৪ নভেম্বর ২০১১ তারিখে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী সংখ্যায় জাফর ইকবালে যে লেখাটি ছাপা হয়েছে তাতে তিনি মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাস তথা ইসলামের পর্দা প্রথা নিয়ে মারাত্নক সমালোচনা করেছেন। উনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, ইসলামের পর্দা প্রথা নারী উন্নয়নের প্রতিবন্ধক। বলেছেন, পর্দা মৌলবাদীদের চাপিয়ে দেওয়া একটা ব্যবস্থা। যারা নারীদের উন্নয়ন চায় না তারা নারীদেরকে ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখতে চায়। ঘরে বন্দী করতে না পারলে বোরকার মধ্যে বন্দী করে রাখতে চায়। এখানে জাফর ইকবাল যে ভুল তথ্যটি দিয়েছেন, তাহলো পর্দা বা বোরকা কোনভাবেই মৌলবাদীদের চাপিয়ে দেওয়া কোন ব্যবস্থা নয়, বরং এটি ইসলামের অন্যতম একটি বিধান (অবশ্য 'মৌলবাদী' শব্দটি বলতে তিনি কাদেরকে বুঝিয়েছেন তা আমি নিশ্চিত নই। জাফর ইকবাল যদি মৌলবাদী শব্দটিকে অল্প বুদ্ধির বেকুব লোকজনদের মত করে ব্যবহার করেন, তখন ওনার বুদ্ধি জ্ঞানের মাত্রা নিয়ে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক)। নারী এবং পুরুষের জন্য পর্দা করা ইসলাম ধর্মমতে ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য। ইসলামে অশ্লীলতা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এর জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। পর্দা করা অশ্লীলতা থেকে বাঁচার অন্যতম উপায়। এ কারণে মুসলমানেরা তা বিশ্বাস করেন এবং তা পালন করেন। কিন্তু বাংলাদেশে ইসলামী আইন প্রচলিত নেই এবং পর্দা করা বাধ্যতামূলকও নয়। বরং বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকাররের আমলে হাইকোর্ট রায় দিয়েছে কাউকে জোর করে পর্দা করতে বাধ্য করা যাবে না। এই ঘোষণার পরও যদি কেউ পর্দা করে তবে ধরে নিতে হবে যে, সে ইচ্ছে করেই পর্দা করছে; এটা তার পছন্দ। জাফর ইকবাল এই পর্দার বিরুদ্ধে লিখেছেন এবং অনেকে তাকে বাহবা দিচ্ছেন। কিন্তু ভেবে দেখা দরকার যে, জাফর ইকবাল ভুল ব্যাখ্যা করে ইসলামকে উন্নয়নের প্রতিবন্ধক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, তিনি মানুষের স্বাধীনতা, পছন্দ, ধর্ম বিশ্বাস ইত্যাদিকে অপমান করেছেন। না কি জাফর ইকবালের মতের বাইরে গেলে তিনি তাকে মানুষের মর্যাদা দিতে ইচ্ছুক নন? প্রশ্ন জাগে, সবাইকে কি জাফর ইকবালের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী জীবন-যাপন করতে হবে? আমি ভেবে পাই না, জাফর ইকবাল কেন পর্দার উপর এত খেপে গেলেন? পর্দা কি সত্যিই মুসলমানদেরকে অনগ্রসর করে রেখেছে? এ রকম কোন গবেষণা কি উনি করেছেন যাতে দেখানো হয়েছে যে, পর্দা করা ছেলেমেয়েদের চেয়ে পর্দা না করা ছেলেমেয়েরা বেশি অগ্রসর? যদি কোন গবেষণা বা অন্য কোন প্রমাণ ওনার কাছে না থাকে তাহলে উনি কোন ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে এমন কথা বললেন? নাকি উনি ভেবেছেন যে, ওনার কথা বা মতামতকে কেউ চ্যালেঞ্জ করার সাহস পাবে না। দু:খজনকভাবে জাফর ইকবাল যে সংষ্কৃতিকে প্রেসক্রাইব করেছেন, সে পাশ্চাত্য সংষ্কৃতির দেশ আমেরিকার স্কুলে মেয়েদের যৌন নির্যাতনের একটি গবেষণার ফলাফল ৬ নিউইয়র্ক টাইমস-এর ৬ নভেম্বর ২০১১ তারিখ সংখ্যায় ছাপা