নাম তার মতিউর রহমান নিজামী। একাত্তরে এদেশে মানুষ তাকে নাম দেয় মইত্যা রাজাকার। তবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাকে বানায় বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য গঠিত আলবদর বাহিনীর সুপ্রীম কমান্ডার। জামায়াত তাকে নিখিল পাকিস্তান ছাত্রসংঘের (বর্তমানের ছাত্র শিবির) সভাপতি বানায়। একাত্তরের ৯ মাসে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় মানব সভ্যতার বিপরীতে এমন পাপ ও জঘন্য কাজ নেই যা নিজামী করেনি। নিজ জন্মভূমির মানুষের বিরুদ্ধে বর্বরোচিত নির্যাতন, হত্যা, গণহত্যা এবং ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয় নিজামী। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আগ মুহূর্তে পালিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর প্রথম সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের পরশ মেহেরবানিতে আবার উদয় হয়ে বাংলার যাত্রাপালার ভিলেনের মতো হা হা করতে করতে বাংলাদেশের বুকের ওপর কঠিন পাথরের মতো চেপে বসল। পাপের বোঝায় ভারি হলো ৩০ লাখ শহীদের বাংলাদেশ। এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমরা এখনও করে যাচ্ছি, এদের আওলাদ বাহিনী একাত্তরের মতো এখনও গুপ্ত কৌশলে খুন করছে বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের, হুমকি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। এক সময় মইত্যা রাজাকার হয়ে গেল মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ভাগ্য সুপ্রসন্ন, শনৈঃশনৈঃ উন্নতি। গোলাম আযমের পর জামায়াতের আমির হলেন। পাবনার এক অভিশপ্ত এলাকার মানুষ ভোট দিয়ে তাকে সংসদ সদস্য বানালেন। এবার মাওলানা নিজামী আবিষ্কার করলেন, ‘একাত্তরে কোন মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, ওটা ছিল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ।’ এখানেই শেষ নয়। আরও উন্নতি হলো। জিয়াউর রহমানের উপযুক্ত পুত্র তারেক রহমান জামায়াত শিবিরকে মায়ের পেটের ভাই ঘোষণা দিলেন। সুতরাং ভাইয়ের উন্নতির জন্য যা করা দরকার তা-ই করা হলো। ২০০১ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে প্রথমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৃষি এবং পরে শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বানায়। তখনও চাকরিরত কিছু মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাথায় বাজ পড়ে, মহাবিপদে পড়লেন তারা। কোন দেশে কোন কালে সে দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের এমন পরাজয়বরণ করতে হয়নি। জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে প্রধানমন্ত্রী বানালেন রাজাকার শিরোমণি শাহ আজিজুর রহমানকে। বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত একজন সেক্টর কমান্ডারের কাছ থেকে সালাম বা স্যালুট নেয়ার সূক্ষ্ম পরিকল্পনা আঁটলেন শাহ আজিজুর রহমান। জাত পলিটিশিয়ান শাহ আজিজ জানে কিভাবে প্রতিশোধ নিতে হয়। তখন সেনাবাহিনীর পাঁচটি এরিয়ার মধ্যে দুটি এরিয়ায় কমান্ডার ছিলেন দুইজন সেক্টর কমান্ডার। শাহ আজিজ তার নিজ এলাকার পার্শ্ববর্তী যশোর সেনানিবাস পরিদর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ করলে জিয়াউর রহমান তার অনুমোদন দিলেন। তখনও মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত গরম। যশোরের এরিয়া কমান্ডার শাহ আজিজুর রহমানকে অভ্যর্থনা জানাতে অস্বীকার করলেন। কিন্তু ২০০১ সালে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সেদিন