পর্ব -১
- আসতে পারি ?
- না বলার কি উপায় রেখেছেন ? চলেই তো এসেছেন
- না, মানে, আপনি বললে আবার চলে যেতে পারি
- তার আর দরকার নেই, আসুন । তবে একটু কষ্ট করে ঐ যে চেয়ারটা দেখছেন...
- চেয়ার !! কোথায় ?
- আরে ধুর, পুরোটা শুনুন তো আগে । ঐ যে চেয়ার, একগাদা কাপড়-চোপড় রাখা ওর উপর । কাপড়-চোপড়গুলো কষ্ট করে তুলে খাটে রেখে চেয়ার টেনে বসুন
আমার কথা শুনে, জনাব আনিস সাহেব তাই করলেন । ভালোই হলো, মাঝে মাঝে আমি নিজেই ভুলে যাই যে আমার রুমে একটা এক্সট্রা চেয়ার আছে । জনাব আনিস সাহেব একজন প্রকাশক, গত এক সপ্তাহ তিনি আমার পিছন পিছন ঘুরছেন । আমিও তাকে অনেকদিন ঘুরিয়ে আজকে সময় দিয়েছি । যদিও কথা বলতে ইচ্ছা করছে না, কিন্তু ভদ্রলোক মনে হয় সেটা শুনবেন না । আমার কাছে একটা লেখা প্রায় ৭-৮ মাস ধরে আটকে আছে ।
আমার লাস্ট বের হওয়া বই "অবেলার সংশপ্তক" ভালোই বিক্রি হয়েছে । সেই বইটা এই ভদ্রলোকের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে বের করা । সেই থেকে নতুন আরেকটা বই দেওয়ার জন্য একেবারে মাথা খেয়ে ফেলছেন । আমি অবশ্য ৭-৮ মাস আগেই লেখাটা শুরু করেছিলাম । নতুন দুইটা নামও ঠিক করেছি, "দ্বিপ্রহরের কষ্ট" নয়তো "অভিশপ্ত জীবননামা" । হয়তো শেষে এই দুইটার কোন নামই ঠিক হবে না । হয়তো নতুন কোন নাম ঠিক করা হবে । কিছুই নিশ্চিত না ।
- তা ইয়ে মানে, লেখাটা কতদূর ?
- লেখা !! কোন লেখা ?
- হা হা হা, আপনি তো ভালোই মশকরা করতে পারেন । ভালোই মজা পেয়েছি জনাব ।
- (আসলে আমি মশকরা করেছি ঠিকই কিন্তু আমার প্রধান উদ্দেশ্য এই ভদ্রলোককে ঘাবড়ে দেওয়া) মশকরা !! কে করলো ?
আমার কথা শুনে এবার মনে হচ্ছে ভদ্রলোক সত্যি ঘাবড়ে গেলেন । পকেট থেকে একটা রুমাল বের করলেন । দেখতে পেলাম তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে । রুমাল হয়তো সেই কারণেই বের করেছেন । তবে মুখে হাসিটুকু ঠিকই ধরে রেখেছেন, হয়তো ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছেন । বুঝা যাচ্ছে না । ভদ্রলোক বেশ ঘাঘু চিজ । ওদিকে আমিও এমন ভান করে চলেছি যে তার কথা কিছুই আমি বুঝতে পারছি না ।
- না, মানে, ঐ যে দ্বিতীয় বইটার কথা বলছিলাম আর কি...
- (অন্য দিকে তাকিয়ে) ফেলে দিয়েছি
- (আমার কথা শুনে মনে হলো ভদ্রলোক আৎকে উঠলেন এইবার) কি !!! ফেলে দিয়েছেন, মানে ?
- হ্যাঁ, ফেলে দিয়েছি । ফালতু লিখেছিলাম । ভালো লাগেনি, তাই ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি ।
- ও মা, এ কি বলেন আপনি ?
পর্ব - ০২
- কেন ? এখানে "ও মা" করার কি আছে !! বুঝলাম না তো । আপনার ভালো লেখা চাই নাকি যেমন তেমন লেখা হলেই চলবে ?
