জাতিসংঘের শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা ইউনেস্কো তার সদর দপ্তর প্যারিস থেকে ২০০৫ সালের ২৭ নভেম্বর এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বাউল গানকে মানবতার ধারক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সারা বিশ্বের ৪৩টি বাক ও বিমূর্ত ঐতিহ্য চিহ্নিত করতে গিয়ে ইউনেস্কো বাংলাদেশের বাউল গানকে অসাধারণ সৃষ্টি বলে আখ্যা দিয়ে একে বিশ্ব মানবতার ঐতিহ্যের ধারক বলে ঘোষণা দেয়। ফলে বাউল গান নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়।
বাউল গান এ দেশের ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত সংগীতের একটি বিশিষ্ট ধারা, বাউল সম্প্রদায়ের নিজস্ব সাধনগীত। বাঙালি জীবনাদর্শন এবং সংস্কৃতির যে বিকাশ কালে কালে হয়েছে, তারই দেখা মেলে বাউল গানে ও বাউল জীবনাদর্শনে। বাংলার উন্মুক্ত আকাশ, চিরসবুজ প্রান্তর, পাখির কাকলি, নদ-নদীর প্রবাহ, সোনা ফলানো মাটি আর মানুষের জীবন-জিজ্ঞাসা বাউল গানে একাত্ম হয়ে ফুটে ওঠে। আর ফুটে ওঠে সাম্যের কথা, মানবতার কথা, আজকে সারা বিশ্বে মানবতা নিয়ে যে উন্মাদনা, তার ভিত্তি ছিল এ বাংলাদেশে হাজার বছর আগে। আজকে যে কল্যাণকর, অর্থনীতির জয়ঢাক সারা বিশ্বে বাজানো হচ্ছে, তারও ভিত্তিভূমি ছিল এ বাংলাদেশের পুন্ড্রনগরে দুই হাজার বছর আগে।
বাংলা গানের আদি উত্স চর্যাপদে গীত হয়েছে সাম্যের কথা। মধ্যযুগে সহজিয়া গানে এমন কী যোগীদের দেহ, সাধনার গানেও সাম্যের কথা প্রকাশ পেয়েছে, যেমন—‘শত বরণ গাভীরে ভাই, একই বরণ দুধ। আপন মনে ভেবে দেখ, আমরা একই মায়ের পুত।’ তবে সাম্যের কথা, মানবতার কথা ব্যাপকভাবে এসেছে বাউল গানে। আর এ ধারাটি পুষ্ট হয়েছে পঞ্চদশ শতাব্দীর তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের ভাব, রাধাকৃষ্ণবাদ, বৈষ্ণব সহজিয়া তত্ত্ব এবং সুফি দর্শনের প্রভাবে। তবে মধ্যযুগে বাংলায় আগত মুসলমান সুফি-সাধকদের সাম্যের বাণীই মূলত বাউল গানকে জনপ্রিয় করে তোলে। বাউল গানের সর্বজনীন রূপটি তখন থেকেই বিকশিত।
নিজ দেহের মধ্যে ঈশ্বরকে পাওয়ার তীব্র ব্যাকুলতা থেকে বাউল ধারার সৃষ্টি। বাউলসাধকদের সাধনার মাধ্যম হচ্ছে গান। সাধকের কাছে সাধন-ভজনের গূঢ়তত্ত্ব প্রকাশ পায় গানের মাধ্যমেই। প্রত্যেক মানুষের অন্তরে যে পরম সুন্দর ঈশ্বরের উপস্থিতি, সেই অদেখাকে দেখা আর অধরাকে ধরাই বাউল সাধন-ভজনের উদ্দেশ্য। ইহজাগতিক কিংবা পারলৌকিক কোনো প্রাপ্তির জন্য বাউল সাধন-ভজন করে না। একান্ত মানবিক ও আধ্যাত্মিক চেতনার বশবর্তী হয়ে তাঁরা ধর্মাচার করেন। পুঁজিবাদী বা সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন তাঁদের নেই। অন্যের জমি দখল করে মসজিদ, মন্দির নির্মাণের প্রয়োজনও তাঁদের নেই। বাউলের ভূখণ্ড বলতে তাঁর দেহ, পথপ্রদর্শক তাঁর গুরু, জীবনসঙ্গী নারী, সাধনপথ বলতে সুর, আর মন্ত্র বলতে একতারা। ভিক্ষা করেই তাঁর জীবনযাপন। ভিক্ষা না পেলেও তাঁর দুঃখ নেই। তাঁর যত দুঃখ মনের মানুষকে না পাওয়ার। বাউলের সাধনপথ যত দীর্ঘায়িত হয়, ব্যাকুলতা তত বাড়ে, দুঃখ যত গভীর হয়; গান হয় তত মানবিক। তাই বাউলের জিজ্ঞাসা—‘মানুষ তত্ত্ব যার সত্য হয় মনে/সেকি অন্য তত্ত্ব মানে।’ তবে মানবকল্যাণ কামনায় সবচেয়ে বেশি সুর ধ্বনিত হয়েছে মরমি সাধক লালনের গানে। লালনের সাম্যবাদী চিন্তাই আজকের উদার মানবতাবাদ। যখন মার্ক্সবাদের জন্মই হয়নি, তখন বাংলাদেশের এক নিভৃত পল্লীতে বসে লালন লেখেন— ‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে। যেদিন হিন্দু মুসলমান/বৌদ্ধ খ্রিষ্টান/জাতি গোত্র নাহি রবে/শোনায়ে লোভের বুলি/নেবে না কাঁধের কুলি/ইতর আতরাফ বলি/ দূরে ঠেলে না দেবে/ আমীর ফকির হয়ে এক ঠাঁই/ সবার পাওনা খাবে সবাই/আশরাফ বলিয়া রেহাই/তবে কেউ নাহি পাবে।’
