গত ২৪ এপ্রিল পূর্ণ হলো রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি দিবস। ২০১৩ সালের ওইদিনে ঢাকা শহরের অদূরে আশুলিয়া-সাভারে অবস্থিত রানা প্লাজা নামক একটি বহুতল ভবন ধসে পড়ে। ভবনটিতে ৫টি পোশাক শিল্প কারখানা, বেশকিছু দোকানপাট এবং অফিস ছিল। ভবনের ধারণ ক্ষমতার চাইতে অনেক বেশি ওজনের এসব প্রতিষ্ঠান, কর্মরত শ্রমিক কর্মকর্তা, কর্মচারী, যন্ত্রপাতি এতে স্থান পেয়েছিল। অনেকই এ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করলেও ভবনের, কারখানার মালিক এবং আরো কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি তাতে কর্ণপাত করার প্রয়োজন মনে করেননি। ভবনের মালিক না হয় বিষয়টি অবজ্ঞা করতে পারেন কিন্তু এতগুলো গার্মেন্টস শিল্পের মালিক কীভাবে নিজেদের কারখানার যন্ত্রপাতির ওজন, বিপুলসংখ্যক শ্রমিক কাজ করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি এই বিষয়টি আমাদের বিস্মিত এবং হতবাক করে। ওইদিন সকালে সবেমাত্র শ্রমিকরা কাজে যোগদান করলেন। শ্রমিকদের বেশিরভাগই গ্রামের হতদরিদ্র ঘরের নারী যারা জীবন-জীবিকার জন্য গার্মেন্টেসে কাজ করতে এসেছেন। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভবনটির ওপর তলা ভেঙে পড়তে থাকে, দেবে যেতে থাকে, কাত হয়ে পাশের ভবনের গায়ে গিয়ে পড়তে থাকে। ক’জন শ্রমিক দৌড়ে বের হয়ে আসতে সক্ষম হলেও বেশিরভাগই তো চাপা পড়ে ভাঙা ভবনের তলায় তলায়, যন্ত্রপাতির নিচে। তাৎক্ষণিকভাবে অনেকে মারা গেলেন, অনেকে মারাত্মক আঘাত পেয়ে লুটে পড়েন, অনেকেই ফাঁক-ফোকড়ে আটকে পড়েন। এ এক বীভৎস যন্ত্রণা, কাতরানো এবং বেঁচে থাকার আকুতির দৃশ্য।
সেই সময় রানা প্লাজার কথা ক’জনই বাইরে জানতেন? কিন্তু আকস্মিকভাবে ভেঙে পড়ার পর বিষয়টি বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত হতে থাকলে হাজার হাজার মানুষ ভবনের নিচে আটকে পড়া জীবিত ও মৃতদের উদ্ধার করতে ছুটে যায়। গোটা দেশ তখন ছুটে গিয়েছিল আর্ত মানুষের পাশে, সরকারি প্রশাসন, ফায়ার ব্রিগেড, সেনাবাহিনী এবং নানা ধরনের উদ্ধারকারী সংস্থা রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে দুর্গতদের উদ্ধারে রাতদিন নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে থাকে, আহতদের চিকিৎসা প্রদানে হাসপাতাল তাঁবু, চিকিৎসা কেন্দ্র ইত্যাদি যেখানে যা প্রয়োজন পড়েছিল তাই করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। খাবার, আর্থিক সাহায্য, কাপড়, রক্তাদানসহ নানা ধরনের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছিল সবাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রানা প্লাজার ধ্বংসযজ্ঞের বিশালতা বুঝতে পেরে সামরিক বাহিনীকে তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার কাজে নিয়োজিত করেন, সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানে একটা ফান্ড গঠন করেন। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থাও একইভাবে হাত বাড়িয়ে দেয়। কষ্টের অভিজ্ঞতা হলো, আটকে পড়া নারী শ্রমিককে উদ্ধার করতে গিয়ে একজন প্রকৌশলী অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারালেন। অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী তরুণ-তরুণী নানা উদ্ভাবনী প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটিয়ে বেশ কিছু আহত এবং অক্ষত মানুষকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন। বস্তুত রানা প্লাজার দুঃসহ স্মৃতি কয়েকদিন গোটা জাতিকে দারুণভাবে কষ্ট দিয়েছে। সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানোর এক বিরল নজির সৃষ্টি করেছিল। রানা প্লাজার ধ্বংসযজ্ঞের বিষয়টি আমাদের সবার অনুমানকে হার মানিয়ে গিয়েছিল। এমনকি বিদেশি মিডিয়াতেও এর খবর প্রতিদিন ছাপা হতে থাকে। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার করে সেই সব নারী শ্রমিকের খবর দেশে-বিদেশে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হতো। এটি একদিকে মানবতার সেবায় আমাদের জনগণ, বিভিন্ন উদ্ধারকারী গোষ্ঠীর সাফল্যের প্রকাশ যেমন ছিল যা বিদেশিরা দূর থেকে দেখে অভিভূত হয়েছিল, অন্যদিকে আমাদের পোশাক শিল্প কারখানার দুর্বলতাও প্রকাশ পেতে থাকে। কিন্তু সেই সময় আমাদের প্রাণপণ চেষ্টা ছিল জীবিত সব শ্রমিককে উদ্ধার করা। সম্ভবত ১৭ দিন পর রেশমা নামক এক নারী শ্রমিককে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করার বিষয়টি ছিল সবার কাছে অবিশ্বাস্য রকমের। বলা চলে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে জীবিত, মৃত ও আহতদের উদ্ধার করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দেশে-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছে। প্রকৃতই আমরা প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় সাহস, ধৈর্য, আবেগ, ভালোবাসা, মানবতা ইত্যাদি গুণাগুণকে কাজে লাগাতে আমরা সর্বোচ্চ শক্তির নিয়োগ করি এবং সেটি রানা প্লাজার উদ্ধার কাজ থেকে প্রমাণিত।
রানা প্লাজার এমন ভয়াবহ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছেন ১১৩৮ জন মানুষ যাদের বেশিরভাগই কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিক ছিলেন। কিছুসংখ্যক পুরুষ শ্রমিকও ছিলেন। ২০৪০ জনের বেশি আহত শ্রমিককে উদ্ধার করা হয় এবং এদের মধ্যে ৮৪০ জনের চিকিৎসার ব্যবস্থা বিজিএমইএ করে। একই সঙ্গে সংস্থাটির কারখানায় ২৮৩৪ জনকে বেতন-ভাতা প্রদান করে। ১২ জন অন্তঃসত্ত্বা নারী শ্রমিককে ৩৫ হাজার টাকা করে ভাতা দিয়েছে। বিজিএমইএ ২৩৯ জন আহত শ্রমিককে কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবল (সিএসআর) অর্থদান করেছে। অনাথ ৫৮ শিশুকে মাসে দুই লাখ টাকা হারে ভাতা দিচ্ছে সংস্থাটি। বিজিএমইএ বেতন, চিকিৎসা ভাতাসহ নানা খাতে মোট ১৫ কোটি টাকা খরচ করেছে। অনাথদের জন্য খরচ করেছে ৭৫ লাখ টাকা। প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য তহবিলের বিজিএমই-এর পক্ষ থেকে ২২ কোটি ৯৩ লাখ, ৫৮ হাজার ৭২০ টাকা প্রদান করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪১ জন মারাত্মকভাবে আহত রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। এদের প্রত্যেকের জন্য ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে খরচ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে ২.৯ মিলিয়ন ডলারসহ মোট ৩০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য তহবিল থেকে বিতরণ করা হয়েছে রানা প্লাজার আহত-নিহতদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে। ৯৬২ জনের পারিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ৭৭৭ জনকে সরকার বিভিন্ন জায়গায় চাকরির ব্যবস্থা করেছে। রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তহবিলে ১৭ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য করেছে। তারপরও বেশকিছু শ্রমিকের নিখোঁজ, পরিচয় উদ্ধার না করতে পারার বিষয়টি কষ্টের এবং দুর্ভাগ্যজনক। তাদের পরিবারকে একইভাবে সাহায্য করার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা ও জটিলতা রয়েছে। তারপরও বলতে দ্বিধা নেই রানা প্লাজার বিপর্যয় বাংলাদেশ কাটিয়ে উঠতে পারার পেছনে সরকার, বিজিএমইএ এবং বিভিন্ন সংস্থার উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এটি বাংলাদেশে বেশ দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করা গেছে। সেটি কি কম গুরুত্বপূর্ণ? অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর দেশের সব মহল থেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছিল যে, আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প হয়তো মারাত্মক সংকটে পড়বে। এটি রোধ করা বোধহয় সম্ভব হবে না। কেননা বর্তমান বিশ্ববাজারে পোশাক শিল্প নিয়ে বড় ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। বায়াররা হয়তো বাংলাদেশ থেকে দ্রুতই চলে যাবেন। এমন আশঙ্কা ছিল। তেমনটি ঘটলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প মারাত্মক সংকটে পড়ত। একই সঙ্গে লাখ লাখ নারী শ্রমিক এবং দরিদ্র পরিবারগুলো শহর থেকে কর্মচ্যুত হয়ে উঠে যেতে বাধ্য হতো। দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয়ও নেমে আসত। ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে এ ধরনের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা দেশে বিরাজ করছিল। কিন্তু সরকার এবং বিজিএমইএ শুরু থেকেই করণীয় নির্ধারণে বিলম্ব করেনি। ফলে পোশাক খাত আইনি এবং ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়নে দ্রুত বড় ধরনের সাফল্য দেখাতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের পোশাক রফতানিতে ন্যূনতম নেতিবাচক কোনো প্রতিক্রিয়া পড়ার আগেই দ্বিতীয় কোনো রানা প্লাজার বিপর্যয় যেন না ঘটে সেই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বিষয়টি বিদেশি নানা সংস্থা, পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন গোষ্ঠী শুরু থেকেই পর্যবেক্ষণ করেছে। তারা এখন স্বীকার করছে যে, বাংলাদেশে পোশাক শিল্পে এখন আর আগের মতো যবুথবু অবস্থা বিরাজ করছে না, সরকার এবং বিজিএমইএ কঠোর নজরদারি প্রতিষ্ঠা করায় প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো ধরনের গড়িমসি করেনি যে, সব প্রতিষ্ঠান সময়মতো সংস্কার করতে পারেনি সেগুলোর দায়িত্ব কেউ নেয়নি। তাছাড়া রানা প্লাজার ধ্বংস মালিকদেরও বোধোদয় ঘটিয়েছে যে, এভাবে শিল্পপতি হওয়া যায় না, উচিতও নয়। এমন বিপর্যয় ঘটলে গোটা পুঁজিই শুধু ধ্বংস হয় না, নিজেদের জীবনও শেষ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এভাবে শিল্প কলকারখানা চালানো উচিত নয়। ফলে মালিক পক্ষও বুঝতে পেরেছে, শিল্প প্রতিষ্ঠানের পরিবেশকে আগে কর্মজীবী মানুষের জীবন নিরাপত্তাদানকারী করতে হবে, তাতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক কমে যায়। কোনো প্রতিষ্ঠান এভাবে ধসে পড়লে তো সবই শেষ হয়ে যায়। এই উপলব্ধির জন্য রানা প্লাজার ট্র্যাজেডির অপেক্ষা করতে হলো সেটিই আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। তবে শেষ পর্যন্ত এক্ষেত্রে অগ্রগতি প্রশংসনীয়।
এমন অগ্রগতির কথা স্বীকার করেছে টিআইবির মতো সংস্থা। টিআইবি গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানায় যে, পোশাক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য সরকার এবং সংশ্লিষ্টরা প্রায় ১০২টির মতো উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যেগুলোর ৭৭ শতাংশেই সফলতা দেখা দিয়েছে। তবে ১৩টির উদ্যোগে এখনো স্থবিরতা বিরাজ করছে বলেও টিআইবি উল্লেখ করেছে। টিআইবি এ ক্ষেত্রে আরো প্রায় ১০টির মতো সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করেছে। বিষয়গুলো সরকার এবং বিজিএমইএসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো ভেবে দেখতে পারে। আমাদের পোশাক শিল্পের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি তো দেশের অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থাকেও দ্রুত পরিবর্তন আনতে পারে। তবে বাংলাদেশ তিন বছরে রানা প্লাজার শোককে অনেকটাই শক্তিতে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বড় ধরনের প্রমাণ রাখতে পেরেছে।
তবে রানা প্লাজার দুর্ঘটনার জন্য যেসব ব্যক্তি ও গোষ্ঠী দায়ী তাদের বিচারের বিষয়টি এখনো আলোর মুখ দেখেনি বলে অভিযোগ আছে। আমাদের মনে হয় এ ক্ষেত্রে কেন এমন হতাশাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো তা তলিয়ে দেখা প্রয়োজন, দ্রুত এমন দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার সম্পন্ন করা প্রয়োজন। রানা প্লাজার বিপর্যয় রোধে কর্তৃপক্ষ পোশাক শিল্পে মারাত্মক বিপর্যয় রোধে সফল হয়েছে সেই কর্তৃপক্ষ দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারে সফল হবে না তা আমরা ভাবতে চাই না। রানা প্লাজার নিহতরা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। সাহায্য বা বিচারের প্রত্যাশা করবে না, কিন্তু আহত ও পঙ্গু হয়ে যারা বেঁচে আছে, যাদের বেঁচে থাকাটাই ভীষণ কষ্টের ঘানি বয়ে বেড়ানোর বোঝা তাদের কমবে কীভাবে? আমরা আর কোনো রানাকে প্লাজার মালিক হিসেবে দেখতে চাই না যাদের অর্থ ও ক্ষমতার দম্ভ এমন বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। আমরা সতর্ক থাকতে চাই এসব ব্যক্তির কাছ থেকে। আমরা স্মরণে রাখতে চাই রানা প্লাজায় যারা নিহত, আহত ও পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছেন, একই সঙ্গে সেই মানুষগুলোকে যারা আর্তমানবতার সেবায় সেদিন উদ্ধার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ওরাই আমাদের হিরো আমাদের প্রেরণাদায়ক মানুষ।
ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী লেখক: ইতিহাসতত্ত্ববিদ ও শিক্ষাবিদএবং রাজনীতির বিশ্লেষক
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১০:৪০