জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বজরায় বসে আছেন লালন সাঁই , একথা সেকথার ফাঁকে ফাঁকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সাঁইজি’র স্কেচ আঁকছেন । জমিদার-নন্দন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সাঁইজি’র গান , সাধন-ভজন সম্পর্কে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছেন আর সাঁইজি তাঁর মতো করে তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন ।কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর আর লালন সাঁইয়ের এই আলোচনা যে নেহায়েতই বাঙালির চিরাচরিত অভ্যেসসমেত আড্ডা সেরকমটা নয় ; লালন সাঁই এখানে তাঁর দিক দিয়ে এসেছেন তাঁর-ই স্বার্থে , তাঁর আখড়ার জমির খাজনা মওকুফ করাতে । আর সেই কাজে এসেই এরকম দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে । এরকমটাই দৃশ্যত … তারপর ছোট-বড় ফ্ল্যাশব্যাকে এই সিনেমা গতি সঞ্চারমাণ করতে থাকে ।
‘লালন কালিগঙ্গার সন্তান , এই কালিগঙ্গায় ভাসতে ভাসতে একদিন ছেউড়িয়ায় এসেছিলেন লালন সাঁই’
অন্ততপক্ষে লালন সাঁইয়ের শিষ্যরা তাই জানেন আর জানে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াবাসি । লালন সাঁই জীবিত থাকতেও তার শিষ্যরা নানাভাবে তাঁর পরিচয় জানতে চেয়েছেন , লালন তাঁদের কাছে তাঁর পরিচয় কখনোই প্রকাশ করে যান নি , লালন সাঁইয়ের শিষ্যদের যারা এখনো আছেন বা প্রশিষ্যরা আছেন তাঁদের কথায় তা-ই প্রতিভাত হয় । সিনেমায় আমরা দেখি নিম্নবিত্ত ‘হিন্দু-কায়স্থ’ (!) ঘরের সন্তান যুবক লালন চন্দ্র কর (!!! ) একজন স্বভাবশিল্পী , যে কীনা যখন তখন গান বাঁধে , সুর করে , গায় এবং তাঁর কাজের প্রতি খুব একটা মনোযোগ আছে বলে মনে হয় না । বিবাহিত আর একমাত্র বিধবা মা । দিন যায় ...হঠাৎ কোনো একদিন সিরাজ সাঁইয়ের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়ে যায় , সিরাজ সাঁই তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হোন । কিন্তু এভাবে তো আর দিন চলে না , নিম্নবিত্ত পরিবারের একজন প্রধান পুরুষের তাই জমিদার বাবুর ঘোড়ার সহিস হয়ে তাঁকে তাঁর সাথে তীর্থে যেতে হয় এবং বলা বাহুল্য যে, সেখানে লালন সাঁই বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে কলাগাছের ভেলায় ভাসতে ভাসতে ছেউড়িয়ায় ভিড়েন এবং এক মুসলমান তাঁতি-বৌ রাবেয়া (!) তাঁকে ভেলায় ভাসতে দেখে ঘরে তুলে নেন এবং আপন সেবা-শুশ্রূষা-মমতায় তাকে ভালো করে তুলেন । আমরা লালন সাঁইয়ের শিষ্যদের বা লালন অনুকারদের কাছ থেকে জানি যে সেই মহীয়সী নারীর নাম মতিজান , অথচ সিনেমায় সেই মহিলার নাম নাম রাবেয়া ! তো ... এমন পরিস্থিতে লালন মুসলমান ঘরের ভাত খেয়ে ‘অন্নপাপ’র দায় নিয়ে জাতহীন হয়ে গুরু সিরাজ সাঁই’র কাছে দীক্ষা নিতে থাকেন । ছেউড়িয়ার জঙ্গলে লোকালয় ছেড়ে ঘরে তুলেন তাঁর আনন্দধাম (!)
