চার-পাঁচ বছরের একটি বালক কয়েকজন রাগি রাগি চেহারার মহিলার সামনে দারিয়ে আছে। তাদের মধ্যে একজন একটার পর একটা পান খেয়ে যাচ্ছে, তার পাশের জন অপেক্ষাকৃত বয়স্ক এবং রোগা, ঠিক তার পাশেই যিনি বসে আছেন তার মুখটা হাসি হাসি। কিন্তু সবার মধ্যে কমন একটি মিল হচ্ছে, তাদের দিকে তাকালেই বুকে কাপুনি ধরে যায়। তাদের থেকে কিছুটা দূরে লম্বা আলখেল্লা গায়ে, মাথায় পাগড়ী পড়া এক সূফী টাইপের বৃদ্ধ বসে আছে। তার নাম মোঃ সাইফুল ইসলাম, অবসর প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। সম্পর্কে ছেলেটির দাদা। তিনি তার বড় নাতীকে, বাড়ির পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে এসেছেন। আজকেই ছেলেটির প্রথম স্কুলে আসা।
হঠাৎ বয়স্ক রোগা মহিলাটি, যিনি বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে “শুঁটকি আপা” হিসেবে পরিচিত, তিনি বলে উঠলেন,
“তোমার নাম কি খোকা”
“আপা, আমার নাম রনী”
এই সময়, পান খাওয়া মহিলাটি ধমক দিয়ে বলে উঠল, “এক টানে কান ছিরে ফেলব, পুর নাম বল”।
ছেলেটি ভয়ে ভয়ে বলল, “ মোঃ মাইনুল ইসলাম রনী”।
হাসি হাসি মুখের শিক্ষিকাটি বলল, “এর পর কেউ নাম জিজ্ঞাসা করলে, পুর নাম বলবে”
“ঠিক আছে, আপা”
“তুমি স্কুলে ভর্তি হতে চাও”
“জি, আপা”
“কিন্তু তুমিতো এখনও ছোট, তোমাকে আগে বড় হতে হবে তার পর তোমাকে আমরা স্কুলে ভর্তি করব”
“আপা, আমি বড় হয়ে গেছি, আমি সকাল বিকাল দুই বেলা দুধ খাই। মিলন ভাইয়া ১১ ক্লাশে পরে, আমি তার মোটা মোটা বই এর নাম পড়তে পারি”।
ছেলেটির এমন কথা শুনে রাগি রাগি চেহারার শিক্ষিকারা মুখ টিপে হাসতে লাগল।
বয়স্ক রোগা শিক্ষিকাটি বলল, “তুমি যদি বাম হাত মাথার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে ডান পাশের কান ধরতে পার, তাহলে আমরা তোমাকে ভর্তি করব”
ছেলেটি ভাবল, এ আর এমন কি কঠিন কাজ এখনি দেখিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু কি আশ্চর্য, ছেলেটি অনেক চেষ্টা করেও বাম হাত মাথার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে ডান পাশের কান ধরতে পারল না। কি সর্বনাশ, তাহলে কি সে স্কুলে ভর্তি হতে পারবে না। ছেলেটি অনেক ভেবেও পেল না বাম হাত মাথার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে ডান পাশের কান ধরার সাথে স্কুলে ভর্তি হওয়ার সম্পর্ক কি? ছেলেটি সেই প্রশ্নের জবাব পরবর্তি জীবনে পেয়েছিল।
মানব শরীরের বেশী ভাগ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ স্বর্গীয় অনুপাত বা সোনালী অনুপাতে গঠিত। সোনালী অনুপাত বা স্বর্গীয় অনুপাত কে বা 'ফাই'(phi) দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এর মান ১.৬১৮০৩৩৯৮৯ (প্রায়)। এটি একটি অমূলদ সংখ্যা। ফিবোনাচ্চি রাশিমালার সাথে এ অনুপাতের সম্পর্ক রয়েছে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি মৃত মানব শরীর ব্যবচ্ছেদ করে এগুলো বের করেছেন। হাতের উপরের অংশ ও নিচের অংশের অনুপাত এটা। পায়ের ক্ষেত্রেও এরকম। আবার মেরুদন্ড সহ অনেক কিছুই নাকি এরকম। এর চেয়েও আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, একজন শিশুর বয়স ৬ বছর না হওয়া পর্যন্ত সে বাম হাত মাথার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে ডান পাশের কান ধরতে পারবে না। এটিকে খুব সহজেই স্বর্গীয় অনুপাত বা সোনালী অনুপাত দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। মোট কথা যে বাম হাত মাথার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে ডান পাশের কান ধরতে পারবে, তার বয়স ৬ বছর এর বেশী। সে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্য।
সে যাত্রায় অবশ্য ছেলেটির জীদের কাছে হার মেনে শিক্ষিকাদের তাকে স্কুলে ভর্তি করাতে হয়েছিল।
কোন গল্প বা উপন্যাস লিখছি না। নিজের ছেলেবেলার কথা লিখছি। আর নিজে নিজেই হাসছি। মানুষের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের এবং সবচেয়ে কষ্টের দিন গুল কাটে তাদের শৈশবে। কারন তখন মনে কোন রঙ থাকে না, আবার সব রঙই থাকে। শিশুদের মন হচ্ছে সাদা, আর বর্নালির ৭ টি রঙের সমন্বয়ে হয় সাদা রঙ। তখন সামান্য আনন্দেই নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মনে হয় আর সামান্য বিষয়েই মন অভিমানে ভরে উঠে।
অন্য সবার মতই আমারও ছিল আনন্দময় একটি শৈশব। শৈশবের সেই সোনালি দিন গুল কখনই ফিরে পাওয়া যাবে না। তাই বলে কি আমি সেই সব দিনের কথা ভুলে যাব! আমিইতো আমার জীবনের রাজা। আমরা সবাই রাজা, আমাদের এই রাজার রাজত্বে। যদিও এ যুগের শিশুদের মত চাহিবা মাত্র PS3 অথবা Computer পাইনি, তবুও বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে দাদা-দাদি, চাচা-মামাদের যে আদর আমি পেয়েছি তা কখনই ভোলার নয়। দিনের শেষে আল্লাহ্র দরবারে অশেষ শুক্রিয়া। পৃথিবীর বিভিন্ন মহাপুরুষগন তাদের জীবনী লিখেছেন, তাদের লেখার একটা বড় অংশ জুরে আছে তাদের ছেলেবেলার সোনালি দিনের কথা। আমি যদিও বিখ্যাত কেউ না, আমার জীবনী লেখার বয়সও হয় নাই। তবুও আমি আমার শৈশব নিয়ে আনন্দিত। তাইত কবির ভাষায় বলতে চাই......
আমি অকৃতী অধম বলেওতো তুমি
কম করে কিছু দাও নি।
যা দিয়েছ তার অযোগ্য ভাবিয়া
কেড়েওতো কিছু নাও নি।
মোঃ মাইনুল ইসলাম রনী
০২-০৬-২০১৪
১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪২১