নুহা ২৫
রাত নয়টার একটু পর রেজা আমাদের সাবলেটের নতুন ভাড়াটিয়া আইরিনকে নিয়ে বাসায় ঢোকে। আমাদের শোবার রুমের দরজা না খুলেও আমি টের পাই আইরিনের গলার আওয়াজে। রেজা রুমে এসে একবার উঁকি দিয়ে বলে যায় - আইরিন আসছে, ওর রুম পরিষ্কার করছিলা? রেজার কথার উত্তর দেয়া দূরের কথা ওর চেহারার দিকেও আমার তাকাতে ইচ্ছা করছে না বলে আমি নিরুত্তর থাকি। এমন ভাব করছে যেন সব স্বাভাবিক। আমি বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়েই থাকি। ভাবছি কী করে নিজের অবস্থার উন্নতি করা যায়। কিন্তু ভাবনার ছেদ ঘটাতে আইরিন এসে দরজায় নক করে কথা বলবে বলে। বাধ্য হয়ে উঠে বসি। রেজা গদগদ ভাবে বলতে আইরিনকে থাকে -
নুহার তো মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। তাই মনে হয় শুইয়া ছিল। বলে ও আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে চায়। আমি আলগোছে মাথা সরিয়ে নেই।
আইরিন ঘরে ঢুকে আমাকে হাগ দেয়। বিছানায় বসে হাত টেনে আমাকেও বসায়। বলে মাইগ্রেনের ব্যথার কষ্ট ও জানে কেমন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে - তোর জন্য কফি বানিয়ে আনি?
আমি তাকে নিষেধ করি। জানাই কিছুক্ষণ আগেই কফি খেয়েছি। ও যাতে নিজের ঘরের গোছগাছ করে নেয় আর কিছুর প্রয়োজন হলে যাতে আমাকে ডাকে। এমনিতেই আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না, তাই হয়ত চেহারায় স্বাভাবিক হাসিখুশির ভাবও ছিল না। অবশ্য আইরিন ধরে নেয় শরীর ভাল না বলেই আমি চুপচাপ। যার যা ইচ্ছা ধরে নিক। আমি কথা না বাড়িয়ে চুপ করে থাকি। আইরিন আমার রুম থেকে বের হলে আমি আমার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। রাস্তার ওপাশের পার্ক থেকে রাতের পাখি অথবা ঝি ঝি পোকার মত কিছু একটা হবে হয়ত, ডাক আসছে। সাথে হিমহিম একটা নরম হাওয়া। আমি চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে চাই কিছুক্ষণের জন্য।
কিছুক্ষণ পরেই শুনি রেজা ডাকছে। আমার উত্তর দিতে বা ঘরে ঢুকতে ইচ্ছা করে না। চকিতে একবার নিনোর কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে একটা হাল্কা অস্থির ভাবও কাজ করে। ইচ্ছে করে রান্নাঘরের বারান্দায় গিয়ে একবার দাঁড়াতে। কিন্তু আমার কী অস্থির হবার মত কিছু হয়েছে? তা তো না। হয়ত কিছুক্ষণের মধ্যেই রেজার আজেবাজে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে বলে আমি অন্য কোনো ভাবনায় বুঁদ হতে চাচ্ছি নিনোকে ভেবে!
নুহা, তুমি নিনোর প্রেমে পড়েছ! হিহিহি একটা হাসি একটানা আমার ভেতরের নুহাটা হেসে যেতেই থাকে। আজকে নুহাকে আমার থামাতে ইচ্ছে করে না।
থামাবে কোত্থেকে নুহা, আমি তো মিথ্যে বলিনি। নুহার কথা শুনে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই। দেখি রেজা বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে।
কী হইলো, ডাকতেছি শুনতেছ না? ভিতরে আসো, কথা আছে।
আমার মাঝে কথা শোনার বা নড়াচড়ার লক্ষণ না দেখে রেজা আমার হাত ধরে টেনে ভেতরে আনে। আমি কোনো প্রতিরোধ দেখাই না। আমার আসলে কথা বলতেও মনে হচ্ছে অনেক শক্তি খরচ হচ্ছে এমন একটা অনুভূতি কাজ করতে থাকে। ঘরে ঢুকে দেখি সেই এনভেলপটা যেটাতে রেজা আর লিয়ানার ছবি ছিল, রেজা বিছানায় ছড়িয়ে রেখেছে ছবিগুলো।
আমার থুতনীতে হাত দিয়ে রেজা বলে -
কী আমার নুহাটার রাগ হইছে নাকি এই ছবিগুলি দেইখ্যা?
আমি তবুও চুপ থাকি। আমার আসলে রাগ হয়নি এটা রেজাকে বলতে ইচ্ছে করে না। সে তার প্রেমিকাকে নিয়ে শহরের বাইরে ছুটি কাটাতে গিয়েছে বউ কে বাংলাদেশে পাঠিয়ে এতে রাগের কিছু নেই। ইনফ্যাক্ট আমি রাগের অবস্থাতেও নেই। আমি কী করে আমার জীবনটাকে গুছাবো সেটাই মাথা থেকে বের করতে পারছিলাম না। প্রতারণার একটা কষ্ট হচ্ছিল। কষ্টটা বড্ড শুষ্ক। সেখানে রাগ একটা তুচ্ছ ব্যাপার।
কী হইলো নুহা, কথা কও না ক্যান? তোমারে চিঠিতে কইছিলাম না বাসায় আইসা জানি দেখি তুমি স্বাভাবিক আচরণ করতাছ আমার লগে? তুমি চিঠিটা পড়ছিলা?
