ফায়ারফক্সে একটা এড-অন আছে (Stumble upon) যেটি তে ইচ্ছে মত ক্লিক করে হরেক রকমের সাইটে যেয়ে আছড়ে পরা যায়। যে সাইট হয়তো আপনি আগে কখনো দেখেননি, যার কন্টেন্ট আপনাকে তাক লাগিয়ে দিবে এমন এমন সাইট। তেমনি কাজ না থাকায় খই ভাজের মত করে ক্লিক করে যাচ্ছিলাম একটার পর একটা সাইট আর একটু পরেই গিয়ে পরলাম দারুণ এক সাইটে। যেটিতে দেখাচ্ছে একজন এক্টর বা এক্ট্রেস নিজেকে কোন ছবিতে মানিয়ে নেওয়ার জন্য কতটুকু ত্যাগ করতে পারে এবং নিজেকে কিভাবে বদলে নিতে পারে। স্ক্রল করে করে মুগ্ধ হয়ে নীচে নামছিলাম এবং হঠাৎ একজন এক্টর এবং সে কোন্ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য নিজেকে পাল্টে ফেলেছে দেখে সেখানেই স্ক্রল করা থামিয়ে দিয়ে মুভিটা খুজতে লেগে গেলাম।
ধান ভানতে শীবের গীত এতক্ষণ গাইলাম কারণ মুভিটার জন্যই আমার এই পোষ্টের অবতারণা।
মুভিটা চে গুয়েভারাকে নিয়ে এবং এর নায়ক কেমন করে যেন দেখতে অভিকল চে। সিনেমায় ধরা দিতে যেন আবার জীবন্ত হয়ে এসেছে। IMDB-তে রেটিং দেখে সন্তুষ্ট হওয়ার দেখতে বসে গেলাম। মুভিটা দুই পার্টে। তবে দুর্ভাগ্যবশত দ্বিতীয় পর্বটা অনেক খুজেও পেলাম না। যা বলছিলাম, চে-র জীবনী নিয়ে আগেই একটা ডকুমেন্টারী দেখা থাকায় মুভিটা শুরুর দিকে খুব একটা টানছিল না। ধীরে ধীরে ভালো লাগতে শুরু করলে এবং শেষ করে আবার আফসোস হচ্ছে দ্বিতীয় পর্বটা না দেখতে পারার দুঃখে।
চে-র জন্ম আর্জেন্টিনায়। আর্জেন্টাইন ডাক্তার চে ডাক্তারী পাশ করে বেরুবার কিছু আগে তার এক বন্ধুকে নিয়ে মোটরবাইকে চড়ে ল্যাটিন আমেরিকা ঘুরতে বেড়োয়। ভ্রমনে সে ল্যাটিন আমেরিকার জনগণের দুঃখ-দুর্দশা, বঞ্চনার সাথে পরিচিত হয়। এই ভ্রমণই আর্নেস্টো গুয়েভারার, বিপ্লবী চে গুয়েভারা হয়ে উঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রথমে আর্জেন্টিনা থেকে যায় চিলি। চিলিতে তখন আমেরিকানরা মাইন ব্যবসা নিয়ে ঝাঁকিয়ে বসেছে। আমেরিকানরা সেখানে গিয়েছিল মূলত সস্তা কাঁচামাল এবং সস্তা শ্রমের কারণে। আমেরিকানদের এমন দানবীয় পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে চে-র মন বিদ্রোহী হয়ে উঠে। সে স্বপ্ন দেখতে থাকে পুঁজিবাদবিহীন একটা পৃথিবীর। চিলি থেকে চে যায় ভেনিজুয়েলায়। এরপর তার মেডিকাল ডিগ্রী শেষ করে চে আবার পথে বেড়িয়ে পরে। এরপর যায় ভলিভিয়ায়। ভলিভিয়া থেকে গুয়াতেমালা। গুয়াতেমালা-তে তখন ছাত্ররা গুয়াতেমালার প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করছিল। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সি.আই.এ সেখানে তখন ষড়যন্ত্র করে গুয়াতেমালার প্রেসিডেন্টকে সরিয়ে এক পুতুল সরকার বসায় তাদের নিজেদের স্বাত্ত হাসিল করবার জন্য। চে সেখানে থাকাকালীন আমেরিকানদের ষড়যন্ত্র চাক্ষুস করে আমেরিকানদের প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করতে থাকে। পরে চে বলেছিল, আমেরিকানরা হচ্ছে মানবতার শত্রু। আমেরিকান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভে চে স্বপ্ন দেখতে থাকে গেরিলা সংগ্রামের মাধ্যমে নতুন এক পৃথিবী গড়ার। গুয়াতেমালা থেকে আর্জেন্টাইন দূতাবাসের সাহায্য নিয়ে চে যায় মেক্সিকো শহরে। সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় ফিদেল