somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পিতমাতা vs সন্তানের চাহিদা

৩০ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১২:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনেক স্বেচ্ছাচারী পিতামাতা আছেন যারা দাবি করেন, যেহেতু তারা জন্ম দিয়েছেন, সেহেতু তারা সন্তানের উপর যাচ্ছে তাই করার অধিকার রাখেন। তাদের মতে, কেউ যদি নিজের সন্তানকে 'শাসন' (মূলত নির্যাতন) করে, তাহলে অন্য কারো সেখানে নাক গলানোর এখতিয়ার নেই। এমনকি নির্যাতিত শিশুটিরও অধিকার নেই কোনরূপ ক্রন্দন বা 'উহ' শব্দটি করার। তাদের দাবি, পিতামাতার খামখেয়ালীপনা বা স্বেচ্ছাচারিতা মেনে নিতে না পারলে বাচ্চাকে আল্লাহ গুনাহ দিবে।
তাদের এ দাবি কতটা গায়ের জোর ও গলার জোরের উপর প্রতিষ্ঠিত, আর কতটা যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায়নীতিভিত্তিক, সেটা এবার বিচার করা যাক। তাদের দাবি, যেহেতু তারা জন্ম দিয়েছেন, লালন-পালন করে বড় করেছেন, তাদের কৃপা ছাড়া যেহেতু সন্তান অস্তিত্বই লাভ করত না, সেহেতু সন্তানকে কষ্ট দেয়া বা সন্তানের ক্ষতি করবার অধিকারও তাদের রয়েছে। (অবশ্য ক্ষতি চান বলে কেউ সরাসরি স্বীকার করেন না, বরং অধিকাংশ পিতামাতাই দাবি করেন, তারা যা করেন ভালর জন্যই করেন। নিজের স্বার্থ বা খামখেয়ালী অভিলাষকেও তারা সন্তানের ভাল বলেই চালিয়ে দেন।) এখন আমরা তাদেরকে প্রশ্ন করতে চাই, তেনারা যদি জন্ম না দিতেন, তাহলে কি হতো? বড়জোর সন্তান অস্তিত্বেই আসত না। যার কোন অস্তিত্ব নেই, তার কোন সুখ-দু:খও নেই। এখন আপনাদের আচরণ বা আপনাদের দেয়া কষ্ট যদি কোন শিশুর বেলায় এই পর্যায়ে চলে যায় যে, এ সমস্ত কষ্ট ভোগ করার চেয়ে অস্তিত্বে না আসলেই ভাল ছিল, তবুও কি বলবেন যে, অস্তিত্বে এনে দিয়েই ধন্য করেছেন? শিশুটির জন্মই যদি না হতো, তবে তো তাকে কোনরূপ কষ্টের সম্মুখীনই হতে হতো না। বিশেষ করে যে সমস্ত শিশু পিতামাতার কাছ থেকে সুখ-শান্তি ও আনন্দ লাভের চেয়ে দু:খ-কষ্ট ও বেদনাই বেশি পায়, তারা তো বলতেই পারে, আমাদেরকে তোমরা জন্ম দিয়ে কষ্টে ফেলার চাইতে জন্ম না দিলেই ভাল করতে। একটা বাচ্চা পিতামাতার কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে কেবল তখনই বাধ্য, যখন সে নিশ্চিতভাবে অনুভব করবে, সে পৃথিবীতে না আসার চেয়ে পৃথিবীতে আসাটাই তার জন্য কল্যাণকর হয়েছে। বিশেষ করে কোন পিতামাতা যদি সন্তানের দুনিয়ার জীবন নষ্ট করার পাশাপাশি ভুল পথে চালিত করবার দ্বারা আখেরাতের জীবনটাও নষ্ট করে দেয়, সেক্ষেত্রে তো একথা আরো নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, জাহান্নামের আগুনে জ্বলার চেয়ে সৃষ্ট না হওয়াটাই লাখো কোটি গুণ ভাল ছিল। অতএব, পার্থিব ব্যাপার হোক বা ধর্মীয় ব্যাপার হোক, সন্তানের উপর পিতামাতার খেয়ালখুশীটাই চূড়ান্ত হতে পারে না, তাদের চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত মেনে নিতে সন্তান সবক্ষেত্রে বাধ্য নয় এবং নিজেদের মতামত প্রতিষ্ঠার জন্য শিশুদের উপর নির্যাতন করাটাও পিতামাতার জন্য প্রশ্নাতীত বৈধ অধিকার নয়।
এবার আসি কর্তৃত্ব ও এখতিয়ার প্রসঙ্গে। ইসলামের দৃষ্টিতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও শর্তহীন সার্বভৌমত্বের অধিকার একমাত্র আল্লাহর। কোন রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক বা পিতামাতার অধিকার নেই নিজের খামখেয়ালীবশত কোন যৌক্তিক কারণ ছাড়া কাউকে কষ্ট দেয়ার বা হয়রানি করার। প্রাচীন রোমান আইনে পরিবারের কর্তা পিতাকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে পরিবারের সদস্যদের জীবনের মালিক হিসেবে ধরা হতো এবং স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যা করবার অধিকার স্বীকৃত ছিল। এমনকি বর্তমানে কোন কোন ধর্মীয় আলেমও পিতামাতার মর্যাদা ও ফযীলত বয়ান করতে গিয়ে পিতামাতার হাতে খুনের লাইসেন্স পর্যন্ত তুলে দিয়ে বসেন। তারা ফতোয়া দেন, পিতামাতা যদি সন্তানকে হত্যা করে, তাহলে নাকি তার জন্য কোন কিসাস নেই। অথচ কোরআন বা হাদীসের কোথাও এমন কোন ফয়সালা দেখতে পাইনি। তবে কিসাস না থাকা বলতে এটা হতে পারে যে, পিতামাতা যদি সন্তানকে চড় দেয়, তাহলে সন্তান পাল্টা চড় দিতে পারে না। স্ত্রী বা সন্তান যদি অসদাচরণ বা অন্যায় কাজ করে, তখন তাকে লাইনে আনার জন্য সহনীয় মাত্রায় হালকা শারীরিক শাস্তি প্রয়োগ করার এখতিয়ার ইসলাম দিয়েছে এবং সেক্ষেত্রে স্বামীকে বা পিতামাতাকে পাল্টা চড় মারার অনুমতিও ইসলামে দেয়া হয়নি। কিন্তু এ ধরনের শাস্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে শর্ত হল এটার পিছনে যৌক্তিক কারণ থাকতে হবে। যেমন- ছেলে চুরি করল বা কারো সাথে মারামারি করে কারো মাথা ফাটিয়ে আসল কিংবা কোন অশ্লীল কাজ বা অশ্লীল কথায় লিপ্ত হল ইত্যাদি। তথাকথিত লেখাপড়া নিয়ে পান থেকে চুন খসলে বাচ্চার উপর সর্বশক্তি নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ার এখতিয়ার ইসলাম কাউকে দেয়নি। শাস্তি প্রদানের আরেকটি শর্ত হল, দোষী ব্যক্তিকে প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। দুই বছরের বাচ্চা লিখতে না চাওয়া বা ৬ মাসের বাচ্চা খাবার মুখে নিয়ে বমি করে দেয়া কোন শাস্তিযোগ্য অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না। অতএব, কিসাস মওকুফ বলতে শুধু এতটুকু বোঝায় যে, যৌক্তিক কারণে কোন শাস্তিযোগ্য অপরাধের শাস্তি বা শাসনযোগ্য ব্যাপারে শাসন করার কারণে কোন পিতামাতা যদি সন্তানকে কেবল যতটুকু শাস্তি প্রাপ্য ততটুকুই দেয়, বাড়াবাড়ি না করে, তখন সেজন্য পিতামাতাকে (স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্বামীকে) পাল্টা শাস্তি দেয়া যাবে না। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, খুনের মামলাও ডিসমিস হয়ে যাবে। বরং কিসাসের ক্ষেত্রে একমাত্র স্বজন (সন্তান বা পিতামাতা) হত্যার মামলাই মওকুফের অযোগ্য। কারণ, অন্য কেউ খুন করলে সেক্ষেত্রে নিহতের আপনজনদের এখতিয়ার থাকে হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেয়ার। কিন্তু হত্যাকারী যদি স্বয়ং পিতামাতা বা সন্তান হয়, তখন তাকে ক্ষমাটা করবে কে?
