সকাল আনুমানিক সাতটা। মালিবাগের জোয়ার্দার লেনের সামনে চারিদিকে লোক আর লোক। অনেকগুলো রিকশা ইতিমধ্যে রাস্তায় এলোমেলো অবস্থায় জড়ো হয়ে আছে। পূর্ব পশ্চিম দুদিক থেকে টুংটাং বেল বাজিয়ে আরো কিছু রিকশা ভিড়ে এসে জটলা পাকাচ্ছে। তারই মধ্যে কতগুলো যন্ত্রযান আটকা পড়ে আছে। অনড় জ্যাম। মধ্যখানে একটা পুলিশের গাড়ি। অসহায়ের মতো সাইরেন বাজিয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে, মাতৃহারা গোবৎস হাম্বা-হাম্বা করছে। অনতিদূরে আটকা পড়া রিক্সায় বসে যুবক এতক্ষণ এসব দেখছিল। তারপর রিক্সা থেকে নেমে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। অনেকে বলছে সামনের পাঁচতলা বিল্ডিং থেকে পড়ে গিয়ে কেউ মারা গেছে। কেউ কেউ অবশ্য আত্নহত্যা বলছে। কিন্তু কেউ জানে না, বলতে পারছে না সে কে। কৌতুহল আটকে রাখতে না পেরে যুবক দু'হাতে মাছি থকথকে ভিড় ঠেলে মাঝে একটুখানি ফাঁক বের করে সামনে এগিয়ে গেলো। এরপরের দৃশ্য দেখে যুবক কিছুটা হলে থমকে যায়। সাড়ে পাঁচফুটের মতো লম্বা গড়নের ক্ষিণকায় দেহের কোন এক যুবতী হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনড় হয়ে পড়ে আছে। পরনে ঝলসে যাওয়া খয়েরী রংয়ের পাট-ভাঙা সুতোর শাড়িকে লাল মনে হলো। দেহের চারপাশে ছোপ ছোপ রক্ত। বিদেশে হলে এতক্ষণে এই জায়গা সিল করে দেয়া হতো। মৃতদেহের চারপাশে যেভাবে পড়েছিল শাদা চক দিয়ে চিহ্ন এঁকে রাখা হতো। এতক্ষণে তদন্তের কাজও হয়তো শুরু হয়ে যেতো। সাথে সাথে ছবি তুলে এ্যম্বুলেন্সে করে মৃতদেহটি সরিয়ে ফেলা হতো। কিন্তু এখানে আপাতত উৎসুক জনতার ভিড় ছাড়া তার কিছুই চোখে পড়ছে না। তৃতীয় বিশ্ব বলেই হয়তো এখানে মানুষের মৃতদেহকে মাদুর পেঁচিয়ে রিকশা না হয় ঠেলাগাড়িতে করে মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। অবশ্য মৃতদেহের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে পুলিশের ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হয়।
তারপর হঠাৎ যুবতীর চেহারার দিকে চোখ যেতেই যুবক আঁতকে উঠে। চেহারার সাথে বিবাহিতা স্ত্রীর মিল খুঁজে পেয়ে যুবকের গলা শুকিয়ে আসে। হন্তদন্ত হয়ে যুবক প্যান্টের পকেট থেকে হাতড়িয়ে মোবাইল বের করে বাসায় ফোন দেয়। হ্যালো.....
এতটুকু দেখার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ৫০১ নাম্বার রুমের কয়েদী আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমি রীতিমত ঘামছি। কাঁপা কাঁপা হাতে স্যাঁতস্যাঁতে হিম সর্প শীতল ফ্লোরে রাখা কলসটা নিয়ে ঢক ঢক করে সবটুকু পানি খেয়ে নিই। এ দুঃস্বপ্ন প্রতিরাতে আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এভাবে আমার প্রতিটা ভোরের শুরু হয়। তারপর দিন কেটে যায়। সন্ধ্যা আসে। আবার রাত হয়। শুধু সময়ের চোরা স্রোতে আটকে পড়া এই আমি ঝা চকচকে সূর্যের হাসি দেখিনা গত পাঁচটি বছর ধরে। ছাদের ওপারের দূর আকাশের উড়ে যাওয়া শাদা-কালো কিংবা স্থির হয়ে বসে থাকা নীল মেঘগুলো দেখিনা অনেকদিন। ক্ষ্যাপাচোখে আমি তৃষ্ণার্ত দেয়ালে নীল দেখি। নীল আসলে শূন্যতা। নীল আমার ভেতরের মানুষটি। মীরা মৃত্যুর ওপার থেকে মাঝে মাঝে চলে আসে আমার এই রুমটিতে। আধাঁরে একটা জোনাকি পোকার মতো সে মৃদু স্মৃতির আলো জ্বেলে পৃথিবীর অবসিত জীবনে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার একটি প্রশ্নের উত্তর। কেন? কেন?? সেই কেন এর উত্তর পেতে স্মৃতির সুতো ধরে ধরে আমি সেসব দিনে চলে যায়।
২.
