তখন ছিল শীতকাল। বেশির ভাগ মানুষ শীতে কাতর হয়ে পড়ে। আমাদের বাসার পাশেই ছিল বিশাল একটি পুকুর। পুকুরটির নাম ছিল গড়ের পুকুর। সে পুকুরে অনেক মানুষ গোসল করতে আসতো প্রতিদিন। এমন দৃশ্য বারান্দাতে আসলেই প্রতিদিনই দেখতে পেতাম। আমাদের বাসার সামনে একটা খালি জায়গা ছিল, প্রতিদিন বিকাল হলে সেখানে আমরা খেলাধুলা করতাম।
আমরা যে বাসাতে থাকতাম, তার পাশেই একটি মোটামুটি বড় একটি বাসা ছিল। সে বাসার বারান্দাতে একজন বৃদ্ধ লোককে প্রতিদিন বসে থাকতে দেখতাম সবসময়। পুকুর থেকে গোসল করে পাশের বাড়ির বারান্দার এক কোণে বসে রোদ পোহাতেন এবং কি যেন গুণতেন একজন বয়স্ক মহিলা। এমন দৃশ্য প্রায়দিনই আমরা দেখতাম। প্রতিদিনের মত গোসল করে ঐ বারান্দায় সেদিনও বসেছিলেন বৃদ্ধ মহিলাটা। ৭০ উর্দ্ধ বৃদ্ধ লোকটি মহিলাকে লাথি দিয়ে বারান্দা থেকে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলেন। শব্দ পেয়ে খেলা বন্ধ রেখে দৌঁড়ে গিয়ে দেখি উনি রাস্তাতে পড়ে আছেন। উনাকে রাস্তা থেকে উঠিয়ে আমাদের বাসাতে নিয়ে এসেছিলাম। সেদিন প্রতিবাদ করার মত বুদ্ধি ছিল না আমাদের।
ভাবীকে ঘটনাটা বলে আমাদের বাসাতে প্রতিদিন বসতে পারেন এমন ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম আমি এবং আমার ভাতিজা মিলে। ভিক্ষা করা মহিলার পেশা ছিল। সারাদিন বিভিন্ন জায়গাতে ঘুরে কিছু টাকা এবং চাল পেতেন সেগুলো গুনতেন আমাদের বাসাতে বসে। খুব ইচ্ছে করতো পয়সা গুনতে। বেশ কয়েকদিন যাওয়ার পর আমি উনা বল্লাম, আমি আপনাকে কি বলে ডাকবো? উনি একটু মৃদু হাস দিয়ে বলেছিলেন আমাকে বুড়ি মা বলে ডেকো। একদিন বল্লাম বুড়ি মা আমি আপনার টাকা গুণে দিব? উনি সাথে সাথে আমাকে বল্লেন প্রতিদিন তুমি আমার পয়সা গুনে দিও। প্রতিদিন বিকালে সময় কাটতো খেলা করে ও বুড়ি মার পয়সা গুনে।
একদিন জানতে চাইলাম বুড়ি মা আপনার বাড়ি কোথায়? ছেলে মেয়ে কয়জন এবং তারা কোথায় থাকেন? আপনাকে তারা দেখাশুনা করে না কেন? এমন নানা প্রশ্ন করতে থাকি, উনি থমকে থাকেন আমাদের কথা শুনে। আবারো জানতে চাইলাম বলেন না বুড়ি মা। একটু চুপ থেকে শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুখ চেপে কাঁদতেছিলেন। তারপর উনি বল্লেন বাড়ি ছিল রংপুর। উনারা রংপুরের প্রভাবশালী ছিলেন। একাত্তরের যুদ্ধের সময় উনার স্বামী এবং বড় ছেলেকে দূবৃর্ত্তরা মেরে ফেলেছিল এবং ছোট ছেলে পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধের পর দু-একবার ছোট ছেলে মাকে দেখতে এসেছিল। তারপর আর কোন যোগাযোগ করেনি মায়ের সাথে। যেহেতু উনি একা হয়ে গিয়েছিলেন, সে সুযোগটা কাজে লাগিয়েছিল এলাকার লোকজন। উনাদের বাড়ির মুল গেটে দুইটা হাতির মূর্তি ছিল এবং সে মূর্তির পেটের মধ্য অনেক কাচা টাকা রেখেছিলেন। উনাকে উচ্ছেদ করার জন্য খারাপ লোকেরা প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছিল গেটের মূর্তি ভাঙ্গা নিয়ে। মুর্তি ভাঙ্গার পর অনেক টাকা পয়সা পাওয়ার পর এক সময় বুড়ি মাকে তাড়িয়ে দেয় রংপুর থেকে। তারপর থেকেই উনি মেহেরপুর আসেন এবং জীবিকা হিসাবে ভিক্ষা পেশাটাকে বেছে নেন।
আজ অফিসে আসার সময় সিএনজির জন্য মেইন রোডের দিকে আসতেছিলাম, এমন সময় একটা বাসা থেকে ১৮/২০ বছরের একটা ছেলে একজন বয়স্ক মহিলাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় এবং ব্যালেঞ্চ না রাখতে পেরে রাস্তায় ছিটকে পড়ে। আমি প্রথম ছেলেটি কে জিজ্ঞাসা করলাম কেন এটা করেছো? আমার প্রশ্নের জবাব দিল সকাল বেলা ভিক্ষা কেন নিতে এসেছে! আমি যদিও তাকে বল্লাম, তুমি যে কাজটা করেছো সে কাজ মোটেও ভাল করো নি। বরং তাকে ভাল ব্যবহার করে বিদায় করতে পারতে। মানুষের সাথে ভাল ব্যবহার করতে হলে ভাল ইন্সটিটিউশন থেকে শিক্ষা পাওয়া লাগে না, বোধগম্যে আনতে হয়। আমরা প্রত্যেকে নিজের পরিবারেই এই চর্চাটা যদি করি, তাহলে এ সকল দুঃসহ
ব্যবহার এবং খারাপ কাজ থেকে দুরে থাকতে পারি।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৩১