মানুষের উপর মানুষের সার্বভৌমত্ব তথা একজনের উপর আরেকজনের নিরঙ্কুশ এখতিয়ারকে ইসলাম স্বীকার করে না। হুকুম জারি কিংবা হুকুম লংঘনের দায়ে শাস্তি প্রদান কেউ নিজের ইচ্ছামাফিক করবে- ইসলাম এটা অনুমোদন করেনি। "মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ" প্রবাদটি একটি শয়তানী বাক্য বৈ আর কিছু নয়, যা রচনা করা হয়েছে কেবল অন্যায় ও জুলুমের এখতিয়ারকে একচেটিয়া ও নির্বিঘ্ন করবার জন্য এবং যেকোন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের দ্বার বন্ধ করার জন্য। একজন ইচ্ছেমত আরেকজনের উপর যতখুশী তত জুলুম করে বেড়াবে, আর অন্য কেউ যাতে সেই জুলুমে ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করাই এ প্রবাদ বাক্যটির উদ্দেশ্য। ইসলামের দৃষ্টিতে মজলুমকে সাহায্য করা শুধু বৈধই নয় বরং একটি ফরজ কর্তব্য। এক্ষেত্রে জালেম যদি মজলুমের মাও হয়, আর প্রতিবাদকারী বা সাহায্যকারী ব্যক্তি যদি শিশুটির কোন আত্মীয় নাও হয়, তবুও এ দায়িত্বটি পালনে আইনগত কোন বাধা নেই। জালেম ও মজলুম যেদেশেরই হোক, আর মজলুমের পক্ষ অবলম্বনকারী ব্যক্তি যেদেশ থেকেই আসুক না কেন, এটা দেখার বিষয় নয়। অন্যের (পরিবার বা রাষ্ট্রের) অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা যাবে না- এ কথাটি মানুষের মনগড়া নীতি; বিশেষ করে যখন তা মজলুমের অধিকার হরণে এবং মজলুমকে অসহায় করে রাখতে ব্যবহৃত হয়। ইসলাম মানুষের প্রাইভেসী ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে সম্মান করে, কিন্তু জুলূমের ব্যাপারে কোন জালেমকে সুরক্ষা দেয় না। তদুপরি সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ সংক্রান্ত বিধানটি আল্লাহ আমভাবেই নাযিল করেছেন, কোন ব্যতিক্রম নির্ধারণ করেননি, এ দায়িত্বটি পালনের ক্ষেত্রে কোন 'ইযা' (যদি) বা 'ইল্লা' (ছাড়া/ব্যতীত) যুক্ত করা হয়নি। কোন ভৌগলিক সীমারেখা, গোত্রীয় ভিন্নতা, বাড়ির দেয়াল, বয়সের ফারাক কোন কিছুই অন্যায়ের বিশেষত জুলুমের প্রতিবাদ করবার পথে বাধার প্রাচীর হতে পারবে না। ইসলাম বড়দের সম্মান করতে বলে সত্য, কিন্তু অন্যায় ও জুলুমে বাধা প্রদানের কাজে কোন আদব-কায়দাকে অন্তরায় হিসেবে দাড় করায় না। যেহেতু নবীর হাদীসে ছোটদের স্নেহ করবার কথা আগে বলা হয়েছে, সেহেতু যারা ছোটদের প্রতি মানবিক আচরণ করে না তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে কেউ বাধ্য নয়। দেখুন, কোরআনে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে বাধাদানের বিধানটি কোন শর্ত বা ব্যতিক্রম ছাড়াই দেয়া হলেও অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রমী বিধান রাখা হয়েছে। যেমন, গীবতের ক্ষেত্রেও জুলুমের প্রতিবাদ করাকে ব্যতিক্রম হিসেবে রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, "আল্লাহ কোন মন্দ কথা প্রকাশ করাকে পছন্দ করেন না, তবে কেবল যার উপর জুলুম করা হয়েছে তার কথা ছাড়া।" এমনকি পিতামাতার প্রতি দোয়াটাও শর্তহীনভাবে দেয়া হয়নি, বরং একটি 'কামা' (যেভাবে) শব্দ যুক্ত করে দেয়া হয়েছে।
মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি হতে পারবে না, এটা একটা অমূলক কথা। কারণ, দরদের পরিচয় কথায়ও নয়, রক্ত সম্পর্কেও নয়, বরং কাজে পাওয়া যায়। মায়ের দ্বারা কখনো বেদরদী কাজ ঘটতে দেখলেও তার দরদ নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না- এ প্রবাদবাক্যটির উদ্দেশ্য তাই। সৃষ্টিজগতের মধ্যে মা জাতির মধ্যেই আল্লাহতাআলা অধিকাংশ দয়ামায়া ও ভালবাসা ঢেলে দিয়েছেন, একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। কিন্তু মাতৃজাতির কলংক দু'চারটা কুলাঙ্গারও যে সৃষ্টিজগতে বর্তমান রয়েছে, একথাও তো অস্বীকার করবার জো নেই। সুতরাং শুধুমাত্র 'মা' পরিচয়ের কারণে তাদের নিষ্ঠুরতা ও স্বেচ্ছাচারিতা ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) পেতে পারে না। কোন কোন সময় মায়ের চেয়ে মাসীও বেশি দয়াশীল হতে পারে। কারণ, একটা মানুষের যদি স্বভাব-চরিত্রে দয়ামায়া আরেকজনের চেয়ে বেশি থাকতে পারে। নিষ্ঠুর দয়াহীন মানুষের পক্ষেও দৈবক্রমে সন্তানের পিতা বা মাতা হওয়া সম্ভব এবং তাদের মধ্যে কারো কারো নিষ্ঠুরতা ও হৃদয়হীনতা নিজের বাচ্চা সন্তানের উপরেও আপতিত হওয়া বিচিত্র নয়। আবার কোন বাচ্চার পিতা বা মাতা এমনকি কোন নিকটাত্মীয় না হয়েও একজন কোন বাচ্চার প্রতি তার পিতামাতার চাইতে বেশী সহানুভূতিশীল হতে পারে- এটা অসম্ভব বা অবিশ্বাস্য কিছু নয়। যে যাই বলুক না কেন, প্রকৃত সত্য কথাটি হল, অন্যায় করার অধিকার আল্লাহ কাউকেই দেননি, বরং অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার আল্লাহ সকল বান্দাকেই দিয়েছেন।