- না, ঠিক আছে কিন্তু তাই বলে ৭-৮ মাস পর এসে আপনি এই কথা শোনাবেন ?
- দেখুন এখানেই তো লেখক আর লেখার মধ্যে ব্যাপারটা । যে কোন কবিতা যেমন কবির কাছে তার সন্তানস্বরূপ ঠিক তেমনি লেখাটাও একজন লেখকের কাছে ঠিক তাই কিন্তু কি জানেন, এই সন্তানকেও মাঝে মাঝে ত্যাগ করতে হয়, সীমাবদ্ধতার কারণে ।
- কি জানি বাপু, আপনারা লেখক মানুষ, কি যে বলেন, ওসব আমাদের মাথার উপর দিয়ে যায় ।
- (আমি কিন্তু এখনও ভদ্রলোকের সাথে মজা চালিয়ে যাচ্ছি) দেখুন আনিস সাহেব, আমরা লেখক ঠিকি কিন্তু আপনার মত সাধারণ মানুষরাই তো পাঠক । এখন বলুন তো, আমার মত লেখকের কথা যদি পাঠকের মাথার উপর দিয়ে যায় তাহলে লেখা কি মাথার উপর দিয়ে যাবে না ?
- আহা লেখক সাহেব, আপনি কোথাকার কথা কোথায় টানলেন !! আমি তো হালকা হলেও বুঝছি, ওটা তো আপনার মন রক্ষা করার জন্য বললাম যে বুঝিনি যাতে করে আপনি অমন ভারি ভারি কথা বলার একটা আলাদা আনন্দ পান । আমি কিন্তু বুঝেছি ।
ভদ্রলোকের কথা শুনে এবার আর হাসি চেপে রাখতে পারলাম না । সত্যি সত্যি জোরে জোরে হো হো করে হেসে দিলাম । আনিস সাহেব প্রাণপণ চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছেন যে আমার সাথে এ যাত্রায় তিনি যেন নিরাশ হয়ে, পরাজিত হয়ে না ফিরে যান । আমিও পরক্ষণেই ভাবলাম, নাহ, ভদ্রলোককে এতটা হতাশ করা ঠিক হবে না । তাই এবার সত্যিটা বলেই ফেললাম ।
- আনিস সাহেব, নিশ্চিন্ত হন, লেখাটা আমার কাছেই আছে । আমি ফেলেনি ।
আমার কথা শুনে আনিস সাহেব লম্বা একটা দম নিলেন বলেই মনে হলো আর তার হাসিমুখটুকু আরও চওড়া হলো । মনে হলো তিনি কিছুক্ষণের জন্য আমাকে কোন প্রশ্ন করার আগ্রহটুকু হারিয়ে ফেলেছেন । আমি সামান্য একজন লেখক হয়ে তার মত একজন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সিইও এর সাথে কিভাবে এরকম সস্তা রসিকতা করতে পারি, এমন কোন ভাবনাও মনে হলো ভদ্রলোকের মাথায় নেই । তিনি এখন নিশ্চিন্ত হতে পেরেছেন, লেখাটা আছে শুনেই । না হলে ৭-৮ মাসের অপেক্ষার গচ্ছা বেশ ভারি আকারে মাশুল দিতে হতো তাকে । একটু পর আমিই জিজ্ঞেস করলাম,
- কি খাবেন, চা নাকি কফি ?
