আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্টি জগৎকে নানা রঙেঢঙে ঢেলে সাজিয়েছেন। সীমাহীন এই জগতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিস্ময়কর সব মাখলুক। সৃষ্টির সেরা মানুষের নানা প্রয়োজনে এসব জানা-অজানা গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ নিয়োজিত আছে। মানুষ তার বিদ্যা-বুদ্ধি আর উপযোগী উপকরণ ব্যবহার করে নিজেকে সজ্জিত করার জন্য বিচিত্র সব বস্তুকে ব্যবহার করতে শিখেছে। সতর নিবারণের জন্য কাপড় ব্যবহার শুরুর সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যুদ্ধের সময় লোহার তৈরি শিরস্ত্রাণ, গায়ে চামড়ার বর্ম পরতে শেখে। বিত্তশালী ও অভিজাত মানুষ সাধারণ থেকে নিজেদের আলাদা করতে, আভিজাত্য ফুটিয়ে তুলতে বিচিত্র সব গাছপালা-কীটপতঙ্গ ব্যবহার করে কাপড় আর পোশাক-পরিচ্ছেদ আবিষ্কারে মনোযোগ দেয়। মানুষের নিত্যনতুন হাজারো আবিষ্কারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার রেশম। রেশম নামক পোকা থেকে সংগ্রহ তন্তু দিয়ে তৈরি হয় রেশমের কাপড়। প্রাচীন আরবের ব্যবসায়ী কাফেলা বিভিন্ন দেশ সফর করে অন্যান্য পণ্যসামগ্রীর সঙ্গে রেশমের তৈরি জামা-কাপড় কিনে ফিরত। প্রাচীনকালে রাজা-বাদশারা তাদের পরিবার ও অভিজাত বংশীয়রা রেশমের তৈরি পোশাক পরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। রেশম পরতে আরামদায়ক বলে এর চাহিদা ছিল আকাশচুম্বী। রেশমের তৈরি কাপড় পরা ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। প্রাক-ইসলামিক যুগে রেশমের তৈরি কাপড় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই ব্যবহার করলেও মুসলমান পুরুষের জন্য রেশমের তৈরি কাপড় হারাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমার উম্মতের পুরুষের জন্য রেশম এবং স্বর্ণ হারাম করা হয়েছে। আর মহিলাদের জন্য এগুলো হালাল করা হয়েছে। (জামে তিরমিজি : ২৭৯)। রেশমের কাপড় জান্নাতে পুরুষের পরিধেয় হবে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় খোদাভীরুরা নিরাপদ স্থানে থাকবে, উদ্যানরাজি ও নির্ঝরিণীগুলোয়। তারা পরিধান করবে চিকন ও পুরু রেশমিবস্ত্র।’ (সূরা দুখান : ৫১-৫৩)।
চীন দেশে সর্বপ্রথম রেশমকীট থেকে গুটি এবং গুটি থেকে সুতা উৎপাদন পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয় বলে ধারণা করা হয়। রেশম চাষের জন্য কলাকৌশল চীনারা প্রথম দিকে গোপন রাখলেও শেষ পর্যন্ত তা অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে সাড়ে ৫ হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রেশমকীটের সাহায্যে উৎকৃষ্টমানের মিহি সুতা প্রাপ্তির কাজ চলে আসছে। অনেক বছর আগে থেকেই রেশমিবস্ত্র বাণিজ্য পণ্য হিসেবে গণ্য ছিল। গ্রিক ও রোমের লেখকদের লেখা প্রাচীন গ্রন্থে ‘গাঙ্গেয় মসলিন’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীন যুগে এগুলো ভারত থেকে আগত বিলাস সামগ্রীর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল। সে সময় রোমে এসব পণ্যের সুন্দর কাব্যিক নাম ছিল যেমন ‘নেবুনা’ যার অর্থ কুয়াশা, বাষ্প বা মেঘ এবং ‘ভেন্টিটেক্সটিলেন’ অর্থ বুনন করা হাওয়া। নবম শতকের পর থেকে পূর্ব ভারতে আগমনকারী আরবীয়, চীনা ও ইউরোপীয় পরিব্রাজকরা বাংলার ধনী বণিকদের সম্পর্কে তাদের বিবরণে জানিয়েছেন যে, এ স্থান চীন দেশ থেকে আবিসিনিয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। এ বাণিজ্যের অন্যতম পণ্য ছিল প্রথমে সুতি এবং পরে রেশম বস্ত্র।
রেশম তন্তু বা সুতা, রেশম মথ নামে এক ধরনের মথের লার্ভার লালাগ্রন্থি বা রেশগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রসের তৈরি। রেশম পোকার ইংরেজি নাম সিল্ক ওয়ার্ম (ঝরষশ ডড়ৎস)। এরা পূর্ণবয়স্ক হলে প্রজাপতির মতো দেখায়। তাই এদের কীট না বলে পোকা বলা হয়। বিভিন্ন প্রজাতির রেশম মথ বিভিন্ন মানের রেশম সুতা তৈরি করে। আমাদের দেশে যে রেশম পোকা পাওয়া যায় তার বৈজ্ঞানিক নাম বোমবিক্স মোরি (ইড়সনুী সড়ৎর)। রেশম পোকার খাবার হলো তুঁত গাছের পাতা, যা মালবেরি পাতা নামেও পরিচিত।
রেশম গুটির চাষের সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষ অনেককাল ধরেই পরিচিত। অল্প পরিমাণ জমিতে তুঁত চাষ করে রেশম গুটি উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশের যেসব উঁচু স্থানে তুঁত গাছ জন্মানো যায় সেসব স্থানে রেশমকীট জন্মানো যাবে। এদেশের প্রায় যে কোনো আবহাওয়া ও তাপমাত্রায় রেশমকীট পালন করা যায়। তবে ২১০ থেকে ২৯০ তাপমাত্রা এবং ৯০ শতাংশ বায়ুর আর্দ্রতা রেশম চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। আবহাওয়া ও উর্বর মাটির জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় সবচেয়ে বেশি রেশম চাষ হয়। এছাড়া নাটোর, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, রংপুর, দিনাজপুর ও সিলেটে রেশম পোকার চাষ করা হয়।
আল্লাহর কুদরতের চমৎকার নিদর্শন পাওয়া যায় রেশম পোকা থেকে সুতা তৈরির পুরু প্রক্রিয়াটিতে। মানুষের কল্পনাতীত কারিগরি আল্লাহ তায়ালা দিয়ে রেখেছেন রেশম পোকার লালায়। লালাগ্রন্থি নিঃসৃত রস দিয়ে তৈরি রেশম পোকার নিজস্ব আবরণ নানা প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করে সুন্দর ঝলমলে মহামূল্যবান পরিধেয় তৈরির জ্ঞান আল্লাহর অস্তিত্বকে আরও বেশি প্রতীয়মান করে তোলে। রেশমের কাপড় হালকা ও অত্যধিক আরামদায়ক, রেশম কাপড়ের অনন্য গুণাবলির অন্যতম হচ্ছে শীতকালে উষ্ণ আর গ্রীষ্মকালে শীতল অনুভূতি দেয়। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে রেশমের তৈরি কাপড়ের চাহিদা অপরিসীম। তাই রেশম চাষ হতে পারে হালাল উপার্জনের মাধ্যমে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৫২