এবং রাউওল কাস্ত্রোর সাথে। ফিদেল কাস্ত্রো তখন পরিকল্পনা করছিল কিউবার একনায়ক সরকার বাতিস্তাকে হটানোর। চে-র ধ্যান-ধারণার সাথে কাস্ত্রো ভাইদ্বয়ের চেতনা মিলে যাওয়ায় চে তাদের সাথে সংগ্রামে যোগ দেয় এবং ১৯৫৬ সালের নভেম্বরের ২৫ তারিখ ৮২ জন গেরিলাকে নিয়ে কাস্ত্রো ভাইদ্বয় এবং চে বোটে চড়ে অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে কিউবার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় বাতিস্তা সরকারকে হটাতে।
এই হচ্ছে চে-র গেরিলা সংগ্রাম শুরু করার প্রাককথন। এরপর কিভাবে নানা চড়াই-উতরায় পেড়িয়ে তারা সেখানকার দরিদ্র চাষাদের মন জয় করে নেয় এবং তাদের সাথে নিয়ে কিভাবে বাতিস্তা সরকারকে হটিয়ে কিউবার ক্ষমতা দখল করে সেটি দেখতে আপনাকে মুভিটা এবং সাথে দেওয়া ডকুমেন্টারীটা (যদি বিশদ জানতে চান) দেখতে হবে। চে মূলত ছিল চুপচাপ প্রকৃতির। সাহিত্যের প্রতিও তার ভালোবাসা ছিল বিশেষ করে পাবলো নেরুদার কবিতা। ডাক্তার হওয়ার সুবাধে চে সহজেই গেরিলা সহযুদ্ধাদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে সে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিত। চের সাথীরা তাকে ভয়, সম্মান এবং একি সাথে প্রসংশার চোখে দেখতো। সে তাদের লিখতে এবং পড়তে শেখাতো এবং আরো নানা সুযোগ-সুবিধার বন্দোবস্ত করেছিল। চে বলতো গেরিলা হওয়া হচ্ছে মানুষের সর্ব্বোচ্চ রুপ, যে কিনা তার আদর্শের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত। চে-র আদর্শ ছিল মার্ক্সসবাদ।
কিউবা স্বাধীন করে চে কিউবা সরকারের উচুঁ পদে আসীন হয়ে দেশ বিদেশ ভ্রমন করেছিল। এমনকি জাতিসংঘের সদর-দপ্তরে বিশ্বনায়কদের মাঝে দাঁড়িয়ে আমেরিকানদের বিরুদ্ধে বিষোদাগার করেছিল। পরে নানা কারণে ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে মতের ভিন্নতার কারণে চে কিউবা-র সাথে সব সম্পর্কে ছিন্ন করে যায় আফ্রিকার দেশ কঙ্গোতে। স্বপ্ন ছিল সেখানে গেরিলা সংগ্রামের বীজ রুপে দেওয়া এবং তার মাধ্যমে সারা বিশ্ব থেকে আমেরিকানদের পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করা। বলা হয়ে থাকে চে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেখানে ব্যর্থ হয়ে চে যায় ভলিভিয়ায়। একি স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু সেখানকার চাষারা সহযোগীতা না করায় এবং বিশ্বাসঘাতকতা করায় চে এবং তার সঙ্গীরা ভলিভিয়ান আর্মির কাছে ধরা পড়ে। এবং তার একদিন পরেই ১৯৬৭ সালের অক্টোবরের নয় তারিখে ভলিভিয়ান সরকার চে-কে মেরে ফেলে গোপন এক স্থানে কবর দিয়ে ফেলে।
যে চে-কে মেরে ফেলে তারা মনে করেছিল সারা পৃথিবী ভুলে যাবে, উলটো সেই মানুষটায় হয়ে উঠেছিল বাকী পৃথিবীর কাছে একজন আদর্শ। সংগ্রামের প্রতীক।
ট্রেইলার
মুভিটার লিঙ্ক নীচে দিলাম
Che: Part One
মুভির IMDB-র রেটিং ১০ এ ৭.৪
http://www.imdb.com/title/tt0892255/
ডকুমেন্টারীটা
True Story of Che Guevara
চে গুয়েভারাকে নিয়ে উইকিপিডিয়ার লিঙ্ক
http://en.wikipedia.org/wiki/Che_Guevara
আমার দেখা ভালোলাগা কিছু মুভির তালিকা
আমার দেখা ভালোলাগা কিছু মুভির তালিকা - ২
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১১ রাত ১২:১২