক পরীর সাথে ন্যাংটার বিয়ে হয়। তাদেরই ছেলে এই জ্বিনটি। মাঝে মাঝে বাঘের বেশে পূর্ণিমা-অমাবস্যার রাতে বাঘের বেশে বাপের সাথে দেখ করতে আসে। আর সেই বাঘের জন্য কি না হারু শেখ ন্যাংটার পীরালীকে অভিযুক্ত করার স্পর্ধা দেখায়…?
কিন্তু এই স্পর্ধা নিয়েই ন্যাংটার খোঁজে পিপড়াকান্দি গ্রামে মামাদের বাড়িতে হারু শেখের ১০ বছর কেটে যায়। তবুও হারু এখনো ন্যাংটা বাবার দেখা পায় নি। সেই সময় ভাদ্রের কোন এক রাতে ন্যাংটাবাবার ওরস চলাকালীন সময়ে পিপড়াকান্দি থেকে ডুলপুশি বিলের হিজলবাগে যে অংশ দেখা যায় সেখানে গ্রামবাসীদের কেউ কেউ নাকি আগুন জ্বলতে দেখে। কিন্তু দিনের আলোতে বিলের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা হিজলবাগে তার কোন চিহ্ন খোঁজে পায় না। পরপর কয়েক রাতে এইভাবে বিলের বুকে আগুন কিংবা অলৌকিক আলো গ্রামবাসীদের মধ্যে বিভিন্ন গল্প কিংবা সম্ভাবনার কথা জাগিয়ে তুলে। কেউ বলে “জায়গাটাতে দোষ ধরেছে”, কেউ বলে এইটা “আইগ্গা বইতালের” কাজ। আবার কেউ কেউ এর সাথে হারু ও ন্যাংটার ঘটনার সম্পৃক্ততা জাগিয়ে তুলে। ন্যাংটার পীরালী দেখে নেয়ার যে বাজি হারু শেখ ১০ বছর আগে ধরেছিল তাকে সফল করতেই নাকি ন্যাংটার ওরসের সময় হারু ন্যাংটাকে ডাকতে নিজেই “আইগ্গা বইতাল“ সাজে, যদি ন্যাংটা আসে-হারুর মুখোমুখি দাঁড়ায় তার পীরালী নিয়ে।
হারুর এইসব স্পর্ধা কিংবা কমবখ্ততা তার মামাদের স্নেহ-মমতা-র্ধৈয সব কিছুর শেষ সীমায় এনে দাঁড় করায়। হারুকে তারা এইবার গৃহস্থি দেখতে বলে। আসছে জ্যৈষ্ঠে হারুকে বিয়ে দিয়ে সংসারি করতে মনস্থির করে তার মামারা। আর মামাদের নেয়া এই সিদ্ধান্তের এক সপ্তাহ পর থেকে পরবর্তি ১২ বছর হারু শেখকে পিপড়াকান্দি গ্রামের লোকেরা আর দেখতে পায় নি। মামার বাড়ির লোকেরা সহ পিপড়াকান্দির সকলের কাছে হারু বিস্মৃত হতে হতে নিরুদ্দেশের ১২ বছর পর কোন সুবেহ সাদিকের সময় সূর্যের আগে কিংবা পরে কিংবা সাথে মামাদের পরাবাড়িতে কয়েকজন সংগীসহ উদয় হয়।
পীর হারুকে চিনতে গ্রামের অনেকেরই প্রথম প্রথম কষ্ট হয়। কিছু সময় তাকিয়ে থাকতে থাকতে হারু শেখ গ্রামবাসীদের বিস্মৃতির অতল থেকে উঁকি দেয়; তারপর কারো কাছে ধীরে ধীরে আবার কারো কাছে ঝটকা দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠে। হারু শেখ হারু পীর হয়ে সল্প ভাষী হয়ে উঠে। মামাদের সাথে হয়তো ২/১টা কথা বলে। অন্যরা তার মুখ হতে শুধু “কূলে ওলী কূলে সাঁই, মুর্শিদ তুই বিনে আমার ভরসা নাই” ছাড়া আর কিছুই শুনতে পায় না।
