রানী কুঠির বাকি ইতিহাস সিনেমাটা যেখানে শুটিং হয়েছিল সেই বিখ্যাত যায়গাটা যে আমার আশেপাশেই এত দিন জানা ছিল না। সেদিন এক কলিগ বলছিলেন, ধনবাড়িতে নাকি বিখ্যাত একটা জমিদার বাড়ি আছে? আমি বললাম, আছে একটা নওয়াব বাড়ি। তবে সেটা বিখ্যাত কিনা জানি না।
বললেন, চলেন যাই। বিখ্যাত কিনা দেখে আসি।
আমি বললাম, চলেন
দরবার হল
এই নওয়াব বাড়ির কথা অনেক শুনেছি। বাইরে থেকে দেখেছিও। কিন্তু বিশাল এক এলাকা জুড়ে গাছগাছালিতে প্রায় ঢেকে যাওয়া সেই উচু প্রাচীর ঘেরা নওয়াব বাড়ির ভেতরটা কখনও দেখার সুযোগ হয়নি। এটার সম্পর্কে জানারও সুযোগ হয়নি।
দুজনে সেই নওয়াব বাড়ি দেখতে গেলাম।
টাংগাইল জেলার ধনবাড়ি থানার নওয়াব বাড়ির রয়েছে একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস। সংক্ষেপে হল, মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ধনপতি সিংহকে পরাজিত করে মোগল সেনাপতি ইস্পিঞ্জর খাঁ ও মনোয়ার খাঁ ধনবাড়ীতে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের কয়েক পুরুষ পরের নবাব ছিলেন সৈয়দ জনাব আলী। সৈয়দ জনাব আলীর পুত্র ছিলেন খান বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী(১৮৬৩-১৯২৯)। সৈয়দ জনাব আলী চৌধুরী কম বয়সে মারা যান।
খান বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী
খান বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ছিলেন ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার প্রথম প্রস্তাবক এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রথম মুসলিম মন্ত্রী। তাঁরই অমর কৃর্তি ধনবাড়ী জমিদারবাড়ি বা নওয়াব প্যালেস।
ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ এবং ধনবাড়ির নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চোধুরী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি(নওয়াব আলী চৌধুরী মাঝে, বসে।)
নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বিয়ে করেন বগুড়ার নবাব আবদুস সোবহানের মেয়ে আলতাফুন্নাহারকে। আলতাফুন্নাহার ছিলেন নিঃসন্তান। তাঁর মৃত্যুর পর নবাব বিয়ে করেন ঈশা খাঁর শেষ বংশধর সৈয়দা আখতার খাতুনকে। নওয়াব আলী চৌধুরীর তৃতীয় স্ত্রীর নাম ছিল সকিনা খাতুন। নওয়াব আলী চৌধুরী ১৯২৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। নবাব ওয়াকফ নামায় তাঁর তৃতীয় স্ত্রীর একমাত্র ছেলে সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী এবং মেয়ে উম্মে ফাতেমা হুমায়রা খাতুনের নাম উল্লেখ করে যান।
সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী
সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী পরবর্তীকালে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পমন্ত্রী নির্বাচিত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৮ সালেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৮১ সালে মৃত্যুবরণ করেন। এই জমিদারবাড়ির বর্তমান উত্তরাধিকারী তাঁর একমাত্র সন্তান সৈয়দা আশিকা আকবর।
বৈঠকখানা
বংশাই ও বৈরান নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত এই প্রাচীন জমিদারবাড়িটি অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী এবং কারুকার্যে সত্যিই মনোরম এবং মনোমুগ্ধকর। তবে রিসোর্ট তৈরির পর নবাব প্যালেসে বেড়েছে চাকচিক্য এবং আধুনিকতা। চার গম্বুজবিশিষ্ট অপূর্ব মোগল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এই শতাব্দীপ্রাচীন নবাব প্যালেস। পুরো নবাব মঞ্জিল বা নবাব প্যালেসটি প্রাচীরে ঘেরা। প্রাসাদটি দক্ষিণমুখী এবং দীর্ঘ বারান্দাসংবলিত। ভবনের পূর্বদিকে বড় একটি তোরণ রয়েছে। তোরণের দুই পাশে প্রহরীদের জন্য রয়েছে দুটি কক্ষ। তোরণটি জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী ব্রিটিশ গভর্নরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য নির্মাণ করেন। প্রাচীরঘেরা চত্বর অংশে আবাসিক ভবন দুটি ছাড়া আরো আছে ফুলের বাগান, চিড়িয়াখানা, বৈঠকখানা, নায়েবঘর, কাচারিঘর, পাইকপেয়াদা বসতি এবং দাস-দাসি চত্বর। প্যালেসটির পাশেই রয়েছে ৩০ বিঘার বিশালাকার একটি দিঘি।
মসজিদ
কচুরিপানায় ঢেকে যাওয়া দিঘী
রিসোর্টটির আরেকটি বিরাট আকর্ষণ নবাব মসজিদ। রয়েল রিসোর্টের ঠিক পাশেই রয়েছে ৭০০ বছরের পুরোনো এক মসজিদ। মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন এই মসজিদের মোজাইকগুলো এবং মেঝেতে মার্বেল পাথরে নিপুণ কারুকার্য অসাধারণ। মসজিদটির পাশে একটি কক্ষ রয়েছে, যা নবাব বাহাদুর সৈদয় নওয়াব আলী চৌধুরীর মাজার। ১৯২৯ সালে নবাবের মৃত্যুর পর থেকে এখানে ২৪ ঘণ্টা কোরআন তিলাওয়াত হচ্ছে, যা এখনো এক মিনিটের জন্য বন্ধ হয়নি। বর্তমানে সাতজন কারি নিযুক্ত রয়েছেন। তাঁরা প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর একেকজন কোরআন তিলাওয়াত করে থাকেন।
মোগল স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত মসজিদটির আকার-অবয়বে বেশ কয়েকবার পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। সুন্দর কারুকার্যময় এ মসজিদের পূর্বদিকে বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলানযুক্ত তিনটি প্রবেশপথ। এ ছাড়া উত্তর ও দক্ষিণে আরো একটি করে সর্বমোট পাঁচটি প্রবেশপথ রয়েছে। মসজিদটি বর্ধিতকরণ ও সংস্কার সাধনের পরেও এর ওপরের তিনটি গম্বুজ ও পাঁচটি প্রবেশপথে প্রাচীনত্বের ছাপ লক্ষ করা যায়।
রানী কুঠির বাকি ইতিহাস সিনেমাটি এই নবাব প্যালেসেই শুটিং হয়েছিল।
দরবার হলের সামনে আমি
সময় স্বল্পতার কারনে পুরো নবাব প্যালেসটা ঘুরে দেখতে পারিনি। ইচ্ছে আছে আর একবার সময় নিয়ে দেখতে যাওয়ার।
তথ্যঃ ইন্টারনেট।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৫৮