এই জীবনে
– মহাদেব সাহা
এই জীবনে হবে না আর মূলে যাওয়া,
চুড়োয় ওঠা-
কাটবে জীবন পাদদেশে, পাদমূলে;
খুব ভেতরে প্রবেশ করা হবে না আর এই জীবনে
হবে না আর ভেতর মধু ফের আহরণ,
হবে শুধুই ওপর ছোঁয়া, ওপর দেখা।
এই জীবনে হবে না আর তোমার নিবিড়
স্পর্শ পাওয়া,
হবে না এই নদী দেখা, জলাশয়ের
কাছে যাওয়া,
একটিবার তোমায় নিয়ে হ্রদের জলে একটু নামা-
হবে না আর পৌঁছা মোটেই ডুব-সাঁতারে
জলের গহীন তলদেশে,
জলে নামা, সাঁতার শেখা;
মূলের সঙ্গে হবে না আর ঠিক পরিচয়
মাত্র এখন অনুবাদের অর্ধ স্বাদেই তৃপ্ত থাকা,
এই জীবনে হবে না আর আকাশ দেখা,
চিবুক ছোঁয়া-
তোমায় নিয়ে নীল পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়া;
এই জীবনে হবে না আর তোমার গোপন দেখা পাওয়া,
একন শুধু চোখের জলে দুঃখ পাওয়া,
নিজের মাঝেই ফুরিয়ে যাওয়া, ফুরিয়ে যাওয়া।
এই জীবনে হবে না আর দুঃখ কারো
মোচন করা,
কারো অশ্রু মুছিয়ে দেয়া সাঁকো বাঁধা,
কারো ক্ষত সারিয়ে তোলা;
এই জীবনে হবে না আর মুগ্ধ ভ্রমণ,
মূলে যাওয়া-
তোমায় ছোঁয়া।
------------------------------------------------------------------------------------
তোমাকে ছাড়া
– মহাদেব সাহা
তুমি যখন আমার কাছে ছিলে
তখন গাছের কাছে গেলে আমার ভীষণ আনন্দ বোধ হতো
লতাপাতার উৎসাহ দেখে আমি সারাদিন তার কাছে ঘুরে বেড়াতাম
কোনো কোনো দেন পাখিদের
বাষভূমিতে আমার অনেক উপাখ্যান শোনা হতো
তুমি যখন আমার কাছে ছিলে
তখন প্রত্যহ সূর্যোদয় দেখতে যেতাম তোমাদের বাড়ির পুরনো ছাদে
তোমার সেই যে দজ্জাল ভাই সারারাত তাস খেলে এসে
পড়ে পড়ে তখনো ঘুমাতো,
তুমি যখন আমার কাছে ছিলে
তখন আমার রোজ ভোরবেলা ঘুম ভাঙতো, যেতাম
প্রকৃতির কাছে মানবিক অনুভূতি নিয়ে
মানুষের দুঃখ দেখে আমার তখন ভীষণ কান্না পেতো
এখন আমার আর সেই অনুভব ক্ষমতা নেই
মানুষের নিষ্ঠুরতা ও পাপ দেখেও আমি দিব্যি চায়ের দোকানে
বসে হাসতে হাসতে চা খাই
সেলূনে চুল কাটার সময় পাশেই অবৈধ কতো কী ঘটে যায়
তুমি কাছে না থাকলে আমি দিন দিন অমানুষ হয়ে উঠি
আশেপাশে সবার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করি
মানুষ ও প্রকৃতির দিকে চেয়ে আমার হিংসা বোধ হয়
তুমি না থাকলে মেয়েদের রূপ কিংবা ফাহমিদা খাতুনের
রবীন্দ্রসঙ্গীত কিছুই আমাকে আকর্ষণ করে না
শিশুদের প্রতি মমত্ববোধ জাগে না আমার