যশোরের এক অঁজপাড়াগায়ের নুন আনতে পানতা ফুরায় পরিবারে আমার জন্ম হয়েছিল। জন্মের পর থেকেই আমার যমজ বোন অভাবের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে। তারপর রিক্সাওয়ালা বাবার কষ্টার্জিত টাকায় আমি একদিন ইন্টার পাশ করে অনেক বড় হবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। আমার অশিক্ষিত মায়ের মুখের রেখায় দুদন্ড হাসি ফোটানোর স্বপ্ন, দিনমজুর বাবার হাতে একমুঠো সুখ দিতে পারার স্বপ্ন। তাই যশোরের অঁজপাড়াগায়ের এই আমি স্বপ্নের শহর ঢাকায় চলে আসি। বাক্সভর্তি স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম ঢাকা ইউনিভার্সিটি'তে। কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে কারো সুপারিশ না থাকায় হলে উঠার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। এতো বড় ঢাকা শহরে কোথাও ঠাঁই নেই আমার। কোথায় যাবো আমি? কোথায়? স্কুলে হঠাৎ পড়া ভুলে যাওয়া ভীত বালকের মতো অস্থিরভাবে চারিদিকে হা-হুতাশ করছিলাম। তারপর একদিনের পরিচয়ে নেতা টাইপের একজনের বদৌলতে হলের একটি রুমে উঠি। ছোট একটা রুম, তাতে তিনটা বেড। তিনটা বেডে নয়টা ফ্লোর, মানে প্রতিটা খাট তিনতলা। আর নয়টা ফ্লোরে ডাবলিং করে থাকে আঠারো জন বৈধ ছাত্র। আবার প্রায়ই কারো না কারো অথিতি এসে থাকে। অবৈধ বহিরাগত অছাত্রের জন্য খাটের নিচের জায়গাটা পরম আশ্রয় বটে। আসার সময় মশারি আনিনি বলে প্রথম প্রথম মশার হাত থেকে বাঁচতে পায়ে মোজা হাতে দস্তানা, মাথায় কাপড় পেঁচিয়ে শুয়ে পরতাম। সকালে ক্লাসে যেতাম। ক্লাস শেষে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে হেঁটে কোথাও কোন টিউশনি আছে কিনা খোঁজ লাগাতাম। এভাবে দিন চলে যাচ্ছিল। তারপর একদিন পূর্ব পরিচয়ের সেই নেতার অতিরিক্ত জোরাজুরিতে অনিচ্ছা থাকা স্বত্ত্বেও হল থেকে বিতাড়িত হবার ভয়ে ছাত্র সংসদের মিটিংয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। পরিচয় হয়েছিল সংসদের আরো অনেকের সাথে। পরে আরো বেশ কবার গিয়ে কবে যে ওদের নোংরা রাজনীতিতে জড়িয়ে গেলাম টেরই পায়নি। তারপর মিটিং-সেমিনার নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে যায়। ধীরে ধীরে আমি ছাত্র সংসদের বড় বড় নেতাদের খুব কাছাকাছি চলে আসি। মাঝে মাঝে বড় ভাইদের হাত ধরে দু একটা এমপির সাথেও দেখা করতে যেতাম। শুধু পড়ালেখাটা আস্তে আস্তে করে দূরে সরে যাচ্ছিল। নেতাদের নির্দেশে ঢাকা শহরের বিভিন্ন অপারেশনে যাওয়া শুরু করি। এভাবে আমি দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠি। ততদিনে ষ্টুডেন্ট পলিটিক্স ক্লাস ওয়ানের দু'য়ের নামতার মতো মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল আমার।
দু'বছর পর সংসদের জিএস নির্বাচিত হই। আমার মতো ডাষ্টবিনের মশা হঠাৎ করে এতোবড় ক্ষমতা হাতে পেয়ে কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সামনে এগোতে তেরজন, পেছনে বারোজন আমাকে ওস্তাদ ওস্তাদ করতো। আমার হাতে কলমের বদলে উঠে আসে মন্ত্রীর টাকায় কিনে দেয়া অত্যাধুনিক অস্ত্র। ইউনিভার্সিটির সবাই ভয়ে আশে পাশে ভিড়তো না। এই জীবনটাকে এতোটাই উপভোগ করতে শুরু করি যে আমি আমার রিক্সাওয়ালা বাবার কথা ভুলে যায়, ভুলে যায় আমার অশিক্ষিত গ্রাম্য মায়ের