আমার মনে হলো আমার প্রশ্ন শুনেই আনিস সাহেব মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমার রুমের বেহাল দশাটুকু দেখতে লাগলেন । আমার রুমটা বেশ বড়ই । সিঙ্গেল রুম এখনও, বিয়ে-সাদি করিনি । সিঙ্গেল লাইফের সবচেয়ে বড় প্যারার নাম আলসেমি আর অগোছালো মনোভাব । আমারও একই অবস্থা । পুরো রুমে কোন একটা জিনিস খুঁজে পেতে গেলেও বেশ কাহিল হতে হবে । কাহিনীর শুরুতেই চেয়ারের কাপড় খাটে রাখার কথাটুকু শুনেই সবার বুঝার কথা ।
একটু পর মনে হলো আমার রুমের বেহাল দশা দেখেই কিনা আনিস সাহেব মাথা নাড়িয়ে না করে দিলেন, যে তিনি চা কিংবা কফির কোনটাই নেবেন না । আমিও আর কি !! মেহমানদারীর উটকো দায়িত্ব থেকে নিস্কার পেয়ে গেলাম ।
পর্ব - ০৩
মাশুলের কথা বললাম এই কারণে যে এই ৭-৮ মাস ধরেই প্রতি মাসে আমি তার কাছ থেকে কিছু সম্মানীর টাকা নিয়েছিলাম । এরকম আরও ২-১ টা প্রকাশনী থেকে সম্মানীর টাকা সংগ্রহ করেই আমার দিন চলে । ডিগ্রি পাশ করে দেশের বিশাল সংখ্যক বেকারত্বের কোটায় নাম লিখিয়েছিলাম । এরপর কয়েকদিন চাকরী-বাকরির জন্য দৌড়াদৌড়ি, কয়েকদিন অস্থায়ীভাবে একটা প্রাইমারী স্কুলে বাংলার শিক্ষক হওয়া, এখন পুরোদস্তর আমার লেখালিখির জীবন । সব মিলিয়ে ভালো আছি যদিও বলা যাবে না, তবুও একেবারে খারাপ নেই ।
নিজের বলতে যারা ছিল সবাইকে ছেড়েছুড়ে এই নির্বাসনের জীবন নিয়ে নিয়েছি আজ প্রায় ৭ বছর হলো । অসহায় আমিত্বের সঙ্গী হিসেবে কাউকে পাইনি । এখন আর কাউকে চাইও না । তবে এই জীবনের দৌড়ে আশেপাশে ২-১ জন শুভাকাঙ্ক্ষী ঠিকি জুটে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে একজনের বদৌলতেই এই আনিস সাহেবের সাথে এবং আরও কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সাথে পরিচয় হয় আমার । আসলে সৃষ্টিকর্তা একজনের সাহায্যে আরেকজনকে ঠিকি জুটিয়ে দেন, তার দুনিয়ায় একেবারে অসহায় হয়ে হয়তো কেউ থাকে না আর থাকলেও সহায় একসময় না একসময় জুটেই যায় ।
আনিস সাহেব উঠে দারিয়েছেন । হয়তো চলে যাবেন । তিনি আর কিছু জিজ্ঞেস না করলেও, আমিই তাকে আগ বাড়িয়ে বললাম যে আর মাত্র ৩ মাসের মাথায় তার লেখাটা জমা দিবো । আগ বাড়িয়ে নিজের একটা আয়ের পথ রুদ্ধ করছি । কি আর করার !! এই পেশায় দায়বদ্ধতা ছাড়া টিকে থাকাটাও তো বেশ কঠিন । হয়তো আমি তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আরও সময় লাগাতে পারি কিন্তু এরপর একবার বদনাম ছড়িয়ে গেলে আমার মত সামান্য লেখক ধূলায় মিশে যেতেও সময় লাগবে না ।
মাস শেষে যেই টাকা আমার কাছে থাকে, সেটা দিয়ে একজন না শুধু, দুইজন মানুষের ঢের চলে যাওয়া যায় । আমিও একা চলি না । একটা মেয়েকে সাহায্য করি । তবে নিয়মিত না, মাঝে মাঝে । মেয়েটা আমার কি হয়, পাঠকের মনে প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক । জী না, মেয়েটার সাথে আমার কোনরকম সম্পর্ক নেই । একদিন রুমে শুয়ে আছি, হঠাৎ দরজায় নক, কেউ একজন এসেছে ভেবে দরজা খুলেই দেখি একটা ২০-২২ বছরের তরুণী মেয়ে দাড়িয়ে । চেহারায় সুস্থ মেয়েটা দরজা খুলতেই কিছু না বলে আমার হাতে লিফলেট ধরিয়ে দেয় একটা । সেখানেই পড়ে দেখি, মেয়েটার জরায়ুতে নাকি টিউমার হয়েছে একটা । খুব অবিশ্বাস্য, তাই না ?