শুধু সাম্য আর দেহতত্ত্ববাদই নয়, লালনের গানে রয়েছে গভীর মানবিকতার ছোঁয়া। মানবজীবনে সংসারধর্ম পালনকে তিনি অপরিহার্য মনে করেছেন এবং সংসারে থেকেই সংসারবিরাগী হয়ে সাধন-ভজন করার কথা বলেছেন। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণ এবং গৃহত্যাগের দুঃখে তিনি লেখেন—ঘরে কি হয় না ফকিরি/কেন হলিরে নিমাই আজ দেশান্তরী/মন না মুড়ায়ে কেশ মুড়ালে/ তাতেই কি রতন মেলে/মন দিয়ে মন বেঁধেছে যে জন/ তারই কাছে সদায় বাঁধা হরি/ফিরে ঘরে চলরে নিমাই/ঘর সাধনে হবে কামাই/বলে এই কথা কাঁদে সচীমাতা/লালন বলে লীলের বলিহারি।’
বস্তুত উনিশ শতকে লালনের বাউল গানই এর সর্বজনীন আবেদনের কারণে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। লালনের গানই বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে মানুষকে আগ্রহী করে তোলে। লালনের কারণেই হিন্দু, মুসলমান সম্প্রদায়ের তেহতত্ত্ববাদীরা সব বিভেদ ভুলে যুত সাধনায় মিলিত হন। তাঁদের শিষ্য-ভক্তদের মাধ্যমে লালনের গান প্রচার ও প্রসার লাভ করে। লালনের পর পান্ডু শাহ, দুদ্ধ শাহ, ভোলা শাহ, পাগলা কানাই, রাধারমন, কাঙাল হরিনাথ, হাছন রাজা এবং আধুনিককালে অতুল প্রসাদ, বিজয় সরকার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম প্রমুখ বাউল ও কবির মাধ্যমে এ দেশের ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত সংগীতের এ ধারাটি আরও পুষ্ট হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু ভারতবর্ষ নয়, সারা বিশ্বে লালনের কথা প্রচার করেন। বাউলের সহজ-সরল জীবন-যাপন এবং বিশুদ্ধ ধর্মাচরণ তাকে মুগ্ধ করে। তাই তিনি বলেন, ‘বাউল ধর্মমতই যথার্থ মানব ধর্ম। এতে পূর্ণ মানবত্বের প্রকাশ পেয়েছে।’ রবীন্দ্রনাথ লালনের ভাবের শিখাটি সারাজীবন বহন করেছেন। তাই অনেকে রবীন্দ্রনাথকে আধুনিক বাউল বলে সম্বোধন করেন। তবে রবীন্দ্র-উত্তরকালে লালনের ভাবের শিখাটি বহন করার মতো আর কোনো যোগ্য ব্যক্তি এগিয়ে আসেননি।
আজকে বাউল গানকে বিশ্বমানবতার ধারক হিসেবে যে স্বীকৃতি ইউনেস্কো দিয়েছে, তা বাউল গানের যোগ্য প্রাপ্তি। এর বেশির ভাগ কৃতিত্ব লালন সাঁইয়ের। এ স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য বিরাট গর্বের। তবে এ স্বীকৃতির সঙ্গে বিরাট দায়িত্বও বর্তায়। এ স্বীকৃতি প্রাপ্তির চার বছরের অধিককাল পেরিয়ে গেলেও তেমন কাজ হয়নি। সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাউল গান সংগ্রহ করে আধুনিকপ্রযুক্তি ব্যবহার করে এ সব গান অডিও, ভিডিও ও সিডিতে সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। এ কাজের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত ও নাট্যকলা বিভাগ এবং বাংলা একাডেমীর লোকসাহিত্য বিভাগকে প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য দিয়ে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। বাউল সংগীত শিল্পী ও বাউল গবেষকদেরও প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। বাউল গান বিভিন্ন ভাষায় ভাষান্তর করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে হবে। তা না হলে এ স্বীকৃতি এক দিন ইতিহাসের বিষয়ে পরিণত হবে।
১. ২১ শে এপ্রিল, ২০১০ সকাল ১১:৫৮ ০