তারিখঃ ১২ জানুয়ারি, ২০১৬
মিঠুন চাকমা
পারিবারিক অভিজ্ঞতা জ্ঞাপন
আমার দাদীর বাড়ি রাঙামাটির লুঙুদু উপজেলার মাহজনপাড়া গ্রামে।বলে রাখি তিনি লেখাপড়া করেননি।তার সময়ে মেয়েদের লেখাপড়া করা বারণ ছিল। তাই সবাই স্কুলে যাবার সময়ে তিনি হয় রান্নাঘরের চুলা সামলাতে মায়ের সহকারী হয়েছেন নতুবা ঘরের নানা কাজে সহযোগিতা করেছেন।তার সাথে আলাপ করার সময় তার বাপের বাড়িতে ঘটা একটি ঘটনার কথা তিনি স্মরণ করছিলেন।তখন তিনি দাদুর বাড়িতে স্ত্রী হিসেবে চলে এসেছেন এবং কয়েকজন ছেলেপিলেও তার হয়েছে।একদিন তিনি জানতে পারেন তাদের গ্রামে তার পিতার ঘর ‘সর্বহারা’রা লুট করেছে। সর্বহারা নামে যারা এই ঘটনা ঘেটিয়েছিল তারা লুট করেছিল ধানের গোলা থেকে ধান, টাকা পয়সা যা ছিল ও তাদের ঘরে যে সকল কাপড়চোপড় ছিল সবকিছু।তিনি জানাচ্ছিলেন, তার মা বেশ কষ্ট করে বেইন বুনে বুনে পিনন ও খাদি (চাকমা নারীদের পরনের পরিধান)বুনতেন। এবং তা একটি পুটলি বা বোাঁচকায় রেখে দিতেন। সর্বহারা’রা যেদিন লুট করতে আসল সেদিন তার মা পিনন ও খাদি’র সেই পুটলি যেন লুটের হাত থেকে বাাঁচাতে পারেন তার জন্য তা ঘরের বাইরে পাহাড়ের নিচে ছুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সর্বহারা’রা তাও কুড়িয়ে নিয়ে যায়। লুটের পরে তার মায়ের পড়নের কাপড় ছাড়া কিছুই ছিল না। তাকে অন্যজন থেকে কাপড় চেয়ে নিতে হয়েছিল। পরে তিনি নিজে তার মায়ের জন্য পিনন বা পরনের কাপড় পাঠিয়ে দেন।
সর্বহারারা কেন মাহজনপাড়া গ্রামে আমার দাদী’র পিতার বাড়ি লুট করেছিল? এ বিষয়ে দাদী কিছু্ই বলতে পারেননি। কারণ তিনি কীই বা বুঝবেন শ্রেনীশত্রু-মহাজন শ্রেনী বিষয়ে! আমি তো অবাক হই এতদিন পরে তিনি কিভাবে এই ‘সর্বহারা’ শব্দটি মনে রাখতে পারলেন তা নিয়ে!
আদতে দাদী বা তাদের পিতার পরিবার কি বড়সড় কোনো জমিদার কেউ ছিলেন? অথবা ছিলেন অত্যাচারী জমিদার, জোতদার?
ধনসম্পত্তির দিক থেকে হয়ত তাদের অন্যজনের চেয়ে ভালো অবস্থান ছিল। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন প্রেক্ষাপটে ধনী বা জমিদার বলতে যা বোঝায় তা হল, ‘বজরঅ ভাদে পারানা’ বা একুনে ধানের যা উৎপাদন তা দিয়ে পুরো একটি বছর কাটিয়ে দিতে পারাই হলো তৎকালীন সময়ে ধনী বা থাউইএ(চাঙমা ভাষায় ধনী অর্থে বোঝাতে) বা জমিদার হিসেবে পরিচিতির বৈশিষ্ট্য।কিন্তু এটাও ঠিক যে এই জমিদার বা ধনী বা চাকমা ভাষায় থাউইএ শ্রেনীর লোকজনকে তাদের নিজেদের জমিতে নিজেদের গতরও খাটতে হতো।তারা বা এই শ্রেনী কাউকে অত্যাচার করতো কি না তা খুঁজতে হলে পাই পাই করে প্রতিজনের বিষয়ে বাস্তব ধারণা নিতে হবে। কিন্তু তারপরেও কি শ্রমিক শ্রেনীর কমিউনিস্ট বা বিপ্লবী রাজনীতিতে এই ‘মাঝারী ধনী’ বা ‘স্বচ্ছল ধ্বনী’ক শ্রেনীকে ‘শ্রেনীশত্রু’ তকমায় ফেলা যায়?
সম্ভবত, চীনে মাও সেতুঙের পিতা তারও চেয়ে অধিক ধনী বা বিত্তবান বা অধিক জমিদার ছিলেন। কিন্তু মাও সেতুঙ কি এই শ্রেনীকে ‘শত্রু’র কাতারে ফেলেছিলেন?
সর্বহারা পার্টি’র ‘পূর্ব বাংলার সমাজের শ্রেনী বিশ্লেষণ’ লেখাটি পড়লে বোঝা যাবে ‘দাদী’র পিতা কোন শ্রেনীতে পড়তেন। সম্ভবত, তারা বড়জোর ধনীক শ্রেনীর কাতারে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন।তবে ধনীক শ্রেনীর কাতারে পড়বেন কি না তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। দাদী বলেছেন, তার পিতা খুব কষ্ট করে নিজে পরিশ্রম করে ‘আগাব ভুঁই’ চাষ অযোগ্য জমির মাটি কেটে কেটে চাষাবাদযোগ্য জমি প্রস্তুত করেছেন। খেটে খেটে জমির পরিমাণ বাড়িয়েছেন। এবং জমিতে তিনি যেমন মজুর নিয়োগ করতেন তেমনি নিজেও জমিতে শ্রম দিতেন। পরে তিনি এলাকায় মহাজন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
এই শ্রেনী সম্পর্কে বলা হচ্ছে-
‘সাধারণভাবে বলতে গেলে তারা পূ্র্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে কিছুটা ভুমিকা পালন করতে পারে এবং জমিদার বিরোধী ভূমি বিপ্লবী সংগ্রামে নিরপেক্ষ থাকতে পারে। এ কারণে আমরা ধনী চাষীদের জমিদার শ্রেনীভুক্ত করবো না এবং অপরিপক্কভাবে তাদের ধ্বংস করার নীতি নেব না।’(সূত্রঃ সিরাজ সিকদার রচনা সংগ্রহ, শ্রাবন প্রকাশনী; প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯; পৃঃ ৫০।
মাও্ সেতুঙ তার ‘চীনা সমাজের শ্রেনী বিশ্লেষণ’ প্রবন্ধে জমিদার শ্রেনী ও মুৎসুদ্দী শ্রেনী ব্যতীত মাঝারী বুর্জোয়া শ্রেনী থেকে শুরু করে পাতি বুর্জোয়া, স্বত্ত্বাধিকারী কৃষক, মালিক-হস্তশিল্পী, ছাত্র-প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক, অফিসের কেরানী, ছোট ব্যবসায়ী, দোকান কর্মচারী, ফেরী ওয়ালা, আধা সর্বহারা, সর্বহারা শ্রেনী প্রমুখকে বিপ্লবে সম্পৃক্ত করার কথা বলেছিলেন। ছোট প্রবন্ধটির শেষে তিনি বলছেন-
‘সংক্ষেপে, এটা সুস্পষ্ট যে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যোগসাজশে লিপ্ত সমস্ত সমরনায়ক, আমলা মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি শ্রেনী, বড় জমিদার শ্রেনী এবং তাদের সঙ্গে সংযুক্ত বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়াশীল অংশ হলো আমাদের শত্রু। শিল্পকারখানায় কর্মরত সর্বহারা শ্রেনীই হলো আমাদের বিপ্লবের নেতৃত্বস্থানীয় শক্তি। সমস্ত আধা সর্বহারা এবং পাতি বুর্জোয়া হলো আমাদের নিকটতম বন্ধু। দোদুল্যমান মাঝারী বুর্জোয়া শ্রেনীর দক্ষিণপন্থীরা আমাদের শত্রু হতে পারে এবং বামপন্থীরা আমাদের মিত্র হতে পারে- কিন্তু আমাদের সর্বদাই সতর্ক থাকতে হবে এবং তাদেরকে আমাদের ফ্রন্টের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে দেয়া চলবে না।’
(পৃঃ ৯)
সুতরাং, শ্রেনী দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে এই ‘ধনীক শ্রেনী’ বা গ্রাম্য ভাষায় ‘জমিদার শ্রেনী’র প্রতি বিপ্লবী পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত বা তাদের বিষয়ে কী কর্মসূচি প্রদান করা করণীয় তা নিশ্চয়ই স্পষ্ট হয়ে থাকবে। তাই নতুনভাবে আর ব্যাখ্যা প্রদান করার দরকার নেই বলে বিশ্বাস।
নিকটাত্মীয় স্থানীয় ব্যক্তির পরিবারের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে এত উদ্ধৃতি দেয়ার কারণ হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বহারা পার্টির ভুমিকা বা তার রাজনৈতিক সাংগঠনিক কার্যকৌশল তথা বাস্তব কর্মসূচি বিষয়ে আলোকপাত করা এবং তা যে শ্রেনী আন্দোলন তথা কমিউনিস্ট আন্দোলনের দিক থেকে নানা দিক থেকে ভুল পথে পরিচালিত হয়েছে সেদিকে দৃষ্টি দেবার চেষ্টা করা। এখানে সিরাজ সিকদার বা তার পরিচালিত সর্বহারা পার্টিকে ‘তুলোধুনো’ করার জন্য এই কাজটি করা হচ্ছে না। এটা বলা প্রয়োজন যে, বিল্পবকে এগিয়ে নিতে হলে বিল্পবী পার্টিকেই ‘মূল্যায়নের’ মধ্যে আনতে হবে। সেদিক থেকে বিবেচনা করেই এই লেখা। সর্হারা পার্টি বা অন্য কোনো পার্টি যদি আদৌ বিপ্লবী পার্টি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়, তবে সেই পার্টিকে এই ‘স্ক্রীনিং’এর ভেতর দিয়েই যেতে হবে। অর্থাৎ পার্টিকে অবশ্যই তার অতীত থেকে বা অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে বাস্তবভাবেই শিক্ষা নিতে হবে।
জাতি বা জাতিসমূহের অধিকার বিষয়ে গঠনতান্ত্রিকভাবে বা দলিলে সর্বহারা পার্টির অবস্থান
সর্বহারা পার্টির নিউক্লিয়াস সংগঠন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত তাদের থিসিসে ‘জাতীয় জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের সাধারণ কর্মনীতি’ অংশে জাতি বা জাতিসত্তাসমূহের বিচ্ছিন্ন হবার অধিকারসহ স্বায়ত্তশাসন ও সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বিকাশের পূর্ণ সুযোগ দেয়ার কথা বলেছে।
এই কর্মনীতি’র ৯ ও ১০ নম্বর অংশে বলা হয়েছে-
‘৯. বিচ্ছিন্ন হবার অধিকারসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিকে স্বায়্ত্তশাসন ও বিভিন্ন উপজাতিকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দেয়া হবে।’
’১০. সকল অবাঙালী দেশপ্রেমিক জনগণের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বিকাশের পূর্ণ সুযোগ দেয়া হবে।’
(সিরাজ সিকদার রচনা সংগ্রহ; পৃঃ ২৪)
কিন্তু পরে উক্ত সংগঠন পার্টি হিসেবে সর্বহারা পার্টি নাম ধারণ করে তার কাজ পরিচালনার সময় ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করে তাতে সুস্পষ্টভাবে ‘জাতি বা জাতিসত্তাসমূহের জনগণের’ অধিকারের পক্ষে কোনো বাক্য বা বাক্যাংশ সংযুক্ত করা হয়নি।শুধুমাত্র প্রথম অধ্যায়ের সাধারণ কর্মসূচি’র ৪ নম্বর অংশে ‘নিপীড়িত জনগণ ও নিপীড়িত জাতির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে’ ‘সমগ্র মানবজাতির মুক্তির জন্য সম্মিলিতভাবে সংগ্রাম’ চালানোর কথা বলা হয়েছে। (সিরাজ সিকদার রচনা সংগ্রহ; পৃঃ ১৩২)
এই খুবই নগন্য বা অস্পষ্ট তাত্ত্বিক সাংগঠিক বা কর্মর্সূচিগত অবস্থান পরে কী ধরণের ভ্রান্তিতে একটি দলকে নিপতিত করতে পারে আমরা পরে তা দেখবো। এবং এই ভ্রান্তির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকারের লক্ষ্যে আন্দোলনরত সংগঠনের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া ও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সর্বহারা পার্টির নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে দেখবো।
এই শ্রেনী বিশ্লেষণ বাদেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত বা জাতিসত্তাগত স্বাতন্ত্র্যের দিকটি বিবেচনায় নিলে সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির জাতি বা জাতিসত্তাসমূহের জনগণের স্বাতন্ত্রের বা স্বাধিকার তথা স্বায়ত্তশাসনের অধিকারের বিষয়টি নিয়ে আমরা আরো বেশি কিছু বলতে পারি।
তবে প্রসঙ্গটির বিষয়বস্তু ব্যাপক বিস্তৃতি হবে বিধায় আমরা সেদিকে আলোকপাত করছি না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনকামী সংগঠন বিষয়ে সর্বহারা পার্টি
এ বিষয়ে শুধুমাত্র একটি দলিল আমরা পাই। দলিলের শিরোনামা- ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপ’। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে স্ফুলিঙ্গ নামক প্রকাশনায় লেখাটি প্রকাশিত হয়। এতে জনসংহতি সমিতি বা জেএসএস’র আন্দোলনকে ‘চাকমাদের আন্দোলন’ বলে অবস্থান তুলে ধরা হয়। লেখাটির প্রথমেই বলা হয়েছে-
সামন্ত ক্ষুদে বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের চাকমা জাতিসত্তার মধ্যে একটি সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চলে আসছে। তারা শোষক ও শোষিত বাঙালীদের মধ্যে কোন পার্থক্য রেখা টানে না, সকল বাঙালীকেই শত্রু মনে করে।(সিরাজ সিকদার রচনা সংগ্রহ; পৃঃ ৬০৩)
এছাড়া এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী চাকমা জাতিগোষ্ঠী অন্যান্য জাতিসত্তার প্রতি নির্যাতনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে বলে বক্তব্য দেয়া হয়। লেখা হয়েছে-
‘তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জাতিসত্তার জন্য স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতি না দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন, কখনো কখনো বিচ্ছিন্নতা দাবি করে।
এ দাবির অর্থ হচ্ছে কিছুটা ক্ষুদে বুর্জোয়া আলোকপ্রাপ্ত সংখ্যাধিক চাকমা জাতিসত্তার ক্ষমতা দখল এবং অন্যান্য জাতিসত্তার উপর তাদের কর্তৃত্ব ও নিপীড়ন।’(সূত্রঃ সিরাজ সিকদার রচনা সংগ্রহ; পৃঃ ৬০৩)
উক্ত দলিলে দেখা যায় কমিউনিস্ট পার্টি জাতি সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম উপাদান বা যা সর্বহারার পার্টির নিউক্লিয়াস পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন ঘোষনা দিয়েছে, সেই ‘বিচ্ছিন্ন হবার অধিকারসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিকে স্বায়ত্তশাসন’ প্রদানের কথা উল্লেখ নেই। তার বিপরীতে লেখা রয়েছে-
‘পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি নিপীড়িত বাঙালী-পাহাড়ীদের ঐক্যের পক্ষপাতি এবং পাহাড়ী-বাঙালীদের সমঅধিকার, পাহাড়ী জাতিসত্তাসমূহের প্রত্যেকের জন্য স্বায়ত্তশাসনের পক্ষপাতী।’(সূত্রঃ সিরাজ সিকদার রচনা সংগ্রহ)
উক্ত দলিলে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনী বা জনসংহতি সমিতি দুর্বল হচ্ছে বা জনভিত্তি হারাচ্ছে এবং সর্বহারা পার্টি শক্তিশালী হচ্ছে।
সর্বহারা পার্টি বিষয়ে জেএসএস বা শান্তিবাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গি
পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত সংগ্রামের কাল ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বলা যায়। এই সময়ের প্রথমদিকে উক্ত অঞ্চলে সর্বহারা পার্টিও সক্রিয় ছিল। তাদের মধ্যে সংঘাত সংঘর্ষ হয়েছে। এবং এ বিষয়ে উপরে উল্লিখিত দলিলে বক্তব্যও দেয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে বিস্তারিত না গিয়ে শান্তিবাহিনী বা জেএসএস সর্বহারা পার্টি বিষয়ে কী মত পোষণ করতো তা নিয়ে কিছু উল্লেখ করা প্রয়োজন। তবে এক্ষেত্রে জেএসএস আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো দলিল আকারে লেখা প্রকাশ করেনি। অন্তত এ পর্যন্ত সেরকম দলিল আমরা পাইনি। তবে বিভিন্ন প্রকাশনায় বা বইয়ে ব্যক্তিগতভাবে শান্তিবাহিনী বা জেএসএস সদস্যদের বক্তব্য আমরা পাই
সর্বহারা পার্টি বিষয়ে তাতিন্দ্রলাল চাকমা প্রকাশ মেজর পেলে জানাচ্ছেন-
“১৯৭৪ সালের এপ্রিল অথবা মে মাসের ঘটনা। স্থানটির নাম নাহক্য, গবমারা। এটা রাঙামাটি জেলার রাজস্থলী থানার একটি গ্রাম। আমার গেরিলা জীবনের প্রথম অপারেশন। ….। খবর পেলাম পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি নিয়ন্ত্রিতি একটি সশস্ত্র গেরিলা গ্রুপের অবস্থান। জানতে পারলাম পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির এই গ্রুপে সাতজন গেরিলা আছে এবং তারা সবাই অস্ত্রধারী।হালকা ভারী সব অস্ত্রই আছে তাদের কাছে।…।সর্বহারা পার্টির জোন কমান্ডার লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা রয়েছেন নেতৃত্বে।
এরা নানাভাবে আমাদের সংগ্রামে বাধা সৃষ্টি করছিল। স্বাধীনতার পর থেকেই এদেরকে মোকাবেলা করতে হচ্ছিল আমাদের। (বোল্ড করা হল)সিদ্ধান্ত হল সর্বহারার এই গ্রুপটির গোপন আস্তানায় গিয়ে আকস্মিকভাবে আক্রমণ করবো।”(সূত্রঃ শান্তিবাহিনীঃ গেরিলা জীবন, গোলাম মোর্তোজা, সময় প্রকাশন, পৃঃ৬৩)
এছাড়া আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ জেএসএস সদস্য স্নেহ কুমার চাকমা সর্বহারা পার্টি বিষয়ে না হলেও পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্যের সাথে দেখা হবার পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে উক্ত ব্যক্তির মতামত জেনে এ বিষয়ে যে মন্তব্য করেন তা এখানে বলা দরকার। তিনি লিখছেন-
পার্টি জীবনে যে কয়েকজন বাঙালী মুসলমান বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীর সহিত আমার ঘটনাক্রমে দেখা হয়েছিল তারা সকলেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ভুমি বেদখলকারী বাঙ্গালী মুসলমানদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করতেন। তাই মনে করি মুসলমান বাঙ্গালী কম্যুনিস্টরা তাদের জাতীয় স্বার্থে সম্প্রসারণ নীতিকে লালন করে কম্যুনিস্ট রাজনীতির চর্চা করেন। তাই করেন বলে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক পর্যায়ে পড়া জুম্মদের অস্তিত্ব রক্ষার কথা চিন্তা করেন না, বলেন না।’(সূত্রঃ জীবনালেখ্য, জীবন, সংগ্রাম ও সংঘাতময় দিনগুলির কথা, স্নেহ কুমার চাকমা, আগস্ট, ২০১১; পৃঃ ১৮৫)
এখানে আমি মাত্র এই দুইজনের উদ্ধৃতি যোগ করলাম। পরে আরো কোনো জেএসএস সদস্য বা জেএসএস’র সাংগঠনিক বক্তব্য প্রকাশিত হলে নিশ্চয়ই তা যোগ করার আশা থাকলো। তবে এই দুই বক্তব্যের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংগ্রাম চলাকালীন সর্বহারা পার্টি বা দেশের অন্য কমিউনিস্ট পার্টি বিষয়ে জেএসএস বা জেএসএস সদস্যদের মনোভাব প্রকাশ হয়েছে বলে মনে করা যায়।
এতে দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের সচেতন রাজনৈতিক অংশ বা যারা তৎকালীন সময়ে জনসংহতি সমিতি বা শান্তিবাহিনী গঠন করে লড়াই করে যাচ্ছিল তারা দেশের বৃহত্তর জাতি বা জাতিসত্তার প্রতিনিধিত্বকারী পার্টিকে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেনি বা বিশ্বাস করেনি।
এখানে বলা দরকার পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের থিসিসের সাধারণ কর্মনীতি অংশের দশ নম্বর ধারায় লেখা হয়েছে- ‘সকল অবাঙালী(গুরুত্বপ্রদানের জন্য বোল্ড করা হল)দেশপ্রেমিক জনগণের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বিকাশের পূর্ণ সুযোগ দেয়া হবে।’ এই ‘অবাঙালী’ শব্দবন্ধ ব্যবহারের মাধ্যমেই বোঝা যায়, সর্বহারা পার্টি আন্তর্জাতিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করার কথা বললেও আদতে ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ থেকে এই দলটি উপরে উঠতে পারেনি।
কমিউনিস্ট আন্দোলনে জাতি বা জাতিসত্তার অধিকারের প্রশ্ন
এই বিষয়বস্তু নিয়ে মার্ক্স, লেনিন, স্তালিন, মাও সেতুং থেকে শুরু করে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের অনেকেই লিখেছেন।সুতরাং আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত যাচ্ছি না।
বাংলাদেশের পাশের দেশ বার্মা বা মায়ানমার বা মিয়ানমার। এই দেশটির কমিউনিস্ট আন্দোলন বিষয়ে আমাদের সচেতন মহলে তেমন ধারনা নেই। এছাড়া এই আন্দোলন বিষয়ে এমনকি বার্মা বিষয়েও আমাদের দেশে তেমন বইপত্র পাওয়া যায় না। কিন্তু বার্মা কমিউনিস্ট পার্টি বিষয়ে সম্ভবত আমাদের দেশের কমিউনিস্ট নামে পরিচিত বিপ্লবী পার্টি-সংগঠন ও ব্যক্তির ধারনা থাকা দরকার বলে মনেকরি।
একসময় বার্মায় কমিউনিস্ট পার্টি অব বার্মা বা বিসিপি/সিপিবি খুব শক্তিশালী সংগঠন ছিল। এই সংগঠন সশস্ত্র সংগ্রামও করেছে। কিন্তু ১৮৮৯ সালের দিকে এই সংগঠন দুর্বল হয়ে যায় এবং একঅর্থে তাদের অস্তিত্ব নিভু নিভু হয়ে যায়, যদিও এখনো তা নেভেনি।
এই পার্টি একসময় সারা বার্মায় ছড়িয়ে ছিল। পরে তারা বার্মার শান রাজ্যের দিকে পশ্চাদ্ভাবন করে। সেখানে তারা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সহায়তায় বার্মার মধ্যে চীন বা হান জাতিসত্তার জনগণের মাঝে তাদের সংগঠনের ভিত সুদৃঢ় করে। কিন্তু ১৮৮৯ সালের দিকে হান জাতি বা সেখানে কোকাং নামে পরিচিত জনগণের কমিউনিস্ট যুবনেতৃত্ব পুরাতন বা বয়স্ক এবং বার্মা জাতিভুক্ত নেতৃত্বকে তাদের অঞ্চল থেকে হটিয়ে দেয়। বার্মা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ চীনে পালিয়ে যান। এই ধরনের অভ্যন্তরীণ ক্যুদেতা বা ক্ষমতা দখল কেন হলো। এ বিষয়ে তেমন জানা না না গেলেও এটা বলা যায় যে, মূলত জাতি বা জাতিসত্তার আন্দোলন বিষয়ে ভুল দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহনের জন্যই একসময়ের শক্তিশালী এই সংগঠন দুর্বল হয়ে যায়। Bertil Lintner নামে সুইডিশ লেখক The Rise and Fall of The Communist Party of Burma নামে একটি বই লেখেন। ১৯৮৬ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৮৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি বার্মা কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে অবস্থান করে নেতৃবৃন্দের সাক্ষাতকার নিয়ে উক্ত বইটি প্রকাশ করেন। উক্ত বই নিয়ে বার্মা সংশ্লিষ্ট একটি ওয়েবসাইটে যে রিভিউ করা হয় তাতে লেখক বইয়ে যে মূল্যায়ন করেন তার দুই লাইনে তুলে ধরেন। তাতে লেখা রয়েছে-
