আমি সবসময়ই বলে থাকি, সিনেমার নিজস্ব একটি ভাষা আছে। এই ভাষাগত কারনেই মুলত একটি সিনেমার সিনেমা হয়ে উঠা হয়। একটি সিনেমার গল্প এটার মুল চালিকাশক্তি; আর পরিচালক হচ্ছে সিনেমার ড্রাইভার বা চালক। তারেক মাসুদের 'রানওয়ে' হচ্ছে স্ট্রং ইস্যু নিয়ে গড়ে উঠা একটি আপাতঃ সাধারন গল্পের অসাধারন চিত্রায়ন যেটা কিনা আমি মাত্র গতকাল দেখলাম।
২০০৫/০৬ সালের জঙ্গীবাদের উপর নির্ভর করে এয়ারপোর্টের কাছের বস্তিতে বসবাসরত এক পরিবারকে ঘিরে রানওয়ে'র যাত্রা শুরু। সাহসী চলচ্চিত্রকার প্রয়াত তারেক মাসুদ রাজনৈতিক ইস্যুর কারনে তখন এই বিতর্কির সিনেমাটি মুক্তি দিতে পারেননি। পরবর্তীতে ক্যাথরিন মাসুদ স্বামী তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের স্মৃতি রক্ষার্তে কিছুটা কাঁটছাট করে সিনেমাটি মুক্তি দেন (শোনা কথা)।
গল্পের মুল চরিত্র, রুহুল, মাদ্রাসায় দাখিল পর্যন্ত পড়াশুনা করেও পরীক্ষা দিতে পারেনি। তার বাবা জমি-বিক্রী করে মধ্যপ্রাচ্য পাড়ী জমিয়েছেন মাসখানেক হলো; মা ব্যাঙ্কলোনের টাকায় গাভী কিনে সেটার দুধ বিক্রী করে সংসার চালান; ছোটবোন দীর্ঘ সময় গার্মেন্টসে শ্রম বিক্রী করে পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করে। পরিবারের পুরুষ বলতে আছেন এক অসুস্থ দাদু। রুহুল হন্য হয়ে চাকুরী খোঁজার পাশাপাশি তার মামার ছোটখাটো এক সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে কম্পিউটার চালানো শিখে। এমন এক সময় তার সাথে পরিচয় হয় 'আরিফ' নামের এক ছেলের সাথে।
আরিফের ইসলামিক লেবাস ও কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে রুহুল অনেকটা নিজের অজান্তেই জড়িয়ে যায় জঙ্গীদের সাথে। রুহুলকে করা হয় ব্রেইনওয়াশড; দেয়া হয় জঙ্গী ট্রেনিং। নিজের অসুস্থ দাদু এবং অসহায় মা-বোনকে রেখে রুহুল জঙ্গীদের সাথে থাকা শুরু করে।
এরকম একটি বিতর্কিত বিষয় নিয়ে সিনেমা বানানো অত্যন্ত সাহসের ব্যাপার এবং তারেক মাসুদ সেই কাজটি করে দেখিয়েছেন। তিনি তার সিনেমা দিয়ে দর্শকদের নিকট কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে; এক অর্থে সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর ও তিনি দিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া, গল্প চিত্রায়ন করতে গিয়ে তারেক মাসুদ সাহায্য নিয়েছেন অনেক রুপক দৃশ্যের। একটি ক্লিপ দেখুন
https যুক্ত ইয়ুটিউব লিঙ্ক
উপরের ক্লিপে দেখুন এরোপ্লেনের প্রতি একটি বস্তির কিশোরের ক্ষোভ। কিন্তু তার এই ক্ষোভ বা আক্রোশ কিসের প্রতি? কেনো সে সামান্য গুলতি দিয়ে বিশাল প্লেনকে আঘাত করতে চায়?
তারেক মাসুদের মিউজিক সেন্স দেখে চমতকৃত হবেন। একটি দেড় মিনিটের ক্লিপ দেখুন যখন জঙ্গীরা প্রশিক্ষন নিতে যাচ্ছে।
https যুক্ত ইয়ুটিউব লিঙ্ক
প্রয়াত মিশুক মুনীরের সিনেমাটোগ্রাফী দেখার সৌভাগ্য আমার কম হয়েছে। রানওয়েতে উনার কাজ দেখে আরেকবার আফসোস হলো এই ভেবে যে কত দূর্ভাগা জাতি আমরা! অসাধারন কিছু দৃশ্য দেখে আপনাকে মুগ্ধ হতেই হবে।
যেদুটো বিষয়ে আমি অতৃপ্তঃ সম্পাদনা (যেটাতে আরেকটু মুন্সিয়ানা দেখাতে পারতেন ক্যাথরিন) এবং সিনেমার দৈর্ঘ্য (আমি হয়তো আরো কিছুক্ষন বুঁদ হয়ে থাকতে চেয়েছিলাম)
সিনেমাটির ব্যাপারে কিছু তথ্যঃ
পরিচালকঃ তারেক মাসুদ
প্রযোজকঃ ক্যাথরিন মাসুদ
স্ক্রিপ্টঃ তারেক মাসুদ, ক্যাথরিন মাসুদ
অভিনয়েঃ জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, নাজমুল হুদা বাচ্চু, ফজলুল হক, মোসলেম উদ্দিন, নাসরিন আক্তার, রিকিতা নন্দিনী শিমু
সঙ্গীতঃ তারেক মাসুদ, ক্যাথরিন মাসুদ
চলচ্চিত্রায়নঃ মিশুক মুনীর
সম্পাদনাঃ ক্যাথরিন মাসুদ
মুক্তিপ্রাপ্ত তারিখঃ ২০১১
সময়ঃ ৯০ মিনিট
[তথ্যসুত্রঃ উইকিপিডিয়া]
কিছু কথাঃ দের ঘন্টার এই সিনেমাটি তথাকথিত কোন বানিজ্যিক সিনেমা নয়। অফ ট্র্যাকের এই সিনেমাতে তারপরেও সিনেমার সকল গুন বিদ্যমান। সিনেমাটি তারেক মাসুদ জেলায় জেলায় ফেরী করে বেড়িয়েছিলেন। ২০১১ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী এনায়েতপুরে সর্বপ্রথম এই সিনেমা মুক্তি দেয়া হয় যদিও ২০১০ সাল থেকেই এটা দেশের আনাচে কানাচে প্রদর্শনী করে দেখানো হয়েছিলো। আপনি দয়া করে সিনেমাটির ডিভিডি কিনুন এবং দেখুন। আমি আশাবাদী যে আপনি ঠকবেন না।