১।
বহু আগে থেকেই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের প্রতি আমার একটা ফ্যাসিনেশন আছে। কি মহা ক্ষমতাশালী সব জিনিস! এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার আর ক্যারিয়ার ব্যাটল গ্রুপ নিয়ে লেখাপড়া করার পর আমার শক্ত ধারনা হয়েছে যে এগুলি থাকার পর কনভেনশনাল যুদ্ধে আমেরিকাকে হারানো, বা কেবল ড্র-ই করা, বাকি পৃথিবীর পক্ষে আদৌ সম্ভব না। চিন্তা করে দেখুন, কিছুদিন আগ পর্যন্তও সমগ্র পৃথিবীর প্রতিরক্ষা বাজেটের ৫৫ ভাগ পেন্টাগন একাই খরচ করতো। এই হিসাবেও আমার 'আমেরিকা বনাম পৃথিবী যুদ্ধ' সিনারিওতে আমেরিকারই জেতার কথা (যদিও সমীকরনটা এতটা সোজা না )।
যাহোক, এবার আসি এই বেহেমথগুলোর কথায়, এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। বর্তমানে যে 'ক্লাসের' এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ব্যবহার করা হয় সেগুলো হল 'নিমিটজ' ক্লাসের। চেস্টার ডাবলিউ নিমিটজ হলেন সেই আমেরিকান অ্যাডমিরাল যিনি মিডওয়েতে জাপানীজ জেনারেল ইয়ামামোতোর চারটি ক্যারিয়ার আর ৩৩২টি এয়ারক্রাফট ধ্বংস করেছিলেন, যা কিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এশিয়ান সমরক্ষেত্রের মোড় আমূল ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
এক একটা নিমিটজ ক্লাস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের দাম পড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার (বা প্রায় ২৭৬ বিলিয়ন টাকা)। ওজন এক লাখ টন; এ-ক লা-খ টন। ক্রু ৬,০০০ এর উপরে। এদের মধ্যে ৩০০০ এর বেশি থাকে মেইনটেনেন্স ইত্যাদিতে। ২৮০০ থাকে এয়ার উইং-এ। ৬০০ এর মত থাকে অফিসার। এ্যাডমিরালের নিজের থাকে ৪৫ জন গার্ড আর ৩৫ জন স্টাফ! একটা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে প্রতি বেলার রান্না সেরকম দেখার মত নাকি ব্যাপার।
এরকম একটা ক্যারিয়ারে প্লেন থাকে ৮০ টা, বিভিন্ন ধরনের। হেলিকপ্টার ৬-৯ টা, নানা রকম। সংগে মিসাইল, নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড আর নিজস্ব ডিফেন্স সিস্টেম তো থাকেই।
পৃথিবীর অন্যান্য 'ধনী' বা 'সামরিকভাবে শক্তিশালী' রাষ্ট্রগুলো এরকম একটা ক্যারিয়ার বানাতেই হিমসিম খেয়ে যায়। তাও কোন দেশ আমেরিকার মত এরকম ৮০ প্লেনের ক্যারিয়ার বানাতে পারে না। ব্রিটেনের যেমন আছে একটা, মাত্র একটা, ৪৫ প্লেনের। ফ্রান্সেরটা ৩৬ প্লেনের। রাশিয়া, জার্মানী, নেদারল্যান্ডস, জাপান, ইসরায়েল এরা নিউক্লয়ার সাবমেরিন আর ডেস্ট্রয়ার নিয়েই খুশি থাকে। আমেরিকা ছাড়া এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের সংখ্যা এখন আঙ্গুলে গোনা যায় (৫-৬ টা হবে)!
আর আমেরিকার আছে কয়টা জানেন? আমেরিকার একারই? ১২টা! এক ডজন! তাও শুধু এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার না, ১৬,০০০ লোক আর ১২টা যুদ্ধজাহাজের ক্যারিয়ার ব্যাটল গ্রুপই আছে ১২টা। যান পালায় যান!