তার পরের দৃশ্যগুলোতে সেই ‘রঙের বাজারে’র মজা নিতে থাকেন দর্শক । সেখানে শুধু কাম আর কাম ! কামবিহীন লালন সাঁই সে কী কখনো দর্শক চিন্তা করতে পারেন , নাকি ভুলেও সে কথা ভাবেন না তাঁরা ? সেই ‘কাম-বাজারে’ লালন-শিষ্যরা সবাই সওদা কিনতে চায় আর লালন সাঁই যেনো সেই দোকানের মহাজন ! কমলি যেনো সেই দোকানের কিশোরগঞ্জের ‘গয়ানাথের বালিশ’ টাইপ মিষ্টান্ন ! যে সারাক্ষণ মহাজনকে রসে ভাসিয়ে দিতে চায় , তেমনি করে তাঁর ভাব-শিষ্যদেরও । এই আনন্দধামের প্রধান মজমা হলো যৌনগন্ধি ‘গয়ানাথের বালিশ’ টাইপ ‘ধ্বজভঙ্গ-যৌন অতৃপ্তি’র এক নিরাবেগ বয়ান । আমরা যথা সময়ে সেসব প্রসঙ্গে যাবো ...
তো, এই আনন্দযজ্ঞে প্রায় চব্বিশ ঘন্টাই সবাই মত্ত থাকে একতারা-দোতারা হাতে সঙ্গীত নিয়ে । যেখানে দিন নাই , রাত নাই শুধু নাচা-গানাই যেনো লালন আখড়ার প্রধান অনুষঙ্গ । অনেকটা রবিবাবুর ভাষায় ...
আনন্দধারা বহিছে ভুবনে ...!
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ সিনেমায় যতোগুলো কারণে-অকারণে গানের মজমা বসানো হয়েছে তা দেখলে দর্শকের মনে হতে থাকবে এখানে পিকনিক হচ্ছে না তো ! দিনের আলোকে ছাপিয়ে রাতের লালন-আখড়া আরো মনোহর , আরো চিত্তাকর্ষক । মোদ্দাকথা আরো যৌনগন্ধি রসাসিক্ত গয়ানাথের বালিশসমেত ! বাঙালির যৌনজীবনে লালন-আখড়া যে সিনেমায় এতোটা ধ্বজভঙ্গধারী হিসেবে চিত্রিত হয়ে উঠবেন সাঁইজি কী আগেই টের পেয়েছিলেন ? টের পেয়ে থাকবেন বোধ করি , না হলে গানে এমনটা বলবেন কেনো ...
‘ বলবো কি সেই প্রেমের বাণী
কামে থেকে হয় নিষ্কামী
সে যে শুদ্ধ সহজ রস
করিয়ে বিশ্বাস
দোঁহার মন দোঁহার ভাবে ।‘
লালন ভাব-দর্শনে এই গানের অন্য মাজেজা থাকতে পারে কিন্তু সিনেমার কমলি আর লালনের মাঝে যে সিনেপাতিক লেপ্টালেপ্টি দেখা যায় তাতে অন্য মাজেজা থাকতে হবে কেনো ? আর সেটা আমরা আশা করবোই বা কেনো ... !?
নাহ এইবার এই সিনেমার এই একপেশে বর্ণনা থেকে দর্শক-ব্লগীয় পাঠককে অন্যদিকে নিয়া যাই ... তো সেই জনমানবহীন ঘন-জঙ্গলে রঙ-বেরঙের হাবলঙ্গের যে বাজার লালন বসিয়েছেন তাতে দেখা যায় এই বাউল সম্প্রদায় খালি নাচা-গানা-ই করে না , মাঝে মাঝে খেয়ালের বসে কলকাতার বাবুদের মতো ধুতি কৌপীন পড়ে খেয়ালহেতু মোল্লা-পুরুতদের সাথে বাহাসেও বসে । গোটা ছবিতেই দেখা যায় গানের ফাঁকে ফাঁকে লালন ও তাঁর অনুসারীরা মোল্লা-পুরুতদের সাথে বিতর্ক-বাহাসে মত্ত আর জমিদারদের সাথে তাঁর বেশ সখ্যতা । লালন অনুকার আর জীবনীকারদের যে প্রামাণিক বই-পত্তর তাতে যে সাঁইজি’র সংগ্রাম-প্রতিরোধ এই সিনেভাষ্যে তা উদাও ! এখানে লালন জমিদারদের অনুগত-পোষ্য ; এখানে উল্লেখ করতে হয় যে মোল্লা-পুরুতদের সাথে সাঁইজি’র বাহাসের এক পর্যায়ে উভয়পক্ষের মাঝে তুমুল মারামারি-কাটাকাটি লেগে যায় আর সেই রক্তক্ষয়ী টানটান উত্তেজনায় রণেভঙ্গ দেয় জমিদার বাহিনীর লাঠিয়ালেরা এবং তা লালনের পক্ষালম্বন করে , আর অবাক করা বিষয় যে জমিদার মহাশয় হাস্যচিত্তে লালনের ছেউড়িয়ার আখড়াকে খাজনাবিহীন করে যে নজির এই সিনেমায় স্থাপন করেন তা বাস্তবে লালনের ছেউড়িয়ার আখড়ায় না হলেও সিনে-আখ্যানে যে সম্ভবপর হয়েছে তা-ইবা কম কীসে !