কথা। মন্ত্রী-এমপি'দের পোষা কুত্তা হয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায়। ঢাকা শহরের বড় বড় টেন্ডার নিজের নামে পেতে শুরু করি। ততদিনে আমার ভেতরের মূল্যবোধকে আমি শক্ত করে পলিথিনের ব্যাগে ভরে কোন একদিন নষ্ট শহরের চৈতালী বাতাসে উড়িয়ে দিয়েছি, কারো নজরে আসার আগে। এভাবে আমার দ্বিতীয় জীবনটাও চলে যাচ্ছিলো। ঢাকা শহরে গাড়ি বাড়ি যেসব কোনদিন আমার ছিল না সব হয়েছে, শুধু যে মা-বাবা আমার নিজের ছিল তাদের আপন করতে পারিনি। অসুস্থ বাবা আমাকে চিনেনি। যে মায়ের নরম শাড়ির আঁচলে লজ্জায় একদিন মুখ লুকাতাম, সে মা অস্ত্রহাতে নিজের ছেলের ছবি দেখে মুর্ছা গিয়ে পরে মরে গিয়েছিল। এই শহরে বড়লোকদের কোন চক্ষুলজ্জা নেই, আছে শুধু তাদের যারা দুমুঠো খেতেও পারে না।
৩.
তারপর একদিন তাকে দেখি, যাকে দেখামাত্রই পৃথিবীর সব, যা যেখানে ছিল, স্থির হয়ে পড়লো। থেমে গেলো সব যানবাহন- রিক্সা, মানুষ, এমনকি ট্রাফিক পুলিশের হাত। এই কংক্রিটের জঙ্গলে মানবদঙ্গলের ফাঁকে সে আমার মতো অমানবের মনে একটুখানি শান্তির স্পর্শ বুলিয়ে গেলো। তাকে দেখে আমি ক্ষণিকের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম যে, আমি অনেক বড় একজন নেতা। যাকে দেখে ভয়ে সবাই মাথানিচু করে হাঁটে। তার চোখে চোখ রাখতেই সে মুখ ফিরিয়ে নিলো অন্যদিকে। ভয়ে নাকি লজ্জায় বুঝতে পারিনি। পরে খবর নিয়ে জানলাম সে এ্যকাউন্টিং তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। আরেকদিন দেখা হয়ে গেলে ওর নাম জানার লোভ সামলাতে পারিনি। নিচুস্বরে আমি 'মীরা' বলে ধীরে পায়ে চলে গেলো। যতদূর যায় আমি অপলক চোখে তার চলে যাওয়া দেখছিলাম। তারপর কবে যে আমি তৃতীয় জীবনে প্রবেশ করেছি বুঝে উঠতে পারিনি। তাকে একপলক দেখতে, তার সাথে একটু কথা বলতে মুখিয়ে থাকতাম। আস্তে আস্তে আমি দ্বিতীয় জীবনের উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। মিটিং থেকে শুরু করে দলের বিভিন্ন কার্যক্রম ফাঁকি দিতে শুরু করি। অনেকদিন দূরে দাড়িয়ে থেকে তাকে দেখতাম। কাছে যাবার সাহস পেতাম না। অথচ আমাকে কত মানুষ ভয় করে। যেই আমি অনেকের কাছে ভয়ন্কর বিষ্ফোরণ, সেই আমি এই মেয়েটির কাছে দুধের বালক। এই মেয়েটির কাছে আমার কিসের ভয়। সেকি আমাকে হাত পা ভেঙ্গে দিবে, নাকি কাউকে ইশারায় বলবে 'ফেলে দে'। দূর, আমি কিসব ফালতু চিন্তা করছি।
তারপর কোন একদিন, যেদিন প্রচন্ড গরম পড়ছিল, আকাশ ছিল তাতানো, বাতাসে ভাসমান সিসাগুলো যেন গলে গলে পড়বে, সেদিন আমি তাকে কাঁপা কাঁপা গলায় ভালোলাগার কথা বলেছিলাম। এটা মুখ থেকে বের হবার পরে ঠান্ডায় আমার হাত পা অবশ হয়ে আসছিল। সে কিছু না বলে চলে যাচ্ছে, অথচ আমি তাকে আটকাতে পারছি না। এভাবে কতদিন অপেক্ষায় ছিলাম। এই বুঝি সে আসবে, কিছু বলবে, এই ভেবে বেহুশ আমি অচেনা নেশায় ডুবে ছিলাম । কিন্তু যার জন্য এতো অপেক্ষা সে আসেনা।
পরে একদিন জানতে পারি সে এক ক্লাশমেটের সাথে প্রেম করছে, ঘুরোঘুরি করছে। এটা শুনে আমার কিছু ভালো লাগে না। আমি ওকে দেখে ভালো থাকতে পারতাম না। পৃথিবীটা ওলট পালট মনে হতো। ইউনিভার্সিটিতে ওদের দুজনের টইটই করতে দেখলে আমার ভিতরে জ্বালা করতো। আমি চাইলেই হাতের ইশারায় ঐ ছেলেটাকে ফেলে দিতে পারতাম। কিন্তু কেন জানি আমার সেটা করতে ইচ্ছে হলো না।
৪.
