আমাদের দেশের জাতীয় খেলা কোনটি? বইতে পড়েছি এবং এখনো শিক্ষার্থীরা পড়ছে - জাতীয় খেলা হাডুডু। কিন্তু বর্তমানের প্রেক্ষাপটে জাতীয় খেলা বলতে হয়ত আমরা ক্রিকেট খেলাকেই বুঝবো। কারণটা সবাইই অনুধাবন করবেন আসলে তাই কারণ ব্যাখ্যার কিছু নেই। আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন থেকেই দেখতাম ভাইয়া ক্রিকেট খেলতো। এ মহল্লার বা ও মহল্লার গ্রুপ মিলে টুর্নামেন্ট খেলতো। মিনি ট্রাক ভাড়া করে হৈহৈ করতে করতে, গানবাজনা বাজিয়ে তারা যেতো ক্রিকেট খেলতে। যাবার আগে ফুপু, ফুপুর ফ্রেন্ড, মা, আপা অন্যান্যদের দোয়া চাইতে চাইতে যেতো। আপা বা ফুপু ফাজলামি করে বলতো -
তোরা যে খেলোয়াড় জানা আছে। হাইরা আসবি।
ঝড়ে বক মরে আর ফকিরের কেরামতি বাড়ে টাইপ ব্যাপার। হেরে এসে ইচ্ছামতো ওদের গালাগালি করতো। মা হয়ত একটু সান্ত্বনা দিতো। ভাইয়াকে পছন্দ করতাম বেশি তাই বুঝে না বুঝে তার জন্যই মন খারাপ হতো। ভাইয়ার বন্ধুদের সাথে দেখা হলে তারাও বলতো - বুঝলা, আমরা হাইরা গেছি। দুই নাম্বারি কইরা আম্পায়ার আমাদের হারাইছে।
কেউ বলতো -
ঐ লম্বু রনির জন্যই হারছি। শরীরে জোর নাই। এমন স্বাস্থ্য নিয়া খেলতে গেছে। ওরে দলে নেওনটা ভুল আছিলো।
কেউ বলতো -
ওগো মহল্লায় আর খেলতে যামু না। মহল্লার পোলাপাইন ভালো না। জুরাইন মাঠেই খেলুম।
ক্রিকেটের প্রতি ভাইয়া আর তার বন্ধুদের ভালোবাসা আর আবেগ এর প্রকাশ সেই স্কুল লাইফ থেকেই দেখে আসছি যা এখনো কমেনি। এখনো সুযোগ পেলে সে খেলে, সাথে তার ছেলেকে নিয়ে যায় মাঠে, আমার ছেলেকে। ফতুল্লা মাঠে, ওসমান আলী স্টেডিয়ামে মাঝে মাঝেই আতাহার আলী, সুজন, দুর্জয়, আকরাম উনারা আসেন, প্রীতি ম্যাচ খেলা হয়।
পুরান ঢাকায় থাকতাম। আমাদের স্কুলের বিপরীতেই আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ( সাবেক ক্রিকেটার) বাড়ি ছিল। উনার বোন ছিলেন আমাদের ক্লাসের টিচার। ভাগ্নি মারিয়া ছিল আমার ক্লাসমেট। আমাদের মর্নিং শিফট শুরু হতো সকাল ৭ টায়। সেই বুলবুল মামা সকাল সকাল উঠতেন ঘুম থেকে আর উনাদের বাড়ির গলির কাছে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করতেন। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগতো। পরে বুঝেছি স্কুলে তো বড় আপুরাও পড়তেন। সুতরাং ব্যাপারটা অদ্ভুতের কিছু রইলো না পরবর্তীতে। মারিয়া তখন ক্লাসের সবার কাছেই গল্প করতো মামার জন্য বউ খুঁজছি ফর্সা গায়ের রঙের।