সিনেমার যে বর্ণনামূলক আখ্যান তাতে আমরা দেখি যে ,’...পারবে অমাবশ্যায় পূণির্মা জাগাতে?’ লালনকে জড়িয়ে ধরে একজন কামুকি নারীর এই যৌনগন্ধি হাহাকারে যখন দর্শক-পাঠকের ইন্দ্রিয় সচেতন তখন সেটা ধরা পড়ে যে, এই নারীকে লালন সাঁইয়ের গুরু সিরাজ সাঁই পাঠিয়ে দিয়েছেন তাঁর অস্থির চিত্তকে (আরও অস্থির করে তুলতে নাকি শান্ত করতে , কোনটা !?) শান্ত করতে । অশান্তি না প্রশান্তি এনেছিলো কমলি সে বিচার আপনাদের উপর ছেড়ে দিলাম ...
আর সেই গ্ল্যামারাস কামুকি নারীই হবে সাঁইজি’র সাধন সঙ্গিনী !
সিরাজ সাঁই’র আখড়া ছেড়ে আমরা এবার চোখ ফেরাই লালন সাঁইয়ের আখড়ায় ... এইখানে যে কামকলা রণেভঙ্গ হয়েছে তা ভাববার কোনো অবকাশ নাই ...কামকেলি যারে আছর করেছে তারে কী এতো সহজে ছাড়ে ? নেহায়েত ভাদ্রমাস বিদায় না হওয়া পর্যন্ত ... ! জ্বি হ্যাঁ , এইখানে পূর্ণিমা রাত্তির সমাগত চকচকা ক্যামেরার লেন্স এসে ভর করেছে সোজা লালনের পুরো দেহে ... ‘আমার জ্বালা মিটিয়ে দেও গো সাঁই!’ এই কথা বলার পর কলমির হাত সোজা নীচের দিকে নামতে থাকে ; লালনের চোখ-মুখ কঠিন থেকে কঠিনতর থাকে । শুধু কী হাত ? সমানতালে কলমির মুখ-চোখ-ঠোঁট লালনের অতীন্দ্রিয়তা স্পর্শ করে তাকে কামরাজ্যে নিয়ে যেতে তৎপর ...গয়ানাথের বালিশ যা কীনা রসে টইটম্বুর , কামাসক্ত কমলি সেই সময় আচমকা বলে উঠে ...’ এইতো তোমার শরীর জেগে উঠেছে। আমাকে শান্ত করো সাঁই। তুমি দেখছি ভাবের ঘরে চুরি করো সাঁই ।‘
লালন তখন আচমকা (!) বেরসিকের মতো বলে উঠেন ...’ শরীর জাগে শরীরের নিয়মে, মন যদি না জাগে?’ দর্শক-পাঠকের মনে তখন পড়তে পারে লালন সাঁই বোধহয় ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ রপ্ত করেছিলেন !
কালুয়া ঘরের কাজ করতেছে , আজ ক’দিন ধরেই তার মন-মানসিকতার বালাই নাই (এ নিশ্চিত ফ্রয়েড জানে না!লালনের দোস্ত হয়েও নামটা পর্যন্ত জানে নি !) ... ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ কলমি গান গায়, মোক্ষম সময়ে মোক্ষম গান বটে । সাঁইজি’র নির্দেশেই সে কালুয়াকে এই ভরা মধ্যাহ্নেই শান্ত করতে চায় । এককালে এই কালুয়াই তাকে উপেক্ষা করেছিলো আজ এই সুযোগে সে তার পুরনো হিসেব চুকাতে চায় কী !? দর্শক-পাঠক তখন হয়তো একটু নড়েচড়ে বসেন বৈকি , কেননা এই কলমি’র একজন সামাজিকভাবে সাধন-সঙ্গী আছে , সে যদিও শারীরিক-মানসিকভাবে নিস্ক্রিয় ; এই সুযোগে সে লালন-কালুয়াকে ‘সেবা’ করে !