দলের এক এমপির কথায় কৌশলে ওদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। মামলা ঠুকে দেয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে এমপির প্রভাব কাজে লাগিয়ে এক মাসের মাথায় তাকে বিয়ে করে মালিবাগের বাসায় নিয়ে আসি। বিয়ের পরে প্রথম কিছুদিন সে আমার সাথে কথা বলেনি। কিন্তু খুব বেশিদিন চুপ করে ও থাকেনি। তবে, সে আমার চাইতে করিম চাচার সাথেই বেশি কথা বলতো। করিম চাচা যিনি রিক্সা চালাতেন, যার মাঝে আমি আমার বাবার ছায়া দেখতে পায়। বেশ কিছুদিন আগে বিরোধীদলের এক নেতার গুলি খেয়ে নালায় পড়ে বিষ-যন্ত্রণায় নলীকাটা জবাই করা মুরগীর মতো ছটপট করছিলাম। তিনি আমাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন এই করিম চাচা না থাকলে আমি মরে এতোদিনে পঁচে যেতাম। মানুষটির আপন বলতে কেউ নেই, আমার মতো। তাই তাকে বাসায় নিয়ে আসি।
বাসার নিচে তিনটে গাড়ী, সাত-আটজন কাজের লোক থেকে শুরু করে সব কিছুই ছিল। শুধু সুখ নামের অধরা শ্বেত কপোতটি আমাদের ছিল না। তারপরও এই শহরের অন্যান্য সংসারের মতো আমাদের সংসার চলে যাচ্ছিলো। এক বছরের মাথায় আমাদের কোলে একটা ফুটফুটে কন্যাসন্তান আসে। আমি ওর নাম রেখেছিলাম 'সুরি'।
মাঝে মাঝে আমি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাসায় ফিরতাম। এটা মীরার একদমই পছন্দ ছিল না। অনেক বাড়াবাড়ি করতো। আমি বলি, বড়লোক- মন্ত্রী সম্প্রদায় মানুষদের সাথে উঠাবসা করলে একটু আধটু খেতে হয়। মাঝে কোন একদিন সে তার পুরনো প্রেমিকের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। ড্রাইভারের কাছ থেকে এটা বের করতে আমার খুব একটা সময় লাগে নি। এটা নিয়ে তার সাথে আমার প্রচন্ড ঝগড়া হয়। এরপর থেকে আমি ওকে সন্দেহ করতে শুরু করি। এটা নিয়ে চরম অশান্তিতে আমার দিন কাটতো। আমি প্রতি রাতেই মাতাল হয়ে বাসায় আসতে শুরু করি।
৫.
একদিন মাতাল হয়ে বাসায় ফিরলে তার সাথে প্রচন্ড রকমের ঝগড়া হলে সে তার বাবার বাড়ি চলে যেতে চেয়েছিল। আমি অনেক ধস্তাধস্তি করে আটকালে সে দৌড়ে ব্যালকনিতে যায়। পেছন পেছন আমাকে যেতে দেখে সে লাফ দিতে গেলে আমি তাকে ধরতে যায়। কিন্তু আটকাতে পারিনি। সে ততক্ষণে পাঁচতলার উপর থেকে নিচে পড়ে যায়। আমি সহ করিম চাচাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে যেতে ততক্ষণে সব শেষ হয়ে যায়। মীরা ক্ষোভে, অপমানে মৃত্যু নামক দূরের সমুদ্রে চলে যায়। যেখানে গেলে কেউ আর ফিরে আসেনা। তারপর ওর বাবা বাদী হয়ে আমার নামে খুনের মামলা ঠুকে দেয়। কিন্তু উপরের নির্দেশে একমাসের মাথায় আমি জেল থেকে বের হয়ে আসি। জেল থেকে বের হয়েও আমি পাপের জেল এবং একটি দুঃস্বপ্ন থেকে বের হতে পারিনি। আমি প্রায় পাগল হয়ে যায়। নিহত বউয়ের সাথে আমিও খুন হয়ে গেছি। আমার শরীর কেটে ছিঁড়ে সেলাই করেছে পোষ্টমর্টেমের ডাক্তার আর মেথর।
তারপর একদিন একমাত্র মেয়েটাকে ওর নানুর কোলে দিয়ে আসি। নিজেকে চাঁদাবাজী, ছাত্রনেতা শান্টু খুনের সাথে জড়িত থাকাসহ অবৈধ অস্ত্র রাখার অপরাধ দেখিয়ে আত্নসমর্পণ করি। দলের সবাই এতে খুব অবাক হয় এবং আমাকে ছাড়িয়ে নিতে তৎপর হয়। কেউ কেউ বিদেশে চলে যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছিল। কিন্তু আমি নিজমুখে জবানবন্দী দিয়ে কারাভোগের শাস্তি মাথা পেতে নিই।
আমার বুকের বাঁ দিকে মাঝে মাঝে খুব ব্যথা হয়। নিশুত রাতে অস্ফুট শব্দ করে জেগে উঠি ব্যথায়। অপমান অবহেলা কম জমা হয়নি। মাঝে মাঝে ভাবি, আমার বেঁচে থাকা বুঝি অসঙ্গত। মৃত্যুর হিম মাঝে মাঝে দূর থেকে, কাছ থেকে স্পর্শ করে যাচ্ছে। হাত বাড়াচ্ছে, আবার সরিয়ে নিচ্ছে। বুকের ভিতর দিনদিন বেড়ে উঠা জৈব পাথরের হাড় নিয়ে বেঁচে থাকি, ভারে মাঝে মাঝে নুইয়ে পড়ি। ব্যর্থতা বুকে, অক্ষম দেহে দুঃসময় আমাকে নিষ্ঠুর হাতে চাবুক মারছে প্রতিনিয়ত। জানো মীরা, আমার একটি নিজস্ব আকাশ আছে। সেই মরা আকাশে জ্যান্ত একটা নক্ষত্র আছে। সেটা কে জানো, সে তুমি।
ঘুমহীন আমি ডুবে যায়, ডুবতে ডুবতে নদীর অতল থেকে আবার বাঁচতে চাই। একমাত্র মেয়েটার জন্য বাঁচতে খুব ইচ্ছে করে মীরা। করিম চাচা কিছুদিন আগে একবার তাকে নিয়ে এখানে এসেছিল। সে এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। জানো, সে তোমার মতো আমার সাথে কোন কথা বলেনি, শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল। সে তার বাবাকে ঘৃণা করে। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তাকে বুকে চেপে ধরে আদর করি। যে আদরে আমার চোখ বন্যায় ভেসে যাবে। তাকে বলতে ইচ্ছে করছিল, মামনি এই ইট পাথরের শহরে খুব সাবধানে বড় হয়ো। কারণ, তোমার ভিতরেই যে আমার বেঁচে থাকা।
(সম্পূর্ণ কাল্পনিক একটা গল্প। পাঠকদের কাছে অনুরোধ সবাই আমার লেখাটির সমালোচনা করবেন, ভুল বানান ধরিয়ে দেবেন। ভালো লাগাটুকু (যদি আদৌ ভালো লেগে থাকে), আর যেখানে ভালো লাগেনি সেটা জানাবেন।)
এই গল্পটি আমার খুব প্রিয় দুজন মানুষকে উৎসর্গ করতে ইচ্ছে হলো। একজন আকাশচুরি নামের অন্তরালে তারেক ভাই, অন্যজন মোস্তাফিজ রিপন ভাই। যারা আমাকে ভাবতে শেখায়। যাদের লেখার আমি একনিষ্ট পাঠক, ভক্ত।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ৯:৩৭