আমাদের কাউকে কাউকে নিজের মামী বানাবার প্রস্তাবও দিতো। কেউ কেউ তো বলেই দিতো তোর কাইল্যা মামারে কে বিয়া করবো। কিন্তু কালো হোক বা ফর্সা হোক ১৯৯৭ সালের পর বুলবুলসহ খালেদ মাসুদ সুজন, নাইমুর রহমান দুর্জয়, আকরাম খান, খালেদ মাসুদ পাইলট, রফিক উনারাই তো আমাদের হিরো হয়ে গেলেন। সেই দিনটা ভুলবার নয় আইসিসিতে খেলার যোগ্যতা অর্জন। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে পড়ি তখন। সেদিন কলেজ গেট থেকে বের হয়ে দেখেছি রঙের নাকানি চোবানি খায়নি এমন মানুষ কমই ছিলো যারা যারা বাইরে বের হয়েছিলো। সেদিনের আনন্দটা ছিলো অভাবনীয়। সেই সাথে মনে করছি মেহরাব হোসেন অপি, বিদ্যুৎ, শাহরিয়ার নাফিস, আব্দুর রাজ্জাকদের কথা।
সেদিনও প্রমাণ হয়েছে ক্রিকেটের সাথে আমাদের বাংলাদেশিদের কতখানি আবেগ জড়িয়ে আছে।
তারপর গত হয়েছে অনেকগুলো বছর। এখন ২০১৬। বাংলাদেশের ক্রিকেটীয় চেহারা অন্যরকম, একটি পরিচিত নাম অন্যান্য দেশগুলিতে। কিন্তু এখনো এতে আবেগ জড়িয়ে। বলছি না আবেগকে বাদ দিতে কিন্তু এখন মনে হয় সময়টা আর আবেগ দিয়ে মূল্যায়িত করার না। প্রফেশনাল হয়ে খেলার সময়, যৌক্তিক চিন্তার সময়। গতপরশুর অস্ট্রেলিয়া আর বাংলাদেশের ম্যাচের জন্যই আমার আজকের এই ব্লগর ব্লগরের প্রসঙ্গ।
বিভিন্ন জনের ফেসবুক স্ট্যাটাস, ক্রিকেট রিলেটেড পেজ থেকে বিভিন্ন দর্শকের মতামত, যুক্তি,আবেগ সব দেখছিলাম খুব বেশি মাত্রায় বিশেষ করে যখন তাসকিনের বোলিং অ্যাকশন অবৈধ ঘোষণা করে শাস্তি হিসেবে খেলা থেকে ছিটকে বের করে দেয়া হলো। অবশ্যই মনে করি সেদিন তামিম ইকবাল সুস্থ থাকলে আর আরাফাত সানি এবং তাসকিন থাকলে আমাদের সেদিনের স্কোর অন্যরকম হতো। আমাদের পয়েন্ট টেবিলেও দুইটা নাম্বার যোগ হতো। এই যদির চক্করে অনেক কিছুই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
তামিমের রিপ্লেসমেন্ট কিংবা মিথুনকে নিয়ে যে কথা প্রায়শই শোনা যাচ্ছে তার নিশ্চয়ই কিছু যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে।
আমি কোনোকালেই কোনো ক্রিকেট বোদ্ধা ছিলাম না। বুঝিও না তেমন। বাংলাদেশের প্লেয়ারদের ছাড়া অন্য দেশের প্লেয়ার কমই চিনি। এটা খুব ফিল করি আমাদের ওপেনারে সমস্যা আছে। সৌম্য ফর্মে নাই কিন্তু এমন না সে ভালো খেলেনি। সৌম্যকে নিয়ে ট্রল দেখলাম একজনের নিউজফিডে। দেখে সত্যি কথা ভালো লাগেনি। ওপেনিং এ সৌম্যর বদলে আর কাউকে খেলানো যায় কিনা ভাবা যেতে পারে। বিজয়কে কেন নেয়া হচ্ছে না জানেন কেউ ?