‘এবার ফিরাও মোরে...’
যথেষ্ট হয়েছে লালনের নামে বদনাম করা ! এইবার আসি এই সিনেমার ঐতিহাসিকতা নিয়ে । হ্যাঁ লালন সাঁই বাঙলা-বাঙালির জীবনে যে জাতপাতের বিভেদভঞ্জনকারী সে তাঁর বিরোধীরাও স্বীকার করে নেন । কিন্তু লালন সাঁইয়ের মতো একজন ঐতিহাসিক ব্যাক্তিত্বকে নিয়ে সিনেমা বানানোর আগে তাঁর সম্পর্কিত যে পঠন-পাঠন দরকার তা কী এই সিনেমার ক্ষেত্রে হয়েছিলো !? যথেষ্ট শ্রদ্ধা নিয়াই বলতেছি শ্রীমান গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’ আখ্যান-চিত্রে লালন সাঁইকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তা বিকৃত-খণ্ডিত-অর্ধ সত্যকারে । উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ আর ঐতিহাসিক মিথ্যাচার দেখে ভাবি একজন সিনেমেকার সিনেমায় কতোটুকু মিথ্যে দিয়ে সত্যকে প্রকাশ করতে পারেন ? কিংবা সেই সত্যের কাছাকাছি যেতে কীরকম মিথ্যেচার লাগে !?
‘শিল্প হলো একটি মিথ্যা যা সত্যকে বুঝতে সাহায্য করে’
পাবলো পিকাসো’র এই কথার রেশ টেনেই বলা যায় শ্রীমান গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষে’ শিল্পের খাতিরে যে ধরণের মিথ্যের স্বাধীনতা নিয়ে আসতে হয় এই আখ্যানে তার কোনো রেশই নাই ! শিল্পের দায় আছে , শিল্পীরও আছে তেমনি তার স্বাধীন পথচলার অধিকার আছে কিন্তু একজন স্বাধীনধারার পরিচালক সেই সুযোগে একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে নিয়া যে ‘জাতহীনের জাত মারার’ তরিকা দেখান তা ভয়াবহ উদ্বেগের-শঙ্কার ।
ঐতিহাসিক চরিত্র আমদানি করে সিনেমা সারা বিশ্বেই হচ্ছে এটা নতুন নয় কিন্তু সেই চরিত্রকে খণ্ডিত-বিকৃত-অর্ধসত্যকারে উপস্থাপন করা কতোটুকু বিবেকের আর কতোটুকু স্রেফ কর্পোরেট দালালির ধান্দা থাকলে করা যায় তা এই সিনেমা না দেখলে পাঠক-দর্শক বুঝবেন না ! কমলি, ময়ূরী ,কালু এইসব চরিত্রের প্রামাণিক-দালিলিক ঐতিহাসিকতা নাই ! লালনের সাধন-সঙ্গী বিশাখা এই চিত্র-আখ্যানে অনুপস্থিত । ক্যানো ...? এইসব হাজারো প্রশ্ন-জিজ্ঞাসা যখন দর্শক-পাঠকের মনে তখন শ্রীমান গৌতম ঘোষ হয়তো আরেক্কান সিনেমার স্ক্রিপ্ট নিয়া বসে গ্যাছেন । ঘরে হয়তোবা ‘মনের মানুষ’ অধিকৃত ‘কান’ , ‘পুসানে’র ‘স্বর্ণ-ভল্লুক’ শোভা পাচ্ছে ! আর শ্রীমান ঘোষ হয়তো সেই আত্মপ্রসাদে দিন গুজরান করছেন আর কীইবা চাই একজন বাঘা ‘সিনে-ব্রাহ্মণের’ আর চাওয়ার কীইবা থাকতে পারে !?
জাত্যভিমানি ‘জাতহীনের’ জাত মেরে হয়তো নিজের জাত জানান দ্যান কিন্তু একজন লালন সাঁই-সিরাজ সাঁই তখন স্বদেশি জাতভাইয়ের ‘জাতহীনের জাতমারার তরিকা’ দ্যাখে হয়তো মুঢ়-বধির চোখে ছেউড়িয়া-কুষ্টিয়াবাসীর দিকে দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে থাকেন । হয়তোবা কন্ঠে তুলেন ...
‘জাত গেলো জাত গেলো বলে একী আজব কারখানা...!’