শিশু নির্যাতন অধিকাংশই হয়ে থাকে লোভ ও ক্রোধের বশে; স্বার্থের জন্য ও স্বার্থহানিজনিত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার জন্য। এ কাজটি কেউ করে থাকে বৈধ-অবৈধ নির্বিশেষে নিজেদের সুখ-সম্ভোগ ও শান্তি-আরামে বিঘ্ন ঘটার কারণে (বৈধ সুখের উদাহরণ হল নিদ্রা ও দাম্পত্য মিলনের সুখ এবং অবৈধ সুখের উদাহরণ হল পরকীয়ার সুখ), কেউ করে থাকে নিজেদের নাম-যশ কামানোর উদ্দেশ্যে (বাচ্চাদের লেখাপড়ার নামে যা হয় তা এর মধ্যে পড়ে)। এমনকি যারা ধর্মশিক্ষা দেবার নামে শিশু নির্যাতন করে, তারাও এটা আল্লাহর সন্তুষ্টি বা বাচ্চার কল্যাণের জন্য করে না, বরং করে থাকে নিজেদের সুনাম এবং পারস্পরিক প্রতিযোগিতা ও জেদাজেদির জন্য। অমুকের বাচ্চাটা যদি আমার বাচ্চার আগে হাফেয হয়ে যায়, অমুকের বাচ্চা যদি আমার বাচ্চার চেয়ে দোয়া-দরূদ বেশি শিখে যায়, তাহলে সমাজে আমি মুখ দেখাব কেমনে- এ চিন্তাই কাজ করে নির্যাতনের পিছনে। আল্লাহর সন্তুষ্টি-প্রত্যাশী ধার্মিক ব্যক্তির কাছে নিজের সন্তানের ধর্ম শেখাটা যতটা আনন্দ দেবে, যে কারো বাচ্চার ধর্ম শেখা থেকেই সে একই আনন্দ লাভ করবে। সন্তানকে ধর্ম শিক্ষা দেয়াটা ধর্মীয় কাজ, আর ধর্মশিক্ষা নিয়ে পার্থিব প্রতিযোগিতায় মত্ত হওয়াটা দুনিয়াবী কাজ। বলাবাহুল্য, নির্যাতনটা ঘটে ধর্মীয় কাজ নিয়ে নয়, বরং পার্থিব বাসনা নিয়ে। শিশুদের উপর নির্যাতনের কাজটা সবাই ব্যক্তিগত স্বার্থ বা ব্যক্তিগত আক্রোশবশত: করে থাকলেও এই আসল কারণটা কেউ স্বীকার করে না। নির্যাতনকারী অভিভাবকরা প্রত্যেকেই দাবি করবেন যে, তারা যা করছেন বাচ্চার মঙ্গলের জন্যই করছেন। খুব কম পিতামাতাই আছেন যারা বলবেন, রাগের মাথায় ভুল করে অন্যায় করে ফেলেছি।
নিয়তের পরিচয় পাওয়া যায় কর্মের মধ্যে, মুখের কথায় নয়। কেউ মুখে বলল জনগণের মুক্তির জন্য আন্দোলন করছে বা জনগণের মঙ্গলের জন্য সংগ্রাম করছে, কিন্তু জনগণের মুক্তির দোহাই দিয়ে যদি সে জনগণকেই পুড়িয়ে মারে; তাহলে বুঝতে হবে জনগণকে মুক্তি দেয়া নয়, বরং নিজে ক্ষমতা লাভ করাটাই তার লক্ষ্য। অনুরূপভাবে, কেউ যদি মুখে বলেন তিনি শিশুর মঙ্গলের জন্যই তাকে শাসন করছেন, কিন্তু এই শাসনের নামে শিশুর পাছার ছাল তুলে ফেলেন; তাহলে বুঝতে হবে শিশুর মঙ্গল আদৌ তার লক্ষ্য নয়, বরং শিশুকে দিয়ে নিজের সুনাম হাসিল করে মানুষের সামনে ফুটানি মারাটাই তার প্রধান কাম্য।
আল্লাহতাআলা যেখানে মানুষের নিজের শরীররর উপরেই মালিকানা প্রদান করেননি, নিজেকে নিজে কোন কষ্ট দেবার অধিকারই মানুষকে দান করেননি, সেখানে নিজের বাচ্চার উপর যাচ্ছেতাই করবার অধিকার আল্লাহ দিতে পারেন- এমনটি মানুষ ভাবে কি করে? আল্লাহ তো কাউকে একটা টাকা খরচ করবার বেলাতেও একথা বলার অধিকার দেননি যে, আমি কষ্ট করে কামাই করেছি, অতএব যেভাবে ইচ্ছা খরচ করব, বা মন চাইলে ফেলে দেব। যেখানে আল্লাহ নিজের কষ্টার্জিত অর্থ নিজের ইচ্ছেমত অপব্যয় বা অপব্যবহার করার এখতিয়ার দেননি, সেখানে আল্লাহ বাচ্চার ব্যাপারে mishandle বা abuse করবার right বা authority দিয়ে বসবেন- এমনটি একেবারেই অসম্ভব। আল্লাহর আইনে জুলুম একটি হারাম কাজ, without any exception। জুলুমের অর্থ হচ্ছে নির্যাতন, জুলুম অর্থ বিনা অপরাধে কাউকে শাস্তি প্রদান। আর যদি তা নিষ্পাপ শিশুদের উপর হয়ে থাকে, তাহলে তা সবচেয়ে বড় জুলুম। জেনেশুনে কোন হারামকে হালাল করতে চাওয়াটা কুফরী। নির্যাতনের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য বাচ্চার কল্যাণকামনা দাবি করার পাশাপাশি নির্যাতনকে জাস্টিফাই করার জন্য অনেক সময় তৃতীয় কারো ব্যাপার টেনে আনা হয়। এক্ষেত্রে আমি বলব, আপনার শাশুড়ি বা ননদ আপনার সাথে কি করল, কিংবা আপনার পিতামাতা শৈশবে আপনার সাথে কি আচরণ করেছিল, সেটা আপনার সাথে তাদের ব্যাপার। তাদের আচরণের খেসারত আপনার বাচ্চা দিতে পারে না। আল্লাহর নবী (সা:) সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, "পিতার অপরাধে পুত্রকে, পুত্রের অপরাধে পিতাকে শাস্তি দেয়া চলবে না।" এখন আপনি যদি আপনার প্রতি অন্য কারো অন্যায় আচরণের দোহাই দিয়ে নিজের শিশুর উপর মেজাজ দেখান, তাহলে পেট্রোল বোমাবাজদের সাথে আপনার পার্থক্য রইল কোথায়? আরেকজনের জুলুমের দোহাই দিয়ে নিজের জুলুমকে, একটা অন্যায়ের অযুহাত দিয়ে আরেকটা অন্যায়কে বৈধ করবার প্রবণতাই বৃদ্ধি পেতে পেতে এক পর্যায়ে মানুষকে এমন স্তরে নিয়ে যায় যে, তখন আর নিজের হাতে নিরপরাধ মানুষকে পুড়িয়ে মারাকেও অন্যায় মনে হয় না। তখন মনে হয়, কাজটির কর্তা আমি হলেও কাজটির কারণ যেহেতু আরেকজন ঘটিয়েছে, আমার উপর আরেকজন জুলুম করেছে বলেই যেহেতু আমি করতে বাধ্য হয়েছি, অতএব আমার এ কাজটির পাপও আমার পরিবর্তে তার (আরেকজনের) আমলনামায় লেখা হবে। আজ আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে বর্বরতা দেখা যাচ্ছে, তা মূলত জাতীয় চরিত্রের অধ:পতনেরই লক্ষণ ও উপসর্গ (sign & symptom) মাত্র। আমাদের জাতির মূল রোগটি হল কোন মহত উদ্দেশ্য হাসিলের নামে কিংবা অন্য কারো অন্যায়ের প্রতিশোধ বা প্রতিকারের নামে অন্যায় ও জুলুমকে একটি বৈধ কর্মপন্থা হিসেবে গ্রহণ করা। এ প্রবণতাটিরই আলামত ঘরে ঘরে দেখা যাচ্ছে শিশু নির্যাতনের মধ্য দিয়ে। জনগণের মাঝে বিস্তার লাভ করা ক্রোনিক রোগটিই রাজপথে এসে অ্যাকিউট রোগের রূপ পরিগ্রহ করেছে। যে দেশে পরিবারের অভিভাবকেরা মনে করবে, আল্লাহ পাপ শুধু বাচ্চাদেরই দেয় (আমাদের কথা না শোনার কারণে); সেদেশে জাতির অভিভাবকেরাও মনে করবে, আল্লাহ পাপ শুধু জনগণকেই দেয় (আমাদের পক্ষে না আসার কারণে)। পাবলিকের পিটিয়ে লেখাপড়া শেখাবার থিউরিটাই বর্ধিত রূপে নেতাদের কাছে পুড়িয়ে গণতন্ত্র শেখাবার ফর্মুলায় পরিণত হয়। যে জাতি যেমন, সে জাতির উপর তো তেমন নেতৃত্বই চেপে বসবে বৈকি!