অন্য কেউ হলে হয়তো অবিশ্বাস করেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে মেয়েটাকে "মাফ করো" কিংবা "ভাগো" কিংবা "ভণ্ডামির আর জায়গা পায় না এরা" ইত্যাদি বলে তাড়িয়ে দিতো । আমার জানি কি মনে হয়েছিল, আমি মেয়েটাকে নিয়ে যাই এক পরিচিত ডাক্তারের কাছে । মেয়েটি স্বাভাবিকভাবেই আমার সাথে গিয়েছিল সেখানে । এরপর ডাক্তার ভাই পরীক্ষা করে মেয়েটার রোগের সত্যতা বের করেন । ঘটনার শুরু তখন থেকেই ।
পর্ব - ০৪
মেয়েটি প্রথমদিন কথা না বললেও পরে জানতে পারলাম যে সে কথা বলতে পারে । আর সেটা ভালোভাবেই । ডাক্তারের কাছে যেয়ে রোগের সত্যতা পাওয়ার পর মেয়েটি ডাক্তারখানা থেকে বের হয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রথম যে প্রশ্নটা করেছিল, সেটা আমি আজও ভুলতে পারিনি । প্রশ্নটা হচ্ছে,
- পরীক্ষা তো করালেন, এখন কি সব দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নেবেন ?
মেয়েটার প্রশ্ন শুনে আমি চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম । ক্ষণিকের জন্য বাকহীন হয়ে গিয়েছিলাম । আশ্চর্য হয়েছিলাম নিজের উপরই । কোন কারণে আমি এতটা করলাম !! এতটা না করলেই কি হতো না !! মেয়েটির প্রশ্নটা খুব বেশি অপ্রাসঙ্গিক ছিল না বরং প্রাসঙ্গিকতার একেবারে কাছাকাছি চলে গিয়েছিল । আমি সেই সময় মেয়েটার হাতে এক হাজার টাকার দুইটা নোট গুঁজে দিয়ে চলে এসেছিলাম ।
নাহ, মেয়েটার সাথে ঐদিন আর দেখা হয়নি, এমনকি এর পরের এক মাসও না । এক মাস পর হঠাৎ ভরদুপুরে আবার দরজায় নক । দরজা খুলে দেখি ঐ মেয়েটা । হ্যাঁ, আমি এক দেখাতেই মেয়েটাকে চিনতে পেরেছিলাম । এইবার আর মেয়েটা চুপ করে থাকলো না, বরং আমাকে জিজ্ঞেস করলো
- ভিতরে আসতে পারি ?
বাহ, কি সাবলীল আর সহজ একটা প্রশ্ন !! এর উত্তর কখনই "না" হতে পারে না । আমিও না বললাম না । এরপর মেয়েটি ঘরে ঢুকে সোজা আমার খাটে গিয়ে বসে পরলো । আমি অবাক হলাম না, দরজা লাগিয়ে আমি আমার চেয়ারে গিয়ে বসলাম । এরপর মেয়েটির কথা শুনে আমি সত্যিই অবাক হলাম ।
- নেন, তাড়াতাড়ি করে নেন । দ্রুত আমি চলে যাই । আমার হাতে টাইম আছে মাত্র আধা ঘণ্টা । এরপর আবার আরেক পার্টির কাছে যেতে হবে ।
- (অনেক সময় লাগলো আমার এই কথা শোনার পর ধাতস্থ হতে । ধাতস্থ হয়ে আমি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম) পার্টি মানে ?
- (আমার প্রশ্ন শুনে এবার মেয়েটি অবাক হয়ে গেলো । আমি এই কথাটা ধরতে পারবো না, এইটা আশা করেনি সে) পার্টি বোঝেন না, আপনি ? আবার এই লাইনে আসছেন ?
এবার আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম । এই লাইন বলতে মেয়েটা কি বোঝালো ? তবে কি মেয়েটা ধরেই নিয়েছে যে আমি ওকে সাহায্য করেছি ওর সাথে এমন উল্টাপাল্টা কিছু করবো বলে ?
(বাকিটা পরবর্তী পর্ব-এ)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:০৬