আর রইল না। মন্ত্রী হওয়ার পর নিশ্চয়ই নিজামী দরজা বন্ধ করে একাকী অট্টহাসি হেসেছেন। নিজের ও দলের ভাগ্যের রমরমায় মনে মনে নিশ্চয়ই ভেবেছেন ৩০ বছর পরে হলেও একাত্তরে ভালবাসার পাকিস্তান ভাঙ্গায় জড়িত ভারতীয় হিন্দুদের দালাল আর দুষ্কৃতকারীদের উপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার শক্তি এখন তার হাতের মুঠোয়। সুতরাং নিজামী মিশন ঠিক করে ফেললেন। প্রথমত. উপযুক্ত দীক্ষা দিয়ে মাঠে নামালেন সশস্ত্র জঙ্গী সংগঠন গুপ্তঘাতক বাহিনী জেএমবি। দ্বিতীয়ত. পাকিস্তান ভাঙ্গার আরেক শত্রু ভারতকে উপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার জন্য অসমের স্বাধীনতাকামী বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন উলফাকে (ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব অসম) সব রকম অর্থ আর অস্ত্রের যোগানদারের সহায়কের ভূমিকা গ্রহণ করলেন স্বয়ং নিজামী নিজ হাতে। জেএমবি এবং হুজি মিলে দেশব্যাপী মসজিদ, গির্জা, মন্দির, আদালত, বার, বিচারক, বিদেশী রাষ্ট্রদূতসহ বাঙালিত্ব ও মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী মানুষ ও সংগঠনের ওপর একের পর এক বোমা আর গ্রেনেড হামলা শুরু হয়ে গেল। জেএমবি নেতা সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলাভাই রাজশাহীর বাগমারায় নিজস্ব হুকুমাত কায়েম করলেন। বিরুদ্ধবাদীদের থেকে বাছাই করে ২৩ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করলেন। মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য এক হতভাগ্যের মৃতদেহ উল্টো করে গাছের ডালের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখলেন। এর ছবি সাংবাদিকরা নিজামীকে দেখানোর পর তিনি বললেন, এসব মিছা কথা, সাংবাদিকদের বানানো গল্প। বিশাল ট্রাক-বাস মিছিল নিয়ে দিনের বেলায় রাজশাহী শহরে গেলে তৎকালীন এসপি মাসুদ বাংলাভাইকে অভ্যর্থনা জানালেন। টেলিভিশন ও পত্রিকায় ছবিসহ খবর প্রকাশের পর নিজামী আবার বললেন, ‘এসব মিছা কথা, বাংলাভাই বলে কেউ নেই।’ বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সবাই নীরব রইলেন। তারপর উলফার জন্য দশ ট্রাক অস্ত্র পাচারের সব ব্যবস্থা হলো নিজামীর শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংরক্ষিত এলাকা চট্টগ্রামের সারখানার জেটির মাধ্যমে। দশ দিন চোরের একদিন গেরস্তের ফর্মুলায় ২০০৪ সালে ২ এপ্রিল ধরা পড়ে গেলেন নিজামী ও গং। বাংলাদেশের সমস্ত মানুষ নির্বাক ও হতভম্ব। নিজ দেশের নিরাপত্তাকে ভয়ানক হুমকির মধ্যে ফেলে পাকিস্তানের এজেন্ডা বাস্তবায়নে অসমের উলফাকে অস্ত্র পাচারে জড়িত দেশের স্বয়ং মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবর্গ এবং রাষ্ট্রের টপ নিরাপত্তা কর্মকর্তাগণ। ভাবা যায় না, বিশ্বে এমন উদাহরণ বিরল। সেই অস্ত্র চোরাচালান মামলায়ও নিজামীর ফাঁসি হয়েছে। কথায় আছে পাপে ছাড়ে না বাপেরে। যুদ্ধাপরাধের মামলায় আপীল বিভাগ রায়ে উল্লেখ করেছেন, ‘একাত্তরে নিজামীর ন্যূনতম অপরাধগুলোও ছিল ভয়ঙ্কর ও বীভৎস। এ কারণেই মৃত্যুদ- ছাড়া অন্য কোন শাস্তি হতে পারে না। মৃত্যুদ-ই তার ন্যূনতম শাস্তি’ (জনকণ্ঠ-১৬ মার্চ ২০১৬)। কিন্তু নিজামী ও গংদের কোন আফসোস নেই, দুঃখ প্রকাশ নেই, ক্ষমা চাওয়া নেই। এখনও এদের আওলাদেরা ‘ভি’ চিহ্ন দেখায়। দেশের অভ্যন্তরে জামায়াতের আর্থিক সাম্রাজ্য এবং বিএনপির মিত্রতাই তাদের এমন সাহস ও ঔদ্ধত্যের মূল উৎসস্থল। ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর চাঁপাইনবাবগঞ্জের জনসভায় বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলে দিলেন নিজামী, সাকা, মুজাহিদ কোন অপরাধ করেনি, এদের মুক্তি দিতে হবে (সমকাল ২০ অক্টোবর, ২০১১)। বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার খোন্দকার মাহবুব হোসেন তার বিদ্যা-বুদ্ধির ওপর নিচে যা আছে তার সব দিয়ে চেষ্টা করছেন এহেন খুনী যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য। বাংলাদেশের এক শ্রেণীর ছদ্মবেশী জামায়াতপ্রেমিক মানুষরা বলে বেড়ান এতদিন পর এই বিচারের প্রয়োজন কেন হলো? এরা সব জেনেও সত্যকে গোপন করেন। এদের জন্য একটা উদাহরণ দেই। সংবাদ সংস্থা এএফপির বরাতে গত ৩০ এপ্রিল পত্রিকায় একটা খবর পড়লাম। তাতে দেখলাম ৯৪ বছর বয়সের এক নাৎসি বাহিনীর যুদ্ধাপরাধীকে সম্প্রতি বিচারের জন্য জার্মানির আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। তার নাম রেইনহোল্ড হ্যানিং। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি হিটলারের এসএস বাহিনীর সামান্য একজন গার্ড (সেপাই) হিসেবে অন্যদের সঙ্গে দায়িত্বে ছিলেন একটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে, যেখানে ১ লাখ ৭০ হাজার বন্দীকে হিটলারের ঘাতক বাহিনী হত্যা করে। ৭০ বছর পর রেইনহোল্ড হ্যানিং এখন আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘আমি অত্যন্ত ব্যথিত, দুঃখিত, মর্মাহত। কারণ আমি এমন একটা বাহিনীর সদস্য ছিলাম, যারা নির্বিচারে নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে, অগণিত ফ্যামিলির দুঃখ-কষ্ট ও ধ্বংসের কারণ হয়েছে। হ্যানিং আদালতে মাথানত করে বলেছেন, আমি লজ্জিত, সে সময়ে আমার সামনে ও জ্ঞাতসারে, এমন বর্বর হত্যাকা- ঘটেছে, যা প্রতিহত করার জন্য আমি কিছুই করতে পারিনি। আমার আচরণের জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।’ আর বাংলাদেশের নিজামীরা একাত্তরে ঘাতক বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। নিজামী হুকুম দিয়েছেন, হত্যাযজ্ঞে পাকিস্তানীদের সহযোগিতা করেছেন এবং নিজেও প্রবল জিঘাংসায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর। তার পরেও এদের কোন আফসোস নেই, লজ্জা নেই বরং তাদের আওলাদ ও মিত্র জোটসঙ্গী নেতাদের কথাবার্তা, কার্যকলাপ শুধু দুঃখজনক বললে কম বলা হবে। বাংলাদেশ আজকে যে জঙ্গীবাদের সঙ্কটে পড়েছে এবং টার্গেটেড কিলিং হচ্ছে তার মূলেও রয়েছে, জামায়াতের উত্থান ও বিস্তৃতি। রিভিউ পিটিশনের শুনানির সময় আদালত বলেছেন, ‘এই নিজামী গংদের সহযোগিতা না পেলে দুই মাসের মধ্যে পাকিস্তানী বাহিনী পরাজিত হতো।’ আদালতের এই পর্যবেক্ষণটি খুবই সঠিক ও গুরুত্বপূর্ণ। দুই মাসে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পরাজিত হলে বাংলাদেশের সার্বিক ক্ষয়ক্ষতি ও জীবনহানি অনেক কম হতো। ৩০ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হতো না। এর অর্থ এই ৩০ লাখ মানুষের জীবনপাতের জন্য পাকিস্তানী বাহিনীর থেকেও এই নিজামী গংদের দায় অনেক অনেক বেশি। যারা বলেন, মূল হোতা পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বাদ দিয়ে সহযোগীদের বিচার করা ঠিক হচ্ছে না, তাদের জন্য আদালতের উপরোক্ত পর্যবেক্ষণটি একটা উপযুক্ত জবাব। তাই বাংলাদেশের মানুষের আরেকটি বহুল প্রতীক্ষার অবসান হলো ৫ মে বৃহস্পতিবার। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত রিভিউ পিটিশন খারিজ করে নিশ্চিত করলেন মৃত্যুদ-ই নিজামীর ন্যূনতম শাস্তি।
লেখক একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক