অফিস হোক কিংবা সহশিক্ষা আজকাল যেন বিয়ের আগে ভালোবাসা হওয়াটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে! অনেকে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রেখে বিচক্ষনতার সাথে চললেও অনেকেই ভালোবাসায় জড়িয়ে যাচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েরা যে ভুল করে তাহল-কেউ টাকার পাগল হয়, কেউ বা সৌন্দর্যের পাগল হয়। ধার্মিকতা, নীতি-নৌতিকতা দিয়ে কাউকে বিচার করে না। তাছাড়া এই পছন্দটা শুধু ব্যক্তিগতভাবে নয় বরং মা-বাবারাও নিজের সন্তানের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ধন-সম্পদ, মান-মর্যাদা আর সৌন্দর্যকেই বেশি প্রাধান্য দেন। তাই দেখা যায়, অনেকে ভালোবেসে বিয়ে করে পস্তায়, আবার অনেকে মা-বাবার পছন্দে বিয়ে করেও পস্তায়। সমস্যা দুই জায়গাতেই। তাছাড়া আমরা যতই সচেতন হই না কেন, এখনো কিছু অহেতুক ঝামেলা স্বরূপ মনগড়া সামাজিকতাকে কাটিয়ে উঠতে পারি নি। যে কারণে বিয়ে কঠিন আর বিয়ে বহিঃর্ভূত সম্পর্ক সহজ হয়ে যাচ্ছে। আজকাল বিয়ে মানেই হচ্ছে পারষ্পারিক লেন-দেনের একটা চুক্তিনামা। কোন পক্ষ কত দিলো, কে রীতি-নীতির তোয়াক্কা করলো, কে এসব মানলো না, এ নিয়ে একেক জনের গাল ফুলা-ফুলি, রাগ অভিমান। জামাইকে কত লাখের শেরওয়ানী আর বউকে কত লাখের শাড়ি দিতে হবে- এসব হচ্ছে আমাদের বিয়ের স্টাইল। মেয়ে খালি হাতে আসলো, না কি যৌতুক নিয়ে ভরা হাতে গেলো এসবই দেখে আমাদের সমাজ। ছেলে পক্ষ, মেয়ে পক্ষ কেউই সচেতন নয়। বলা হয়-মেয়ে খালি হাতে গেলে শাশুড়ির নাকি কথা শুনতে হবে। আর যৌতুক নিয়ে গেলে শাশুড়ির বলার কোনো জায়গা থাকবে না। আমার প্রশ্ন হলো- আমাদের চিন্তা-ভাবনা এত নীচ কেনো? একটা মেয়ে নিজের সব কিছু ছেড়ে অন্যের বাসায় এসে, এক অচেনা পরিবেশে তাকে খাপ খাইয়ে নিতে হচ্ছে, সম্পর্ক ঠিক রাখতে হচ্ছে, অন্যের মন জুরিয়ে থাকতে হচ্ছে- এটাই কি বেশি না? শাশুড়ি কথা শুনাবেন কোন যুক্তিতে? অপরদিকে, একটা ছেলে যখন বিয়ে করছে তখন এটা তার দায়িত্ব যে, বাসায় যদি বাড়তি কিছু লাগে তাহলে সেটার ব্যবস্থা করা। তাছাড়া একটা ছেলে আগে পরিবারের যত জনকে নিয়ে চলতো এখন তাকে আরেক জনের ভরণ-পোষন করতে হবে। তার উপরও একটি বাড়তি চাপ। ছেলে যে এত কষ্ট করে ব্যবস্থা করছে সেজন্য বউকে অবশ্যই কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। অথচ আমাদের সমাজ চলছে উল্টা নিয়মে। আর এসবের জন্য দায়ী আমাদের অনৈতিক আচরণ ও চিন্তা-ভাবনা। তাই বিয়ের আগে সঙ্গী নির্বাচনের সবচেয়ে ভালো ও সহজ উপায় হলো- যা রাসূল সাঃ বলেছেন- “সঙ্গী নির্বাচনের সময় চারটি দিক বিবেচনা করা হয়, ধন-সম্পদ, বংশ-মর্যাদা, সৌন্দর্য, আর দ্বীনদারী। তবে সবচেয়ে শেষ দিকটা বিবেচনা করাই সর্বোত্তম”- (বুখারী)।
অপদিকে আমরা দেখি, অনেকেই নিজের ভালোবাসার মানুষকে না পেয়ে আত্মহত্যা করে। দেখা গেছে মা-বাবা রাজি হয় নি বলে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। প্রথমেই বলবো, এক্ষেত্রে ছেলে বা মেয়ে দুটোই নির্বোধের মত কাজ করে। তারা দুনিয়ার স্বার্থকে বড় করে দেখে, নিজেকে নিজের জীবনের মালিক মনে করে ভুল পথে পা বাড়িয়েছে। বেচে থাকলে হয়তবা ভবিষ্যতে তাদের ভালো কোনো পরিণতি হত। কিন্তু এভাবে মৃত্যু বরণ করে নেয়ার পরিণতি কি হতে পারে, তা তারা কল্পনাও করে নি। আত্মহত্যা সম্পর্কে রাসুল সাঃ বলেছেন-“এক ব্যক্তি আহত হয়েছিল। সে আত্মহত্যা করলে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, আমার বান্দা বড় তাড়াহুড়া করলো। সে নিজেই নিজেকে হত্যা করলো। আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম”। (বুখারী) অপরদিকে ছেলে-মেয়ের মা-বাবা যখন নিজেদের অপছন্দ স্বত্ত্বেও সন্তানদের ফিরাতে পারেননি তখন সন্তানকে তার ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেয়াই উচিত মনে করি।
নিঃসন্দেহে বিয়ের পরে ভালোবাসাটা উত্তম। এতে নিজের দ্বারা পাপকর্ম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তবে অনেক পরিবারে দেখা যায়-ছেলে-মেয়েদের ভালোবেসে বিয়ে করাটা সমর্থন করেন না। তাদের মতে, ভালোবাসাই অন্যায়। আর সেক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েরা শত বুঝালেও তারা কোনো কথাই শুনতে চান না। তারা যাচাই-বাছাই করে দেখতেও চায় না। তাই বিপদে পরে দুটি জীবন। সংঘটিত হয় অপরাধ। তাই এক্ষেত্রে মা-বাবাদের উদ্দেশ্যে বলতে হয়- ছেলে-মেয়েরা যখন তাদের ভালোবাসার প্রকাশ করবে, তখন বুঝে নেবেন সন্তানেরা আপনাদের ভালোবাসে বলেই আপনাদের মতামতকে সম্মান করে আপনাদের ইচ্ছায় বিয়ে করতে চাচ্ছে। তাই তাদের ভালবাসাকে প্রথমে ভালো চোখে দেখুন। সমাজের কে কি বলবে সেটা পড়ে ভাবুন। আগে ভাবুন আপনি সঠিক করতে যাচ্ছেন কিনা। এরপর আপনার সন্তানের ভালোবাসার মানুষকে যাচাই-বাছাই করুন। যেহেতু আপনার সন্তানটি একটা সিদ্ধান্তে পৌছাতে আপনার কাছে এসেছে, তাই তাকে একটা সঠিক সিদ্ধান্ত দিন। যদি আপনার কাছে পছন্দ না হয় তবে স্পষ্টতই বুঝিয়ে বলুন। এরপরও যদি সন্তান আপনার বিরোধীতা করে তবে তাকে তার ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিন। উত্তেজিত হয়ে ত্যাজ্য করবেন না।
অপরদিকে সন্তানের উচিত- যে মা-বাবা তাকে অসহায় অবস্থা থেকে সীমাহীন কষ্টে (যা সে কখনো শোধ করতে পারবে না) বড় করেছেন তার সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা করা। কেননা, তাদের সন্তুষ্টিতেই সন্তানদের ইহকাল ও পরকালের শান্তি। তাই তাদের বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে নিজের সিদ্ধান্তটি সঠিক কিনা তা ভেবে দেখুন। কেননা, বিয়ের পরে সন্তানের সুখী জীবন দেখে মা-বাবাদের মন গলতেও পারে। আর বিয়ের পর দুঃখী হলে তখন কিন্তু মা-বাবাকে আর কাছে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না, বরঞ্চ তখন সমাজের বিভিন্ন লোকের বিভিন্ন ভঙ্গির কথা হজম করতে হবে। এমনও অনেক পরিবারে দেখা যায়, সন্তান ধার্মিক কিন্তু মা-বাবা আধুনিক মনা। তাই মা-বাবা সন্তানের জন্য তেমনই তথাকথিত আধুনিক পাত্র/পাত্রী পছন্দ করেন। সেক্ষেত্রে ধর্মে দেয়া স্বাধীনতার ভিত্তিতে সন্তানের কর্তব্য, নিজের মতামতটি মা-বাবাকে জানানো। তাছাড়া অবিবাহিতরাও নিজের জীবনের জন্য দোয়া করতে পারেন এভাবে যা আল্লাহ তা’য়ালা শিখিয়েছেন- “হে আমাদের রব, আমাদেরকে আমাদের স্ত্রীদের ও আমাদের সন্তানদের দ্বারা চক্ষু সমূহকে শীতলতা দাও” (সূরা- আল ফুরকা’ন, ৭৪)।
বিয়ের আগে কাউকে ভালোলাগলেও সম্পর্ক গড়া সম্পূর্ণ অনৈতিক ও গর্হিত কাজ। সহজ কথায় এটা সমাজে নিরব অপরাধ ছড়ানোর একটা মাধ্যম। অনেককেই দেখি ভালোবাসলেও সেটাকে ‘বিয়ে’ নামক বৈধ সার্টিফিকেট দিতে চান না। তারা বিয়েকে ঝামেলা মনে করেন। কেউ কারো জীবনের দায়িত্ব নিতে অনাগ্রহী। হ্যা, যেমনটি আগে বলেছি, আমরা বিয়েকে রীতি-নীতির কারাগারে আটকে রেখে ইট-টুগেদার, ট্যুর টুগেদার, লিভ-টুগেদার সব কিছুকে সহজ করছি। সমাজ কি বলবে, পাছে লোকের কথা ভেবে অনিচ্ছায় পকেট খালি করে বিয়ের আসল উদ্দেশ্য ভুলে লেন-দেনের হিসাব করছি। তবে এই কঠিনত্বকে দূর করার দায়িত্বও কিন্তু আমাদের। আমরা যদি হার মেনে কুপ্রথার প্রচলন রেখে গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করি তাহলে কিন্তু কঠিনতর বিপদ ও দুঃশ্চিন্তার স্বীকার হবো এই আমরাই। বিয়ে মানুষকে নিজের পাশাপাশি অন্যের ব্যাপারে যতœশীল হওয়ার শিক্ষা দেয়, নৈতিকতা গঠন করে। কিন্তু যাদের, সম্পর্ক রাখবে অথচ বিয়ে করতে যত অনীহা, সংকোচ- তারা মূলত সুখের পাখি, জীবন সঙ্গী নয়। তারা অন্যের অধিকার হরণ করতে ও সুযোগ বুঝে পালিয়ে যাওয়ার পক্ষে।
ক্যাম্পাসে অনেককেই দেখা যায়, লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করে বেড়ায় অথচ বিয়ের কথা জিজ্ঞাস করলেই, পড়াশুনা শেষ হওয়ার কথা বলে, আর্থিক সমস্যা দেখায় অথবা মা-বাবা রাজি না হওয়ার কথা বলে। এগুলো সবই হচ্ছে খোড়া যুক্তি। ইচ্ছা থাকিলে উপায় হয়। বিয়ে করতে(কাবিন) বেশি টাকা লাগে না। টাকা লাগে আনুষ্ঠানিকতা করতে। এবার তাহলে প্রশ্ন জাগে- নিজের পবিত্র ভালবাসাকে গোপনে আলাপ করে, ভয়ের চোটে খারাপ নিয়তে ক্যাম্পাসের কোণায়, দেয়ালের চিপায়, রাস্তার ফুটপাতে বসা ভালো, নাকি কাবিন করে বুকে সাহস নিয়ে সবার সামনে দুই জন ঘুরাঘুরি করা ভালো? প্রশ্নটা দেশের সকল সচেতন মানুষের কাছে।
পরিশেষে, বর্তমানে কিছু ছেলে-মেয়েদের দেখা যায়, সোস্যাল নেটওয়ার্কিং (ফেসবুক, টুইটার, গুগল+ ইত্যাদি), চ্যাটিং, বোনাস পেয়ে অচেনা নাম্বারে কথা বলে পাত্র/পাত্রী নির্বাচন করেন। যদিও অচেনা/অদেখা মানুষের সাথে অহেতুক আলাপ করে, প্রযুক্তির অপব্যবহার করে সম্পর্ক গড়ে তোলা একটা অনৈতিক কাজ। শুধু তাই নয়, এক্ষেত্রে ধোকা খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া প্রেম করে ঘন্টার পর ঘন্টা মোবাইলে কথা বলার পাশাপাশি আজকাল দেখা যায়, বিয়ের কথা মাত্র ঠিক হয়েছে, এখনো তাদের বিয়ে হয় নি, অথচ ফোনে আলাপ, হাসি ঠাট্টা শুরু হয়ে যায়। অবাক হতে হয়, তারা একটিবারও ভেবে দেখে না আজ যার সাথে কথা বলছি সে যদি আমার ভাগ্যে না থাকে তাহলে পরে গিয়ে নিজের উপর দিয়ে কি তুফান বয়ে যাবে! ভবিষ্যতের সেই চিন্তা আজ মানুষের নেই। ধৈর্য নেই। বিচক্ষণতা নেই। এসব হয় একটা কারণেই তা হলো মনে আল্লাহ'র ভয় না থাকা আর নিজেকে পরোক্ষভাবে নিজের ভবিষ্যতের মালিক মনে করা। আমরা যদি নিজেরাই নিজেদের ব্যাপারে সচেতন না হই, তাহলে এর দায় নিজেকেই বহন করতে হবে। না জানি এই বোঝা আমাদের জীবনের জন্য কত ভারী হয়!