একে একে সকাল দুপুর সারাদিন নষ্ট হয়
কোনোকিছুই করতে পারিনে আমি
তুমি না থাকলে বড়ো দুঃসময় যায়, সর্বত্র বন্ধুবিহীনভাবে
বাস করি
এই ঢাকা শহর ভীষণ রুক্ষ মনে হয়
কাউকি ডাকলে সাড়া দেয় না, সবাই আমার বিরুদ্ধাচরণ করে
তুমি না থাকলে এই বাড়িঘর শহরের লোকজন
সম্পূর্ণ আমার অপরিচিত মনে হয়
নিজেকেই নিজের অচেনা লাগে
মনে হয় দীর্ঘ দিন থেকে আমি যেন কোনো অজ্ঞাত অসুখে ভুগছি
তুমি না থাকলে বাস্তবিক আমি বড়ো কষ্টে পড়ি
বড়োই কষ্ট হয়।
---------------------------------------------------------------------------
এ জীবন আমার নয়
– মহাদেব সাহা
এ জীবন আমার নয়, আমি বেঁচে আছি
অন্য কোনো পাখির জীবনে,
কোনো উদ্ভিদের জীবনে আমি বেঁচে আমি
লতাগুল্ম-ফুলের জীবনে;
মনে হয় চাঁদের বুকের কোনো আদিম পাথার আমি
ভস্মকণা,
ভাসমান একটু শ্যাওলা আমি;
এই যে জীবন দেখছো এ জীবন আমার নয়
আমি বেঁচে আছি বৃক্ষের জীবনে,
পাখি, ফুল, ঘাসের জীবনে।
আমি তো জন্মেই মৃত, বেঁচে আছি
অন্য এক জলের উদ্ভিদ-
আমার শরীর এইসব সামদ্রিক প্রাণীদের
সামান্য দেহের অংশ,
আমি কোটি কোটি বছরের পুরাতন একটি
বৃক্ষের পাতা
একবিন্দু প্রাণের উৎস, জীবনের
সামান্য একটি কোষ;
এ জীবন আমার নয় আমি সেইসব অন্তহীন
জীবনের একটি জীবন,
আমি বেঁচে আছি অন্য জীবনে, অন্য
স্বপ্ন-ভালোবাসায়।
-------------------------------------------------------------------------
শুদ্ধ করো আমার জীবন
-মহাদেব সাহা
তুমি শুদ্ধ করো আমার জীবন, আমি প্রতিটি ভোরের মতো
আবার নতুন হয়ে উঠি,
হই সূর্যোদয়
আমার জীবন তুমি পরিশুদ্ধ করো, আমি প্রস্ফুটিত হই
আমি বহুদিন ঝরা ব্যথিত বকুল অন্ধকারে, আমি বহুদিন
বিষন্ন বিধুর ;
একবার আমার মাথায় হাত রাখো, সুপ্রসন্ন হও
এই দগ্ধ বুকে করো শ্রাবণের অঝোর বর্ষণ
আমি শ্যামল সবুজ বৃক্ষ হয়ে উঠি ।
তুমি শুদ্ধ করো আমার জীবন, আমি হই সূর্যোদয়,
আমি হই উদিত আকাশ
আমি হয়ে উঠি প্রতিটি শিশুর হাতে প্রথম বানান শেখা বই,
হয়ে উঠি ভোরবেলাকার পাখিদের গান ;
আমার জীবন তুমি শুদ্ধ করো, আমি হই নতুন সবুজ
কোনো দ্বীপ,
আমি হই বর্ষাকাল, আমি হই বরষার নব জলধারা
আমি বহুদিন ব্যথিত বিষাদ, আমি বহুদিন একা
ঝাউবন ।
তুমি শুদ্ধ করো আমার জীবন, আমি হয়ে উঠি সদ্যফোটা ফুল
আমি হয়ে উঠি সকালের ঘুমভাঙ্গা চোখ ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০১১ বিকাল ৩:৪৫