আল্লাহতাআলা বলেছেন, "তাদের (মুশরিকদের) দেব-দেবীরা তাদের দৃষ্টিতে সন্তান হত্যাকে শোভনীয় করে দিয়েছে।" আজ আমাদের অনেকের মধ্যে যশপ্রীতি নামক দেবী তথাকথিত লেখাপড়ায় প্রথম স্থান অধিকার করা বা করানোর মোহকে এমন এক উপাস্যে পরিণত করেছে যে, যার জন্য শাসনের নামে শিশু নির্যাতন একটি দরকারি ও ন্যায্য বিষয় হিসেবে গৃহীত হয়েছে।
যারা সন্তানের উপর পিতামাতার (আইনসম্মত বা শরীয়তসম্মত) অধিকারের দোহাই দিয়ে নিজেরা শিশু নির্যাতন করে এবং শিশু নির্যাতনে লিপ্ত অন্যান্য ব্যক্তিদেরকেও সমর্থন করে, যারা মনে করে কোন বাচ্চার উপর তার পিতামাতার অধিকারে হস্তক্ষেপ করে সেই বাচ্চার পিতামাতাকে কষ্ট দেয়াটা অন্যায়, তারা নিজেরা কিন্তু অন্যের বাচ্চার উপর জুলুম করতেও পিছপা হয় না এবং সেক্ষেত্রে পরের বাচ্চাকে মেরে সেই বাচ্চার পিতামাতাকে দু:খ দেয়া হল কিনা সেই বিবেচনাও তাদের থাকে না। এমনকি প্রয়োজনে নিজেদের পিতামাতাকে কারণে-অকারণে কষ্ট দিতেও এদের বাধে না। সেসব ক্ষেত্রে হয়তো চাকর-চাকরানীর উপর মনিবের অধিকার, পুত্রবধুর উপর শ্বশুর-শাশুড়ী বা ননদদের অধিকার এসবই প্রযোজ্য হয়। আসলে খলের ছলের অভাব হয় না। জালেম কখনো একটা নিয়মের উপর থাকে না, কোন একটা সীমারেখা মেনে চলে না। তাই তো তাদেরকে সীমালংঘনকারী বলা হয়। আমাদের সমাজে (হয়তো সবখানে নয়, বরং জালেম অধ্যুষিত বা জালেমের আধিপত্য কবলিত সমাজ ও পরিবারগুলোতে) অন্যের বাচ্চাকে 'আহলাদ' দেয়াকে যতটা উপহাসের দৃষ্টিতে দেখা হয়, পরের বাচ্চার প্রতি 'দরদ' দেখানোকে যতটা অনধিকার চর্চা বলে মনে করা হয়, পরের বাচ্চার উপর জুলুম করাকে সেরকম অন্যায় বা নিন্দনীয় হিসেবে গণ্য করা হয় না। অবশ্য যে বিকৃত রুচির মানুষেরা আদর-আহলাদকে তাচ্ছিল্যযোগ্য ও নিন্দনীয় মনে করে, তারা শুধু পরের বাচ্চাকে দরদ দেখানোর সমালোচনা করেই ক্ষান্ত হয় না, বরং যেসব পিতামাতা নিজেদের বাচ্চাদের প্রতিও মানবিক আচরণ করতে চায় তারাও এদের বিদ্রূপবাণ থেকে রেহাই পায় না। ন্যায়পরায়ণতা শব্দটি যাদের ডিকশনারীতে নেই, যারা স্বভাবগতভাবেই অন্যায়পরায়ণ, তারা যে কেবল অন্যায় কাজ ও অন্যায় আচরণকেই পছন্দ করবে, এটাই স্বাভাবিক।
যারা স্বভাবগতভাবেই অন্যায়পরায়ণ, যেকোন জুলুম-নির্যাতন বিশেষত শিশু নির্যাতনের কাজকে অকৃপণভাবে সমর্থন প্রদান করে, তারা যেকোন জালেমকেই সমর্থন করে থাকে। শিশু নির্যাতনকারী ব্যক্তি নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ বা প্রতিহিংসার কারণে করুক, বা অন্য কোন অসৎ উদ্দেশ্যে করুক, সর্বক্ষেত্রেই সমর্থন প্রদানে পিছপা হয় না। এমনকি কোন জালেম শয়তান ব্যক্তি যখন শিশুকে ঈমান ত্যাগে ও চরিত্র বিসর্জনে বাধ্য করবার উদ্দেশ্যে, জোরপূর্বক মন্দ কাজে বা নোংরা জিনিস ভক্ষণে বাধ্য করবার জন্য নির্যাতন করে, তখন তাদের প্রতি শর্তহীন সমর্থন প্রদানে এদেরকে বেশি অগ্রগামী দেখা যায়। যুক্তি হিসেবে এরা তখন সন্তানের উপর পিতামাতার অধিকার সংক্রান্ত ধর্মীয় বিধানের দোহাই দিলেও ধর্মে যে বিধর্মীদের সাথে (বিশেষত ধর্মের শত্রুদের সাথে) বন্ধুত্ব ও সমর্থন-সহযোগিতা নিষিদ্ধ, এ ব্যাপারটা ভুলে যায়। ধর্ম যে বিবাহিত ব্যভিচারীদের ধরাপৃষ্ঠে বেঁচে থাকবারই অধিকার দেয় না, একথাও তাদের মনে থাকে না। শুধু সন্তানের উপর পিতামাতার অধিকারটির কথাটিই এদের মনে থাকে, তাও কেবল নিজেদের মতলবমাফিক নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের জন্য। মুসলিম শিশুর উপর বিধর্মী জালেমকে সমর্থনকারী এই সুযোগসন্ধানী মতলববাজরা আবু হুরায়রার (রা:) মায়ের ঘটনার রেফারেন্স দিয়ে যুক্তি দেখায়, যেহেতু আবু হোরায়রার ক্ষেত্রে মা-ছেলের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে নবীজী অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, অতএব যেকোন সন্তানের উপর মায়ের অত্যাচারের ক্ষেত্রে তৃতীয় কারো হস্তক্ষেপ বৈধ নয়। কিন্তু যুবক ছেলের উপর বৃদ্ধা মায়ের চড় আর অসহায় শিশুর উপর যুবতী ব্যভিচারী মায়ের সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া দুটো কি এক বিষয় হল? তদুপরি যে ব্যক্তি না বুঝে রাগের বশে ছেলেকে একটা চড় দিয়ে বসেছে, আর যে ব্যক্তি জেনেবুঝে সুপরিকল্পিতভাবে সর্বনাশ সাধনের প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে, দুজনের ব্যাপারে ফয়সালা কি একরকম হবে? প্রথমজনের বেলায় নবীজী (সা:) হেদায়েতের দোয়া করেছিলেন বলে কি দ্বিতীয়জনের ক্ষেত্রেও আমরা বসে বসে হেদায়েতের দোয়া করতে থাকব?