মুশফিকও অফ ফর্মে কিন্তু মুশফিক আমাদের অতীতে কী দিয়েছে সেটা কি ভুলে যাবার মতো? দর্শকদের মাত্রাতিরিক্ত আবেগ কখনো কারো জন্য সুফল বয়ে আনবে না মনে হয়।
“ ওরে বদলাইয়া অন্য কীপার নাও, ওরে ব্যাটিং করতে দিও না “ এই জাতীয় ফাউল কথা শুনতেও ভালো লাগে না।
সাকিবের ফর্ম এগেইন কাম ব্যাক। কিন্তু সাকিব হেটারদের কথা ভুলি কী করে! সবাই কি সবদিন ভালো খেলতে পারে? সাকিব বিদেশ গেলে খেলা উজাড় করে খেলে আর বাংলাদেশে ফালতু খেলে। আর ব্যাস শুরু হয়ে যায় সাকিবের বউ,বাচ্চা গুষ্ঠি উদ্ধারের অভিযান।
নাসির আমার একজন প্রিয় খেলোয়াড়। স্পেশালি তার অনবদ্য ফিল্ডিং, ক্যাচ এসবের জন্য। কিন্তু নাম উল্লেখ না করে বলি আমার এক পরিচিত সেদিন বলছিল –
কি দেইখ্যা ওরে আপনার ভাল্লাগে? টায়ফয়েড রোগী। ওর বডি দেখছেন, খেলোয়াড়সুলভ ফিটনেস আছে, কব্জিতে জোর আছে? খালি একটা দুইটা ক্যাচ ধরলেই হইব!
আমি স্পীকার হয়ে গেছিলাম। নাসিরকে কেন বসিয়ে রাখা হয় এটা আমার একটা আফসোস। দলীয় পারফর্মেন্সের ভিত্তিতে ওকে মনে করি খেলানো দরকার। খালেদ মাহমুদ সুজনের প্রিয়ভাজন বলে ( শোনা কথা ) শুভাগত হোমকে খেলানোর চেয়ে নাসির বেস্ট। জার্নির ধকল, প্র্যাকটিস না করে ওয়ার্ল্ড কাপে খেলতে দেয়ার চেয়ে সেদিন শুভাগতের চেয়ে নাসির ছিল এপ্রোপ্রিয়েট অপশন। যেহেতু আমি আমজনতা তাই আমি কম বুঝি তাই বিসিবি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আর যা ভালো বুঝেছেন তাই আমরা খেলার মাঠে দেখেছি স্কোয়াড হিসেবে।
বর্তমানের ফর্ম বিবেচনায় তামিমের সাথে সাব্বিরকে ওপেনিং এ আর ওয়ান ডাউনে মাহমুদুল্লাহকে নামানো কতটা যৌক্তিক বা ভালো হবে আমার এই প্রশ্নে আমার কাজিন বলছিল –
আপনে বিসিবিতে যোগ দেন। বিসিবির হর্তাকর্তাদের পছন্দের লোকরা কই খেলবে? মহল্লায়?