তিনি লিখেছেন, ‘উত্তরপূর্ব অঞ্চলের ঘাঁটি এলাকার জনগণের কাছে কমিউনিস্ট মতাদর্শ ফাঁপা বুলি বা ধারণা হয়ে গেল জনগণের কাছে কোনো অর্থ বহন না করায় বা বস্তুগত কিছু বোধগম্য প্রমাণিত না হওয়ায়।’(Communist ideology became a hollow concept without any real meaning to the people in the northeastern base areas,” he writes.)।
‘বার্মা কমিউনিস্ট পার্টির জন্য এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ শিক্ষা যে,দলটি বিদ্রোহের মুখে পড়েছিল কারণ তারা মতাদর্শকে উপরে স্থান দিয়েছিল এলাকার জাতিসত্তাসমূহের অধিকার প্রদানের চেয়ে।’(“It would be an important history lesson for the CPB that it faced mutiny because they had prioritized their ideology rather than ethnic rights (in the region).”)
লেখকের বক্তব্যকে হুবহু আমলে না নিয়েও এটা বলা যায়, তত্ত্ব ও প্রয়োগের মধ্যে সংযোগ সাধন করতে না পারায় এবং জাতিসত্তার জনগণকে কমিউনিস্ট মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে না পারায় এতবড় একটি পার্টি পরে তার সকল শক্তি হারিয়ে ফেলে।
এই একই কথা পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির ক্ষেত্রেও যে অসত্য তা বলা যাবে না।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে চীনে মাও সেতুঙের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি ঐতিহাসিক লংমার্চের সময় বিভিন্ন জাতি বা জাতিসত্তার জনগণ অধ্যুষিত জনগণের বিরাট বিরাট এলাকা অতিক্রম করার সময় সে সকল স্থানে অবস্থানকারী জাতি বা জাতিসত্তার জনগণের ব্যাপক প্রতিরোধ ও হামলার মুখোমুখি হয়েছিল। কিন্তু চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সে অঞ্চেলের জাতি বা জাতিসত্তার বিরুদ্ধে কোনো বিরুদ্ধ পদক্ষেপ না নিয়ে ধৈর্য ধরে পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছিল এবং পরে চীনের এই সকল জাতি বা জাতিসত্তার জনগণ চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকে সর্বতোভাবে সহায়তা করেছিল এমনকি হয়তো গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকাও তারা পালন করতে সক্ষম হয়েছিল।
কিন্তু বাংলাদেশে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি থেকে শুরু করে কমিউনিস্ট নামে পরিচিত বিভিন্ন সংগঠন পার্টি জাতি বা জাতিসত্তার অধিকার নিয়ে যেমন সঠিক অবস্থান নেয়নি তেমনি বৃহত্তর প্রেক্ষিতে নিশ্চয়িই আরো অনেক গুরুতর ভ্রান্তির মধ্যে পড়েছিল বলে আজ দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন যে মাত্রা ও গুরুত্ব নিয়ে জনগণের কাছে হাজির হবার কথা তার অনুপস্থিতি আমরা লক্ষ্য করি। এ বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ আরো হওয়া প্রয়োজন।
কৈফিয়ত: এখানে যে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে তা নিয়ে আরো অন্য দৃষ্টিভঙ্গি বা ভিন্ন বক্তব্য থাকতে পারে।এ বিষয়ে আলোচনা হলে খুশি হব।
১. ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:০৪ ০