শিশু নির্যাতনকারী কোন জালেম ব্যক্তির পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে তার অন্ধ সমর্থক ও একান্ত সহযোগীরা নিজের পূজনীয় ব্যক্তির অনুকূলে অদ্ভুত সব সাক্ষ্য ও দাবি পেশ করে থাকে। এগুলো সাধারণ মানুষের কমন সেন্সে ও বিচারবুদ্ধিতে ধোপে টিকবে কিনা, সেই হুঁশ তাদের থাকে না। যেমন বলা হল, অমুক বাচ্চাটির মা বাইরে শত কঠোর হলেও তার দেলটা একেবারে তুলার চেয়েও নরম। কিন্তু আমরা যদি নিজেদের নাফসের দিকেও খেয়াল করি, নিজেদের অবস্থাও বিচার করি, তাহলেও এটা স্বাভাবিকভাবেই বুঝে আসে যে, মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রণ করা হল সবচেয়ে কঠিন। মনের চেয়ে মুখকে নিয়ন্ত্রণ করা তুলনামূলকভাবে একটু সহজ এবং তার চেয়েও সহজ হল হাত-পাকে নিয়ন্ত্রণ করা। এখন যে ব্যক্তির ক্রোধ ও প্রতিহিংসা তার হাত-পাকেই সংযত থাকতে দেয়নি, যার আক্রোশ ও শত্রুতা তার মুখকেই সামলে রাখতে দেয়নি, তার মনের ভেতর একগাদা দয়া-ভালবাসা ও স্নেহ-মমতা সঞ্চিত ও গচ্ছিত রেখে দিয়েছে- একথা কি বাস্তবসম্মত? যেখানে স্বয়ং আল্লাহতাআলা কোরআনে বলেছেন যে, "শত্রুতাপ্রসূত বিদ্বেষ তাদের (ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুদের অর্থাৎ কাফের-মুনাফিকদের) মুখেই প্রকাশ পায়, আর যা তাদের অন্তরে লুকিয়ে আছে তা আরো বেশি ভয়ংকর", সেখানে আমরা কিভাবে মাসুম বাচ্চাকে অসভ্য বাষায় গালিগালাজকারী ও নৃশংস নির্যাতনকারী মুনাফিক জালেম ব্যক্তির সম্পর্কে নরমদিল হবার কথাকে বিশ্বাস করব? তাও আবার এমন ব্যক্তির সম্পর্কে, যার ধর্মবিরোধী ও মানবতাবিরোধী চরিত্র ও মানসিকতা এবং অশুভ প্রবণতার কথা তার কথা, কাজ ও আচরণে প্রকাশ পেয়েছে। আমরা তো বরং মুনাফিকদের সম্পর্কে একথাই জানি যে, তাদের মুখে মধু ও অন্তরে বিষ। সেখানে যাদের অন্তরের বিষের ভাণ্ডার এতটাই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় যে একেবারে বাইরে উপচে পড়ে, তাদের অন্তরের মধ্যেই মধুর খনি আবিষ্কার করার মতলবি প্রয়াস কেন? আপনি তার মন নরম হবার সার্টিফিকেট দেন কিসের ভিত্তিতে? আপনার প্রতি তার আচরণ নরম-কোমল বলে? আপনার কাছে তো তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে, তার চোগলখুরির মাধ্যমে ফেতনা সৃষ্টির কাজে সহযোগিতার প্রয়োজন আছে, শিশু নির্যাতনের কাজে সমর্থন লাভের গরজ আছে; কাজেই আপনার প্রতি সে কঠোর চেহারা প্রদর্শন করতে যাবে কোন্‌ আক্কেলে? তদুপরি আপনিও যদি তার মতই খাডাস প্রকৃতির হয়ে থাকেন, তাহলে সে আপনার প্রতি নরম হবে না তো কি নিষ্পাপ শিশুর প্রতি নরম হবে?