- না, রাগ করিনি তোমার আর লিয়ানার ঘনিষ্ঠ ছবি দেখে। হয়ত তুমি ছবিগুলো আমাকে দেখিয়ে তোমার আর লিয়ানার সম্পর্কটা আরো স্পষ্ট করতে চাচ্ছিলে। সব ভালো যার শেষ ভালো তার একটা কথা আছে না! সত্যিটা সামনে চলে এলো। আইরিনকে এজন্য ধন্যবাদ দেয়া দরকার।
- আরে ধুর ধুর এইগুলি বাদ দ্যাও তো। পাস্ট ইজ পাস্ট। লিয়ানা তো আমার বান্ধবী। এখন কও তুমি কাইল রাইতে কই আছিলা? শবনমগো বাসায় তো যাও নাই আমি কায়দা কইরা জাইন্যা নিছি।
- বলব না। জানার ইচ্ছা থাকলে তো বের হতেই দিতে না। - তোমার রাগের মইধ্যে জোরাজুরি করতে চাই নাই- এহন কও কই আছিলা কাইল রাইতে?- বলছি তো বলব না- বয়ফ্রেন্ড জুটাও নাই তো? আমি হা হা করে হেসে উঠি রেজার কথা শুনে। শ্লেষ মিশিয়ে বলি -
বয়ফ্রেন্ড জোটালেই কী! সো হোয়াট! তুমি ঘরে বউ রেখে যদি আরেক মেয়ের সাথে ফিজিক্যালি ইনভলভ হতে পারো তাহলে সেখানে আমাকে এসব প্রশ্ন করা তোমাকে মানায় না।
- যাউকজ্ঞা এসব বাদ দ্যাও তো। ভাত দ্যাও, খিদা লাগছে
- রেজা তোমার সাথে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। প্লিজ বিরক্ত করবে না। তোমার সাথে আমার একটা ডিসিশন নেয়ার সময় আসছে। তুমি প্রস্তুত হও।
রেজা ওর কোলে রাখা বালিশটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে বলে ওঠে -
- ঐসব বালের হুমকি আমারে দিও না। এইগুলি রেজা বাল দিয়াও পুছে না।
আমার ওর সাথে তর্ক করতে ইচ্ছা করে না। এতে মনে হয় আমার উপর রেজার রাগ আরো বাড়ে। নিজেই গজ গজ করতে থাকে আর বলে -এত ত্যাজ বাপের বাড়ি যাইয়া দেখাও গা। সামনের মাসে যখন তোমার ভাই আইব, খেতা বালিশ লইয়া বাংলাদেশে যাও গা। এইসব এইখানে চলবো না।
বিছানা থেকে নেমে রেজা বাইরের পোশাক বদলাতে বদলাতে আবার বলতে থাকে -এত সোনারে মনারে কইয়া কাছে ডাকি তাও মন গলে না। এইরকম মরা শইল লইয়া কী করুম আমি। কোনোভাবেই জাগাইতে পারি না। অন্য ব্যাটাগো মত লাত্থির উপ্রে রাখলে বুঝতা জামাইর ঘর আর ভাত খাওন কারে কয়। জীবনডারে তিতা বানায় দিতাছে। একটা বালেরে বিয়া করছিলাম।
আমার ইচ্ছে করে রেজার গায়ে থুতু মারতে। তীব্রভাবে ইচ্ছে করে। দাও না মেরে। তাহলে বুঝবো তোমার জীবনে একটা পরিবর্তন হবে। নুহা আমাকে বলে।- সত্যি থুতু মারবো? - মারো। একবার না। দুইবার মারবে। তারপর বলবে - করলাম না তোমার সংসার।
রেজা আরো কিছু হয়ত বলতে নিচ্ছিলো। কিন্তু ওর মুখ বরাবর আমাকে ওর দিকে তীব্র চোখের চাহনিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাগ আরো বেড়ে যায়। বলে -
এইরকম ঘাড় ত্যাড়ার মত চাইয়া রইছ ক্যান? দুইডা চটকানা খাইলে ঠিকই মুখ দিয়া বাইর হইব কাইল সারা রাইত কই আছিলা? ফাজিলের ফাজিল। আমারে পুলিশের ডর দেহায়। দিছি কইয়া তোর বাপ মায়েরে যে তুই আমারে বাল দিয়াও পুছছ না।
আমি আবারো শব্দ করে হেসে উঠি। নুহার শেখানো কাজটাই করি। রেজার গায়ে থুতু মারি। ওর অবাক ভাব কাটতে না কাটতে আরো একবার থুতু মারি ওর গায়ে।
- চুপ আর একটা কথাও বলবা না, রেজা। নিচে নামতে নামতে অনেক নিচে নেমে গেছো। স্টপ নাউ।
ঘটনার আকস্মিকতায় রেজার মুখে কোনো কথা নেই। ও হয়ত বিশ্বাস করতে পারে না আমি এমন কিছু করতে পারি। আমি দরজা খুলে রুম থেকে বের হয়ে আইরিনের রুমের দিকে হাঁটতে থাকি। তার আগে তিন কাপ কফি বানাবার ব্যবস্থা করি। এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে। তখন আইরিনের সাথে ভালভাবে কথা বলা হয়নি। এখন কফি খেতে খেতে ওদের মা আর মেয়ের ঘর গোছানোটা দেখা যেতে পারে।
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:৫৫