এই বিশাল ১২ ব্যাটল গ্রুপের (যা নাকি সামনে বেড়ে ১৮টা হতে পারে; দুইটা আরব সাগরেই রেখে দিতে হবে না ) মেনটেইনেন্স খরচেই যায় পেন্টাগনের বছরে ৪৪ কোটি ডলার। প্রতি এক বা দেড় দশকে আবার ধীরে ধীরে পুরোনো মডেল ফেজ আউট করে নতুন মডেলও নিয়ে আসা হয়; ইতিমধ্যে নিমিটজ ক্লাসের রিপ্লেসমেন্ট মডেলের কাজ শুরু হয়ে গেছে, ২০১২-তে মনে হয় নামার কথা, নিশ্চিত না যদিও।
২।
একটা ক্যারিয়ার ব্যাটল গ্রুপ কি করতে পারে? হুমম। এক কথায় উত্তর, অর্ধেক দুনিয়া ধ্বংস করতে পারে। প্রতিটা ক্যারিয়ার ব্যাটল গ্রুপের নিজস্ব নিউক্লয়ার স্টকপাইল আছে, ট্যাকটিকাল নিউক থেকে নিউট্রন বোমা পর্যন্ত। আরো আছে নিজস্ব ১১,০০০ টনী গাইডেড মিসাইল ক্রুজার, ২টা করে আল্ট্রা মডার্ন নিউক্লয়ার সাবমেরিন, ডেস্ট্রয়ার, ব্যাটল ক্রুজার, ফ্রিগেট, সোনার/রাডার শীপ ইত্যাদি। ব্যাটল ফরমেশনে নড়াচড়া করার সময় একটা ক্যারিয়ার ব্যাটল গ্রুপের ১,০০০ মাইলের মধ্যে একটা মাছিও না ধরা পড়ে ঢুকতে পারার কথা না। পেন্টাগনের হিসাব অনুযায়ী কেবল মাত্র আর একটি মার্কিন ক্যারিয়ার ব্যাটল গ্রুপ একটি ক্যারিয়ার ব্যাটল গ্রুপের 'ক্ষতিসাধন' করতে পারে। সাধারনত যে মহড়াগুলো হয় তাতে 'রক্ষনাত্মক' (আগে থেকে কোন এলাকায় থাকা) ব্যাটল গ্রুপ বিশালভাবে জয়লাভ করে। সেদিক দিয়ে দেখলে এনট্রেন্চড একটা ব্যাটল গ্রুপকে হারাতে ৩-৪ টা মার্কিন ব্যাটল গ্রুপও লাগতে পারে, আর এগুলো সাধারনত এনট্রেন্চড অবস্থায়ই থাকে।
এত অতিরিক্ত ক্ষমতাশালী হওয়ায় যা হওয়ার তাই হয়েছে। এই মহা শক্তিধর সামুদ্রিক দূর্গগুলো হয়ে গেছে 'পাওয়ার প্রজেক্টর'। এদের পুরোদস্তুর ব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শুন্য। কোথাও আমেরিকার কিছু পছন্দ না হলে এদের শুধু ধারে কাছে চলে যেতে বলা হয়, যেমন ১৯৭১-এ সেভেন্থ ফ্লিটের বঙ্গোপসাগরে আগমন, তাতেই হাউ মাউ কাউ (নাইলে '৭১ এ ভারতের এই বিশাল জয়ের পরও পাকিস্তানের কোন টেরিটরি লস হল না কেন? "সেভেনথ ফ্লিট আসছে আম্মা (গান্ধী)")। বা ভিয়েতনামে ১৯৬৮ সালে 'ইয়াংকি স্টেশন' আর 'ডিক্সি স্টেশন' এর ব্যবহার (এগুলো রোটেটিং ব্যাটল গ্রুপ ছিল; ভিয়েতনামে বম্বিং প্ল্যাটফরম হিসেবও ব্যবহার করা হয়েছিল)।
কিছুদিন আগে ক্যারিয়ার ব্যাটল গ্রুপের মহা ক্ষমতার আরেকটা প্রমান পাওয়া গিয়েছিল যখন মোটামুটি ক্যাজুয়ালি একটা ব্যাটল গ্রুপ থেকে শুট করে পড়ন্ত একটা কৃত্রিম উপগ্রহ ধ্বংস করা হয়। এই কাজটা করাটা মোটামুটি ভয়ংকর রকম কঠিন একটা কাজ হওয়ার কথা; না থেমেই একটা আমেরিকান ব্যাটল গ্রুপ এ কাজ করায় রাশিয়া আর চীনের মাথা পুরা গরম হয়ে গিয়েছিল! চীন এখনও ভূমি থেকে এ কাজ করেই, মানে নিজের ফিক্সড অরবিট স্পাই স্যাটেলাইট মেরে আরকি, লাফালাফি করে!