যারা ব্যক্তিগত স্বার্থ বা ব্যক্তিগত আক্রোশে খামখেয়ালীপনাবশত: শিশুদের উপর অত্যাচার বা দুর্ব্যবহার করেন, তাদেরকে বলব, নির্যাতন করতে হয় করুন, কিন্তু কল্যাণকামনার অযুহাত দেবেন না, কিংবা আর যাই করেন ধর্মের দোহাই দেবেন না। ধর্ম নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার আপনাদের কে দিয়েছে? আপনাদের ভণ্ডামি ও খামখেয়ালীপনার জন্য নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ধর্মবিরোধীদের শিবিরে ভিড়বে, এ আমরা হতে দিতে পারি না।
পবিত্র কোরআনে পিতামাতার প্রতি 'উহ' শব্দ করতে যে নিষেধ করা হয়েছে, সেটা পিতামাতার বার্ধক্যে তাদের সেবা করতে গিয়ে বিরক্তি প্রকাশ না করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বাচ্চার শৈশবে পিতামাতার হাতে মার খেয়ে ক্রন্দন বা কষ্ট প্রকাশ করার ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়। এছাড়া শরীয়তের যেকোন বিধান কেবল বালেগদের উপরই প্রযোজ্য। নাবালকদের উপর কোন শরীয়তী বাধ্যবাধকতা ইসলামে আরোপ করা হয়নি। অতএব, পিতামাতার হাতে নির্যাতিত হয়ে ক্রন্দন করলে বা প্রতিবাদ করলে বাচ্চাকে আল্লাহ পাপ দিবে বা আগুনে দিবে- একথার কোন ভিত্তি নেই। যারা নিজেদের হাতে নির্যাতিত শিশুদের 'উহ' শব্দকে সহ্য (tolerate) করতে চায় না, তারা নিজেদের পিতামাতাকে কিন্তু 'উহ আহ' করারও সুযোগ দেয় না।
"আমার কথা না শুনলে তোমাকে দোযখে যেতে হবে"- এ কথাটি প্রকারান্তরে নিজেকে খোদা দাবি করারই নামান্তর। পিতামাতা হিসেবে হোক; শিক্ষক-ওস্তাদ হিসেবে হোক; কিংবা নেতা, পীর বা খলীফা হিসেবে হোক; কোন অধিকারবলেই কোন মানুষ অপর কোন মানুষের কাছে এ দাবি করতে পারেন না। শুধুমাত্র নি:স্বার্থভাবে দ্বীনের দাওয়াত বা ধর্মশিক্ষা প্রদান করবার সময় আল্লাহতাআলার হুকুম-আহকাম তথা আদেশ নিষেধের বর্ণনা দিয়ে বলতে পারেন, এগুলো যেহেতু আল্লাহর হুকুম, তাই তা না মানলে অসুবিধা হবে। কিন্তু আল্লাহ আমাকে তোমার উপর হুকুমদাতা হিসেবে নাযিল করেছেন, তাই সবসময় আমি যখন যা বলব তা তোমাকে মেনে চলতে হবে, আর আমার হুকুম পালনে ত্রুটি হলে সেজন্য তোমাকে আল্লাহর কাছেই শাস্তি পেতে হবে- এমন দাবি আপনি করতে পারেন না। নিজেদের হুকুমকে আল্লাহর নামে (মানে আল্লাহর হুকুম বলে) চালিয়ে দেবার প্রবণতা আমাদের বদলাতে হবে। তাহলে তাতে আমাদের নিজেদের জন্যও মঙ্গল হবে, আমাদের বাচ্চাদের জন্যও মঙ্গল হবে।
পিতামাতার সকল আদেশ পালন করা সন্তানের জন্য বাধ্যতামূলক- এমন ধারণাই সমাজে শিশু নির্যাতনকে বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা দেয়। প্রচলিত ধারণাকে নাকচ করে দিয়ে এবং কর্তৃত্ববাদী অভিভাবকদের হতাশ করে দিয়ে বলতে হয়, পিতামাতার আনুগত্য করতেই হবে এমন কথা কোরআনে কোথাও নেই; আনুগত্যবাচক শব্দ 'আতিউ' বা 'তাবিউ' পিতামাতার ক্ষেত্রে কোরআনের কোন আয়াতে ব্যবহার করা হয়নি। বরং পিতামাতার ক্ষেত্রে করতে বলা হয়েছে সদ্ব্যবহার (এহসান) ও কৃতজ্ঞতার (শোকর) কথা। অবশ্য হাদীসে বলা হয়েছে, "পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি, আর মায়ের পায়ের নিচে জান্নাত।" কিন্তু পিতামাতার সকল আদেশ-নিষেধ সন্তানের জন্য অবশ্যপালনীয় এমন কথা বলা হয়নি। এ জান্নাত হাসিলটা করতে হবে সেবা-শুশ্রূষা ও বৈধ আদেশ-নিষেধ পালনের মাধ্যমে। পিতামাতার কোন অন্যায় আদেশ পালন করা সন্তানের জন্য জরুরী নয়। একমাত্র আল্লাহ ও রাসূল ছাড়া অন্য কারো শর্তহীন আনুগত্য করতে বলা হয়নি। কোরআনে সর্বত্র শুধু আল্লাহ ও রসূলেরই আনুগত্য করতে বলা হয়েছে, শুধু এক স্থানে আল্লাহ ও রসূলের পরে নেতা বা কর্তৃপক্ষের আনুগত্য করতে বলা হয়েছে শর্তসাপেক্ষে এবং নেতার আনুগত্যকে আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্যের অধীন করে দেয়া হয়েছে এই বলে যে, নেতার সাথে অনুসারীদের কোন মতভেদ ঘটলে সে ব্যাপারে আল্লাহ ও রসূলের ফয়সালা অনুসারে মীমাংসা করতে হবে। কোন মানুষকে মানুষের উপর হুকুম জারি করবার এবং হুকুম পালনে বাধ্য করাবার ক্ষমতা দেয়া হয়নি এ কারণে যে, মানুষ ভুল করতে পারে, অন্যায় করতে পারে। দোষ-ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতার অধিকারী মানুষের সন্তানদের জন্য যদি নিজ নিজ পিতামাতার সকল আদেশ-নিষেধ পালন করা সকল সন্তানের জন্য আমভাবে ফরজ করে দেয়া হতো, তাহলে তা মানুষের অনেক পার্থিব ও পারলৌকিক ভ্রান্তি ও গোমরাহির কারণ হয়ে দাড়াতো। যেহেতু অগণিত মানুষের পক্ষে নিজ নিজ সন্তানকে ভুল আদেশ দেয়া খুবই স্বাভাবিক। আর মানুষের মধ্যে শুধু নেতার আনুগত্য করতে এজন্য বলা হয়েছে যে, লাখো মানুষের মধ্যে সৎ ও যোগ্য মানুষ খুঁজে বের করে নেতা বানানো সম্ভব, তাই নেতার আনুগত্যের দ্বারা মানুষের বিপথগামী হবার সম্ভাবনা তুলনামূলক কম থাকে, যতটা আশংকা থাকে পিতামাতা বা অন্য কারো আনুগত্যের দ্বারা। আর সেই নেতার হুকুমের মধ্যেও কোরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী কোন কিছু খুঁজে পাওয়া গেলে তা শুধরে দেবার সুযোগ থাকে। তদুপরি নেতার আনুগত্য করতে বলার সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা একথাও বলে দিয়েছেন যে, তোমাদের মাঝে (নেতা ও অনুসারীদের মাঝে) কোন মতভেদ দেখা দিলে আল্লাহ ও রসূলের কাছে ফিরে আসতে হবে। বড়দের কথা না শুনলে দোযখে যেতে হবে- এ কথাটি কোরআনে কোথাও পাওয়া না গেলেও বড়দের কথা শোনাটা যে কারো কারো জন্য দোযখে যাবার কারণ হয়েছে সেকথা কিন্তু কোরআনে উল্লেখ আছে। দোযখীদের একটি