পাকিদের যুদ্ধটা তো প্রচলিত অনান্য যুদ্ধের মত যেমন আরব-ইসরাইল বা ইরান-ইরাক যুদ্ধের মত ছিল না। (যদিও ঐ সকল যুদ্ধে ভিন্ন মাত্রায় যুদ্ধাপরাধ হয়েছিল)
এই যুদ্ধটা ছিল সুপরিকল্পিত একতরফা গনহত্যা। দখলদার পাকিস্তানের নিয়মিত বাহিনী দিয়ে একটা জাতি কে আংশিক ভাবে নিশ্চিন্ন করে ফেলা। যাতে তাদের তাবেদার-দালালদের দিয়ে নির্বিঘ্নে দেশ শাসন করা যায়।
রায়ের বাজার ইটখোলা, ডিসেম্বরের শেষদিকে বুদ্ধিজীবি গনহত্যার একটি কিলিং গ্রাউন্ড।
তাদের মনস্তত্ত্ব বোঝা যায় গণহত্যার সম্ভাব্য মোটিভ দেখে। আর তাদের হত্যা পরিকল্পনা ও তালিকা কিছুটা বোঝা যায় বিভিন্ন গণহত্যার বিবরন দেখে।
১ – বুদ্ধিজীবী, বাঙ্গালি সংস্কৃতিমনা, সমাজের উচ্চ শিক্ষিত অংশ। শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, লেখক, শিল্পী, ইত্যাদি। হত্যা তালিকায় তারা ছিল পাকিস্তানের সবচে বড় শত্রু। এরা – Think tank বাঙালি জাতীয়তাবাদী-বামপন্থি। এরা পাকিস্তানে জন্মের শুরু থেকেই ধর্ম নিরপেক্ষ বাংগালী জাতীয়তাবাদীর পক্ষে এবং সব অপকর্মের মুল হোতা। এদের by Name তালিকা তৈরি করা ছিল।
২ – হিন্দু ধর্মাবলম্বী সবাই
এরা জাতশত্রু। তাদের ধারনা পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল সব সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকার মুল কারন তারাই। এরা জন্মগত বেইমান, তাদের সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করার এখনই সময়। (বৌদ্ধ রাও রেহাই পাই নাই হিন্দু ভেবে)
৩ – আরবান দুস্থ বস্তিবাসী, ফুটপাতে ঘুমানো হতদরিদ্র লোকজন, ভুমিহীন দরিদ্র লোকজন।
তাদের ধারনা এরা সমাজের বোঝা, আবর্জনা যত কমানো যায়, উন্নত পাকিস্তানে এরা সংখায় যত কম থাকে ততই ভাল, এরাও মিছিলে থাকে সব সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে ভোট দেয়, ২৫মার্চ কাল রাত্রে ৯০% victim এরাই।
৪ – তরুন সমাজের প্রায় সবাই। (কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া) শহরবাসি গ্রামবাসী তরুন, Student.
এরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে বা দিতে পারে, মিছিলে থাকে, গন্ডগলের-বিদ্রোহের মুল শক্তি। বাড়ী বাড়ী খুজে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হত। খানসেনারা তল্লাশি করার সময়ে সবসময়ে পরিবারে অন্য সদস্যরা তাদেরকে লুকিয়ে রাখতে দেখেছি।
এদের সবাই কে পালাক্রমে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্যে টাস্কফোর্স গঠন করে নৃশংস হিটলারি পরিকল্পনা করা হয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সর্বোচ্চ থেকে। সুপরিকল্পিত ভাবেই চলছিল নিধন।
ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পথে যশোরের একটি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিল শতাধিক গ্রামবাসি। বিহারিদের মাধ্যমে খবর পেয়ে খানসেনারা তাদের নির্মম ভাবে হত্যা করে। পরে বিদ্রোহী ইপিআর সদস্যরা যশোর পুনর্দখল করে। মৃতদেহগুলোকে গনকবর দেয়া হয়েছিল।
দালাল-রাজাকাররা গ্রাম গুলি চিনিয়ে দিচ্ছিল। যে সব বাড়ী থেকে যুবক বয়সিরা অনুপস্থিত মানে তারা মুক্তিযুদ্ধে আছে, লুন্ঠনে পটু বিহারিরা চিনিয়ে দিচ্ছিল হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম, কিছু কিছু গ্রামের সবাইকেই মারে ফেলা হয়েছিল। ধর্ষন আর লুন্ঠনের কথা বললে পাতার পর পাতা লিখেও শেষ করা যাবে না। গণহত্যা চলছিল অব্যাহত ভাবে।
এভাবেই চলত।
কিন্তু নভেম্বরের দিকে যখন পরাজয় অবধারিত হয়ে যায়, তখন তল্লাশিরত পাক বাহিনীর সাথে সাদাপোষাকে সশস্ত্র স্থানীয় কিছু তরুন দের মাঠে দেখা যায়। বেসামরিক বাঙ্গালি চেহারা অথচ সৈনিকদের ধমক দিয়ে কমান্ড করছে! কয়েকজনের কাঁধে সাবম্যসিনগান।
এরা কেন্দ্রীয় নির্দেশে জামাতের কতিপয় radical student wing ইসলামি ছাত্রসঙ্ঘ এবং জামাতের তরুন নেতৃবৃন্দ, যারা গণহত্যার পরিকল্পনাকারী জেনারেল রাও ফরমান আলিদের সাথে একসাথে কাজ করছিল সুরু থেকেই। কিন্তু নভেম্বরের আগে ফ্রন্টে আসতে দেখা যায়নি। তারা ‘আল বদর’। তারা উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন এবং নীতি নির্ধারন পযায়ে ছিল।