আস্তে আস্তে দেখতে দেখতে হারু শেখ মোটামুটি ভাবে হারু পীর হয়ে উঠে। আশে পাশের ৮/১০ গ্রাম থেকে লোকজন বিভিন্ন মানতে তার কাছে আসতে থাকে। হারু সবাইকে পানি পড়া দেয়। তার পড়া পানিতে লোকজনের কাজ হতে থাকে। হারু পীর হওয়ার পরে শেখেদের পরাবাড়িতেই দিনরাত কাটাতে থাকে। “কূলে ওলী কূলে সাঁই, মুর্শিদ তুই বিনে আমার ভরসা নাই” বলে হারুর ফুঁ দেয়া পানি লোকজন ভিড় করে নিয়ে যায়। কেউ বলে হারু শেখ গত ১২ বছর ন্যাংটার হাওলায় ছিল। ন্যাংটাবাবা নাকি তাকে তুলে নিয়ে যায় জ্বিনের রাজ্যে। সেখানে সে ন্যাংটার মুরিদ হয়। ১২ বছর সাধনার পর ন্যাংটার সন্তুষ্টি লাভের পর সে পায় খেলাফত। তাইতো তার পড়া পানিতে লোকজনের মনোবাঞ্চা পুরা হয়। আবার কেউ কেউ বলে ন্যাংটার পীরালীকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যই ১২ বছর কামরুপ কামাখ্যায় সাধনা শেষে হারু এই অবস্থায় পৌঁছতে পেরেছে। তবে লোকে যাই বলুক বা মানুক হারুর পীরালীতে বিশ্বাস করে না তার মামারা। তাই হয়তো নিজেদের পরাবাড়ির পাশ দিয়ে নৌকা চালিয়ে যেতে যেতে হারু শেখের মামা আব্বাস আলী শেখ তার ভাই আসগর আলী শেখকে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে- “ভাই দেখ; আমরার হারুও পীর হইয়া গেছে…!”
এদিকে পীর হারুর উপস্থিতি এই অঞ্চলে ধীরে ধীরে ন্যাংটাবাবার আধ্যিপত্যকে ম্রিয়মান করে তুলতে থাকে। পিপড়াকান্দিতে ন্যাংটার ওরস আর আগের মতো জমজমাট হয় না। ন্যাংটাবাবার নামের তাবিজের চেয়ে হারু পীরের “কূলে ওলী কূলে সাঁই, মুর্শিদ তুই বিনে আমার ভরসা নাই” বলা পড়াপানিতে মানুষের ভরসা বেশি দেখা যায়। এইভাবে কোন এক ভাদ্রে আর ন্যাংটার ওরসের আয়োজন দেখা যায় না পিপড়াকান্দিতে। আর এটাই ন্যাংটা পীরের প্রতি হারু শেখের প্রতিশোধ কি না তা এই অঞ্চলের কেউই বুঝতে পারে না। যে ভাদ্রে ন্যাংটাবাবার ওরস বন্ধ হয় তার থেকে ৩ ভাদ্র পর কোন এক কাঠফাটা দুপুরে হারু শেখের কবর হয় পিপড়াকান্দির শেখেদের এই পরাবাড়িতে। হারুর পীরালীর প্রতি তার মামাদের অবিশ্বাস কিংবা অনাগ্রহই তাদের পরাবাড়িতে হারু শেখের পীরালী ও তার কবরকে ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের মানুষের স্মৃতি থেকে সরিয়ে দিতে থাকে।
হারু শেখের মুত্যুর প্রায় দেড়শত বছর পর কোন এক ভাদ্রের কাঠফাটা দুপুরে পিপড়াকান্দির শেখেদের পরাবাড়ির বেতগড়ার চাপা পথে যার থেকে শ’খানেক গজ দূরে হারু শেখের কবর; যা আজ আর চিহ্নিত করা যায় না সেখানে কাদের আলীর মৃত্যু অনেক গল্প ও সম্ভাবনা নিয়ে হারু শেখ কিংবা তার কবরকে জাগিয়ে তুলে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১০:১৪