স্বীকারোক্তি কোরআনে উল্লেখ আছে এভাবে, "আমরা আমাদের নেতাদের ও বড়দের আনুগত্য করেছিলাম, তারাই আমাদের বিপথগামী করেছিল।" আল-কোরআনে দোযখীদের আরো একটি আবেদনের কথা বর্ণিত হয়েছে, "হে আমাদের রব! যে সমস্ত জিন ও মানুষ আমাদেরকে বিপথগামী করেছিল, তাদেরকে আমাদের পায়ের সামনে মাড়ানোর সুযোগ দিন।" অতএব, আল্লাহর আইন অনুসারে সন্তান কেবল পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশে বাধ্য, ন্যায়-অন্যায় প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় নির্বিশেষে সকল আদেশ-নিষেধ পালনে বাধ্য নয়। যেহেতু সন্তান পিতামাতর কাছে ঋণী, তাই পিতামাতা ভাল হোক বা মন্দ হোক, মুমিন হোক বা কাফের হোক, সেই ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থেকেই নম্র ব্যবহার ও সেবা-শুশ্রূষা লাভ করাটা পিতামাতার অধিকার। উদাহরণস্বরূপ, আপনি কোন খ্রীস্টান মিশনারী এনজিও থেকে ঋণ গ্রহণ করলেন। এখন সেই ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে আপনি বাধ্য। কিন্তু ঋণগ্রহীতা হিসেবে তাদের সকল দাবি ও আবদার পূরণে আপনি বাধ্য নন। অর্থাত, ঋণদাতার কোন দাবি যদি শরীয়তবিরোধী হয়, যেমন স্বধর্ম ত্যাগ করে তাদের ধর্ম গ্রহণ করা, কিংবা নিজের বউকে তাদের হাতে তুলে দেয়া ইত্যাদি, তাহলে সেটা মানা যাবে না।
ইসলামের বিধান মতে, সার্বভৌমত্বের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ। মানুষের উপর হুকুম জারি করা এবং সেই হুকুম অমান্যের দায়ে শাস্তি প্রদান করা একমাত্র আল্লাহরই এখতিয়ার। অন্য কারো হুকুম অমান্য করাটা শাস্তিযোগ্য অপরাধের পর্যায়েই পড়ে না, যদি কেউ নিজের ব্যক্তিগত মর্জিমাফিক প্রদত্ত আদেশ লংঘনের দায়ে কাউকে শারীরিক শাস্তি প্রদান করে, তাহলে সে খোদার উপর খোদগিরি করল। মানুষ পারে কেবল আল্লাহ প্রদত্ত হুকুমটাই নিজের অধীনস্তদের নিকট পৌঁছে দিতে এবং যেক্ষেত্রে হুকুম অমান্যের জন্য পার্থিব শাস্তির বিধান আছে (যেমন- চুরি, নৈতিক বিচ্যুতি, মারামারি ইত্যাদি), কেবল সেক্ষেত্রে আল্লাহ প্রদত্ত শাস্তিটাই প্রয়োগ করতে পারে। আর মানুষ যে হুকুমটা প্রদান করবে নিজের মর্জিমাফিক, সে হুকুমটি পালনে তার অধীনস্তরা নৈতিকভাবে বাধ্য নয়। কিন্তু আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অগ্রাহ্য করে মানুষের সার্বভৌমত্বের বিধান সমাজে এমনভাবে প্রচলিত হয়ে গিয়েছে যে, পিতামাতা কর্তৃক সন্তানকে, শাসক কর্তৃক শাসিতকে নিজের ইচ্ছেমত হুকুম প্রদান করা এবং হুকুম অমান্যের দায়ে শাস্তি প্রদান করা একটা সমাজ স্বীকৃত অধিকারে পরিণত হয়েছে এবং কেউ যদি নিজের সার্বভৌমত্বের গণ্ডির মধ্যে কাউকে অন্যায়ভাবেও শাস্তি প্রদান করে, সেক্ষেত্রেও বাইরের কারো হস্তক্ষেপের এখতিয়ার রাখা হয়নি। কিন্তু মানব সৃষ্ট এ প্রচলনটা যে কতটা অসার, তা বোঝানোর জন্য একটা উদাহরণ পেশ করছি। মনে করুন, পিতামাতার সকল আদেশ পালন করা যদি সন্তানের জন্য বাধ্যতামূলক হয়, তাহলে দুই বন্ধু বা প্রতিবেশী শিশু বা যুবকের মধ্যে একজনের পিতামাতা আদেশ করল আরেকজনের সাথে মারামারি বাধাতে, আবার সেই দ্বিতীয় ব্যক্তির পিতামাতাও আদেশ দিল প্রথমজনের সাথে মারামারি বাধাতে। এখন বলুন তো দেখি, তারা যদি নিজ নিজ পিতামাতার আদেশ রক্ষার্থে পরস্পর মারামারিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তখন কি এটা ভাল ও সওয়াবের কাজ হবে? সেক্ষেত্রে তারা যদি পিতামাতার আদেশ পালন থেকে বিরত থাকতে চায়, অর্থাৎ পরস্পর মারামারিতে লিপ্ত হতে না চায়, আর এ অপরাধে যদি নিজ নিজ পিতামাতার তরফ থেকে শাস্তির সম্মুখীন হয়, তখন তাদেরকে রক্ষা করবার এখতিয়ার কি অন্য কারো থাকবে না? অথবা ধরুন, রহিমের পিতা বা মাতা আদেশ দিল করিমের মাথায় বাড়ি মারতে, এখন রহিম এ আদেশ পালন থেকে বিরত থাকবার জন্য করিমের পিতা বা মাতার কাছে সাহায্য চাইল, এখন করিমের পিতা বা মাতা যদি রহিমকে সাহায্য করে বা আশ্রয় দেয়, ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত থেকে বাঁচতে সাহায্য করতে চায়, তখন কি এটা অনধিকার চর্চা হবে? সেটা কি পরের অধিকারে নাক গলানোর পর্যায়ে পড়বে? একই কথা প্রযোজ্য রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে। যদি সবাই মনে করে, দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ, আর সেই দেশপ্রেমের সংজ্ঞা যদি হয় নিজ নিজ রাষ্ট্রের শাসকদের আদেশ বিনা বাক্যব্যয়ে পালন করা, তাহলে দুই রাষ্ট্রের নাগরিকরা যদি নিজ নিজ সরকারের আনুগত্য করতে গিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে রক্তপাতে লিপ্ত হয়, তাহলে বিবদমান পক্ষদ্বয়ের মধ্যে কোন্ পক্ষটিকে আপনি ঈমানদার বলবেন? মানবরচিত দেশপ্রেমের বানোয়াট সংজ্ঞানুসারে তারা দু'পক্ষই তো দেশপ্রেমিক হবার দাবিদার। দেশের জন্য জীবন দিয়ে দু'দলের মানুষই কি শহীদ বলে গণ্য হবে? আর আলোচ্য দু'দেশের মধ্যে কোন দেশের কোন নাগরিক যদি অযথা হানাহানি থেকে বাঁচতে চায়, রক্তপাতে লিপ্ত হয়ে প্রাণনাশ ও প্রাণিবিসর্জন দিতে রাজি না হবার অপরাধে স্ব স্ব শাসক কর্তৃক দেশদ্রোহী হিসেবে অভিযুক্ত হয়, সেটা কি যুক্তিসঙ্গত হবে? অন্য দেশের বিরুদ্ধে অন্যায় যুদ্ধে লিপ্ত হবার আদেশ বা অন্য যেকোন অন্যায় কাজের আদেশ লংঘন করার দায়ে কিংবা ধর্মীয় বা জাতিগত কারণে অথবা যেকোন কারণে নিজ দেশের শাসকদের হাতে দণ্ড বা নির্যাতনের শিকার হয়ে বাঁচার আকুতি জানায়, তখন অন্য কোন দেশের মানুষ কর্তৃক তাদেরকে রক্ষা করার চেষ্টা করাটা কি অনধিকার চর্চা হবে?