যুদ্ধের শেষ দিকে স্বরুপে ফিরে না আসা পর্যন্ত আলবদর নাম টি অনেকের কাছে এমন কি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সুত্র মার্কিন গোয়েন্দাদের কাছেও অজানা ছিল। ‘পরাজয় নিশ্চিত’ এটা তারা উপলব্ধি করে মোটা বুদ্ধির পাকি জেনারেলদের অনেক আগেই। এর পর মরিয়া হয়ে অসমাপ্ত কাজ দ্রুত সমাপ্ত করার চেষ্টা করে, নিজেরাই অস্ত্র হাতে নেমেপরে। সাথে ছাইরঙ্গা ইউনিফর্মধারি সশস্ত্র রাজাকার ও কালচে ছাইরঙ্গা বিহারি মুজাহিদ।
তালিকার ১ নং কে high priority ধরে বেপরোয়া ভাবে ধরপাকড় চালায়। যে কজনকে পাওয়া যায় হাত-পা বেঁধে রাজাকারের হাতে ইট খোলায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। শেষ দিন ১৬ই ডিসেম্বর ভোর পযন্ত চলতে থাকে তাদের নারকীয় তান্ডব।
আলবদর chief কে ছিল সেটা হয়ত কখনই জানা যাবে না, তবে নিজামি এবং মুজাহিদ নামটি বার বার এসেছে। একটি হত্যা তালিকার অস্তিত্ব ছিল এটা পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলির বক্তব্যে স্বীকার করা হয়েছিল। পাকিস্তানি হামিদুররহমান কমিশন তদন্তেও এই হত্যা তালিকার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যদিও পাকিস্তান এই হত্যাকাণ্ডের দায় কখনোই স্বীকার করেনি।
সম্প্রতি অবমুক্ত তৎকালীন মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের একটি বিবরনে ঢাকায় নভেম্বর ও ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী গণহত্যা হয়েছিল বলা হয়েছে। এবং হত্যাকারী হিসেবে পাকি সৈনিক না, জামাতের সসস্ত্র লোকজনদের স্পষ্ট ভাবে দায়ী করা হয়েছে।
গোলাম আজম গ্রেফতার হওয়ার আগের দিন স্বীকার করলেন, উর্ধ্বতন পাকি জেনারেলদের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। বিভিন্ন টিভি সাক্ষ্যাতকার। নয়াদিগন্ত ও জামাতের দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায়ও তার পুর্নাংগ ইন্টারভিউ ছাপা হয়েছিল।
সেখানে একটি অংশে তিনি পাঞ্জাবী সেনাদের হাতে আটক একজন বাঙ্গালির জীবন বাচানোর গল্প করছিলেন, সেখানে স্পষ্ট স্বীকার করেছেন টিক্কা খান ও জেঃ রাও ফরমান আলির সাথে তার ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। তার হটলাইন ফোন সব সময় তার কাছে থাকতো (দুর্গত-বিপদগ্রস্ত বাঙালিদের সাহায্যের জন্য.!!)
তার বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে তিনি যেকোন সময় ক্যান্টনমেন্টে ঢুকে ফরমান আলিদের বাসভবনে যেতে পারতেন
আলবদর বাহিনী জামাতের নিজস্ব সংগঠন, এটা জামাত এখন আর স্বীকার করেনা। কিন্তু প্রমান আছে পদে পদে।
জামায়াতে ইসলামীর নিজস্ব সংবাদপত্র ‘দৈনিক সংগ্রামের’ ১৪ নভেম্বর ৭১এ প্রকাশিত সংখ্যাটিতে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর লেখা একটি নিবন্ধের একটি অংশ -
“আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে, দেশপ্রেমিক পাক-বাহিনীর সহযোগিতায় এ দেশের ইসলামপ্রিয় অসম সাহসী তরুণ সমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে অবলম্বন করে পাকিস্তানের সশস্ত্র সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ‘আলবদর’ বাহিনী গঠন করেছে। সেদিন আর খুব দূরে নয় যে যৌথভাবে তারা হিন্দু-বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে হিন্দুস্তানের অস্তিত্বকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করবে”
- মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী
Reference-
তথ্যগুলো ১৯৭১ এ প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা দৈনিক পুর্বদেশ, দৈনিক পাকিস্তান, দৈনিক সংগ্রাম, International Herald Tribune (Hong Kong)
দৈনিক প্রথম আলো ১৪-১২-১২। এবং প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিদের সাক্ষাতকার থেকে সংগ্রহিত। লেখক নিজেও একজন প্রত্যক্ষদর্শী
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:৩০