হয়েছে। সে গবেষণায় দেখানো হয়েছে ৭ম থেকে ১২শ গ্রেডে পড়ুয়া মেয়েদের ৫৬% এবং ছেলেদের ৪০% যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এই যৌন নির্যাতন ছেলে মেয়েদের উপর কী রকম নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তাও রিপোর্টে প্রকাশ করা হয়েছে। ইসলামে এই যৌনতা নিষিদ্ধ বলেই পর্দার বিধান এসেছে। এখন জাফর ইকবালরা যদি যৌন নির্যাতনকে উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা না করে যৌন নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য ব্যবহার করা পর্দাকে উন্নয়নের প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচনা করেন তাহলে তো আর আলোচনার কিছু থাকতে পারে না। নিউইয়র্ক টাইমস এর খবরের লিংক:
Click This Link harassment&st=cse
এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে জাফর ইকবালের এই মানসিকতা নিয়ে মুসলমানেরা চিন্তিত। ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, যখন তীব্রভাবে ইসলামের বিরোধীতা করা হয়, তখনই ইসলামের প্রসার বাড়তে থাকে। মহান আল্লাহতায়ালা মুসলমানদেরকে ইসলামের মত মহামূল্যবান দৌলত দিয়ে ভাগ্যবান করেছেন। যিনি ইসলামের আলোকে আলোকিত হতে পেরেছেন তিনি অন্ধকার দেখে ভয় পাবেন না, এটাই স্বাভাবিক। একজন জাফর ইকবালের কী ক্ষমতা আছে যে তিনি মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাসকে নষ্ট করতে পারেন? উনি যা করেছেন তাহলো জেনে বুঝে মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাসকে অপমান করেছেন, ইসলামের নিয়মকে উন্নয়নের সাথে সাংঘর্ষিক করে উপস্থাপন করেছেন, ইসলামের বিধানকে মৌলবাদীদের চাপিয়ে দেওয়া বলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন, ইসলামের নিয়মকে ত্যাগ করতে বলেছেন এবং অন্য বিশ্বাসকে প্রেসক্রাইব করেছেন। একজন মানুষ কোন একটি বিশ্বাসে বিশ্বাসী নাও হতে পারেন, বা নাও মানতে পারেন, তাই বলে তিনি সেই বিশ্বাসে বিশ্বাসীদেরকে কোনভাবেই অপমান করতে পারেন না। আমি স্পষ্টভাবে জাফর ইকবালকে এবং যারা ওনার মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাস অপমান করাকে সমর্থন করছেন, তাদেরকে জানিয়ে দিতে চাই, আপনারা এখনও মানুষ হয়ে উঠতে পারেননি। আপনাদের কাছে ভিন্নমত নিরাপদ নয়। আপনাদের হাতে কলম আছে, তাই কলম নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। যদি আপনাদের হাতে অস্ত্র দেওয়া হয়, আপনারা অস্ত্র নিয়েও মুসলমানদের বিরু্দ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন। এই যখন আপনাদের অবস্থান তখন সঙ্গত কারণেই মুসলমানদের উচিত নিজেদের বিশ্বাসকে আপনাদের হাত থেকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করা।
জাফর ইকবালের ইসলাম বিরোধী অবস্থান এবং লেখালেখির কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন তারা সঙ্গত কারণেই জাফর ইকবালের লেখার প্রতিবাদ করেছেন, ভিন্নমত পোষণ করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় জাফর ইকাবলের অবস্থান বোঝার প্রয়াস নিয়েছেন অনেকেই। এই প্রয়াসেই মেয়েদের হলে মেয়েদের সাথে হিন্দী গানের সাথে জাফর ইকবালের নাচানাচি; ওনার মেয়ে ইয়েসিমের পোষাক, সংষ্কৃতি, যাপিত জীবন ইত্যাদি আলোচনায় এসেছে। জাফর