৩।
এই মহাক্ষমতাধর জাহাজগুলিকে পরাস্ত করার কি তাহলে কোন উপায়ই নেই? আছে, থিওরিস্টদের ধারনা, অসম্ভব স্টেলদী কোন সাবমেরিন দিয়ে। পশ্চিমা বিশ্বের এলিট এ্যাডমিরালরা এখন সব এজন্যই সাবমেরিন সার্ভিসে ঢুকেন, আর এজন্যই রাশিয়ার বিশাল এই নিউক্লিয়ার সাবমেরিন ফ্লিট, যদিও বেচারারা এটার রক্ষনাবেক্ষন করতে পারছে না। খুব উন্নতমানের ভবিষ্যৎ স্টেট অফ দ্য আর্ট একটা সাবমেরিন মডেল (বা খুবই ভাগ্যবান বর্তমান একটা সাবমেরিন মডেল) যদি একটা ক্যারিয়ারের নিউক্লয়ার রিয়্যাক্টরযুগলকে ডিটোনেট করতে পারে গাইডেড মিসাইল (যেমন ব্রিটিশ একসোসেট) দিয়ে, তাহলে কেল্লা ফতে। প্রতিটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের নিজস্ব দুটো জিই পিভিডব্লিউ নিউক্লয়ার রিয়্যাক্টর থাকে। এছাড়া আলাদা নিজস্ব ১০-১২টা টারবাইনও থাকে বিদ্যুৎ জেনারেট করার জন্য। যাহোক এরকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনা খুবই, খুবই কম!
বরং আমেরিকান এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলোর বড় শত্রু হল নিজেদের পাইলট। যারা 'বিহাইন্ড এনেমী লাইনস' মুভিটা দেখেছেন বা ফ্লাইট সিমুলেটর গেমগুলো খেলেছেন তাদের মনে হয় কিছুটা ধারনা থাকবে যে একটা ক্যারিয়ারে ল্যান্ড করা কি কঠিন ব্যাপার পাইলটদের জন্য। এইজন্য আমেরিকার এলিট পাইলটরাই কেবল ক্যারিয়ারগুলোতে কাজ করতে পারে। তার পরও নিয়মিতই (১-৫%) প্লেন বা ক্যারিয়ার ডেকের ক্ষতি হয়। ডিসকভারী চ্যানেল ট্যানেলে প্রায়ই ল্যান্ডিং ভুলের কারনে ক্ষতির ভিডিও দেখায়। একটা এফ-১৪ টমক্যাট গেলে আমেরিকান ট্যাক্সপেয়ারের গেল সাড়ে তিন কোটি ডলার; কিন্তু কি আর, ভুল তো হবেই।
এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলির নাম রাখা হত আমেরিকার স্টেট বা শহরগুলির নামে (টেক্সাস, ফ্লোরিডা, ওরেগন, জর্জটাউন, ইয়র্কটাউন)। এখন রাখা হয় মানুষের নামে। বর্তমানের কিছু ক্যারিয়ারের নাম হল ইউ এস এস জন সি স্টেনিস, ইউ এস এস থমাস জেফারসন, ইউ এস এস আব্রাহাম লিংকন, ইউ এস এস কার্ল ভিনসন, ইউ এস এস জর্জ বুশ (আব্বা বুশ এটা) ইত্যাদি। লিংকন জানি না, কিন্তু জেফারসনের প্রতিক্রিয়াটা জানতে পারলে ভাল হত।
৪।
তাহলে পাঠকগন, কি মনে হয়, এগুলো থাকার পরও কনভেনশনাল ওয়ারফেয়ারে কেউ পারবে আমেরিকার সাথে? কেউ বাদ দিন, বাকি পৃথিবী মিলে ড্র করারও চান্স আছে? এবার বুঝছেন আমেরিকার সাথে বাকি পৃথিবীর মিলিটারি তফাৎ? 'লাইফ ইজ আনফেয়ার' উক্তিটার নতুন অর্থ দাড়ায় যায় এসব ক্যারিয়ার নিয়ে পড়লে।
কি ভয়ানক সুন্দর সব বস্তু! মাস্টার অফ দ্য সেভেন সী'জ, ড্রেড লর্ড অফ দ্য কন্টিনেন্টস!
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মে, ২০০৯ বিকাল ৫:৫৫