সেদিন অস্ট্রেলিয়া আর বাংলাদেশের ম্যাচের খেলায় অনেক অনেক মতামত পেয়েছি ক্রিকেটের ফেসবুক পেইজে। কেন মাশরাফি শুরুর ওভার করে বসে পড়লো। যেখানে সাকলাইন সজীবের বিশ্বকাপের মতো আসরের চাপ নেয়ার অভ্যাস নাই, এত রান দিয়েছে সেখানে কেন ম্যাশ বোলিং করলো না! আপনাদের মতামত কি? সেদিন সজীবের রনি খেললে কি ভালো হতো? আসলেই কি রুবেলের ইঞ্জুরি চলছে নাকি বিসিবির খেয়ালের শিকার? আর মাশরাফি ক্যাপ্টেন হিসেবে কেমন সেটা আমরা সবাইই জানি। তাই সুনীল গাভাস্কার কি বললো বা কে কি বললো সেটা মনে হয় আমাদের ক্যাপ্টেন এর ভাবার দরকার নাই।
মুস্তাফিজের যোগ্য সম্মান মুস্তাফিজ পেয়েছে। তাকে অভিনন্দন। খারাপ দেখে দেখে ভয় লাগে মুস্তাফিজও না আইসিসির শিকার হয়ে যায়।
আরেক প্রিয় খেলোয়াড় আল-আমিনের কথা না বললেই না। অন্যদের তুলনায় সে ফোকাসড কম হয় কিন্তু যোগ্য খেলোয়াড়ের পেছনে শ্রম আর যত্ন দিলে সেও ঠিক হীরক খন্ড হয়েই থাকবে।
আরো অনেক অনেক কথা হয়ত চলে আসবে এভাবে লিখতে গেলে। এগুলো আমার একান্তই ভাবনা। আপনাদের ভাবনা, বাংলাদেশের ক্রিকেটের পরবর্তী পদক্ষেপ কেমন হলে ভালো হবে আপনাদের মতামতও শুনতে চাই।
আরেকটা কথা কোনো দেশের ক্রিকেটারদের নিয়ে ট্রল দেখতে সত্যিই ভালো লাগে না। আমাদের দর্শক, ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে যে সুনাম সেটা যেন ধরে রাখতে পারি এটা আমারও চাওয়া। এক দুই ম্যাচ ভালো খেললে তাকে আকাশে তুলে দেয়া প্রশংসা করে করে আবার সেই খেলোয়াড়ই যদি তিন চারটা ম্যাচে খারাপ খেলে তাকে বকাবকি, অমুক ,তমুক বলে লাশ বানিয়ে ফেলতেও দ্বিধা করি না। এই মানসিকতা বদলাতে হবে।
জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় দেখি অনেকেই অনেক রকম ভঙ্গীতে জাতীয় সঙ্গীত গায়। কেউ দুলে দুলে, কেউ বুকে হাত রেখে! অদ্ভুত লাগে। জাতীয় সঙ্গীত কি কেউ এভাবে গায়? ছোট থেকেই তো পড়ে আসছি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গাইতে হয়। ক্যামেরা সামনে আসলে লাফিয়ে ওঠা, ফ্লাইং কিস দেয়া ইত্যাদি আরো কিছু। জাতীয় সঙ্গীত শুনলে আমার নিজের গায়েই কাঁটা দিয়ে ওঠে। আমাদের সবার উচিত এই সময়টায় যথাযথ ভাবে সম্মান জানানো। জানি ক্রিকেটের সাথে আবেগ জড়িয়ে কিন্তু এই আবেগের সাথে লাফালাফি, নাচানাচিটা ঠিক যায় না আর কি!
আজকের খেলায় আমাদের জন্য পিচ, টস কতটা সহায়ক হবে জানা নেই। আশা দেখি ভারতের বিপক্ষে খেলে জয়ের জন্য। আমরা যত বড় দলের বিপক্ষেই খেলি না কেন শুরুতেই যেন মনোবল না হারিয়ে ফেলি, বডি ল্যাংগুয়েজটাও যেন স্ট্রং থাকে। খেলে হারার আগে যেন আমরা শুরুতেই হেরে বসে না থাকি।
আমাদের টাইগার্সদের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।
(সেদিন অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের ম্যাচের খেলার প্রথম অংশ দেখতে পারিনি। যারা ফেসবুকে আপডেট করে আমাকে জানিয়েছিলেন তাদের ধন্যবাদ। সাড়ে তিন বছর পার হবার পরেও একের অধিক ছবি কীভাবে পোস্ট করতে হয় জানতাম না বা ভুলে গেছি। একজন শিখিয়ে দিলো। তাকে ধন্যবাদ।)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:১৮