ইরানি বিপ্লব পরবর্তী যে সংস্কার কার্যক্রম চলে তার একটা বড় প্রভাব পড়ে থাকবে ইরানি শিল্প-সাহিত্যে । প্রাগৈতিহাসিক কিংবা নিকট অতীতে সাহিত্য-সংস্কৃতির যে পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা সমজদার ইরানীয়রা তা তাঁদের দুর্জনেরাও (ইঙ্গ-মার্কিন ! এম্নিতেই ত্যানারা পুরাই আউলা জাউলা মাথা খারাপ ঝাতি, শাশক-শোষকেরা জাতি নয়! এরা সব সময়য়ই দুড়া কাউয়া ছিল , পরে একসময় এক হইয়া পাতি কাউয়ার লগে প্রতারণা কৈরা শেক্সপিয়ররে ধইরা কুকিল হইয়া গ্যাছে কিংবা আছে, যাউজ্ঞা আইজ এই থাকুক , এই আলোচনা অন্যত্র করমুনে) অস্বীকার করে না । বোধকরি এর একটা বড় প্রভাব পড়ে গেছে ইরানীয় সিনেমায় ।
আব্বাস খিয়োরোস্তামি , জাফর পানাহি , মাজিদ মাজিদি , বাহ্রাম বেজাই , দারিয়স মেহেরজুই , মহসেন মাখমালবাফ , পারভেজ কিমাইভি , সামিরা মাখমালবাফসহ আরও একঝাক মেধাবী প্রতশ্রুতিশীল ফিল্মমেকার এই দেশটির সিনেমায় জন্য যে খাটাখাটুনি করছেন তা এককথায় বিস্ময়কর । কারণ , রাষ্ট্রপক্ষ সিনেমার জন্য যে নীতিমালার বিধান করে রেখেছেন তা মুক্তসিনেমার জন্য বাধা , তদুপরি এই সিনেমেকাররা যেভাবে কৌশলে-ইঙ্গিতে সিনেমাকে শারিরীক-বাচনিক ভঙ্গিতে উপস্থাপিত করে চলেছেন তা পুরো সিনেওয়ার্ল্ডের জন্য চিন্তার বিষয় । এতোএতো বাধা-বিপত্তি মাড়িয়ে ইরানি সিনেমা সারাবিশ্বে যেভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে , বিশেষ কৈরা ইউরোপ-অ্যামেরিকায় (যেখানে পশ্চিমারা ইরানকে পারলে আজই কলনিয়াল রাষ্ট্র বানাবার জন্য বুক চিতিয়ে আছে , সেখানে ইরানি সিনেমা পশ্চিমাদের সদরে-অন্দরে ঢুকে বুকের পাঁজরে ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে , এইটা মনে হয় শীতল যুদ্ধের লক্ষন !?) তা আমাদের মতো দেশের সিনেপ্রেমিদের জন্য আনন্দদায়ক ও সুখকর সংবাদ ।
ইরানি সিনেমা আজকের কথিত ইউরোপ-অ্যামেরিকান সিনেমাকে যেভাবে চ্যালেঞ্জড করে তার স্বরূপ চিনিয়ে দিচ্ছে তা সিনেপ্রেমি হিসেবে আমি আমরা সবাই উৎফুল্লিত । এই ধারাবাহিকতার একটা সুনির্দিষ্ট বয়ান থাকা দরকার , থাকবেও । তয় আলস্যবশত এর দীর্ঘ ছেদ পড়তে পারে । ইরানি সিনেমার যে বৈপ্লবিক পট-পরিবর্তন তা এই লেখা কিছুটা ধরতে চেষ্টা করবে তয় সেটা করবো সিনেমাকে কেন্দ্র করে । এতে হয়তো নিবন্ধ-প্রবন্ধের রেশ পাওয়া যাইতে পারে তবে তা আশা না করাই ভাল ।
বিবর্ণ , ছেঁড়া , রঙ-পাংশুটে জুতোজোরাঃ ছোটোবেলায় ইদের আগের রাতে বাবা যখন নতুন জুতোজোরা হাসিহাসি মুখে চোখের সামনে তুলে ধরতেন তখন কী যে ভাল্লাগতো ! সে বোধহয় সবারই কমবেশি অভিজ্ঞতা আছে সে ইদ কিংবা পুজোই হোক । তখন ইদের সকালের জন্য সে কী অপেক্ষা , সারারাত ঘুম হতোনা । আলি জুতোজোরা হাড়িয়ে নির্বাক , আতঙ্কিত-শঙ্কিত । একমাত্র বোন জারা ,যার নিত্যদিন এই বিবর্ণ , ছেঁড়া , রঙ-পাংশুটে জুতোজোরা পড়েই স্কুলে যেতে হয় । আর বলা নাই , কওয়া নাই সেই জুতোজোরা কীনা আলি এই দুর্মূল্যের বাজারে গায়েব করে এলো ! রয়া , জারার ক্লাসমেট । তার পায়েই কীনা সেই বিবর্ণ , ছেঁড়া , রঙ-পাংশুটে জুতোজোরা ! এও কী সম্ভব ?