ইকবাল ভক্ত বা কিছু মানবতাবাদী বা সুশীল নামধারী লোকজন সমস্বরে বলে যাচ্ছেন যে জাফর ইকবালের মেয়ের (ইয়েসিম ইকবাল) প্রাইভেসি নষ্ট করে তার মহা ক্ষতি করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু তারা নিজেরাও ভাল করেই জানেন যে, সবগুলো ছবিই ইয়েসিম নিজে ফেসবুকে পোস্ট করেছে, যে পোস্ট সবার জন্য এখনও উন্মুক্ত। এখন ফেসবুকের ছবি সামহোয়্যারইন ব্লগে প্রকাশ করাটা যদি এত বড় অন্যায় হয়, তাহলে ওয়েব দুনিয়াকে মুক্ত বলা হচ্ছে কেন? আপনি যা কিছু মুক্তভাবে ইন্টারনেটে দিচ্ছেন, আপনি চান বা না চান, প্রতিদিন সেগুলো বিভিন্নভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ব্যবহার করবে এটাই বাস্তবতা। ইয়েসিম ইকবাল যদি ঐ ছবিগুলো গোপন রাখতে চাইতো বা ছবিগুলো শুধুমাত্র তার বন্ধুদেরকে দেখাতে চাইতো তাহলে সে সুযোগও তার ছিল। কিন্তু সে তা করেনি অর্থাৎ ছবিগুলো মোটেই তার একান্ত ব্যক্তিগত নয়; বরং তার নিজের দিক থেকেই তা সবার জন্য উন্মুক্ত। এমতাবস্থায়, ইয়েসিম ইকবালের ব্যক্তিগত ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে, তার পার্সোনাল ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে বলে যে রব উঠেছে তা যুক্তিতে টেকে না। ছবিগুলোর মাধ্যমে জাফর ইকবালের নিজস্ব অবস্থান বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। যেহেতু ছবিগুলো জাফর ইকবালের মেয়ের, সেহেতু ধরে নেওয়া যায় যে, জাফর ইকবাল সে সংষ্কৃতি সমর্থন করেন। মেয়েদের হলে জাফর ইকবাল মেয়েদের সাথে অশ্লীল হিন্দী গানের সাথে নাচছেন - এমন ভিডিও ইন্টারনেটে আছে। এ থেকে জাফর ইকবাল-পছন্দ সংষ্কৃতি কিছুটা বোঝা যায়। জাফর ইকবাল তার মেয়ের জীবন-যাপনকে অপছন্দ করেন বলে শুনিনি। আর জাফর ইকবালের অমতে তার মেয়ে যদি এ রকম ভিন দেশী সংষ্কৃতি মেনে চলে থাকে, তাহলে জাফর ইকবালের উচিত তা খোলাখুশি ভাবে বলা। সেক্ষেত্রে তিনি বলতে পারেন, যদিও আমি বাঙালি সংষ্কৃতিকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল সংষ্কৃতি মনে করি, রবীন্দ্রনাথকে পুজা করা যায় বলে মনে করি কিন্তু আমার নিজের মেয়ের কাছে আমি বাঙালি সংষ্কৃতি বা রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারিনি। সে তার নিজের সংষ্কৃতি নিজে বেছে নিয়েছে। কিন্তু তোমরা নিজের পছন্দ নিজে ঠিক করে নেবে না। আমি যা বলি তা তোমরা করবে। তোমরা দাড়ি, টুপি আর বোরকার খোলস থেকে বেড়িয়ে এসে উন্নত হও (অবশ্য ওনার জন্য দাড়ির বিরুদ্ধে বলা মুষ্কিল কারণ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ দাড়ি রেখেছিলেন)। অথবা এ রকম করে নিজের অবস্থানকে পরিষ্কার করতে পারেন। সেক্ষেত্রে ইয়েসিমের যত ব্যক্তিগত ছবিই ইন্টারনেটে বা ব্লগে দেওয়া হোক না কেন তা জাফর ইকবালের গায়ে লাগবে না।
এখন পর্যন্ত জাফর ইকবালের লেখা ও তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ব্লগে যা হয়েছে তার দায় প্রথমত জাফর ইকবালকেই নিতে হবে। কারণ, তিনিই প্রথমে মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাসকে আঘাত করেছেন; অন্যায়ভাবে সমালোচনা করেছেন। এটি যদি তিনি না থামান, তাহলে পরবর্তীতেও আমাদেরকে এ রকম আরোও অনেক কিছু দেখার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।