পিতামাতার সাথে দুর্ব্যবহার করা যে নিষিদ্ধ- এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। এ প্রসঙ্গে নবীজী (সা:) বলেছেন, "এমনকি তারা যদি তোমার উপর জুলুম করে তবুও।" তবে এই হাদীসের অর্থ এই নয় যে, সন্তানের উপর জুলুম করাটা পিতামাতার জন্য জায়েয হয়ে গেল। কিংবা জুলুমের হাত থেকে বাঁচার পথ খোঁজা বা আত্মরক্ষার চেষ্টা করাও যে সন্তানের জন্য হারাম হয়ে গেল, তাও নয়। জুলুমের প্রতিকার করতে গিয়ে পাল্টা জুলুম বা দুর্ব্যবহার করাটা শুধু নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর এই জুলুমের মোকাবেলায় দুর্ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞাটাও কেবল প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যেহেতু শরীয়তের হুকুম মানার বাধ্যবাধকতা কেবল বালেগদের উপরই বর্তায়। শিশু নির্যাতন কিংবা শিশুদের উপর অন্যায় বা অপ্রয়োজনীয় জবরদস্তি প্রতিরোধে তৃতীয় কারো হস্তক্ষেপকে নিষিদ্ধ হওয়াও এ হাদীস দ্বারা বোঝায় না। বরং শিশুদের জীবন এবং শান্তি ও সুস্থতা রক্ষায় যেকোন সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ বৈধ। কেবল সুস্থ সবল ও প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান নিজে যদি পিতামাতার সাথে পাল্টা অসদাচরণ করে, সেটাই অবৈধ বলে গণ্য হবে। আবার একথাও ঠিক, শুধু আইন দিয়ে বা বাইরের হস্তক্ষেপ দিয়ে সাময়িকভাবে বাচ্চাকে প্রোটেকশন দেয়া যায়, কিন্তু আইন দিয়ে তো আর ভালবাসা পয়দা করা যায় না, শিশু নির্যাতন সমস্যার স্থায়ী সমাধানও হয় না। অভিভাবকদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর জন্য মোটিভেশন ও কাউন্সেলিং করতে হবে। বাচ্চার সুস্থতা ও নিরাপত্তা যে আর সবকিছুর চেয়ে বড়, এ কথাটি তাদেরকে বোঝাতে হবে। তবে যারা স্বভাবগতভাবেই অমানুষ, তাদেরকে কঠোর আইনগত ব্যবস্থার মাধ্যমেই দমন করতে হবে।
আপনি যদি মানুষ হয়ে থাকেন, সন্তানের প্রতি ভালবাসা যদি আপনার মনে থেকে থাকে, বাচ্চার প্রতি আপনার আচরণটা যদি ইতিবাচক হয়, তাহলে আপনার আনুগত্য করানোর জন্য বাচ্চাকে দোযখের ভয় দেখাবার প্রয়োজন পড়বে না। একজন ভাল বাবা-মা কখনোই চাইবে না যে, আমার কারণে আমার সন্তান দোযখে যাক, বরং তার কারণে সন্তানের দোযখী হবার কোন আশংকা বাস্তবে থেকে থাকলেও সে নিজে থেকেই আগ বাড়িয়ে দাবি ছেড়ে দেবে আর দোয়া করবে, আল্লাহ! আমার কারণে ওকে দুনিয়া বা আখেরাতে বিপদগ্রস্ত করো না। আমাদের সমাজে দোযখের ভয় দেখানোটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজের ব্যক্তিগত মতলবে প্রয়োগ করা হয় বলেই কমুনিষ্টরা ধর্মকে ভণ্ডামি ও জুলুমের হাতিয়াররূপে প্রমাণ করার এবং এর দ্বারা নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করবার সুযোগ পায়।
কেউ হয়তো ভাবতে পারেন, আমাদের এ ধরনের লেখার দ্বারা (নির্যাতনকারী) পিতামাতার বিরুদ্ধে (নির্যাতিত) ছেলেপেলেকে বিদ্রোহের উষ্কানী দেয়া হচ্ছে না তো? এক্ষেত্রে আমরা বলব, বিদ্রোহ যা হবার তা তো এমনিতেই হবে। কারণ, কোন জুলুমই কেউ বসে বসে চিরকাল হজম করে যায় না। যেহেতু প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটা সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। আমরা চাই, বিদ্রোহ হলে সেটা যেন ভুল জায়গায় বা ভুল পয়েন্টে না হয়ে ঠিক জায়গায় হয়। আমরা চুপ করে থাকলেও ছেলেমেয়েদের অবস্থার সুযোগ নেয়া বা তাদেরকে দরদ দেখিয়ে ফুসলানোর মানুষের অভাব হবে না। পিতামাতাদের অমানবিক আচরণে বিগড়ে গিয়ে মুসলিম পরিবারের সন্তান-সন্ততিরা যেন মুক্তমনাদের দলে না ভিড়ে যায়, সেটা নিশ্চিত করাই আমাদের উদ্দেশ্য। আমরা যদি নির্যাতিতদের প্রতি সান্ত্বনা ও সহানুভূতি জানাতে পারি, সমর্থন ও সমবেদনা জানাতে পারি, তাহলে তারা আর অন্য কোথাও যাবে না। পিতামাতার সাথে রাগ হয়ে শিশুরা ছেলেধরার কাছে যাবার চেয়ে আমাদের ছেলেরা অন্তত আমাদের কাছেই থাকুক। ইসলাম যে জালেমের রক্ষক বা হাতিয়ার নয়, ধর্ম যে সবসময় মজলুমের পক্ষে- এ সত্যটি কচিকাচাদের সামনে তুলে ধরতে পারলে তারা আর মুক্তির নেশায় ধর্মবিরোধীদের পালে ভিড়বে না, বরং ইসলামকেই নিজেদের আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নেবে। ধর্মের অপব্যাখ্যাকারী ও অপব্যবহারকারীদের থেকে ধর্মকে আলাদা করে দেখাতে পারলেই তরুণদের ধর্মত্যাগের প্রবণতা বা ধর্মের প্রতি বিরূপ মনোভাব রোধ করা যাবে। আল্লাহ দোযখের আগুন শুধু অবাধ্য শিশুদের জন্যই রেখেছেন, অত্যাচারী পিতামাতার জন্য কোন শাস্তির ব্যবস্থা রাখেননি- এ ফতোয়া যে মানুষের মনগড়া, এ কথাটি শিশুদেরকে জানিয়ে দেয়াই উত্তম। এতে করে পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস নষ্ট হয় হোক, কিন্তু অন্তত আল্লাহ ও রসূলের প্রতি বিশ্বাসটা তো ঠিক থাকবে
ঘুরে আসতে পারেন আমার ব্লগ আড্ডাঘর
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১২:৪৩
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×