রঙ , পেনসিল , সোনালি কলম অতপরঃ সেই রাতেই আলি রফা করে । জারা'র মর্নিং শিফটে ক্লাশ , সে আলির বেমানান জুতো পড়ে যাবে আবার ছুটির আগে আগে কিংবা পড়ে যদ্দুর পারে দৌড়ে আলি'র স্কুলের আগে পৌঁছে দিবে । জারা বাধ্য হয়েই ম্লানমুখে মাথা নাড়ে , আলি আপন সহোদরাকে পেনসিল, ক্লাস পরীক্ষায় দ্বিতীয় হওয়া পুরস্কার সোনালি কলম হাতে গুঁজে দেয় , জারা ফিক করে হাসে । সে হাসিতে ভাই-বোনের ভালবাসাই নয় প্রশ্ন রেখে যায় এই চাওয়া-পাওয়াই কী সব প্রাপ্য নয় ? আলি আর কীইবা দিতে পারে কিংবা পারতো ?
অন্ধ-শ্রমিক ও দিনমজুরেরাঃ দিনমান খাটাখাটুনির পর বাবা-মা স্বপ্ন দ্যাখেন ছেলে-মেয়ে যেন আপন মেধায়-যোগ্যতায় নিজেকে ছাড়িয়ে যায় । এইটা বামচোখের স্বপ্ন হয়তোবা , নাহলে এমন বাস্তব ক্যাম্নে চুরি-চামারি হয়ে যায় ! ডান চোখতো কাজের খুজেই দিনাতিপাত করে । রয়া'র বাবা অন্ধ বলে কী স্বপ্ন দ্যাখেন না , নাকি দ্যাখেন ? আর আলি-জারা'র বাবার স্বপ্ন কী বামাদোষে দুষ্ট বলে স্বপ্ন-স্বাধীনতা , অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা কিংবা সাম্য-মৈত্রীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ছেড়ে দিছেন ?
বামাস্বপ্ন কিংবা স্বপ্ন ছিনতাই ! আলি-জারা'র দৌড়ঃ নাটাই নয় , ঘুড়ি নয় , ফুটবল নয় , কুতকুত কিংবা পুতুল নয় , দড়ি খেলা নয় এক্কেবারে সরাসরি দৌড় ! আলি প্রতিযোগী ,সাথে বেনিয়া পুঁজিবাদী গুষ্ঠির প্রতীক হাজারে হাজার ছেলে প্রতিযোগী । জারা সেই খেলার নিয়তি । জারা-আলি জানে এই খেলায় ফার্স্ট নয় থার্ড হতে হবে , নয়তো সেই পাদুকা মিলবে না । পা'ই যদি না থাকে জুতো কিংবা পাদুকা দর্শনে কী মাহত্ম্যে থাকে ! আফগান , ইরাক , লিবিয়া , কঙ্গো , নাইজেরিয়া , ফিলিস্তিনীদের কী পাদুকা লাগে , নাকি ক্রাশ , কোনটা ? সেই ক্রাশ ক্যাডা সাপ্লাই দেয় ? তাইলে আর পাদুকা-জুতো দরকার নাই জারা পা'ই দরকার , বোন ক্ষমা কর ! এই কী ভাবছিল আলি ? ৭০ , ৫০ , ২০ ফিট দূরে আলি , ফার্স্ট ! ফার্স্ট !! ফার্স্ট !!!
ফ্ল্যাশব্যাক ! বাস্তব-সিনেমায়ঃ যেভাবে বেকায়দায় ফেলে যখন-তখন যেকোন দেশকে ইঙ্গ-মার্কিনীরা কলোনিয়াল রাষ্ট্রের দাসানুদাসে পরিণত করতে চাচ্ছে , তাদের বলি জারা-আলি'রা সেই মানসিকতা-সাহসিকতা নিয়া দৌড়াচ্ছে , গন্তব্য কী খুব দূরে , আলি-জারা সহোদর কী আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে ? সাধু সাবধান !
কবিতা , ক্যামেরা কাহিনি চিত্রনাট্য ও মাজিদ মাজিদিঃ সিনেমায় কবিতা বিক্রি আজতক ইরানীয়রাই অত্যন্ত সফলভাবে বাজারজাত করে বেনিয়া-বুর্জোয়া পশ্চিমাদের মাংসাশী পেটকে ফুটো করে দিচ্ছে এই ফুটো দিয়া এখন মধ্যপ্রাচ্যের তেল ঢুকে শাতিল আরবে রূপ নিচ্ছে ! তো বলছিলেম কবিতা যখন জন-জাগৃতিতে নাই বুঝতে হবে কবিতা তার স্থান কিংবা স্বধর্মচ্যুত হয়েছে ,এমতাবস্থায় মাজিদ তাঁর ''চিলড্রেন অব হ্যাভেন'' এ যেভাবে তার সফল রুপায়ন করেছেন তা সত্যি অবিশ্বাস্য । ক্যমেরার চোখ কী সব ধরতে পারে ? প্রশ্ন করলে উত্তর নির্মিতির কারিগর দিবেন কীভাবে ? তাইলে ''চিলড্রেন অব হ্যাভেন'' দ্যাখেন । জুতো সেলাই , মুদি দোকানির ঠকানো গেইটের মানুষখেকো ককুরের ঘেউঘেউ পর্যন্ত সবই ধরা পড়েছে ।
কাহিনি নাকি সিনেমার প্রাণ ! চপেটাঘাত করলেন মাজিদ মাজিদি । সাদামাটা কাহিনিকে যেভাবে সিনেবন্দী করে রাজনৈতিকভাষ্য তৈরি করলেন তা ইরানি সিনেমার তো বটেই তাবৎ সিনেমেকারদের জন্য একটা গল্পহীন গল্পও তৈরি করে রাখেলন ।
জয়তু আলি-জারা ! জয়তু ''চিলড্রেন অব হ্যাভেন'' !! জয়তু মাজিদ মাজিদি !!!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:০৬