''বাবার দেশের মাটি ,
দাবদাবায়া হাঁটি !''
এই আত্মপ্রসাদ নিয়ে এখনো বাবার দেশেই আছেন উকিল শশীকান্ত সেনগুপ্ত । কিন্তু ততোদিনে বাংলা হয়েছে দ্বি-খণ্ডিত । ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হল । কেউই জানলো না ,বুঝলো না কি থেকে কী হয়ে গেল ! দুই নেতা বৈঠক করে দেশটাকে ভাগাভাগি করে নিলেন । একটা হল পাকিস্তানের অংশ আরেকটা ভারতের । এই পূর্ব-পাকিস্তানের অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের চিত্রা পারের নড়াইলের বাসিন্দা শশীকান্ত সেনগুপ্ত । ১৯৪৭ এর দেশভাগের ফলে শশীকান্তের গ্রামের অধিকাংশ হিন্দুরা ভয়ে আতঙ্কে দেশ ছেড়ে পালাতে লাগলো । শশীকান্ত অনড় । তাঁর এককথা
... এই চিত্রা নদী ছেড়ে স্বর্গেও সুখ নাই !
১৯৬৪ ! সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা । যাও মুষ্টিমেয় হাতেগোনা ক'ঘর হিন্দু ছিল তারাও প্রাণভয়ে রাতের আঁধারে দেশ ছেড়ে চলে যেতে লাগলেন । শশীকান্ত পালাবে ক্যান ! চিত্রা ছেড়ে যে স্বর্গেও সুখ নাই । এদিকে শশীকান্তের মেয়ে মিনতিও এখন কলেজে পড়ছে । সব মিলিয়ে খুবই অরাজক পরিস্তিতি । প্রেম কি আচার ধর্মের বাধ্য-বাধকতা মেনে চলে , নাকি মেনে চলেছে কখনো !? বাদল আর মিনতির বেলায় তা মানবে কেন ? দাঙ্গায় দেশ রক্তের প্লাবন বয়ে গেলেও বাদল-মিনতির হৃদয়ে তখনো প্রেমের ঢেউ । তবে বাঙালি নারীর ট্র্যাজেডি বুঝি সেই দুর্গা থেকেই শুরু । দুর্গা শিবের স্ত্রী কিন্তু কালীর বাধ্য । আইনত কালীর স্বামীও । শিব স্বামী বটে তবে পরবাসী-প্রবাসী , মিথলজিক্যাল ননবেঙ্গলি । আর দুর্গা বাঙালি । রাধারও প্রাণপরুষ কৃষ্ণও পরবাসী-প্রবাসী ! সেই হিসেবে মিনতিও সেই ট্র্যাজেডির শিকার । বাদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন আইয়ুবের মার্শাল বিরোধী আন্দোলনে মারা যায় ।
যত্র-তত্র হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা লাগছে । মার্শাল ল জারি দেশজুরে । না ! পালান নি উকিলবাবু । চিত্রা নদীর পারেই মহাপ্রস্থান করেন । মৃত্যুও তাঁকে ধাবাতে পারেনি তার বাবার মাটি থেকে !
প্রকৃতিতে তখন দুর্গার আগমনধ্বনি , একসময় আসেও । শত্রু নাশিনী দুর্গা কী পারে শত্রু নাশিতে ? বাসন্তি দাঙ্গার হায়েনা শিকারে ধর্ষিত হয় । দুর্গা বিসর্জিত হচ্ছে , বাসন্তিও পানিতে ঝাঁপ দেয় । পার্থক্য একটাই দুর্গাকে লোকজন মা জ্ঞানে বিসর্জন দিচ্ছে আর বাসন্তি জেনে গেল সমাজ ধর্ম তাঁকে ভ্রষ্টা জ্ঞান করে বিসর্জনের নাম করে হত্যা করলো ! হায় দুর্গতি নাশিনী ! হায় !
'দেশভাগ কল্লি , ঘর ছাড়া কল্লি , স্বামী-পুত্রহারা কল্লি এখন দু'বেলা পেটের ভাতই জোটে না ! উপরের (ঈশ্বর) মিনসেটাইবা কেমন , এ কোন বিচার তোর !?'
জনৈক মহিলার এই কথাতেই প্রতিভাত হয়ে উঠে দেশভাগের চিত্র ।
''আমরা ভাবতাম কালো পিঁপড়ারা কামড়ায় না তাই ওগুলো মুসলমান , আর লাল পিঁপড়ারা হিন্দু কারণ ওগুলো কামড়ায় তো ! আমরা কী ছেলেমানুষ ছিলামরে , তাই না !?''
এই ভয়াবহ-রোমহর্ষক নির্জলা সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মিনতি ঠাণ্ডা অথচ নির্বিকার গলায় বাদলের বোনের কথার জবাব দেয় ...
'' হয়তো এখনোও তাই আছি !''
যে পিঁপড়েরা ভয়েভয়ে হাতির শুঁড়ে কামড়াত , সেই পিঁপড়েই কীনা আজ কোন অদৃশ্য শক্তিবলে বুনো হাতিররূপ ধারণ করেছে ! সেই বিকট ভয়াবহ হাতি দর্শনেই কীনা মিনতি এখন সব পরিষ্কার দেখতে পায় ! তাইতো মিনতি আর অনুপ্রভা মাসির চোখে ভেসে উঠে ...
"ওপেন টি বাইস্কোপ
নাইন টেন ট্রাইস্কোপ
সুলতানা বিবিয়ানা
সাহেববাবুর বৈঠকখানা
লাট বলেছে যেতে
পান সুপারি খেতে
পানের আগায় মরিচবাঁটা
ইস্কাবনের ছবি আঁকা
ছোটো ছোটো যাদুমণি
যেতে হবে অনেকখানি
কলকাতা কলকাতা কলকাতা ... "
বাংলাদেশের বাংলা সিনেমা ! বলে যারা নাক সিটকান তাঁদের সবিনয়ে চ্যালেঞ্জ করি তানভীর মোকাম্মেলের বিখ্যাত 'সিনেমা চিত্রা নদীর পারে' দেখার জন্য । আপনার এতোদিনের ধ্যান-ধারণা সমূলে আঘাত করবে 'চিত্রা নদীর পারে' । এতোদিন যারা মেকি চোখের জল , নাকের জল একসা করে হিন্দি-ইংরেজি সিনেমা দেখে চোখের মাথা খেয়ে ফেলেছেন তাঁদের আহ্বান জানাই সিনেমাটা দেখার জন্য । ভাল থাকুন ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১২ রাত ১২:১৮